কখন একটি জাতি রাষ্ট্র গঠন করতে চায়? কিংবা কখন একটি জাতি আলাদা হয়ে ওঠে? জাতি বলতে কী বোঝায়? জাতি মানে কী নির্দিষ্ট একটি ভাষা গোষ্ঠি? নাকি কোন একটি ধর্ম কিংবা সাংস্কৃতিক গোত্র? পৃথিবীতে সব জাতির রাষ্ট্র নেই, সব ধর্মের রাষ্ট্র নেই, সব সাংস্কৃতিক গোত্রের রাষ্ট্র নেই। জাতি মাত্রেই রাষ্ট্র হয়ে ওঠে না। জাতিকে রাষ্ট্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হয়। স্বতন্ত্র ভাষা সংস্কৃতি ধর্ম সব থাকলেও রাষ্ট্র গঠিত হয় না যদি সেই রাষ্ট্র গঠনের কোন নেতা না থাকে, যদি সেই নেতার পেছনে ঐক্যবদ্ধ জনগণ না থাকে। অনেক জাতির নিজস্ব ভূখণ্ড থেকেও রাষ্ট্র নায়কের অভাবে কাংখিত রাষ্ট্রসুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে পরাধীন জাতি হিসেবে শাসিত হচ্ছে। শাসিত হচ্ছে ভিন্ন জাতি, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির মানুষের দ্বারা। অনেক দেশের ভেতরে এমন রাষ্ট্রহীন জাতির বসবাস আছে। কোন কোন রাষ্ট্রের ভেতর আছে একাধিক জাতির অস্তিত্ব।
পৃথিবীতে পরাধীন জাতির সংখ্যা শতাধিক। সেইসব জাতিসমূহের মধ্যে কেউ কেউ নিজস্ব একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবীদার। নিজস্ব রাষ্ট্র হয়ে ওঠার মতো সব উপাদান বর্তমান আছে তাদের। কিন্তু সব যোগ্যতা থেকেও তারা শক্তিশালী কোন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিজেদের সকল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে বিসর্জন দিয়ে নিজ দেশে পরবাসী জীবনযাপন করতে থাকে। নিজেদের কোন অধিকারকে বাস্তবায়িত করতে পারে না। সেইসব জাতি রাষ্ট্রহীন জাতি হিসেবে চিহ্নিত। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তেমন পরাধীন নিগৃহীত নিপীড়িত জাতির উদাহরণ অনেক। সংখ্যার বিচারে যেসব মুক্তিকামী রাষ্ট্রহীন জাতির নাম সবার উপরে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো Kurdi, Yoruba, Igbo, Rhinelanders, Occitan, Uyghur, Tibetan, Indian Gurkha, Palestinian, Zulu, Bavarian, Kongo, Kabyle, Andalusian, Catalans, Rohinga, Kashmiri, Srilankan Tamil, Inuit, Mapuche, Pamiris, Maori ইত্যাদি।
একসময় বাংলাদেশের নামও এই তালিকায় ছিল। এসব পরাধীন জাতিকে যারা পদানত করে রেখেছে তাদের বড় অংশই বৃহৎ রাষ্ট্র শক্তির অধিকারী কিংবা তাদের অনুসারী। যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের স্বাধীন সত্তা অর্জন করা যায়নি। কিন্তু শক্তিই শেষ কথা নয়, মানুষের স্বাধীনতার আকাংখা বাস্তবায়িত হবার সুযোগ কখনো কখনো সময়ের ডাকেই এসে হাজির হয়। এভাবেই স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র। আগামী সময়েও স্বাধীনতার আলো মেখে জেগে উঠবে নতুন সব রাষ্ট্র।
রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা ভূগোলের নিয়ম লংঘন করেছে। যেখানে যুক্তি নয়, শক্তিই নির্ধারক। কোন রকম ভৌগলিক সাংস্কৃতিক সংযোগ না থেকেও হাওয়াই কেন আমেরিকার অংশ হয়, উইঘুর কেন চীনের অংশ হয়ে থাকে, কুর্দিরা কেন ইরাক-তুরস্কের অংশ হয়ে থাকে, মায়ানরা কেন নিজ দেশ ছেড়ে ছড়িয়ে থাকে ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে, মাপুচেরা কেন অনাদরে পড়ে থাকে চিলির প্রত্যন্ত অঞ্চলে- তার কোন জবাব নেই। এরকম শত শত উদাহরণ দেয়া যাবে বিশ্বজুড়ে নানা জাতিসত্ত্বার। যাদের ঘর অন্যের দখলে, যারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরাও তেমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল।
৫০ বছর আগেও পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামের কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। হাজার বছর ধরে বাঙালীদের নিজস্ব সমৃদ্ধ ভাষা সংস্কৃতি সবকিছুই ছিল, তবু একশো বছর আগেও আমরা নিজস্ব একটি রাষ্ট্রের কথা ভাবতে পারিনি। একটি বাড়ি তৈরীর জন্য যেমন স্থপতির প্রয়োজন হয় তেমনি একটা রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্যও স্থপতির প্রয়োজন হয়। জাতির বয়স হাজার বছরের বেশী হলেও জাতিকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত করার মতো স্বপ্নবাজ কোন নেতৃত্ব আমাদের ছিল না। বৃটিশরা এদেশে আসার আগে বাংলা ভূখণ্ডটি মাঝে মাঝে কিছু সময় স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে শাসিত হলেও তার শাসকরা ছিল ভিনদেশী। বাঙালী কখনো বাংলাদেশকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে শাসন করেনি ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত। পৃথিবীতে এখনো অনেক জাতি স্বেচ্ছায় পরাধীন জীবন যাপন করছে। আমরাও স্বেচ্ছায় পরাধীন ছিলাম ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত। স্বেচ্ছায় পরাধীনতা মেনে নেবার অন্যতম একটি কারণ হলো, নেতৃত্বের অভাব, দ্বিতীয় কারণ কারণ হলো বঞ্চনার অনুভবের অভাব। আমরা যে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত আছি সেই অনুভবটাই আমাদের ছিল না। যতক্ষণ এদেশে বৃটিশরা ছিল, ততদিন আমরা ভেবেছি ওরা চলে গেলেই ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হবে আমাদের আর কোন সমস্যা থাকবে না।
কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের মাত্র এক বছরের মধ্যেই বাঙালীদের জন্য স্বাধীনতার পুরস্কার হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা জানিয়ে দেয় বাংলা ভাষার বদলে উর্দুকেই মেনে নিতে হবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। সেই ছিল প্রথম আঘাত। সেই আঘাতেই বাংলাভাষীরা প্রথমবারের মতো টের পেতে শুরু করলো যে পাকিস্তান আমাদের সঠিক রাষ্ট্র নয়। মাতৃভাষায় মানুষের জন্মগত অধিকার, এ হলো প্রাণের অধিকার। সেই অধিকারের সীমানা বুঝতে কোন রাজনৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন হয় না। এই অধিকারের চেতনা মানুষের জন্মগত। মাতৃভাষা লাঞ্ছিত না হলে বাঙালী হয়তো কোনদিন ভাবতো না যে আমাদেরও নিজস্ব একটি ভূখণ্ড প্রয়োজন যেখানে আমরা নিজেদের ভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবো।
