• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

কৃতঘ্নের একদিন

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: বুধ, ১৪/০৫/২০১৪ - ১১:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুবর্ণ এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগির ঝাপসা জানালা দিয়ে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিটা বাড়িয়ে দিলাম বাইরে। ঢাকা এখন আমার কাছে অচেনা একটা শহর। আমার স্মৃতির ঢাকা শহরের সাথে এই গিজগিজ উঁচু দালানের ধোঁয়াটে শহরের কোন মিলই নেই। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্ম আমার খুব চেনা। আমাকে দেখেই যেন ওরা ডাক দিল। ডাকলে ডাকুক, আজ আমি কোন ডাক শুনতে আসিনি। টুকরো টুকরো মোজাইকের নকশা মাড়িয়ে আমি এগিয়ে গেলাম টিকেট চেকারের দিকে।

দুপুর সোয়া একটা বাজে। রাস্তায় নামতেই শহুরে গরমের ঝাপটা মুখে চড় মারলো। গেট পার হয়ে আস্তে আস্তে রাস্তার দিকে হাঁটছি। একটা রিকশা ধরতে হবে। ঘন্টাপ্রতি রেট কত কে জানে। দুয়েকটা দেখার পর রাত আটটা পর্যন্ত একজনকে বুক করে ফেললাম পাঁচশো টাকা দিয়ে। রিকশায় উঠেই উদাস হয়ে গেল মনটা। এই শহরে আমার চেনা কেউ নেই। কোথাও যাবার নেই। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য এসেছি। দিনের বাকীটা কাটিয়ে রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবো। আমি শুধু ঢাকার বাতাসের একটু ঘ্রাণ নিতে এসেছি আর ছোট্ট একটা কাজ…..

কতযুগ পর আসলাম এখানে? রিকশার চাকার সাথে স্মৃতির সেলুলয়েড ঘুরতে শুরু করলো।

আমি কোথায় জন্মেছি মনে নেই। শুধু মনে আছে কোথায় বেড়ে উঠেছি। আমি বেড়ে উঠেছি ফুটপাতে, রেলস্টেশানে, মার্কেটের বারান্দায়। আমার কখনো কোন ঘর ছিল না, পরিবার ছিল না। মা বাবা ছিল না। একজনকে মা ডাকতাম কিন্তু একটু বড় হয়ে জেনেছি সে আমার আসল মা নয়। খুব ছোটকালে আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। একদিন সেও কোথাও উধাও হয়ে যায় আমাকে ফেলে- বাচ্চা বড় হলে মা পাখি যেমন উড়ে যায়। ততদিনে আমি নিজের খাবার নিজেই খুঁটে খেতে শিখেছি। তারপর নিজের যুদ্ধটা নিজেই করতে শিখে গেলাম। আমার কেউ নেই তবু খিদে পেলে বা ব্যথা পেলে আমি মা মা করতাম, এমনকি এখনো করি, কেন করি আমি জানি না। আমার মাতৃতৃষ্ণা দূর হবার নয়।

শৈশবের স্মৃতি বলতে যা আছে সেটা শুধুই খাবারের কষ্ট। আমার সারাক্ষণই খিদে লাগতো। খিদে ছাড়া আর কোন সমস্যা মনে পড়ে না। আমার কোন ঘর নেই। তাতে কি, খোলা আকাশের নীচে যে কোন জায়গায় আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যেতে পারি। আমার কোন জামা নেই, তাতে কি?একটু খুঁজলেই কোন মার্কেটের আশপাশে দুয়েকটা ছেড়া প্যান্ট শার্ট গেঞ্জি খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু খিদেটা বড্ড জ্বালাতন করতো। আমি যেখানে খাবার খুঁজে যেতাম, সেখানে কিছু কাক আর কয়েকটা কুকুর সেই খাবার নিয়ে ঝগড়াঝাটি লাগাতো। আমি ওদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না। তাছাড়া কুকুর আমার ঘেন্না লাগতো। কারণ ওরা প্রায়ই আমার ঘুমানোর জায়গাটায় পেচ্ছাব করে যেতো।

