চোর ডাকাতেরা জানতো না ফাঁকা মাঠের মাঝে এই বাড়িটার দরোজাগুলো কতো নাজুক। ভেতর থেকে কোনমতে বন্ধ করা গেলেও বাইরে তালা দেবার কোন উপায় নাই। এ বাড়ির কেউ কখনো একসাথে কোথাও যায় না। কেউ না কেউ থাকেই।
কিন্তু সেবার হঠাৎ এমন এক দুর্যোগ অতর্কিতে হানা দিলো সবাইকে পালাতে হলো ঘর ছেড়ে। এক রাতের অবিরাম ভারী বর্ষণে সমস্ত শহর যখন ডুবে গেল, তখন এই বাড়িটাও খুব দ্রুত এক বুক পানির নিচে ডুবে যাচ্ছিল দেখে সাত সকালে বাড়ির বাসিন্দারা কোনমতে এক কাপড়ে বেরিয়ে কয়েকশো গজ দূরে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলো। পেছনে দরোজা-খোলা বাড়িতে রয়ে গেল যাবতীয় আসবাবপত্র, টিভি-ফ্রিজ-কম্পিউটার, মধ্যবিত্ত পরিবারের অমূল্য সম্পদ।
ছেড়ে আসা বাড়িটা ছিল আমাদের। সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। অবিরাম বর্ষণ তখনো চলছিল। জল নামার কোন লক্ষণ নেই। থই থই করছে চারপাশ। প্রতিবেশীর দোতলা বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম বন্যা কবলিত গাছপালা ঘেরা নিঃসঙ্গ বাড়িটার দিকে। গত বিশ বছরে এই প্রথম বাড়িটা একা হলো। বাড়ির ভেতরে একটা জিনিসও অক্ষত থাকবে না। বইগুলোর জন্য বেশী মায়া লাগলো। টিভি আর ফ্রিজটা কোনমতে টেবিলের উঁচুতে তুলে রাখা হয়েছে। সার্টিফিকেটের ব্রিফকেসটা আলমারির উপরে।
আলমারি? আলমারির কথায় মনে পড়ে গেল ওখানে কত কি দামী সব জিনিস রয়ে গেছে। আছে অতি মূল্যবান গয়নার বাক্সগুলো। একদম নীচের তাকে আছে, ভিজে নিশ্চয়ই সুপসুপে হয়ে গেছে। এত বেশী পানি, তালা খুলতে ডুব দিতে হবে। কুচকুচে নর্দমার জলে ডুব দেয়া সম্ভব না। চাইলেও তাই বের করা যাবে না। কিন্তু চোরের কাছে ওসব ঝড় জল কিছুই না। এ কথাটা মনে হতেই বন্যার চেয়ে বড় বিপদের আশংকাটা জাগলো। চোরেরা শাবল দিয়ে আলমারী খোলে। চাবি লাগে না। নিশ্চয়ই চোর আসবে রাতে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই কোথাও। খানিক পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে। এতদিন যেসব চোর চুরি করার সুযোগ না পেয়ে মনে মনে ক্ষুব্ধ ছিল তারা মনের সাধ মিটিয়ে ঘর খালি করে দেবে। যেসব জিনিস অক্ষত আছে এখনো, সেসব চোরের হাতেই নিকেশ হবে।
ফিরে গিয়ে বাড়ি পাহারা দেবো? অন্ধকারে এক বুক পানির ভেতরে দাঁড়িয়ে কী পাহারা দেবো? মালের চেয়ে জানের মায়া বেশী। থাক, জিনিস গেলে যাক। প্রাণ থাকলে কত কিছু কেনা যাবে।
তখনই আবার মনে পড়ে গেলো তাদের দুজনের কথা। আমার সাহস না থাকলেও তাদের উপস্থিতি চোরকে ঠেকিয়ে দিতে পারে না? ভেবে দেখলাম, নিশ্চয়ই পারে। অন্ততঃ একটা সম্ভাবনা আছে।