ঠিক তখন থেকেই বাংলাভাষীদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজীয়তা অনুভব করা শুরু হলো। সেই অনুভবটা গণদাবীতে পরিণত হলো মাত্র দুই দশকের মধ্যে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের একের পর এক চাপিয়ে দেয়া অবিচারের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালীদের নানামুখী দাবী স্বাধীনতামুখী এক গণআন্দোলনে পরিণত হলো। বলা বাহুল্য, সেই আন্দোলনের প্রধান কারিগর ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
অবশেষে ১৯৭১। গনহত্যা। মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশ। হাজার বছরে যা সম্ভব হয়নি, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সেটি সম্ভব হলো। বাংলাভাষীদের জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্নপুরণ হলো। এই রক্তক্ষয়ের জন্য জাতি ব্যথিত হলেও আক্ষেপ করেনি কখনো। এই রক্তক্ষয়ের পেছনে একটা গভীর চেতনা ছিল, সেই চেতনাটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। যদু মদু কেউ ডাক দিলেই তেমন চেতনার জন্ম হয় না। সেই চেতনাটি বছরের পর বছর ধরে জাতির মগজে স্নায়ুতে রোপন করে যেতে হয়। জেল জুলুম নির্যাতন সয়েও সেই কাজটি যাচ্ছিলেন অক্লান্ত একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। যাকে হত্যা করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না।
এতগুলো বছর পার হবার পরও আমরা কী তাঁকে বুঝেছি? আমরা কী জানি তিনি আসলে কী যাদুতে একটি জাতিকে তাঁর স্বপ্নের পেছনে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন? তিনি শুধু রাজনীতি করে আর জেল খেটে পাকিস্তানের ২৪ বছর পার করেননি, তিনি একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন সাত কোটি মানুষের হৃদয়ে। সাত কোটি মানুষের হৃদয় মগজ তিনি জয় করেছিলেন তাঁর কন্ঠ দিয়ে, শব্দ দিয়ে, স্বপ্নের সুতো দিয়ে বোনা বাক্যবন্ধ দিয়ে। আর কোন অস্ত্র তাঁর ছিল না। পরাক্রান্ত কবিতার মতো প্রোথিত শব্দের সমাহারই ছিল তাঁর শক্তি।
এই কাজটি যে কেউ চাইলেই পারে না। শেখ মুজিবের চেয়ে বড় বড় নেতাও পারেননি। শেখ মুজিব যে কারণে সফল হয়েছিলেন, সেই কারণটি অন্য কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা সেই কারণটি কোন সুযোগ্য দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্টি হওয়া স্বাধীনতার মাইকওয়ালা হবার মতো সফলতা ছিল না। সেই কারণটির পেছনে ছিল তিলে তিলে একটি জাতির স্বপ্নকে মহীরূহে পরিণত করার অতুলনীয় একটি যোগ্যতা। পৃথিবীতে আজ যে কটি জাতি পরাধীনতায় ধুকছে তাদের অনেকেরই একজন শেখ মুজিব নেই। একজন শেখ মুজিবের জন্ম না হলে বাঙালীর রাষ্ট্রস্বপ্ন আরো কয়েকশো বছর বিলম্বিত হতে পারতো।
রাষ্ট্রহীন জাতিরা এমন একটি নেতার জন্য যুগ যুগ প্রতীক্ষা করে, অথচ বাঙালীর ইতিহাসের সেই যোগ্যতম নেতাটিকে আমরা স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যে হত্যা করেছিলাম প্রবল নিন্দার কালিমায় লিপ্ত করে। কতটা গুরুতর ছিল তাঁর ভুল? স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে অক্ষম একটি জাতিকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অবশিষ্ট রক্তমূল্যই কী তিনি দিয়েছিলেন সপরিবারে প্রাণ দিয়ে?
ইতিহাস বাংলাদেশকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে যাবে প্রতিটি ১৫ই আগষ্টে।
মন্তব্য
লেখাটা পড়ে মনে হলো আপনি বলতে চাচ্ছেন জাতি হলেই তাকে রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হবে; সেটাই বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্রত্বই তার কাঙ্ক্ষিত, আরাধ্য, যৌক্তিক বা আদর্শ লক্ষ্য, মোক্ষ, গন্তব্য, পরিণতি ইত্যাদি। আর এই লক্ষ্যেই জাতিদের নিরন্তর "চেষ্টা" করে যেতে হবে। আর এই মোক্ষলাভ না হওয়া পর্যন্ত এইসব জনগোষ্ঠী নিতান্তই দুর্ভাগা "রাষ্ট্রসুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে পরাধীন জাতি"!!!
এই কথাগুলি অত্যন্ত জেনারালাইজড বক্তব্য। জেনারালাইজড বক্তব্য হিসেবে আমি এর একটি কথার সাথেও একমত না।
****************************************
সহমত!
-নামহীন
কথাগুলো জেনারেলাইজড এবং নিজস্ব ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। সবাই একমত হবেন সেটা আশা করি না। কিন্তু মনে হলো, একটা বিষয় বুঝতে হয়তো ভুল করেছেন। এখানে সব জাতির স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হয়ে ওঠার কথা বলিনি। বলেছি সেইসব জাতির কথা যারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের মতো সব উপাদান নিহিত আছে, যেসব জাতি অন্যায়ভাবে নিপীড়ন সয়ে টিকে আছে, ভিন্ন জাতি সংস্কৃতির রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে, তাদের কথা বোঝাতে চেয়েছি। যাদের মধ্যে আছে চীনের উইঘুর থেকে আজারবাইজানের আর্তসাখ পর্যন্ত অনেক জাতি রয়েছে যারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য যুগ যুগ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আছে চিলির আদিবাসী মাপুচে যাদেরকে নিজের দেশে পরবাসী করে রেখেছে স্পেনিশ উপনিবেশের উত্তরাধিকারীরা। সেইসব দেশের মুক্তি পাওয়ার অধিকারের সাথে আপনি একমত না হলে কিছু করার নেই। তবে আসল কথাটি ছিল এক বাক্যের। আমাদের একজন শেখ মুজিব ছিল বলেই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পেরেছি, অনেকের তা নেই।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এইবারে আপনার বক্তব্য তুলনামূলকভাবে অনেকখানি স্পষ্ট হলো এবং আমিও ঐ স্পষ্ট অংশের সাথে একমত!
মূল লেখায় আমার মতে বেশ খানিকটা পরস্পর-বিরোধিতা আর অস্পষ্টতা ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি একাধিক পরস্পর-বিরোধী ইস্যু conflate করে ফেলেছিলেন। তাছাড়া আলোচ্য প্রসঙ্গে "জাতি"-র সংজ্ঞা বা "জাতি" বলতে কি বোঝায় বা আপনি কি বুঝেন তা নিয়েও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। ফলে ঐ অস্পষ্টতাকে ভিত্তি করে বলা অন্যান্য কথাগুলির মধ্যেও পরস্পর-বিরোধিতা বা ভ্রান্তির অবকাশ সুপ্ত রয়ে গেছে বলে আমার অন্তত মনে হচ্ছে। তবে আমিও অবশ্য ভুলের উর্ধ্বে নই!
আমার যেখানে অস্পষ্টতা/পরস্পর-বিরোধিতা বা কনফ্লেশন মনে হয়েছে তার দুয়েকটা বলছি। এগুলি নিশ্চিতভাবেই আপনার জানা, তবু আমার দ্বিধা কোথায় তা পরিষ্কার করার স্বার্থেই সবার জানা কথাই আবার বিস্তারিত পুনরুল্লেখ করছি। এতে আমার কোথাও ভুল থাকলে সেটাও পরিষ্কার হবে। আর হ্যাঁ, সংক্ষেপে নিজের বক্তব্য বুঝিয়ে বলার ক্ষেত্রে আমার বিশাল অক্ষমতা রয়েছে। এজন্যে শুরুতেই ক্ষমাপ্রার্থী!
