বিষাক্রান্ত বাংলাদেশ!

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: মঙ্গল, ১০/০৬/২০১৪ - ৯:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশে ১০০% বিশুদ্ধ খাবার খেতে পারেন কত শতাংশ মানুষ? তাদের বিশুদ্ধ খাবারের উৎস কী? তারা কোথা থেকে বাজার করে? সেই বাজার রান্না হবার আগে এবং পরে বিশুদ্ধতা যাচাই করে কে? যাচাই করার পদ্ধতি কি?

হতে পারে কিছু শীর্ষ ক্ষমতাবান মানুষ, সংখ্যানুপাতে যারা ০.১% অথবা ০.০১% এর মতো ক্ষুদ্রাংশ, নিশ্চয়ই বিশুদ্ধ খাবার খায়। তাদের মধ্যে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রী আমলা শীর্ষ ধনকুবেরগন রয়েছেন। নিশ্চয়ই ভেজালমুক্ত রান্নাঘর তৈরীর ক্ষমতা তাদের আছে। সাধারণ মানুষের সে ক্ষমতা নেই, এমনকি ভেজালমুক্ত মানুষেরা কী পদ্ধতিতে ভেজাল থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখেন তাও জানার উপায় নেই।

ভেজাল দিয়ে যদি ভাগ করি, তাহলে দেশটা দুই ভাগে বিভক্ত। বিশাল অংশের ভাগটা ভেজাল খাবার খায়, আরেকটা ছোট্ট অংশ ভেজালমুক্ত খাবার খান।
যারা ভেজালমুক্ত আছেন, তারা কি ভেজালযুক্ত মানুষের কথা ভাবেন? মনে হয় না। দেশের ৯৯.৯% মানুষের বাজার, খাবার, রান্নাঘর ইত্যাদি পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা জানতেও পারি না প্রতিদিন আমরা কি পরিমান ফরমালিন খেলাম, কি পরিমান কার্বাইড গিললাম, কি পরিমান ক্রোমিয়াম পাকস্থলীতে জমা করলাম। যদি জানতাম তাহলে হয়তো আমরা আমাদের আয়ু সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারতাম। বুঝতে পারতাম, আমি মরবো কিডনী রোগে, তুমি মরবে যকৃতধ্বংস হয়ে অথবা সে মরবে পাকস্থলীর কোলন ক্যান্সারে।

একটা লঞ্চ ট্রেন কিংবা বাস দুর্ঘটনায় ৫০ জন মানুষ মারা গেলে সারাদেশ ব্যাপী তোলপাড় ঘটে যায়। কিন্তু ভেজাল খেয়ে বছরের পর পর হাজার হাজার মানুষ নীরবে মারা যাচ্ছে সেটা খুব বেশী গুরুত্ব পায় না। এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

এদেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনস্টিক সেন্টার, ডাক্তারের চেম্বার কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ছুটছে চিকিৎসা পেতে। বাজার খরচের টাকা না থাকলে আধপেটা থাকা যায়। কিন্তু চিকিৎসা খরচ না থাকলে ডাক্তার চোখ তুলেও দেখবে না, ডায়গনস্টিক সেন্টারও বলে তফাত যাও। তাই সর্বস্বান্ত হয়ে, ঋনগ্রস্থ হয়েও চিকিৎসার খরচ যোগাতে হয়। আমার চারপাশের চেনাজানা আত্মীয়বন্ধুর গড়পড়তা ৫০টি পরিবারের খোঁজ নিলে দেখবো, সম্পূর্ণ সুস্থ আছে তেমন পরিবার একটিও নেই। প্রতি পরিবারে একজন না একজন অসুস্থ রোগীর দেখা মিলবেই।

বিশ পচিশ বা পঞ্চাশ একশো বছর আগেও অসুস্থ হতো মানুষ। কিন্তু সেটার ধরণ ছিল ভিন্ন। ওটা ঘটতো বছরে দুয়েকবার মাত্র। জ্বরজারি সর্দি কাশি আমাশা ডায়রিয়া ছাড়া তেমন গুরুতর কোন সমস্যা থাকতো না। এখন তো প্রতিমাসে, কখনো কখনো প্রতি সপ্তাহেও আমাকে ডাক্তারের কাছে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে পরিবারের কোন না কোন সদস্য নিয়ে। একজন সুস্থ হতে না হতেই আরেকজন অসুস্থ হয়। গুরুতর সব রোগের নাম। কারো কিডনী চলে গেছে, কারো লিভার নষ্ট, কারো পাকস্থলী, কারো খাদ্যনালী। সামাজিক বা বন্ধুবান্ধবের যে কোন আড্ডায় বসলে অবধারিতভাবে চলে আসবে ডাক্তার হাসপাতাল রোগ বালাই ইত্যাদির কথা।

দেশব্যাপী এই বিরামহীন অসুস্থতার পেছনে প্রধান অবদান খাবারের। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যে খাবার সংগ্রহ করছে দিনরাত পরিশ্রম করে, সেই খাবার খেয়েই মানুষ মরতে বসছে। শরীরের যেসব অংশ দিয়ে খাবারদাবার আসা যাওয়া করে সেই পথগুলো ভয়াবহ সব সমস্যায় আক্রান্ত।