একদিন অদ্ভুত একটা ঘটনা। এক বিয়েবাড়ির ফেলে দেয়া খাবার কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে কঠিন মার খেলাম সঙ্গীদের কাছ থেকে। মার খেয়ে রক্তাক্ত শরীরে বাড়ির গেটের কাছে অজ্ঞান পড়েছিলাম। আমার জ্ঞান ফিরলো একটা পাকা ঘরের ভেতর। তখন শীতকাল, আমার শীত করছিল খুব। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। চারদিকে বদ গন্ধ ভোঁ ভোঁ করছে। চারদিকে গিজগিজ করছে কাঁটাছেড়া ব্যাণ্ডেজ দেয়া মানুষ। এ কোন জায়গা? মার কাছে দোজখের গল্প শুনছিলাম, এটা সেই জায়গা না তো?

ভয়ে আমি এতটুকু হয়ে গেলাম। হাতটা নাড়াতে গিয়ে খুব ব্যথা করলো। উঠে বসতে চাইলে কোত্থেকে একটা বাজখাই গলা হুংকার দিয়ে উঠলো, ওই পোলা!! উঠিস না, চুপ করে শুয়ে থাক!!

জায়গাটা হাসপাতাল। হুংকারের মালিক একজন দয়ালু নার্স।

কয়েকদিন পর একটু সুস্থ হতে আমাকে বুড়োমতন একজন এসে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে গেল। অচেনা লোক। আমি কিছু না বলে লোকটার পিছু পিছু একটা রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাটা যেখানে থামলো সেই বাড়িটা দেখেই চিনে ফেললাম। এটা সেই বাড়ি যে বাড়ির বিয়ের খাবার নিয়ে মারামারি করছিলাম।

বাড়ির মালিক আমাকে দেখে বললেন, এখন থেকে আমি যেন ওই বাড়িতে থাকি। আমার জন্য বরাদ্দ হলো বুড়ো দারোয়ানের নীচতলার ঘরটা। যে লোকটা আমাকে নিয়ে এসেছিল, সে বাড়ির দারোয়ান। সেদিন খাবারের যুদ্ধে যে মার খেলাম, বাড়ির মালিকের একমাত্র মেয়ে শাহানার বিয়ের উচ্ছিষ্ট খাবার।

শাহানার বিয়ের পর বুড়ো একা হয়ে পড়ে। বিশাল বাড়িতে আর কেউ নেই। বউ মরে গেছে বহুবছর আগে। আমাকে সেদিন অজ্ঞান পড়ে থাকতে দেখে কেন যেন তার প্রথম সন্তানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল- দশ বছর বয়সে যে কঠিন এক রোগে মারা গিয়েছিল। সেও বহুকাল আগের কথা। গেটের কাছে আমাকে রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখে দারোয়ানকে দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে সুস্থ করে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল।

আমার জীবনের নতুন এক পর্ব শুরু হলো সেদিন। পরবর্তী নয় বছর আমি ওই বাড়িতে ছিলাম। আমার কোন বেতন ছিল না, কিন্তু খাওয়া পরার কোন অভাবও ছিল না। আর ছিল অবাধ স্বাধীনতা। বয়সে ভারাক্রান্ত হয়ে আগের দারোয়ান চাকরী ছেড়ে দিলে আমি নতুন দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যাই। তখন আমি শুধু দারোয়ান না, এ বাড়ির সকল কাজের কাজী। রান্না বান্না থেকে ঘরের সব কাজ আমি একাই করি। এত বড় বাড়িতে আমি আর বুড়োটা ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়ের বিয়ের আগে আত্মীয় স্বজন আসতো মাঝে মাঝে। মেয়েটার বিয়ের পর তেমন কেউ আসে না। মাসে দুমাসে একবার অতিথি আসে।