আপনি বলেছেন,
- আপনি কি বলতে চাইছেন তার মূল নির্যাসটা আমি বুঝতে পারছি এবং নির্যাসটার সাথে আমি সহমতও, কিন্তু তারপরও এই বক্তব্যে ঝামেলা আছে। সংক্ষেপে বললে, আমি যট্টুকু বুঝি - রাষ্ট্রোপযোগী জাতি হিসেবে আমাদের বয়স মোটেই হাজার বছর নয়। হাজার কেন পাঁচশ বছর আগেও সেটা ছিল না বলেই জানি। রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে "জাতি" নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই জাতির এই বিশেষ রূপটাকেই রেফার করতে হয়, অন্য কিছুকে না। জাতি-রাষ্ট্র ও সেই প্রসঙ্গের জাতি (ইংরেজিতে একে আমরা "নেশন" ও নেশন-স্টেট বলি বোধহয়?) -- দুটিই সম্পূর্ণ নতুন উদ্ভাবন, এবং আধুনিক যুগের আগে এদের কোন অস্তিত্ত্ব ছিল না, বা সেটা থাকা সম্ভবও ছিল না।
"জাতি" বলতে বাংলায় অনেক কিছুই বোঝায় – আমরা ‘নেশনও’ বুঝি, আবার এথনিক/নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, ভাষিক গোষ্ঠী, থেকে শুরু করে ধর্ম, বর্ণ – ত্বকবর্ণ ও হিন্দু ধর্মীয় বর্ণপ্রথার বর্ণ, শ্রেণী, বংশ, পেশা, লিঙ্গ, প্রাণীর প্রজাতি হয়ে এমনকি ফুলফল বা প্রায় যে কোন সমলক্ষণযুক্ত শ্রেণীবিন্যাসকেই বুঝি। এর ফলে বাংলায় এই আলোচনা অনেক সময় একটি অর্থে শুরু হয়ে অনেক সময় নিজেদের অগোচরেই কাছাকাছি অন্য অর্থে পিছলে বা সুইচ করে অর্থের তালগোল পাকিয়ে ফেলে এবং তখন একটা থেকে আরেকটা কেন, কখন ও কতটুকু পৃথক সেই জট ছোটানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে – এমনকি হয়তো সেটা নজরেই আসে না। আলোচনা তখন দিশা হারিয়ে ফেলে। হাজার বছর আগে এই দেশে রাষ্ট্রোপোযোগী-জাতি দূরে থাকুক, সেভাবে কোনো সাংস্কৃতিক জাতিও ছিল কিনা সন্দেহ আছে। যা ছিল তা হলো - কিছু সমলক্ষণযুক্ত (আবার অনেক পার্থক্যযুক্তও বটে) বিভিন্ন ধরণের বহু গোত্র-গোষ্ঠী-বর্ণ-সম্প্রদায়-অঞ্চল ও ভাষিক ভেরিয়েশনে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন কৃষিভিত্তিক সমাজ। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো সামগ্রিকভাবে ঐক্যসাধনকারী ও “জাতি”-গঠনকারী বা "জাতি"-গঠনের জন্য অপরিহার্য নৈর্ব্যক্তিক ও কনটেক্সটমুক্ত যোগাযোগ, উচ্চ মাত্রার সাংস্কৃতিক প্রমিতকরণ, শাসন-সত্তার সাথে সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্য এবং সর্বোপরি "সমষ্টি" হিসেবে আত্নপরিচয়বোধ ও আত্মভাবমূর্তি, নিজের অব্যবহিত গোত্র-বর্ণ-এলাকা বা বাস্তবতার বাইরে কোনো বৃহত্তর/ওভারআর্চিং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা ভাষিক এমনকি এথনিকালি এক্সক্লুসিভ ঐক্য, সংহতি ও কমিউনিটিবোধের মানসচিত্র সর্বজনীন, ব্যাপক এমনকি সীমিতভাবেও প্রচলিত ছিল না বলেই মনে হয়। যা ছিল তা নিতান্তই সামন্ততান্ত্রিক, এগ্রো-লিটারেট, বিক্ষিপ্ত, অস্পষ্ট, দূর্বল, স্থানীয় শ্রেণীর। এইরকম সমাজের পক্ষে রাষ্ট্রগঠনের কোন ধরণের আকাঙ্ক্ষা বা ঐধরণের রাজনৈতিক মানসপ্রতিমা ধারণ বা কল্পনা করাই বোধহয় সম্ভব ছিল না।
মোদ্দা কথা হলো, হাজার বছর আগে আসলে রাষ্ট্রোপোযোগী অর্থে বা আধুনিক অর্থেও আমাদের কোনো "জাতি" ছিল না - "জাতিরাষ্ট্র"-তো দুরস্থান! কিন্তু আমরা আবেগ, আতিশয্য এবং [url=https://en.wikipedia.org/wiki/Presentism_(literary_and_historical_analysis)]প্রেজেন্টিজমের[/url] বশবর্তী হয়ে অনেক সময় যেটা করে ফেলি তা হলো ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় সামাজিক/রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক/সাংস্কৃতিক বিবর্তনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বা/এবং পুঞ্জীভূত আকাঙ্ক্ষা থেকে অর্জিত আমাদের বর্তমান আবেগ-অনুভূতি-উপলব্ধি-জ্ঞান-মূল্যবোধকে বা তজ্জনিত বায়াসগুলিকে সুদুর অতীতের উপর প্রোজেক্ট করে ্সেটাকে নিজেদের মনোমত পুনর্নির্মান বা পুনকল্পনা করার চেষ্টা করি (অনেকে একে মীথও বলতে পারে)। যে অতীতে হয়তো আসলে ওগুলি ছিল না বা আমাদের বর্তমানের আবেগ-অনুভূতি-দৃষ্টিভঙ্গী-জ্ঞান-মূল্যবোধ বা বায়াসের সাথে কম্প্যাটিবল ছিল না বা তা ধারণের উপোযোগী ক্ষেত্র ছিল না। এবং ছিল না বলে সেটা যে কোনোভাবে খারাপ বা অনাকাংখিত ছিল সে কথাও নেসেসারিলি বলা যায় না - কিন্তু ভুল [url=https://en.wikipedia.org/wiki/Presentism_(literary_and_historical_analysis)]প্রেজেন্টিজমের[/url] বশবর্তী হওয়াতে আমাদের কথায় অনেক সময় সেটাও ইমপ্লাইড হয়।
আপনার উধ্বৃত বক্তব্যে মনে হয় হাজার বছর আগেও আমাদের একটা রাষ্ট্রোপোযোগী "জাতি" ছিল, সব ছিল, ছিল না শুধু একটা রাষ্ট্র। না থাকার কারন তখন শেখ মুজিবর রহমানের মতো রাষ্ট্র গড়ার মত কোনো স্বপ্নবাজ নেতা বা স্থপতি ছিলেন না। মুজিব বা সেরকম কেউ থাকলেই - সেটিও হয়ে যেত! আমি এইরকম বক্তব্যের সাথেই - আবেগটা বুঝলেও - সম্পূর্ণ দ্বিমত করি। মুজিব কেন, যতবড় মহামানবই আসুন না কেন - তিনি কিছুই (জাতি বা রাষ্ট্র) করতে পারতেন না তখন। ঐ সমাজ সেজন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এবং ঐ সময়ের কোনো নেতা এখনকার চেতনাসম্পন্নও হতেন না। এবং তাই বলে সেটা খারাপও ছিল না। হাজার বছর ধরে ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান-পতন-বিবর্তনের পথ পেরিয়ে ধীরে ধীরে আমরা আজকের অবস্থায় - জাতিচেতনা এবং রাষ্ট্রচেতনায় পৌঁছেছি। এবং এই যে যেখানে পৌঁছেছি - তাতে যেমন শেখ মুজিবের অবদান আছে, তেমনি শেখ মুজিবের সৃষ্টি হওয়ার পিছনেও এই পৌঁছানোটার অনিবার্য ভূমিকা ও অবদান আছে। শেখ মুজিব শুন্য থেকে সৃষ্টি হননি, উনি এই বিবর্তনেরই একটা ফসল, একটা প্রোডাক্ট, যে বিবর্তনের পিছনে আরও অসংখ্য মানুষের ভূমিকা আছে। মুজিব হাজার বছর কেন, আরও একশ বছর আগে আসলেও যা হয়েছেন তা হয়তো হতে বা করতে পারতেন না ভিন্ন বাস্তবতার কারনে। মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু ইতিহাস মানুষকে তার থেকে অনেক বেশি করে সৃষ্টি করে। তাই আমার কঙ্কলুশন হচ্ছে, শেখ মুজিব যে দেশে এবং সময়ে নেতৃত্বে এসেছেন, তিনি সেই দেশ এবং ঠিক সেই সময়ের জন্যই উপযুক্ত/শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন - অন্য দেশ বা অন্য সময়ের জন্য না। এই ধরণের তুলনা করাটা আমার মতে ভুল। আমাদের দেশেই অন্য সময়ের জন্য কেন "শেখ মুজিব" উপযুক্ত হতেন না তা বলেছি, অন্য দেশের জন্যও হয়তো "ওনার মতো" কেউ উপযুক্ত হবেন না - কারন তাদের বাস্তবতা হয়তো ভিন্ন যেখানে ঠিক "শেখ মুজিব"-এর মতো কোনো নেতা প্রযোজ্য বা প্রয়োজনীয় নন, প্রয়োজন অন্য কেউ বা কিছু। আমাদের একজন শেখ মুজিব ছিল বলেই আমরা এই মুহূর্তে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পেরেছি এটা সত্যি কথা, কিন্তু "অনেকের তা নেই" বলে তারা হতে পারছে না বলাটা বা ইমপ্লাই করাটা কিন্তু সিরিয়াস আতিশয্যজনিত অতিশয়োক্তি বা এক কথায় -- 'ভুল'!
