অর্ডিনারি ম্যান

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: শনি, ১৯/০৪/২০১৪ - ৪:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'আই'ম অ্যান অর্ডিনারি ম্যান' - বাক্যটাকে বাংলা করলে 'আমি একজন সাধারণ মানুষ' বোঝায়। কিন্তু আমি বাংলার বদলে ইংরেজিতে অর্ডিনারি শব্দটা বেছে নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি কেননা বাংলায় সাধারণ মানুষ বলতে যা বোঝায় তাতে ঠিক অর্ডিনারি শব্দটার অনুবাদ হয় না। বরং আমি একজন যেনতেন মানুষ বললেই অধিক অর্থবহ হয়। কিন্তু যেনতেন মানুষের চেয়ে অর্ডিনারি শব্দটা অলংকারসমৃদ্ধ মনে হয়। তাই 'আই'ম এন অর্ডিনারি ম্যান' বাক্যটাই বেছে নিলাম। এটি অবশ্য দুইশো বছরের ইংরেজের গোলামী খাটার ফলও হতে পারে। বিদেশী চামড়া দেখলে এখনো বাঙালী খটাশ দাঁড়িয়ে যায়। বিলিভ ইট অর নট। এই দেখেন বারবার ইংরেজি জ্ঞান এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। আসল কথায় ফিরি।

সেই যে বললাম। ওই বাক্যটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। একশোভাগ খাঁটি সত্য কথা বলা অসম্ভব হলেও এই বাক্যটির সততা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কেননা বাক্যটা আমার নিজকে নিয়ে বলা, এবং নিজেকে আমি অন্য দশজনের চেয়ে বেশী বুঝি। আমার সবকিছুই অর্ডিনারি। এই বাক্যটা শুনে আক্ষেপের সুর কল্পনা করবে কেউ কেউ। কিন্তু না, এটার সাথে আক্ষেপের চুল পরিমান সম্পর্কও নেই। এই অর্ডিনারি জীবনেই আমি তৃপ্ত, সুখী। তবু এরকম একটা লেখার প্রয়োজনীয়তা আসলো কেন? বাকীটা পড়লে সেকথার উত্তর পাবেন।

আমার চিন্তা চেতনা জীবনযাপন শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুর মধ্যে সাধারণত্বের স্পষ্ট ছাপ। আমি কখনো অসাধারণ হয়ে উঠতে চাইনি। অসাধারণ মানুষদের উপর কিছুটা দায়বদ্ধতা চাপে, আমি বরাবরই সবকিছু থেকে দায়মুক্ত থাকতে চেয়েছি। সাধারণ একটা স্কুল, সাধারণ একটা কলেজ, সাধারণ একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণভাবে পাশ করে খুব সাধারণ একটা চাকরীতে ঢুকে পড়ি। চাকরী জীবনের আগাগোড়াই আমি সাধারণের দলে। ক্যারিয়ারে অসাধারণত্বের নিদর্শন প্রদর্শনের অনেক সুযোগ আমি হেলায় নিক্ষেপ করেছি। আমার ভয় ছিল যদি আমি অসাধারণ উচ্চতায় উঠে যাই তবে দায়িত্বের যে বোঝা, তার চাপে পিষ্ট হয়ে দুটো পয়সা বেশী কামাবার চেয়ে জীবনটা হালকা চালে উপভোগ করতে থাকি। ফলে আমার উন্নতি এক জায়গায় এসে থমকে গেছে।

থমকে যাবার পর আমাকে হাতছানি দিল সাহারা মরুভূমি। আমি একদিন উড়ে চলে আসি সাহারার মধ্যভাগের একটা শহরে। এই শহরটিও আমার মতো। এর পদে পদে মাটির গন্ধ, রোদের গন্ধ, অনেক উঁচুতে উড়ে যাওয়া চিলের পাখার গন্ধ। এখানে চিল নেই, শকুন আছে। তবু আমি দূর থেকে তাদের মধ্যে জীবনানন্দের সোনালী ডানার চিল আবিষ্কার করি।

সাহারা মরুভূমিতে আমি রাখালের কাজ করি। আমার পদবীকে বাংলা করলে রাখালই হবে। আমার অধীনে কয়েকশো ভেড়া কাজ করে। সেই ভেড়াদের কাজ হলো পালা করে প্রতিদিন কারো না কারো পিঠের লোম দান করা। পিঠ ন্যাড়া সেই ভেড়াগুলোকেও তখন আমার অর্ডিনারি ম্যান বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। আই'ম এন অর্ডিনারি ম্যান উইথ হানড্রেডস অব অর্ডিনারী ল্যাম্ব, মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ, মাইলস টু গো। আহ, আবারো গোলামীর ভাষা!