বিয়ের কিছুদিন পর শাহানা বিদেশে চলে যায় বরের সাথে। সে তার বাবাকেও বিদেশে চলে যাবার কথা বলে। কিন্তু বুড়ো দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে রাজী নন। মাঝে মাঝে বেড়াতে যান, কয়েক মাস থেকে আবার ফিরে আসেন। বুড়ো দেশের বাইরে থাকলে পুরো বাড়ি আমার দখলে।

বলতে অসুবিধা নেই, বাড়িটা যখন আমার দখলে থাকে তখন আমি কিছু আলগা কামাই করি। মাঝে মাঝে এটাকে ভাড়া দেই দুয়েক রাতের জন্য। ঢাকা শহরে প্রেম করার নিরাপদ জায়গার খুব অভাব। হোটেলে নানান ঝামেলা। এরকম জায়গা পেলে লোকজন বেশী ভাড়ায়ও রাজী হয়।

এক হোটেল দালালের সাথে আলাপ আছে আমার। সে মাঝে মাঝে কাস্টমার যোগাড় করে দেয়। বেশীরভাগ বয়স্ক মানুষ। দেখলেই বোঝা যায় অগাধ টাকার মালিক। চকচকে গাড়ি নিয়ে আসে। একদম চ্যাংড়া কিছু কাস্টমারও আসে মাঝে মাঝে। এদেরকে জায়গা দেয়া একটু রিস্কি, হৈ হুল্লোড় করে বান্ধবী নিয়ে। আশেপাশে লোক জানাজানি হবার ভয় আছে। তবু ভাগ্য ভালো যে বাড়িটার লাগোয়া আর কোন ঘরবাড়ি নাই।

সেদিন এক বয়স্ক লোক ঘরটা ভাড়া নিল তিনদিনের জন্য। চেহারায় অভিজাত লোকটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হতে পারে। সাথে অপরূপা এক তরুণী। অন্য কোথাও দেখলে লোকটার নিজের কন্যা মনে করতাম ওকে । কিন্তু এখানে সবাই পরের কন্যাদের নিয়েই আসে অকাজ করার জন্য। করলে করুক। আমার পকেটে টাকা আসলেই হলো। দিনে দুহাজার টাকা ফাও ইনকাম হয় দালালের পাঁচশো বাদ দিলে। চাইলে একসাথে চার পাঁচ জোড়াকে ভাড়া দেয়া যায়। কিন্তু অতি লোভে তাঁতী নষ্ট। একরাতে এক জোড়াই সই। মাঝে মাঝে কিছু জুটি একদিনের জন্য ভাড়া নিয়েও মাত্র ঘন্টা দুই মৌজ করে চলে যায়। তখন চাইলে আরেক দফা ভাড়া দেয়া যায় বিকালের শিফটে।

এই লোকটাকে প্রথম দেখাতেই আমার ভেতর একটা বিরক্তির বীজ জন্ম নিল। লোকটা দেখতে খুব সুশীল ভদ্র গম্ভীর, আছে মোটা পাওয়ারের চশমা। প্রফেসার সাব মনে হয় দেখতে। কিন্তু এরকম লোকের ভেতরে কীরকম অমানুষ বাস করলে তার মেয়ের বয়সী তরুণীকে নিয়ে রাত কাটাতে আসে? আমি কখনো কোন কাস্টমারের রুমে আড়ি পাতি না। ওরা যখন ব্যস্ত থাকে, আমি আমার ঘরে ঘুমাই। কিন্তু এই লোকটাকে দেখে কেন জানি আড়ি পাতার বদখেয়াল জাগলো আমার। আসলে লোকটা হয়তো না, মেয়েটার জন্যই হয়তো। মেয়েটা অতি সুন্দরী আর যৌবনবতী। এরকম চোখ ধাঁধানো রূপবতী মেয়ে আমি আগে দেখিনি মনে হয়।