অন্ধকারে জল ঠেলে তাদেরকে পাহারায় নিয়োজিত করার জন্য ফিরে গেলাম থই থই জলে ডুবন্ত বাড়িটাতে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। দরোজাটা হা করে খোলা। টর্চের আলোয় দেখলাম ঘরের সমস্ত জিনিস ভাসছে। ঘটি বাটি সোফা চেয়ার ওয়ার্ড্রোব জামা কাপড় সব। দেখেও দেখিনি ভাণ করে মনোকষ্ট চেপে ভেতরে ঢুকে একজনকে আলগোছে আলমারীর উপর বসিয়ে দিলাম। অন্যজনকে জলে চুবিয়ে বাইরের বারান্দার দড়িতে ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর দরোজা ভেজিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ফিরে এলাম প্রতিবেশীর বাড়িতে। তখনো জানি না কতটা কাজ হবে এই কৌশলে।
পরদিন সকালে জল খানিকটা নেমেছে। ভয়ে ভয়ে আমি জল ডিঙ্গিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখলাম জিনিসপত্র কিছুই খোয়া যায়নি। চোর ডাকাত কেউ আসেনি। বারান্দার দড়িতে ঝোলানো লুঙ্গিটা তখনো শুকোয়নি। ঘরের ভেতর হ্যারিকেনটা তখনো জ্বলছে মিটমিট করে।
লুঙ্গি এবং হারিকেনের যৌথ পাহারায় টিকে গেল অক্ষত মূল্যবান সম্পদগুলো।
*************************************************************************
[অনেকদিন গল্প লিখি না, লিখতে পারি না। কী করে যেন সচলায়তনের জন্মদিন উপলক্ষে একটি সাদামাটা অভিজ্ঞতাসূচক অনুগল্প বেরিয়ে গেল। বেঁচে থাকুক সচলায়তন!]
মন্তব্য
এটা কোথায় ও কবে?
বাঁচবে কিভাবে, যদি আপনার মতো লেখকরা না লিখেন আর পাঠকরা মন্তব্য না করেন দলে দলে? এটা যেন একটা দুষ্টচক্র। যারা একসময় সচলে আসর জমিয়ে রাখতেন নিত্যনতুন জমাটি লেখা দিয়ে, তারা গত অল্প কয়েক বছরে বছরে কোথায় যেন হঠাৎ উধাও হয়ে গেছেন। তারা একসময় যেমন দারুন সব লেখা দিয়ে সচলের আঙ্গিনা ভরিয়ে তুলতেন তেমনি তাদের লেখার আকর্ষনে আরো অনেক সচল-পাঠক দলে-দলে ঝাপিয়ে পড়ে মন্তব্যের ঘর আলাপ-আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক-রঙ্গ-রসিকতায় চনমনিয়ে ঝমঝমিয়ে জমিয়ে তুলতেন। আর ঐ জমাটি আসরে অংশগ্রহণের লোভেই হয়তো অনেক নতুন নতুন পাঠক/সার্ফার সচলে যোগ দিতেন, আর তাদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসতো আরো নতুন ও ভালো লেখক। অথচ এখন পুরনো সেই লেখকরা প্রায় কেউ লিখেনই না, মন্তব্যও করেন না। এমনকি লগইন করতেও দেখা যায় না তাদের। সবাই প্রায় একযোগে লেখা বন্ধ করেছেন (যা বেশ আশ্চর্যজনক এবং অস্বাভাবিক)। নীড়পাতা অচল পড়ে থাকে দীর্ঘসময় ধরে, মন্তব্যের মাঠ পড়ে থাকে ফাঁকা। আর সচলের এই ফাঁকা বিরান তেপান্তর বা ভাঙা আসর দেখেই মনে হয় নতুন পোটেনশিয়াল মন্তব্যকারী ও লেখকরাও লিখতে উৎসাহী হন না। আবার মন্তব্যের ঘরে যথেষ্ট সংখ্যক এপ্রিশিয়েটিভ বা তর্কমূলক - যাই হোক না কেন - মন্তব্য না পেলে নতুন-পুরনো-পোটেনশিয়াল লেখকরাও নতুন লেখা দেয়ার কষ্ট করতে উৎসাহ বোধ করেন না মনে হয়। এইজন্য বলছিলাম দুষ্টচক্র। বা ইনফিনিট লুপ? এই চক্র কোন একটা জায়গায় না ভাঙলে সচলায়তন হয়তো অচিরেই অচলায়তনে পরিণত হয়ে স্মৃতির কোন ধূলিধুসরিত বিস্মৃত প্রকোষ্ঠে হারিয়ে যাবে চিরতরে। আপনার-আমার শুকনো শুভকামনায় কোন কাজ হবে না। তবে এটাই হয়তো জীবনের অনিবার্য নিয়ম, দুনিয়ার নিয়ম, সাইবার জগতেরও নিয়ম!