আমি যখন দেশে ছিলাম তখন আমি দেশের কথা ভাবতাম না। এখন দেশ আমার বুকের খাঁচায় ২৪ ঘন্টা। আমি কি দেশপ্রেমিক? প্রেমিক হতে হলে দূরে যেতে হয়। শরৎচন্দ্র এই জন্যই বলেছিলেন, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও......আচ্ছা দূর কী? মাইলের পর মাইল ফিতে টেনে গুনে যাওয়া অচ্ছ্যুত গন্তব্যকেই দূর বলে?

আমি চলে আসার পর কোথাও কিছু থেমে থাকেনি। অর্ডিনারী ম্যানের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো তার অস্তিত্ব বিনাশ হলেও কেউ টের পাবে না। সাড়া না জাগিয়ে চলে যাওয়ার মধ্যে নীরব আনন্দ আছে।

ফোকাস জিনিসটা আমার খুব অপছন্দ। পার্টিতে গেলে আমার উপর যেন কোন আলো এসে না পড়ে, আমার নাম ধরে মঞ্চ থেকে কেউ যেন ডাক না দেয়, আমি যেন ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারি, সেজন্য সতর্ক থাকতে হয়। একবার স্কুলে একহাজার মিটির দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে আমি লুকিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বারবার মাইকে ডাকা হচ্ছিল। যতই ডাকছিল ততই আমি এমনভাবে সিঁটিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছিলাম যেন আমার কোন অস্তিত্ব নেই। আমি জানতাম না আমাকে ওভাবে ডাকা হবে। যদি না ডেকে বলা হতো, দৌড় দে! আমি অনায়াসে দৌড় দিতাম। চিরটাকাল আমি ফোকাস থেকে সযত্নে দূরত্ব রেখে চলেছি। আমাকে যত কম লোক চেনে ততই স্বস্তিকর। আড়ালে থাকতে থাকতে থাকতে আমি অচেনা হয়ে যেতে চেয়েছি। তবু হঠাৎ রাস্তায় পুরোনো বন্ধুর মুখ খুব চমকে দিত কখনো কখনো। যখন হঠাৎ কেউ একজন জিজ্ঞেস করত- কেমন আছিস? আমি জবাব দিতাম না। অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সটকে পড়তাম।

এই বিশাল দূরত্বে অর্ডিনারি ম্যান ভালো আছে। এখানে এত মরুভূমি ডিঙ্গিয়ে আমাকে কেউ খুঁজতে আসবে না। কিছুদিন স্মৃতিতে থাকবো কারো কারো। একদিন স্মৃতি থেকেও অপসারিত হয়ে যাবো। সেদিন আমি একজন খাঁটি অর্ডিনারি ম্যান হয়ে যাবো। অর্ডিনারি ম্যান দেশে ফিরবে অচেনা হয়ে। ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যাবে, কেউ ফিরে তাকাবে না, কেউ ফিরে ডাকবে না। অবাধ ঘুরে বেড়াবো ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল, শাহবাগ থেকে যাত্রাবড়ি। ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেট খুলনা রাজশাহী কোথাও কেউ খুঁজবে না অর্ডিনারি ম্যানকে। দিনের পর দিন বাসে ট্রেনে ফুটপাত রেলস্টেশানে যাযাবরের জীবন কাটিয়ে একদিন গারো পাহাড়ে উঠে যাবো। গারো পাহাড়ের চূড়ায় উঠে হিমালয়ের ছায়া খুঁজবো। হিমালয়ে আমার একটা আত্মা রাখা আছে।

তারপর একদিন ডাক আসবে দক্ষিণ সমুদ্রের সর্বশেষ দ্বীপটি থেকে। বহুকাল আগে আমি ওখানে ছিলাম। গত শতকের শেষ প্রান্তে। আমার জীবনের পূর্ব অধ্যায়ে। সেই নীলিমা বোর্ডিং আবারো ডাকলো আমাকে, যার ডানদিকে অসীম সমুদ্র আর বামদিকে নীল জলের স্বচ্ছ নদী। সেই নদী আর সমুদ্রের মধ্যখানে যে পাহাড়শ্রেনী তার কোলেই দাঁড়ানো নীলিমা বোর্ডিং।

এখানে এখন আর কেউ থাকে না। পরিত্যাক্ত হয়েছে অর্ধশতক আগেই। সাইনবোর্ড ঝরে গিয়ে জঙ্গলবাড়িতে রূপান্তরিত হওয়া নীলিমা বোর্ডিং এখন বিষাক্ত সাপখোপের আস্তানা। দোতলার সেই ঘরের দুটো ভেন্টিলেটরের একটিতে থাকে রাত জাগা পেঁচা, আরেকটিতে আমি। আমি পেঁচাটিকে হরদম দেখতে পেলেও সে আমাকে দেখতে পায় না। কেবল একবার আমার খোপটিতে বসতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত ধাক্কা খেয়েছিল। তারপর থেকে এদিক মাড়ায় না আর।