রুমে ঢুকেই দুজনে দরোজা বন্ধ করে দিল। ব্যস্ত হয়ে গেল নিজেদের নিয়ে। রাতের খাবার ভেতরেই খাবে মনে হয়। হাতে খাবারের ব্যাগ ছিল। আমি রান্না শেষে রাতের খাবার খেয়ে শোবার আগে পা টিপে টিপে ওদের রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তারপর বন্ধ দরোজায় কানটা লাগিয়ে শুনতে লাগলাম। কয়েক মিনিট শোনার পর আমার কান লাল হয়ে আগুন ঝরতে লাগলো। এসব কি বলে খবিসের খবিস। জিন্দেগীতে এরকম কিছু কল্পনাও করি নাই। আমার শরীর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো। মাথা ঘুরাচ্ছে উত্তেজনায়। আমি পালিয়ে নিজের ঘরে এলাম।

পরদিনও সারাবেলা ওরা ঘরের মধ্যে কপোত-কপোতীর মতো কাটালো। মাঝে একবার বেরিয়ে লোকটা হোটেল থেকে খাবার ইত্যাদি কিনে আনলো। আমি যেন কিছুই খেয়াল করছি না এভাবে থাকলাম। কিন্তু কানটা সবসময় খাড়া। লোকটা প্রায় অশ্লীল রসিকতা করছে মেয়েটার সাথে। সংকোচ কেটে গেছে বলে আমার সামনেও বলছে, আমার উপস্থিতি গ্রাহ্যই করছে না। মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে বারবার। এই শব্দগুলো কোন ভদ্রলোকের মুখ থেকে বেরোতে পারে আমি ভাবতেই পারি না। আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো মেয়েটার জন্য। সত্যি বলতে কি আমার মধ্যে অন্যরকম একটা বোধ জেগে উঠছে। শুধু তাই না মেয়েটাকে পাবার এক দুর্মর বাসনা ভেতরে কম্পন তুলতে শুরু করেছে। যে কোন সময় ঝড় উঠতে পারে।

মনটাকে অন্যদিকে ঘুরাবার জন্য বাগানের কাজ শুরু করলাম। মাটি কাটলাম। গাছপালা ছাঁটলাম। ঘাসগুলো সমান করলাম। পাইপ দিয়ে সমস্ত বাগানে পানি দিলাম। পাশের দোলনাটাকে ঝেড়ে মুছে পরিস্কার করলাম। তারপর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সারলাম। মাথায় বেশ করে পানি দিলাম। কিন্তু কিছুতেই আগুন নিভছে না।

রাতে আবারো সেই নিয়ন্ত্রণহীন কৌতুহল। আবারো পা টিপে টিপে হাজির হলাম ওদের ঘরের কাছে। হঠাৎ দরোজা খুলে মেয়েটা ডাইনিং এ বেরিয়ে এল পানি খেতে। আমি চট করে সরে গেলাম আড়ালে। ওখান থেকেই মেয়েটার বন্য সৌন্দর্যের সবটুকু দৃষ্টি দিয়ে শুষে নিতে লাগলাম। মেয়েটা এমন স্বচ্ছ একটা জামা পরে আছে যা পুরুষ মাত্রেরই মাথা নষ্ট করে দেবে। আমার কপালের দুপাশের রগগুলো দপদপ করছে। ঘামতে শুরু করেছি ভেতরে ভেতরে। মেয়েটা পানি খেয়ে রুমে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিল আবার।

এরপরই আমার মাথায় একটা তড়িৎ প্ল্যান খেলে গেল। আমি কান পাতা বাদ দিয়ে রাত দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর পা টিপে টিপে দরোজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। লোকটার নাক ডাকা ছাড়া কোন শব্দ পেলাম না। মেয়েটাও ঘুম নিশ্চয়ই। দরোজায় মৃদু টোকা দিলাম। সাড়া নেই। আওয়াজ দিলাম-