যাগ্গে, এতসব বলার মানে এই না যে আমি বঙ্গবন্ধুকে ছোট করতে চাচ্ছি। আমি শুধু আতিশয্যজনিত অতিরঞ্জন-মুক্ত হয়ে মানুষ হিসেবেই তাকে দেখতে ভালোবাসি, দেবতা হিসেবে নয়। আর ইতিহাস পাঠ ও বোঝার ক্ষেত্রেও "প্রেজেন্টিজম"-এর ফ্যালাসি এড়িয়ে চলতে চাই। এই শেষেরটার কারনে ইদানিং তাই ইতিহাস বা রাজনীতি-সংক্রান্ত কোনো লেখা বা আলোচনায় "স্বর্ণযুগ", "প্রাচীণ গৌরব.." বা "হাজার বছর ধরে..." টাইপের কোনো কিছু দেখলে বা শুনলেই আগে থেকেই একটু তটস্থ হয়ে যাই!!!
একটা শেষ খটকা। আপনার লেখা এবং আমাদের কমেন্টালোচনায় তিনটা মৌলিক উপাদান ছিল - জাতি, রাষ্ট্র আর "আমরা"। প্রথম দু'টা উপাদান নিয়ে অনেক আলোচনা হল। কিন্তু ৩য়টাকে বাদ দিলে সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু এর উত্তর আমার কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তো আপনার বর্তমান লেখা ও কমেন্টে এই "আমরা"-টা আসলে কে বা কাহারা? হাজার বছর আগে এই "আমরা"-টা ঠিক কে বা কাহারা ছিল, এবং হাজার বছর পরে এই বর্তমানেই বা এই "আমরা"-টা ঠিক কে বা কাহারা?? একটু পরিষ্কার করবেন?
****************************************
ইউআরএলে যদি "(" বা ")" থাকে, তাহলে লিঙ্ক দিতে গেলে ভচকে যাবে। বামঢাল বা "(" এর জায়গায় %28 আর ডানঢাল বা ")" এর জায়গায় %29 লিখতে হবে।
হায়রে, এই কথাটা আপনি যদি "জবাব" বাটন টিপে না দিয়ে আলাদা মন্তব্যে দিতেন, তাহলে কি যে ভাল হতো!!!
****************************************
Presentism = অধুনাবাদ?
জানি না। আক্ষরিক অনুবাদ করলে তাই দাঁড়ায় বটে এবং এর চেয়ে ভালো কিছু মাথায়ও আসছে না - আবার মন থেকে ঠিক সায়ও পাচ্ছি না। অধুনাবাদ যে Presentism-এর অনুবাদ আগে থেকে মাথায় না রাখলে এটা "আধুনিকতাবাদ" (Modernism)-এর সাথে বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া শব্দটা থেকে এর প্রকৃত অর্থও বোঝা যায় না, যা অবশ্য মূল শব্দটা থেকেও কিছুতেই বোঝা যায় না কেউ বলে না দিলে।
লিখতে লিখতেই একটা শব্দ মাথায় আসলো.... আমার মনে হয় "বর্তমানবাদ" বললে হয়তো সামান্য একটু উন্নতি হতে পারে। অন্তত "আধুনিকতাবাদ"-এর সাথে গুলাবে না।
****************************************
মৃদু শ্লেষ যোগ করে "এখনপনা" বলা যায় কি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলা যেতে পারে! তবে এর মধ্যে আপনি যেমন বলেছেন - একটা শ্লেষাত্নক ভাব বা লঘুচাল আছে। তাই লেখককে সেটা মাথায় রেখেই শব্দটা ব্যবহার করতে হবে। প্রেজেন্টিজমের আলোচনাটা সাধারনত একটু সিরিয়াস বা গুরুগম্ভীর হওয়ার কথা, তাই লেখক সেখানে লঘুচাল আমদানি করবেন কিনা, সেটা ঐ নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে/স্থানে মানানসই হবে কিনা, সেসব লেখকের বিবেচনা। আরেকটা ব্যাপার - এসব শব্দ একবার বহুল ব্যবহৃত হতে থাকলে এসব লঘুত্ব-গুরুত্ব হারিয়ে অনেক সময় স্বাভাবিক শব্দ হয়ে যায়। আমার উপরের কমেন্ট থেকে দুয়েকটা বাক্যে "প্রেজেন্টিজম"-কে "এখনপনা" দিয়ে রিপ্লেস করে দেখি কেমন লাগেঃ
কি মনে হয়?
****************************************
খারাপ লাগছে না তো। আপনি মানুষের এই প্রবণতা নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ লেখা বাংলায় (যতটা সম্ভব) লিখুন না আপনার পছন্দমতো শব্দ দিয়ে? তাহলে অন্তত এক দফা হাতেনাতেখাতেপাতে প্রয়োগ-পরীক্ষা দুটোই হবে।
না, খারাপ লাগছে না মোটেই। লিখতে শুরু করলে এর মধ্যে নতুনত্বের খোঁচাটা এমনিতেই ভোতা হয়ে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
বিষয়টা আগ্রহোদ্দীপক হলেও নিজের মনোমত একটা ভাল লেখা লিখতে হলে অনেক খাটা-খাটনি করা লাগবে। আপাতত সেই শক্তি আর স্বাস্থ্য নেই। এমনিতেই সচলায়তনের জন্য অনেকগুলি প্রোজেক্ট পেন্ডিং পড়ে আছে - দা গোল্ডেন এ্যাসের অনুবাদ, ৭১ ও তার অব্যবহিত পরের সময়ে নিজের বাংলাদেশ-পাকিস্তানের স্মৃতি/অভিজ্ঞতা ও পাকিস্তান থেকে কোয়েটা থেকে কান্দাহার হয়ে আফগান বর্ডার দিয়ে পলায়নের স্মৃতিচারণ, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা অন্যান্য এখনো জীবিত বাঙালিদের স্মৃতিচারণের অডিও সংকলণ, সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় প্রবাদ-প্রবচণ-লোকজ ছড়া-বাগধারা এবং বিভিন্ন লোক-সাংস্কৃতিক রিচুয়ালের সংকলণ/অভিধান, ইত্যাদি। সবই ইচ্ছার খাতায় লেখা আছে, বাস্তবে হয়ে উঠছে না। দেখা যাক অবস্থার একটু উন্নতি হলে ২০২০ সালে কিছু করা যায় কিনা!