****************************************
যথার্থ বলেছেন।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
সচলায়তনে একসময় যাদের আনাগোনা ছিল তাঁরা কেন আনাগোনা করেন না সে ব্যাপারে অনেকবার প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। আমরা সবাই জানি আমরাই দায়ী, কিন্তু তবু আমরা সক্রিয় নই। একচোখা বিচারে গেলে আমি ফেসবুককে দায়ী করবো। প্রযুক্তির পরিবর্তন আমাদেরকে ফেসবুক অভিমূখী করেছে। ফেসবুকে মগ্ন হয়ে পড়ার কারণে অনেকে ব্লগমুখী হতে চান না। ওটা একটা নেশার মতো। দুষ্ট শিষ্ট যাই বলেন চক্রটা ওখানেই খেলছে। ভার্চুয়াল জগতের যে আড্ডাবাজী সেটা আগে ব্লগে হতো, এখন ফেসবুকে হয়। আগে যে ব্যাপারটাকে ব্লগিং বলা হতো এখন সেটাকে ফেসবুকিং বলা হয়। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম - এই ব্যাপারটা এখন স্মৃতিতেই থেকে যাবে। অদূর ভবিষ্যতেও ব্লগ কখনো পুরোনো জমজমাট আসরে আবির্ভূত হবে না। এখানে একটাই শান্ত্বনা বা স্বস্তি আছে, সচলায়তন কখনো সামুর মতো ছাগলের লেদানোর ময়দানে পরিণত হবে না। সে কারণে ফেসবুকের মোহ কাটিয়ে এখানে কেউ কেউ এখনো লিখছেন। সুস্থ লেখালেখি এখন একমাত্র এই প্ল্যাটফর্মেই হয়। আপনার চমৎকার মন্তব্যটি আলোচনার সুযোগ উস্কে দিল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
হারিকেন? এটা কি ৮৮'র বন্যার সময়ের কথা, নাকি তারও আগের?
'হারিকেন' দেখে মনে হচ্ছে গল্পের সময়কালটা আশির দশক হলেই যুক্তিযুক্ত হতো। কিন্তু এই ঘটনা সাম্প্রতিককালের। ২০০৭ সালের জুন মাসের। তখনো কোথাও কোথাও হারিকেনের অস্তিত্ব জাদুঘরের মতো টিকে ছিল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
না লেখার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ নাই। না লিখতে না লিখতে না লেখাটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
অজ্ঞাতবাস
আপনার বুদ্ধিটা ভালো ছিল। এই পোস্ট ধরে সচলায়তনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম। বেঁচেবর্তে থাকো হে সচলায়তন।
আয়নামতির আসল আইডির কী হলো? মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সুন্দর গল্প।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ সোহেল ইমাম
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
মজার গল্পতো! আপনার গল্প দেখে খুব আয়েস করে ভাবছিলাম, কী হয়, কী হয়! শেষটাতে দুর্দান্ত মজা পেলাম। অনেকদিন পর তাই লগইন হবার লোভ সামলাতে পারলাম না। এই লেখার সুবাদে অনেকগুলো ভাল লেখা পড়লাম আজ সচলে। তাই শেষ মন্তব্যটা আপনার লেখাতেই করলাম।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
পড়া ও চমৎকার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আরো গল্প দেন নীড়ুদা
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
আপনাকে অনেক বছর পর দেখলাম। আবার লিখতে শুরু করেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নতুন মন্তব্য করুন