-স্যার, দরজাটা খোলেন।
-(কোন সাড়া নাই)
-স্যার, দরজাটা খোলেন, একটা বিপদ হইছে। (আরো জোরে ডাকলাম)
-কে, কে? (মেয়েটার ভীত সন্ত্রস্ত গলা পাওয়া গেল)
-আমি ম্যাডাম। দরোজাটা একটু খোলেন। বাইরে পুলিশ।
-অ্যাই, অ্যাই যে ওঠেন, বাইরে নাকি পুলিশ।
-হোয়াট দ্য ফাক (লোকটা বিরক্তির সাথে বলে উঠলো)
-স্যার জলদি দরজা খোলেন, বিপদ আছে বিপদ।

লোকটা দরোজা খুলে বাইরে আসামাত্র আমার হাতের শাবলটা সরাসরি লোকটার মাথার উপর। আমি খেয়ালই করলাম না লোকটা অজ্ঞান হলো নাকি মরে গেল। আমার মাথায় তখন স্বচ্ছ পোষাকের মেয়েটা। চিৎকার দিয়ে উঠলো মেয়েটা। এবার আমি শাবলটা উঁচিয়ে মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে হিসহিস করে বললাম, চোপ! কোন শব্দ করবা না, আওয়াজ করলে তোমারও ওই দশা হবে। একদম চোপ!

মেয়েটা এরপর একদম জোরাজুরি করেনি। যেভাবে যা চেয়েছি, সব দিয়েছে। আমি বাকী রাতটা মেয়েটাকে নিয়ে কাটিয়ে সকালে উঠে ব্যাগট্যাগ গোছালাম ধীরে সুস্থে। বাড়িতে টাকা পয়সা, সোনা দানা যা ছিল, সব পুটলি করে বেঁধে নিলাম। এই বাড়িতে নয় বছর থাকার কোন স্মৃতি আমাকে আলোড়িত করছে না। এখন একমাত্র চিন্তা পালাতে হবে দ্রুত। আশ্চর্য পাষাণ আমার মনটা।

মেয়েটার কাছ থেকে জানলাম লোকটা একটা ব্যাংকের বড় কর্তা। মেয়েটা একটা নিন্মবিত্ত ভদ্র পরিবারের সদ্য পাশ করা নবীন অফিসার। লোকটা প্রমোশনের লোভ দেখিয়ে নানান জায়গায় বেড়াতে নিত ওকে। কিন্তু তাতেও পোষাচ্ছিল না বলে চুড়ান্ত কিছু করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছিল। মেয়েটার চেহারায় একরকম অপরাধবোধ দেখা যাচ্ছে। যেন সে কাঁদতে চাইছে কিন্তু পারছে না।

আমি মেয়েটাকে বললাম, “আমি চলে যাচ্ছি আর তুমিও পালাও জলদি। তবে চুপে চাপে। যদি এই খুনের ঘটনা পুলিশকে জানাও, তাহলে আমার ফাঁসি হলেও, তোমারও কয়েক বছরের জেল হবে খুনের সহযোগিতা করার জন্যে। তাছাড়া জেল হবার পাশাপাশি তোমার এই অভিসারের খবর পত্রিকায় বের হয়ে যাবে। ধরা পড়লে আমি তো সব বলে দেবো। সুতরাং ভেবে দেখো, কী করবা। তো আমার কথা যদি শোনো সব থেকে ভালো হবে তুমি এখানে কোনদিন আসোনি। একদম চেপে যাও সব। এই দুদিন তুমি ঢাকা শহরেই ছিলে না। বান্ধবীর সাথে বেড়াতে গিয়েছিলে সিলেট বা চট্টগ্রাম।”

হুমকিটা কাজে দিল। নিজের বিপদটা টের পেল সে। ভদ্র পরিবারের মেয়ে। এরপর দুজনে নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বের হয়ে দুই দিকের রাস্তা ধরলাম। পেছনে পড়ে থাকলো সেই অনাকাংখিত লাশ।