****************************************
তবে সামগ্রিক প্রপঞ্চটার উদাহরণ সহ আলোচনার বদলে "মানুষের এই প্রবণতা"-টা নিয়েই যদি শুধু প্রশ্ন করেন, তাহলে হয়তো খুব সংক্ষেপে মাত্র দুয়েক লাইনেই আমার মতামত/কঙ্কলুশন যাই বলেন দেয়া যেতে পারে।
এই মুহূর্তে এখনপনা বা এখনপনাগত ভ্রান্তি বা পক্ষপাত (ফ্যালাসি বা বায়াস) চর্চার প্রবণতার দুটি রূপ বা তার পিছনে দু'টি কারন অন্তত দেখতে পাচ্ছি --
১। এটা প্রায়ই বর্তমানের কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস/মতাদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, আকাঙ্খার ন্যায্যতা/যাথার্থ্য প্রতিপাদন, মাহাত্ন্য-কীর্তন বা প্রসারবৃদ্ধি করার জন্য একটা ছদ্মবেশী রাজনৈতিক কৌশল (পলিটিকাল টুল) হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কৌশলটা রাজনৈতিক বা অন্য যে কোনো উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন, এর প্রয়োগ রাজনীতি থেকে শুরু করে ইতিহাস বা সাহিত্য-চর্চার ক্ষেত্রেও বিস্তৃত। এই উপমহাদেশের রাজনীতি, ইতিহাসচর্চা আর সাহিত্য এইরকম চর্চায় প্রায় আপাদমস্তক ডুবে আছে। বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে বঙ্কিম থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত এর চর্চা পুরোদমে অব্যাহত আছে। অবশ্য পৃথিবীর সর্বত্রই এটা কমবেশি আছে বলে মনে হয়। উদাহরণ দিলাম না।
২। বর্তমানের মূল্যবোধকে মানদণ্ড ধরে ঐতিহাসিক অতীতের বিভিন্ন বিশ্বাস, ঘটনা বা চর্চাকে বিচার করে তার ভালোমন্দ সম্পর্কে রায় দেয়া, ঐ সময়ের মানুষদের এজন্য প্রশংসা বা নিন্দেমন্দ করা - যে সময়ে বর্তমানের এইসব মূল্যবোধ বা তার যৌক্তিকতা প্রচলিত বা জ্ঞাত ছিল না। এসব করতে গিয়ে তাদের অন্য ভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলিকে উপেক্ষা করা। এগুলি অনেক সময় বুঝে অনেক সময় না বুঝেই করা হয়। তবে এই ক্ষেত্রে এখনপনার প্রয়োগ সবসময়ই অনুচিত এমন নির্বিচার বা ব্যতিক্রমহীণ মতামত নিয়েও আবার কিছু বিতর্ক আছে। এখনপনার এই প্রয়োগটাও কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের হাতিয়ার, কখনো উদ্দেশ্যমূলক "অপরায়ন" প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, আবার কখনো স্রেফ মানুষের স্বভাবগত/ইন্সটিংটিভ "অপরিচিত বা অজানার প্রতি ভীতি" জাতীয় প্রবণতাজাত প্রতিক্রিয়া হিসেবে আসে বলে মনে হয় আমার।
****************************************
প্রেজেন্টিজম বা এখনপনার চর্চাটা যে খারাপ বা ভুল, এই কথাটার ব্ল্যাঙ্কেট প্রয়োগেও কিন্তু আবার কারো কারো আপত্তি আছে। যেমন ধরুন, এখনপনা ভুল মানলে ১৭-১৯ শতকে মার্কিন স্লেভারির ইতিহাসে স্লেভারি সম্পর্কেও কোনো ভ্যালু জাজমেন্ট দেয়া যাবে না, কারন ঐ সময়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত এর খারাপত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল না। এখন তা প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু এখনপনার চর্চাটা ভুল মানলে এখনকার লেন্স দিয়ে তাদের বিচার করলে ভুল হবে। সুতরাং এই সময়ে বসে অতীতের স্লেভারি বা এরকম বিশ্বজুড়ে আরও বিভিন্ন প্রসঙ্গে শুধুমাত্র নিরপেক্ষ, নিরাসক্ত, অব্জেক্টিভ বর্ণনা দেয়া ছাড়া ইতিহাসবিদের আর কোনো কাজ নেই, ঐসব ঘটনার উপর তার নিজের সময়ের কোনো মূল্য বা চেতনা আরোপ করা তার দায়িত্ব নয়। তো এটা অনেকে মেনে নিতে পারেন না। এদের একাধিক যুক্তি আছে, তার মধ্যে একটা হলো - কিছু ইটার্নাল মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ আছে যা থেকে কোনো যুগের মানুষই মুক্ত নয়, এবং তার প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক বিচারের উর্ধ্বে নয় - বিশেষ করে খুব বড়-বড় ঘটনার ক্ষেত্রে। এই আলোচনাটা বেশ বিতর্কিত মনে হয় - বিস্তারিত জানি না। তবে কিছুক্ষণ আগে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের এক বংশধরের একটি বক্তব্য ইউটিউবে দেখে কথাগুলি মাথায় আসল। বাংলাদেশ থেকে দুয়েকজন ইউটিউবার মুর্শিদাবাদে তার বাড়িতে অতর্কিতে হাজির হয়ে তাকে নিয়ে সেনসেশনাল/ভাইরাল ভিডিও বানিয়ে মজা-টজা করতে চেয়েছিল মনে হয়। ঐ ভিডিওটা ভাইরাল হওয়ার পর উনিও ইউটিউবে একটা সাক্ষাৎকার দেন প্রতিবাদ করে। এখানে তার বক্তব্যের মধ্যে বেশ ইন্টারেস্টিংলি একটা জায়গায় মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা প্রসঙ্গে এই এ্যান্টি-প্রেজেন্টিস্ট বা এখনপনা-বিরোধী একটা আর্গুমেন্ট এসেছে। আমি ঐ ভিডিওর ঠিক ঐ আর্গুমেন্টের জায়গাটাতে লিঙ্ক দিচ্ছি (তবে চাইলে পুরো ভিডিওটাই দেখতে পারেন): https://youtu.be/nUVWfvER9R4?t=838 ।
এই ভিডিওতে এই ভদ্রলোক যে যুক্তি দিচ্ছেন, সে বিষয়ে আপনার / পাঠকের কি মতামত তা জানতে খুব কৌতুহল বোধ করছি!
****************************************
যদিও একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু এখনপনার সাথে ক্ষীণ সমান্তরালে আরেকটা প্রবণতার কথা হুট করে মাথায় এলো; আর কোথাও জায়গা না পেয়ে এখানে বলছি, সে জন্যে লেখক ও অন্যান্য আলোচকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগাম। আমরা যেমন অতীতকে বর্তমানের নিক্তিতে মাপাকে এখনপনা বলছি, একইভাবে অন্যের সাধ্যকে নিজের পারঙ্গমতার নিক্তিতে মাপার প্রবণতাটির জন্যে কোনো বিশেষায়িত শব্দ কি বাংলা বা অপর কোনো ভাষায় আছে? আমি জানি না বলে এই "শূন্যতা" পূরণ করছি "অহমপনা" শব্দটি দিয়ে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, দবির কোনো একটা কিছু পারে না। ধরা যাক সে গান গাইতে পারে না। এখন সে কিছুতেই মানবে না যে কবির গাইতে পারে, কারণ সে কবিরকে চেনে বা ছোটকালে চিনতো বা দুনিয়ার বাকি সব মাপকাঠিতে কবির তার সমকক্ষ, অতএব দবির গান গাওয়ায় তার নিজের অকুশলতা কবিরের ওপর না চাপিয়ে তিষ্ঠাতে পারে না। এর বিপরীত চিত্রও আছে, ধরা যাক দবির একবারে একশটা বৈঠক দিতে পারে, কবির পারে তিনটা। এখন দবির কিছুতেই মানবে না যে কবির বাকি সাতানব্বইটা দিতে অপারগ, সে গোঁ ধরবে, আমি পারি তুই পারস না ক্যান? এই যে নিজের সাধ্যের সীমাকে অন্যের ওপর চাপানো, বা যদি বলি অন্যকে নিজের সমসীম ধরে নেওয়া, একে কি অহমপনা বলা যায়?