সামর্থ্য থাকলে আমি হয়তো ভালোমন্দ বাজার করে রান্নাঘর ভর্তি করে ফেলতে পারি কিন্তু বিষমুক্ত খাবারের ব্যবস্থা করা আমার জন্য অসম্ভব। ফলমূল, শাকসবজী, মাছ, মাংস, তেল মশলা কিসে নেই বিষ? আমার কাছে বিষাক্ততার মাত্রা যাচাই করার যন্ত্রপাতি নেই। তবু আমি জানি প্রতিদিন যা কিছু খাবার কিনছি তার বিরাট অংশেই ছড়িয়ে আছে নিঃশব্দ ঘাতক। আমি বাজারের থলেভর্তি করে বিষমুক্ত খাবার কিনে বাসায় যাই। পরিবারের পুষ্টি, আমিষ-প্রোটিন বাড়াতে গিয়ে রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেই বিষের ভিটামিন।

আমাদের কথা বাদ দিলাম। বলি যারা দেশ পরিচালনা করেন, যারা দেশের আইন কানুন, পরিবেশ, বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের সবার খাবার কি ১০০% বিষমুক্ত? তারা কি নিশ্চিত হয়ে প্রতিদিন বাজার করেন, রান্না করেন? যদি না হয় তাহলে তারাও কী ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে হাঁটছেন না? তাহলে সমগ্র জাতিই দীর্ঘমেয়াদী আত্মহননের পথে যাচ্ছে? কী ভয়াবহ ব্যাপার!!

এই জাতির ভবিষ্যত কী? নিকষ কালো আঁধার? নাকি একটু আলো আছে। শেষমেষ বাংলাদেশকে কেউ বিষমুক্ত করতে না পারলে আমরা কি এমন অসম্ভব কোন আশা করতে পারি বিষের সঙ্গে বসবাস করতে করতে মানুষের শরীর কোন একদিন এই সকল বিষ হজম করার মতো শক্তি অর্জন করে ফেলবে অভিযোজন প্রক্রিয়ায়? উটপাখির পাকস্থলী নাকি লোহা পাথর ইত্যাদি কঠিন জিনিস হজম করার মতো শক্তি রাখে। আমাদের পাকস্থলীও কি একদিন সেরকম শক্তিমান হয়ে উঠবে?

সবশেষে একটা সংবাদ পড়ে মনটা আরো দমে গেল। এতদিন ভাবতাম অন্য ফলে যাই ঘটুক, মোটা চামড়ার কাঁঠাল নিশ্চয়ই ফরমালিন মুক্ত। পছন্দের ফল না হলেও এতে একটু ভরসা রাখার জায়গা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই কাঁঠালেও ফরমালিন। হারাধনের আর একটি ছেলেও অবশিষ্ট রইলো না।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে, যদি এই দেশে থাকতে হয় তাহলে ভেজাল খেতেই হবে। এর থেকে পরিত্রানের পথ আপাতত নাই... ধ্রুব

মন মাঝি এর ছবি

আচ্ছা, নারকেলে ফরমালিন দেয় না? হাসি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

নারকেল যদি এমনি এমনি সংরক্ষন না করা যেত, তবে নারকেলেরও রেহাই ছিলো না। তবে ডাব নিয়ে আমি এতটা নিশ্চিত নই

----ইমরান ওয়াহিদ

হিমু এর ছবি

ফরমালিন মেশানোর শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড। এর কম কিছু নয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বিশ পচিশ বা পঞ্চাশ একশো বছর আগেও অসুস্থ হতো মানুষ। কিন্তু সেটার ধরণ ছিল ভিন্ন। ওটা ঘটতো বছরে দুয়েকবার মাত্র। জ্বরজারি সর্দি কাশি আমাশা ডায়রিয়া ছাড়া তেমন গুরুতর কোন সমস্যা থাকতো না।

না, অসুখ তখনো ছিল, বরং বেশ ভয়ানক ভাবেই ছিল। বিভিন্ন রকম জ্বর ছাড়াও বেশ কিছু প্রাণঘাতী অসুখের অস্তিত্ব তখন ছিল, যেমন- কলেরা, গুটিবসন্ত, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ইত্যাদি, যাতে প্রতিনিয়ত বহু মানুষ প্রান হারাতো। আর টাইফয়েড জ্বরেও বহু মানুষ প্রান হারাতো, অনেকে বিকলাঙ্গ হতো। গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রকোপও ভয়াবহ মাত্রায় ছিল, আর ছিল বাত ব্যথার যন্ত্রনা। বিভিন্ন ধরনের মেয়ালি অসুখ ছিল, যার খবরও কেউ কখনো জানতে পারতো না, বিভিন্ন অসুখে শিশু মৃত্যুর হার ছিল অত্যাধিক।
তবে এটা ঠিক যে, খাদ্যে ভেজালের অস্তিত্ব তখন ছিল না। তখন একমাত্র ভেজাল ছিল দুধে পানির মিশেল, সেটাই তখন ছিল গুরুতর অপরাধ।
তখন স্বাস্থ্য সম্মত খাবারের ধারনা মানুষের ছিল না, এখন সে ধারনা হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে বদলে গেছে অর্থ উপার্জনের আকাঙ্খার ধরন। মানুষের জীবনকে জিম্মি করে অর্থ উপার্জনের বিষয়টা এখন এ দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে একটা সাধারন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলমূলে ফরমালিন কিংবা খাদ্যে ভেজাল মিশ্রন সেই সার্বিক অবক্ষয়েরই একটা খন্ডিত অধ্যায় মাত্র।