ঠিকানাবিহীন লোকদের জন্য বাংলাদেশ চমৎকার একটা জায়গা। যদি খুন খারাবি করতে চাও, ঠিকানাবিহীন হও। কেউ তোমাকে খুঁজবে না। বাংলাদেশ হলো ঠিকানাবিহীন অপরাধীদের স্বর্গ। আমি ওখান থেকে পালিয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম, তারপর সোজা টেকনাফ হয়ে সেন্টমার্টিন। একটা জেলে নৌকায় কাজ যোগাড় করলাম। পরিশ্রম করলে কী না হয়, আর কিছু টাকা নগদ থাকলে তো কথাই নাই। কিছুদিন পর নিজেই একটা নৌকার মালিক হয়ে গেলাম। অতীতটা রাবার দিয়ে ঘষে মুছে ফেললাম।

মাছ ধরার ব্যবসার পাশাপাশি অন্য আমদানী রপ্তানীর ব্যবসাও চলতে শুরু করলো। দিনের আলোয় বার্মা যাওয়া আসা করি। নাসাকা বাহিনীর লোকদের সাথেও খাতির হয়ে গেছে। টাকার অভাব চলে গেছে কবেই। নিজেরই কয়েকটা ট্রলার আছে এখন। জায়গা জমি বাড়ি কিনেছি কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, টেকনাফে। ঢাকাতে কিছু করি নাই কেন যেন। ভয়টা এখনো? তবে ঢাকায় গেছি কয়েকবার। সেই ঘটনার দশ বছর পর একদিন ওই বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখি একটা বহুতল ভবনের সাইনবোর্ড। বাড়িটা কি বিক্রি হয়ে গেছে? কি হয়েছিল শেষে? কিছুই জানি না।

হঠাৎ আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। রিকশাওয়ালা পেছনে ফিরে একবার তাকালো।

আমি বললাম, তুমি তোমার মত চালাও, আমি এমনি এমনি হাসি, নিজের সাথে কথা বলি।

তারপর বিড়বিড় করতে থাকলাম - আসলে তো কিছুই ঘটেনি। এই বাড়িতে কেউ আসেনি। কেউ ফিরে যায়নি। মেয়েটা তখন সিলেটে বেড়াতে গিয়েছিল। আর আমি? ঢাকা শহরে আমার কোন অস্তিত্বই ছিল না তখন। আমি জন্মেছি টেকনাফে, বাংলাদেশী নাগরিক। আমার কোন নাম ছিল না। লতু বলে ডাকতো সবাই। আসল নাম বলতে কিছু ছিল না। ছিল না বাবা মায়ের নাম। আমি কিছুই জানতাম না আমার।

অথচ এখন? এখন আমার সকল পরিচয় লিপিবদ্ধ করা আছে জাতীয় পরিচয়পত্রে। মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ করে আমি আঙুলের ছাপ দেয়া বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে গেলাম ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে। এখন আমার নাম লতিফ আকবর। পিতা: শওকত আকবর। মাতা: জোহরা বেগম। জন্মতারিখ: ২রা আগষ্ট। রক্তের গ্রুপ-এবি+। আমার আইডি নং ১৫৭৮৯২........। এই আইডি ফুলের মতো পবিত্র। এই আইডি থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কোন অপরাধের নজীর নেই।

ঢাকা শহরের সবগুলো চেনা জায়গায় রিকশা নিয়ে ঘুরে ঘুরে দিন পার করে দিলাম। মাঝে দুবার বিরতি নিয়েছি। লাঞ্চ করেছি, বিকেলে চা খেয়েছি। তারপর সর্বশেষ গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম। ধানমণ্ডির একটা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড় করালাম। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাস্তার ভিড় কমেনি এখনো। লেকের পাড়ে লোকজন বসে আড্ডা দিচ্ছে। চটপটি ফুচকা খাচ্ছে।