অতি চমৎকার এবং মূল্যবান একটি সংযোজন। কিন্তু এমন সাধারণ আবেগময় পোস্টের সরলীকৃত বক্তব্যের বিপরীতে এত গভীর বিশ্লেষণ পান্তাভাতের বিপরীতে কাচ্চি বিরিয়ানী হয়ে গেছে। এই পোস্ট এমন মন্তব্যের উপযুক্ত স্থান নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গভীরতর কোন আলোচনার জন্যই ওটা রাখা যেতে পারে। তবু দুটো কথা বলছি।
আপনি একটি জাতির রাষ্ট্র হয়ে ওঠার বিষয়ে যেসব তত্ত্ব বিশ্লেষণ দিয়েছেন তা খুব চমৎকার এবং অনেক দেশের ক্ষেত্রেই সেটা প্রযোজ্য। কিন্তু আমার মতে বাংলাদেশের স্বাধীন হয়ে ওঠার পেছনে নানান ধরণের সমীকরণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল একজন ব্যক্তির তত্ত্বহীন রাজনৈতিক অবস্থান। বছরের পর বছর তাঁর আপোষহীন গোয়ার্তুমিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পথে এগিয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য জাতিকে মানসিকভাবে তৈরী করে দিয়েছিল তাঁর মাঠের রাজনীতি। পঁচিশে মার্চের পর যে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা-কৃষক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার মূল কারণ ছিল দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য অদম্য একটা আবেগ। কোটি কোটি মানুষের ভেতর সেই আবেগের বীজ পুঁতে দিয়েছিল ওই তত্ত্বহীন মানুষটা। সে কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল অল্প সময়ে অনেক বেশী রক্তক্ষয় করে। নয় মাসে বাংলাদেশে যা ঘটেছিল তা কোন যুক্তি তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই এখন যদি কেউ এসে বলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফলটি সময়ের প্রয়োজনে বিবর্তিত হতে হতে ১৯৭১ সালে পেকে উঠেছিল এবং শেখ মুজিব ঠিক ওই সময়ে ওই গাছের নীচে ছিলেন বলে তিনি তা পেড়ে ফেলতে পেরেছেন- আমি তাতে একমত হতে পারি না।
আপনার শেষ প্রশ্নটির কারণ বুঝলাম না। আপনি ভালো করেই জানেন 'আমরা' কারা? শেখ মুজিব যে দেশটির স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই দেশটির আলোচনাই চলছে এখানে। পৃথিবীতে বাংলাভাষীদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রও একখানাই। এখন হাজার বছর আগে আমরা কে কে এখানে ছিলাম কে কে ছিলাম না, সেটা নিয়ে যদি তর্ক উঠে, সেই তর্কের জন্য এই পোস্ট উপযুক্ত মনে হচ্ছে না। এই পোস্ট ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক আবেগ নিয়ে লেখা। জাতিতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে অন্য কোনদিন বসা যাবে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ফর দা রেকর্ড, আমি এই কথা বলি নাই। এটা আমার বক্তব্যের একটা গুরুতর বিকৃত কমিকাল অপব্যাখ্যা! আমার আন্তরিক মতামতের এমন জবাবের কারনটা অবশ্য বুঝতে পারছি না - অসহিষ্ণুতা, বোঝার অক্ষমতা নাকি অমনোযোগিতা, জানি না!
****************************************
আমার কিন্তু মনে হয় হাজার বছর আগেই বাঙ্গালী জাতির গঠন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল, তবে জাতি বিষয়ে এখনকার ধ্যান ধারনা তখন তাদের মধ্যে ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। বাংলা ভূখণ্ডের মানুষকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার বহু উল্লেখ আমরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপকরণে পাই, কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের বাঙ্গালী বলেই অভিহিত করা হয়েছে। এটাই বাঙ্গালী জাতিয়তা।
মাঝি-দাদা, বরাবরের মতই অত্যন্ত পছন্দের মন্তব্য
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
শেখ মুজিবর রহমান কি সময় তৈরি করেছেন
না কি সময়ই বঙ্গবন্ধৃুকে গড়ে তুলেছে
তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের সামগ্রিকতাকে লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারবো।
বাংলাদেশের একটি স্বাধীন রাষ্ট হয়ে ওঠাটা অনিবার্য ছিল
তা রাজনীতির সাথে ভূগোল বিদ্যাকে মিলিয়ে দেখলেই
একটা বিজ্ঞানের জ্ঞানের মতো হয়ে উঠে আসে।
জানুয়ারি ১৯৬৭, NATIONAL GEOGRAPHIC- এই সংখ্যার কাভার স্টোরিতে
একটা দোলনায় পাকিস্তানের দুই বালিকাকে দুলতে দেখা যাচ্ছে।
আর প্রধান যে নিবন্ধ তার শিরোনাম
PAKISTAN : Problems of Two-part Land
এই নিবন্ধে এই পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোটাই একটি অবাস্তব বাস্তবতা
যা আসলে টিকে থাকতে পারে না
এমন ইঙ্গিতকে তুলে ধরে।
লেখাটি উপভোগ করলাম। পুরোটাই। আমার যে বিষয়ে আলাদা মত ছিল, সেটুকুই শুধু বলার চেষ্টা করলাম। মন মাঝির সঙ্গে আপনার মন্তব্য বিনিময়ও খুব আকর্ষনীয় ছিল
সময় বঙ্গবন্ধুকে তৈরী করেছে নাকি বঙ্গবন্ধু সময়কে তৈরী করেছে এটা নিয়ে অনেকে বিতর্ক করে। কিন্তু ষাটের দশক জুড়ে বাংলাদেশ নেতাশূন্য ছিল না। শেখ মুজিবের চেয়ে বেশী বোদ্ধা রাজনৈতিক নেতাও ছিল গণ্ডায় গণ্ডায়। ছিল ভাসানীর মতো জনপ্রিয় নেতাও। কিন্তু গণমানুষ সংগঠিত হয়েছিল শেখ মুজিবের পেছনে। কারণ তিনি বাকিদের চেয়ে কোথাও আলাদা ছিলেন, অনন্য ছিল তাঁর কোন কোন বৈশিষ্ট্য। এখানে সময়ের উপরে ব্যক্তির প্রাধান্য চলে আসে। তিনি যদি প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে বিপ্লবী পথে অগ্রসর হতেন, তাঁকে জেলখানাতে গুলি করে হত্যা করা হতো। তিনি তা না করে লাইনে থেকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেটা সময়ই প্রমাণ করেছে। ভারত রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে যে ভূমিকা রেখেছে, সেখানেও ছিল ব্যক্তির ভূমিকা। শেখের জায়গায় যদু মধু কেউ থাকলে ওটা বোধহয় হতো না।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার মনে হয়, "সময় মানুষকে তৈরি করে", "ভাষা বহতা নদী", "আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন", এগুলো সমপর্যায়ের কথা, যেটা এক বাঙালি অলস আরেক বাঙালি অলসকে শুনিয়ে নিজেদের আইলসামিকে হালাল করে এবং নিজের পরিচিত কর্মিষ্ঠরা যে তাদের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন কিছু না, সে সান্ত্বনা নিজেদের দেয়। এটা অনেকটা আলোকচিত্রীকে তার ক্যামেরা আর কোরকের সংস্করণ কী, সে প্রশ্ন শুধিয়ে "ছবিটা তো ভালোই উঠেছে" বলার মতো, যেন ঐ ছবির পেছনে আলোকচিত্রীর নিজের বুদ্ধি-প্রস্তুতি-শ্রম-অধ্যবসায় কিছুই নাই, সেটা যন্ত্রের জোরে "উঠে গেছে"।
সুন্দর হইছে !