সজীব ওসমান এর ছবি

এই অংশটুকু আসলেই সঠিক নয়। মহামারীর ইতিহাস শুধু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। কিন্তু এখনকার মহামারীটা অন্যরকম।

সজীব ওসমান এর ছবি

আমাদের সামনের মহামারীগুলি হবে সম্ভবত নিশ্চিতভাবেই রাসায়নিক কারনে। আর্সেনিক এবং খাদ্যে বিষ। উপায় বের করতে হবে। কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আসলেই হয়তো খাদ্যে বিষপ্রয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে। সঙ্গে খাবারকে যেন পোকামাকড়ের প্রকোপে কম পরতে হয় সেই বিষয়গুলো নিয়েও কৃষিবিদেরা, বিজ্ঞানীরা চিন্তা করে দেখতে পারেন।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

নীরব ঘাতক!!!

____________________________

এক লহমা এর ছবি

ফরমালিন প্রয়োগ বন্ধ করার লড়াই ভালই জটীল। সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো এ লড়াইয়ের এক বড় উপাদান।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

লোভ বড় ভয়ংকর জিনিশ। মানুষ মরলে মরুক, সাথে আমি নিজে মরলেও কিছু যায় আসে না, অন্তত টাকাতো আসছে, এখন সেটা যেভাবেই আসুক। যারা খাবারে বিষ মেশায় তাদের জন্য কঠর শাস্তির ব্যবস্থা করলেও মনে হয় না তেমন ফলপ্রসূ হবে। যে লোক কার্বাইড মিশিয়ে কলা পাকায় সে কি কখনও আম খায় না? সে কি কখনও ভাবে সে যেমনটি করে কলায় কারবাইড মেশাচ্ছে ঠিক তেমনটি করে অন্য কেও আমে ফরমালিন মেশাচ্ছে?

ফরমালিন আর কার্বাইডের বড় দাওয়াই হচ্ছে জন সচেনতা। কিসে ক্ষতি বেশি? বিষ মেশানো ফল খাওয়া নাকি ফল খাওয়া একদম ছেড়ে দেয়া? ৬ মাসে একটি ফলও না খেলে যারা ফলে বিষ মেশায় তাদের কি অবস্থা হবে এক বার ভেবে দেখেন?

সোহেল লেহস

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ভাবছি দেশে কিছুকাল আগেও ১০০% খাবার খেতে পারত জনসংখ্যার কত %? এখন হয়তো কিছুটা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে, তার কথা হচ্ছ, সরকাদের ওপর মহলের সদিচ্ছাই ফরমালিন -নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পন্থা। যতদিন তা না হচ্ছে, হাট-বাজারে এভাবে ফরমালিনযুক্ত খাবার নষ্ট করে ফেলা ঠিক নয়। আজ পর্যন্ত বাংলা দেশে রান্না পরবর্তী ফরমালিনের কার্যকারিতা নিয়ে সঠিক গবেষণা হয়নি। যে তাপমাত্রায় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রান্না প্রক্রিয়া চলে তাতে ফরমালিনের কার্যকারিতা সম্ভবত অনেক কমে যায়। হয়তো এর চেয়ে বেশী বিষ আমরা প্রকৃতি থেকেই গ্রহণ করছি। তার কথা এই গরীব দেশে এভাবে এত খাবার নষ্ঠ করা ঠিক নয়। কার্যকর পন্থা অবলম্বনই জরুরী। কথাটা আমাকে ভাবিয়েছে। আপনারাও ভেবে দেখবেন।

তবে শাস্তির বিধান মৃত্যুদন্ড সমর্ধন করি। সেক্ষেত্রেও প্রয়োগকারী সংস্থাকে সততার সাথে কাজ করতে হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি হিমুর সাথে গলা মেলাতে চাই।
খাদ্যে ফরমালিন মেশানোর শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

ফরমালিন খেয়েও ভালো থাকুন নীড় সন্ধানী।
শুভকামনা আপনাকে।

---------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

আমি হিমুর সাথে গলা মেলাতে চাই।
খাদ্যে ফরমালিন মেশানোর শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

ফরমালিন খেয়েও ভালো থাকুন নীড় সন্ধানী।
শুভকামনা আপনাকে।

---------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

দুর্দান্ত এর ছবি

জমিতে যে ইউরিয়া দেয়া হয়, সেটা কি কোনভাবে ফর্মালিনে রূপান্তরিত হতে পারে?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।