আমি যে বাড়ির সামনে নামলাম সেই বাড়িটায় এখন কে থাকে আমি জানি না। বাড়িটার গেট বন্ধ ভেতর থেকে। নক করার সাহস হলো না। কী পরিচয় দেবো। আসল পরিচয় দিলেও কেউ চিনবে না। আসল পরিচয় কী? ফুটপাতে বড় হওয়া লতু? না হবে না। চুরি করেই ঢুকতে হবে। রাত হোক। আরেকটু নির্জন হোক পথঘাট। অভিজাত এলাকায় এই এক সুবিধা। পথের ধারে দোকানপাট খাড়া হয়ে থাকে না। রাত আটটা নটা বাজতেই মধ্যরাতের নির্জনতা। অপেক্ষা করি। রিকশাওয়ালাকে বিদায় করে দিলাম।

কাছের বড় রাস্তায় এসে একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করে খেয়ে নিলাম। টেবিলে বসে যেটুকু বিদ্যা আছে সেটুকু বিদ্যা দিয়ে একটা চিঠি লিখলাম। তারপর প্যাকেটটা খুলে ওটার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম চিঠি।

নটার পর সত্যি জনবিরল হয়ে গেল গলিটা। দেয়াল টপকে ঢুকতে কোন সমস্যা হলো না। একসময় অনেক এসেছি এই বাড়িতে। এখনো প্রায় আগের চেহারায় আছে বাড়িটা। ওদের ড্রইং রুমের দরোজার পাশে বড় একটা জানালা। ওটার একটা পাল্লা খোলা। বাতি জ্বলছে ভেতরে।

উঁকি দিয়ে দেখি এক মাঝবয়েসী মহিলা বসে বসে টিভি দেখছে। মহিলাকে চিনতে পারছি না। মহিলাও চিনবে না আমাকে। চিনলে আরো বিপদ হতো। কি করবো এখন? আমি হাত ঢুকালেই দেখে ফেলবে। জানালার পাশে একটা সোফা। ওটায় ফেলে রেখে যাই? হাতে সময় কম। দেখে ফেললেও উপায় নাই।

আস্তে করে জানালার গরাদের ভেতরে কবজি গলিয়ে জিনিসটা টুপ করে ছেড়ে দিলাম সোফার উপর। সাথে সাথে মহিলার গগনবিদারী চিৎকার। চোর চোর চোর!!!

আমি এক দৌড়ে দেয়াল টপকে সোজা বাইরে গিয়ে গলির উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করি। ততক্ষণে মহিলার সাথে আরো অনেক চিৎকার যোগ হয়েছে। লোকজন জড়ো হচ্ছে। আমাকে খুব দ্রুত এলাকা ছেড়ে সটকে পড়তে হবে।

***** ******
রাত এখন পৌনে এগারোটা। ট্রেনের পয়তাল্লিশ মিনিট বাকী। কমলাপুর স্টেশানের রাতের দৃশ্যগুলো এত বছরেও বদলায়নি। প্ল্যাটফর্মের একটা বাধানো বেঞ্চিতে বসে সিগারেটের একটা শলায় আগুন দিয়ে ভাবছি, শাহানা আপা নিশ্চয়ই এখনো বিদেশে। ওর কাছে এই চিঠি কখনো পৌঁছাবে কিনা জানি না, কিন্তু আমার খুব হালকা লাগছে আজ। নিজেকে মুক্ত লাগছে দীর্ঘকালের একটা অপরাধবোধ থেকে। এতক্ষণে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা চিঠিটা পড়তে শুরু করেছে নিশ্চয়ই।