পূর্ণ সহমত।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ইচ্ছে থাকার পরও শতকের পর শতক ধরে মানুষ পরাধীন হয়ে আছে আর এইদিকে একটা মানুষ চরম অনিচ্ছুক একটি জাতিকে দেশ দিয়েছে, স্বাধীনতা দিয়েছে এবং সেইসব মানুষই তাঁকে খুন করেছে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এবং খুন করার দিনটাকে জাতির একাংশ ভুল জন্মদিন পালন করে আরো মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
হ।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
"মাতৃভাষা লাঞ্ছিত না হলে বাঙালী হয়তো কোনদিন ভাবতো না যে আমাদেরও নিজস্ব একটি ভূখণ্ড প্রয়োজন যেখানে আমরা নিজেদের ভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবো।" অন্তত এইটে বলাই যেতে পারে যে "মাতৃভাষা লাঞ্ছিত" হওয়াটা জোরাল অনুঘটকের কাজ করেছে। সামগ্রিক ভাবেই তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিম ভূখণ্ড নিজেদেরকে পূর্ব ভূখন্ডর তুলনায় উন্নত মনে করত। বস্তুতঃ এই উপমহাদেশে গোটা মহাদেশ জুড়ে ঐতিহাসিকভাবে এইটে একটা জনপ্রিয় জীবনচর্চা। বাংলা হচ্ছে পাণ্ডববর্জিত দেশ। যাই হোক, কিভাবে কি হয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার সওয়াল-জবাব পাওয়া গেল আব্দুল্লাহ এ.এম.-এর মন্তব্যে। আর সেইটা আপনার লেখার সাথে একাত্মতা জারী রেখেই পরিপূরকও হয়ে উঠেছে। এই লেখা আর তার সাথে মন্তব্যগুলি মিলে আবারও একটি চমৎকার দলিল হয়ে রইল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
বাংলায় 'গোনা' ক্রিয়াপদের সমাপিকা আর অসমাপিকা রূপ কাল ও পুরুষভেদে ভিন্ন। আপনার এই লেখার শিরোনামে 'গুনে' অসমাপিকা ক্রিয়ারূপ। সঠিক প্রয়োগ হবে 'গোনে'।
হয়তো খুব সামান্য ব্যাপার। কিন্তু দেখা যাবে আরেকজন এখানে "গুনে" এভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে দেখে ভুল শিখবে বা সংশয়ে পড়ে যাবে। এই ব্লগে আপনারা চিন্তা করে অনেক কিছু লেখেন, বানানে ত্রুটি থাকলে সে লেখার ওজন নষ্ট হয়।
আমি নিজেও খানিক সংশয়ে ছিলাম এটা নিয়ে। সংশোধনের পরামর্শের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ঠিক করে দিচ্ছি।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধরা যাক ষাটের দশকই হচ্ছে সেই মোক্ষম সময়, যখন বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটার মত সর্বলক্ষন পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল এবং যখন পূর্ব বাংলার মানুষেরা একটি জাতি রাষ্ট্র সৃষ্টি করার জন্য সম্পূর্ন উপযোগী অবস্থায় উপনীত হয়েছিল। সে পরিস্থিতিতে একজন শেখ মুজিবের যদি অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলেও কি বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটতো? উত্তরটা হল- না। না, কারন বাংলাদেশের বাংলাদেশ হয়ে ওঠার প্রথম উপাদান ছিল ছয় দফা। মুজিব অনেককেই অনুরোধ করেছিলেন ছয় দফা উপস্থাপনের জন্য, কেউ রাজি হন নাই। স্বয়ং আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারাই ছয় দফা প্রত্যাখ্যান করে ছালাম খানের নেতৃত্বে ভিন্ন আওয়ামী লীগের জন্ম দিয়েছিল। সুতরাং ধরে নেয়া যায় মুজিব না থাকলে ছয় দফার জন্মই হত না, এবং বাংলাদেশেরও।
আবার ৬৬তে ছয় দফা উপস্থাপনের পর রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মাথায় নিয়ে মুজিব যখন ফাঁসির দণ্ডাদেশের অপেক্ষায়, তখন তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছাত্র সংগঠন হয়েও ছাত্রলীগ যদি একটা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুজিবকে মুক্ত করে না আনতে পারতো, মুজিবের অনুপস্থিতিতেও যদি সবাই একাট্টা হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়তো, ইন্দিরা গান্ধী যদি চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্বেও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদান না করতো, সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি দৃঢ়ভাবে ভারত এবং বাংলাদেশের পক্ষে না দাঁড়াত, তাহলেও কি বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটতো? উত্তরটা হল- না।
দুটো পয়েন্টই একশতভাগ খাঁটি। দুটো পয়েন্টেই সবগুলো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু ব্যক্তি শেখ মুজিবের বিচক্ষণতা এবং সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহন ক্ষমতা। তাঁর ৬ দফাকে ঘিরেই ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে গেছে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
মন্তব্যে
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমার একটা কৌতুহল। এই প্রশ্নটাকেই যদি একটু উলটো করে করা হয়, তাহলে উত্তরটা কি হবে?! ধরুন যদি এভাবে প্রশ্ন করা হয় --
পরের অংশটা পড়ার আগে একটু ভেবে দেখুন!