আমার ভালোলাগার মানুষগুলো সব আরো অর্ধশতক আগেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্বর্গ বা নরকে আশ্রয় নিয়েছে। শুধু আমি মধ্যখানে ঝুলে আছি। অভিশপ্ত এক যাদুর কাঠির স্পর্শে যেদিন অদৃশ্য মানবে পরিণত হয়ে যাই, সেদিন থেকে আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে আর কেউ জানে না। খোদ মৃত্যুদুত তার শিডিউল টাইমে এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে ভুল মানুষের জান কবজ করে নিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। তারপর আমি আরো একশো বছর কাটিয়ে দিলাম। সাহারা থেকে বাংলাদেশ আসা যাওয়ার ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত আমার একটা দীর্ঘমেয়াদের আশ্রয়কেন্দ্রের দরকার ছিল। নীলিমা বোর্ডিং এর হাতছানিটা তাই লোভনীয় মনে হলো।

কিন্তু মানুষের স্পর্শের মায়া কাটিয়ে নীলিমা বোর্ডিং নামের এই জঙ্গলবাড়িতে আরো একশো বছর কি কাটানো যাবে? উন্নয়ন সভ্যতা এখানে এসে আবারো দাঁত বসাবে না তো?


মন্তব্য

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সাধক কবীর বলেছেন,
"যেদিন তুমি জন্মিলে এ ভবে, কাঁদিলে তুমি হাসিল আর সবে।
এমন কর্ম হেথা করিতে হবে, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে সবে।"

না, আমি বরং লাও-ৎসুর সুরে সুর মিলিয়ে বলি---
"নিষ্কর্মা না হয়েও যাঁরা কীর্তির পিছনে ছোটেননা, এ পৃথিবীতে তাঁরাই সুখী।"
(চীনা দার্শনিক -- লাও-ৎসু)

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

এক্সট্রা অর্ডিনারি লেখা, ম্যান!!

লেখার জায়গায় জায়গায় মনে হচ্ছিল পাওলো কোয়েলহো পড়ছি বুঝি!!

এরকম লেখা আরো চাই।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

হাততালি হাততালি

আপনার লেখা আমার এ কারণে ভালোলাগে, কেমন জানি একটা মন্ত্রমুগদ্ধতা থাকে সেখানে, থাকে খুব সাধারণ শব্দে সাধারণ গল্প বলা। মাঝখানে অনেকদিন লেখেননি তখন মিস করেছি আপনার অর্ডিনারি লেখাগুলো।

মাসুদ সজীব

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

জটিল লাগল পড়তে ..... চলুক

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

মর্ম এর ছবি

এ ধরণের লেখাতেও আলাপের অভাব দিয়ে এখনকার সচল আমায় একটুখানি আশাহত করে ।

আমরা পাঠক হিসেবে একটু বোধ হয় বেশিই আলসে হয়ে গেছি খাইছে

আরেকটু হলেই লেখাটা চোখ এড়িয়ে যেত হয়ত। এড়িয়ে যে যায়নি, সেটার জন্য ভাল লেগেছে খুব। হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

অতিথি লেখক এর ছবি

আলাপের অভাব দিয়ে এখনকার সচল আমায় একটুখানি আশাহত করে

চলুক সহমত। সবার অংশগ্রহন বেশ কম এখন, এটা আমাকে ও আশাহত করে। অনেক ভালোলেখা থেকে যাচ্ছে মন্তব্যহীন, আলোচনাহীন। লেখায় পাঠক না থাকলে নতুন লেখকদের উৎসাহ কিংবা আগ্রহ কমে যায় হাসি

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা পড়ি সবসময়। ভালো লাগলো। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

---এবিএম।

এক লহমা এর ছবি

সাব্বাশ! আমি যে কবে এরকম লিখব! ৫ তারা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আয়নামতি এর ছবি

দারুণ লাগলো রে ভাইয়াঅর্ডিনারি ম্যান!
কয়েকটা টাইপো চোখে পড়লো : চুড়া>চূড়া, মিটির>মিটার, শ্রেনী>শ্রেণী/শ্রেণি, পৌছে>পৌঁছে
আরো বেশি বেশি লিখুন হাসি

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

গল্পের নামকরণ, থিম সবই অসাধারণ হয়ে উঠেছে লেখনীর গুণে।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।