আপা, আমি লতু। আপনি আমাকে অন্ততঃ নামে চিনবেন। বহুবছর আগে আমি আপনাদের বাড়িতে কাজ করতাম। পালাবার সময় আমি অনেক জিনিসের সাথে শোকেস থেকে একটা বাঁধানো ছবিও চুরি করি সোনার ফ্রেমের লোভে। আমি জানি চাচা আমাকে কোনদিন ক্ষমা করেননি, আপনিও করবেন না। আমি জীবনে অনেক অপরাধ করেছি, আপনাদের কাছ থেকে চুরি করা অনেক জিনিস বিক্রি করেছি, কিন্তু আপনার ভাইয়ের ছবিটা কিছুতেই বিক্রি করতে পারিনি। আমার আর কোন অপরাধ আমাকে এতটা পোড়ায়নি যতটা পুড়িয়েছে এই ছবিটা। আমি আপনার বাবাকে সারা জীবনের জন্য বঞ্চিত করেছি এই ছবি থেকে। আপনার বাবা হয়তো বেঁচে নেই। তবু আমার ইচ্ছে ওই ছবিটা অন্ততঃ তার বোনের কাছে থাকুক।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লাগলো গল্পটা।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ :)

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

নামকরন সার্থক হয়েছে।।।।

লেখককে বলব-- "বেশী করে পড়ুন।।।

---সোহেল মাহামুদ 0অতি ক্ষুদ্র একজন0

নীড় সন্ধানী এর ছবি

জী আরো বেশী পড়তে হবে। সহৃদয় মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। :)

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

আরেকটু অন্যরকম আশা করেছিলাম শেষটা :) । আপনার আগের গল্পগুলোর তুলনায় একটু হালকা মনে হলো। পরেরটি নিশ্চয় আগের ফর্মে ফিরবে।

মাসুদ সজীব

নীড় সন্ধানী এর ছবি

প্রত্যাশা ব্যাপারটাই হতাশা ডেকে আনে। পরেরবার চেষ্টা থাকবে প্রত্যাশা পূরণের :)

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

দীনহিন এর ছবি

সিনেম্যাটিক লেগেছে, তবে মাঝে মাঝে উপভোগ্য ছিল!

হুংকারের মালিক একজন দয়ালু নার্স।

এমনিতে হয়ত বিদ্ঘুটে মনে হবে, তবে অনেক বাজখাই কন্ঠের দরদি নার্স কিন্তু সত্যি সত্যি দেখা যায়!

মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ করে আমি আঙুলের ছাপ দেয়া বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে গেলাম ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে। এখন আমার নাম লতিফ আকবর।

এ জায়গাটা পছন্দ হইছে!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ড্রামাটিক করতে গিয়ে সিনেমাটিক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে :))
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। (ধইন্যা)

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ে ভাল লাগলো।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটা ভালো লেগেছে নীড় সন্ধানী।
আপনার জন্য অনেক শুভকামনা।
ভালো থাকবেন।

------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

এক লহমা এর ছবি

:) দীনহিনের উত্তরে আপনার কমেন্টটাই বসায় দেই
"ড্রামাটিক করতে গিয়ে সিনেমাটিক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে" :D
লেখা এগিয়েছে অতি চমৎকার। পরের গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল। শেষটা একটু farfetched মনে হচ্ছে। এতদিন পর সেই চিঠি শাহানার কাছে কিভাবে পৌঁছবে কিংবা আদৌ পৌঁছবে কিনা-এটা নিয়ে সন্দেহ আছে। নিশাচর জীব।

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার বর্ননা শৈলীতে অপূর্ব লেখা। তবে একজন নগ্ন নারীর রূপ দেখে দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ততা ছিন্ন করে অজানার. উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া, ঠিক যেন মিলছে না। ধন্যবাদ। ---সাখাওয়াৎ

অর্বাচীন এর ছবি

শেষের দিকটায় তাড়া দিয়ে শেষ করে দিলেন বোধ হয়। ভারো লেগেছে। (Y)

অতিথি লেখক এর ছবি

এক টানে পড়ে ফেললাম। প্রথম দিকটার তুলনায় শেষটা আরও দুর্দান্ত হবে আশা করেছিলাম।

-রায়হান শামীম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।