আপনার উত্তর কি হবে আমি জানি না, তবে দুটো প্রশ্নেই আমার উত্তর হচ্ছে -- না এবং না! আমার মতামত হচ্ছে ইতিহাস ও ইতিহাসের একটি সুনির্দিষ্ট স্থান-কালের পাত্র-পাত্রী পরস্পর-পরস্পরের সাথে এবং তাদের বর্তমানের সাথে ত্রিমুখীভাবে ইন্টারএ্যাক্ট করে (সচেতন ও অচেতন - দুই স্তরেই) এবং এই ইন্টারএ্যাকশন বা মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল হিসাবে নতুন ঘটনার জন্ম হয়, ইতিহাস/সমাজ সামনে এগোয় ঐ বিশেষ স্থান-কালভিত্তিক ইন্টারএ্যাকশনের ফলে তার নিজস্ব চরিত্র নিয়ে, সে নতুন গতিমুখ পায় কিম্বা পায় না। এখানে ইতিহাসকে বাদ দেয়ার আসলে কোনোই উপায় নাই। পৃথিবীর কোনো ব্যক্তি, মানুষ, দেশ বা সমাজই শুন্যের গর্ভে জন্মায় না। এটা একদম বেসিক কমনসেন্সের কথা। সবাইই ইতিহাস বা সময়ের পরিক্রমায় একটি অন্তর্বর্তীকালীণ পর্যায়, সবারই অতীত আছে, বর্তমান আছে এবং আশা করা যায় একটা ভবিষ্যতও থাকবে। এখানে অতীত বা ইতিহাসের ভূমিকার অপরিহার্যতার কথা বলা মানে বর্তমানের বা ঐ বর্তমানের (১) পাত্র-পাত্রীদের বা (২) কোনো সুনির্দিষ্ট পাত্র বা পাত্রীর ভূমিকা বা (৩) তার স্থান বা সময়ের ভবিষ্যতের রূপায়নে তার ব্যক্তিগত ভূমিকার বা তার বুদ্ধি-প্রস্তুতি-শ্রম-অধ্যবসায়-ত্যাগ-তিতিক্ষার গুরুত্ব বা অপরিহার্যতার কথা অস্বীকার করা নয় বিন্দুমাত্র। যারা কোনো মত, পথ, ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী বা দেশের ঐতিহাসিক হিরোইজম, মূল্য, ভূমিকা, অবদান বা গুরুত্বের পূজারী, তারা অনেক সময়ই এই জায়গায় এসে না বুঝেই ভীষণ ডিফেন্সিভ হয়ে যান, অনেক সময় এগ্রেসিভও হয়ে যান। তারা হয়তো মনে করে বসেন ইতিহাসকে গুরুত্ব বা স্বীকৃতি দিতে গিয়ে তাদের প্রিয় ব্যক্তি, দল, দেশ ইত্যাদি্র গুরুত্বকে অস্বীকার বা খাটো করা হচ্ছে। তারা ভুল করে ইতিহাসের ভূমিকার স্বীকৃতিকে ইতিহাসের একটা সুনির্দিষ্ট পর্বের পাত্র-পাত্রী বা নায়কদের ভূমিকার গুরুত্বকে অস্বীকৃতির সাথে ইকুয়েট করে ফেলেন। এটা বিরাট ভুল একটা পার্সেপশন। ইতিহাস যেমন মানুষকে প্রভাবিত করে তেমনি এর কুশীলবরাও এই ইতিহাসকে প্রভাবিত, নির্মান ও পুনর্নির্মান করেন। কেউ-কেউ প্রচণ্ডভাবেই করেন। কেউ-কেউ হয়তো এতটাই করেন যে ইতিহাসের গতিধারাও হয়তো বদলে যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে। আমার এই মুহূর্তে কলম্বাস ও ভাস্কো দা গামা, গ্যালিলিও ও কোপার্নিকাস, নিউটন ও আইনস্টাইন, নেপোলিয়ন-লেনিন- ও হিটলারের কথা মনে পড়ছে। আরো ভাল বা যুৎসই উদাহরণ নিশ্চয়ই আছে, তবে আপাতত এদের দিয়েই কাজ চালাই। ভালো বা মন্দ যে কোনভাবেই হোক পৃথিবীর ইতিহাসে এদের যুগান্তকারী নতুন-ইতিহাস-সৃষ্টিকারী ভূমিকা আছে, অবদান আছে। কিন্তু এদেরও কি কেউই ইতিহাস-মুক্তভাবে বিশুদ্ধ শুন্যের মধ্যে জন্মেছিলেন বিগ-ব্যাং সিঙ্গুলারিটির মতো??? নাকি এদের ইতিহাসের কথা তুললে এদের বুদ্ধি-প্রস্তুতি-শ্রম-অধ্যবসায়-ত্যাগ-তিতিক্ষা-সাধনা-অবদান বা শয়তানির (হিটলারের মতো লোকের ক্ষেত্রে) গুরুত্বকে বিন্দুমাত্রও অস্বীকার, খাটো বা লঘু করা হয়??? আমার দ্ব্যার্থহীণ উত্তর হচ্ছে - না, করা হয় না!
বরং ইতিহাসের কথা তুললে কন্টেক্সটটা, নিজেদের, দেশের, পৃথিবীর বা মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে, আমরা সমৃদ্ধ হই এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা / পাথেয় পাই অন্ধ বীরপুজার নিস্ফলা আবেগ-সর্বস্বতার বদলে। আমি তাই অন্ধ বীরপুজার বদলে চক্ষুষ্মান বীর-বিশ্লেষণ পছন্দ করি বেশি। বীর-বিশ্লেষণকে আমি আমি বীরের অপমান বলে মনে করি না।
শেখ মুজিব সম্পর্কে আমি যেসব কথা বলেছি এই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে তা উপরের এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেছি। এই দৃষ্টিভঙ্গির সুবাদেই আমি উপরে লিখেছি -
এখানে মুজিব যে শুন্য থেকে সৃষ্টি হননি, তাঁর সৃষ্টি হওয়ার পিছনে যে ইতিহাস, সমাজের বিবর্তন এবং "অসংখ্য মানুষের ভূমিকা" আছে সেকথা বলা হয়েছে। এগুলি কি মিথ্যা??? নাকি এগুলি বললে পাকিস্তান-পর্বে বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য আন্দোলনে তার অবদান ও কৃতিত্ব কোনোভাবে খাটো হয়ে যায় বা অস্বীকার করা হয়??? শুরুতেই যেমন বলেছি, বৃটিশ-রাজ আর পাকিস্তান-রাজের পটভূমিতেই শেখ মুজিব গড়ে উঠেছেন। এই হিসেবে তার গড়ে ওঠায়, তার কর্মে ও চেতনায়, ইতিহাসের অনিবার্য ভূমিকা আছে। সব মানুষের ক্ষেত্রেই সেটা থাকে। কিন্তু তারপর সেই ইতিহাস দিয়ে উদবুদ্ধ হয়ে উনি নিজে যা করেছেন, নিজের বুদ্ধি-প্রস্তুতি-শ্রম-অধ্যবসায়-ত্যাগ-তিতিক্ষা-সাহস এসবের অসামান্য প্রয়োগে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে যে একটা অপরিহার্য-অনিবার্য চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিলেন, ইতিহাসের ক্রীড়নক (?) নয়, বরং নতুন ইতিহাসের স্রষ্টা বা নিজেই সাক্ষাৎ ইতিহাস হয়ে উঠেছিলেন - এই কথা কি কোথাও অস্বীকার করেছি? এই কথাটা কি কোনোভাবে আমার অন্য প্রতিপাদ্যটির (তার গড়ে উঠার পিছনে নির্দিষ্ট ইতিহাসের ভূমিকা, সেই ব্যাকগ্রাউন্ড ইতিহাসে অন্য মানুষেরও ভূমিকা এবং তার স্বীকৃতি) সাথে সাংঘর্ষিক?? আমার উত্তর হল- না!!! কিন্তু যারা মনে করেন সাংঘর্ষিক, তারা আসলে শেখ মুজিবকে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব / নেতা না, বরং একজন ঐশী ওহী নাযিল হওয়া বা ঈশ্বরপুত্র নবী/পয়গম্বর, মর্ত্যধামে ভগবানের অবতার বা দেবতা-টেবতা হিসেবে বেদীতে বসিয়ে অন্ধআবেগে পুজা করতেই বেশি ভালোবাসেন - যার কোনো অতীত নেই, ইতিহাস নেই এবং যার উপরে অতীত বা ইতিহাসের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করলেও সেটা ব্লাসফেমি/এপোস্টেসির সমতুল্য শাস্তিযোগ্য মহাপাপ হয়ে যাবে। আমার তো ভয় হয়, শেখ মুজিবের যে রক্তমাংসের বাবা এবং গর্ভধারিণী মা ছিলেন এবং তাঁদের জন্যই মুজিব দৈহিকভাবে ধরাধামে এসেছেন - এমনকি একথা বললেও এরা খেপে যাবেন। আমি ঠিক এই প্রবণতারই ঘোর-বিরোধী। আমি তার দেবতায়ন নয়, মানবিকায়ন করতে চাই। দেবতার বেদীতে বসিয়ে অন্ধ ভক্তির অলৌকিক অর্ঘ্য নিবেদন নয়, মানুষের বেদীতে বসিয়ে সাদা চোখে দেখতে চাই, মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ ইহজাগতিক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বাধীণতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অনন্য ও অতুলনীয় ভূমিকায় আমার বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই। এবং একমাত্র এভাবে দেখলেই তার প্রকৃত মহিমা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যাবে বলে বিশ্বাস করি - অন্য কোনভাবে নয়। এখানেই একজন পয়গম্বর, ঈশ্বরপুত্র বা ঈশ্বর-প্রেরিত ত্রাতা, অবতার, দেবতা, পীর, দরবেশ, সাধু, ধর্মগুরু বা কাল্ট-লিডারের সাথে তার পার্থক্য - মানুষ হিসেবে বিচার করতে গেলে যাদের অধিকাংশেরই কোনো মূল্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।
****************************************
নতুন মন্তব্য করুন