বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নানান রকম তামাশা দেখছি গত কয়েক বছর ধরে। তামাশার একটা অংশ হলো সৃজনশীল প্রশ্ন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সেই তামাশাটা কিভাবে উপভোগ করছি সেটার একটা নাগরিক প্রতিক্রিয়া লিখলাম। ভুক্তভোগীদের পড়ার আহবান জানাই।
সৃজনশীলতার অন্য একটি অর্থ হলো সৃষ্টিশীলতা। সাহিত্য বা শিল্পের যে কোন শাখায় প্রতিভাবানেরা সৃজনশীলতা দিয়ে তাদের কাব্য সাহিত্য কিংবা শিল্প সৃষ্টি করে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও তেমন একটি ব্যাপার আমদানী হয়েছে- সৃজনশীল প্রশ্ন। শিশুদেরকে সৃজনশীল হবার জন্য পাঠ্যসূচিকে পূর্বেকার ব্যবস্থা বদলে সৃজনশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে চালু হওয়া এই নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের পেছনে অনেক মহতী বিদ্বান ব্যক্তিদের ব্যাপক গবেষণা এবং শ্রমসময় জড়িত। স্কুলের বইপত্রগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করার পর মনে হয়েছে বাংলাদেশে সৃজনশীলতা বিষয়টি ভুল পথে চলছে। সৃজনশীলতার ব্যাপারটা যেভাবে চলছে সেটা বোঝাবার জন্য উদাহরণ হিসেবে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর একটা বইয়ের সাহায্য নিতে পারি।
পাঠ-১,২: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে পাঠ-১ ও ২ নম্বরে তিন পৃষ্টা ব্যাপী বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানী শাসন থেকে কিভাবে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তার সার সংক্ষেপ আছে। এটা বুঝতে ছাত্রদের সমস্যা হবে না। এই অংশটুকু মোটামুটি যত্ন নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু এর পরের পাঠগুলোতে যেসব তথ্য ঠেসে দেয়া হয়েছে সেগুলো মোটেও এই বয়সী শিশুদের উপযোগী নয়।
পাঠ-৩,৪,৫ বাংলাদেশে মানব বসতি ও রাজনৈতিক ইতিহাস
এটি একটি অধ্যায়মাত্র। এটা হতে পারতো পাঠ-৩। কিন্তু এটার শিরোনাম কেন ৩,৪,৫ সেটা বোঝা গেল না। এখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যে আদিম মানুষ এখানে বাস করতো সেইসব বিক্ষিপ্ত কথা এবং সিন্ধু সভ্যতা, মৌর্য যুগ, উয়ারী বটেশ্বর, গুপ্ত শাসনামল, পালরাজবংশ, কৈর্বত বিদ্রোহ, সেন রাজবংশ ইত্যাদি নিয়ে হযবরল অসংলগ্ন কিছু ভারী তথ্য ঠেসে দায় সারা হয়েছে। এসব অগোছালো ইতিহাস পড়ে ১১ বছরের একটা শিশু কিছু বুঝবে দূরে থাকুক বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দেয়া মানুষও শিখতে হিমশিম খাবে। ওজনদার বই থেকে কপিপেস্ট করে অযত্ন সম্পাদিত একটি অংশ। দেখে শুনে মনে হয়েছে এখানে একেকটা অধ্যায় একেকজন অধ্যাপকের দায়িত্বে দেয়া হয়েছে, সবাই যার যার মতো করে নিজের অংশ তৈরী করে এনেছেন। সম্পাদকেরা সেগুলা একের পর এক জোড়াতালি দিয়ে একেকটা অধ্যায় নির্মান করেছেন। ফলে অধ্যায়গুলোর তথ্য, বিন্যাস, কোনটাতেই ধারাবাহিকতা নেই, ভারী ভারী তথ্যগুলো শুধু পাতা ভরানোর কাজই করেছে।
পাঠ-৬, প্রাচীন বাংলাদেশের গৌরব: সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম
এই অংশে কৃষি, কুটিরশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে সংক্ষেপে বলা হয়েছে। কিন্তু ধর্মমত অংশে জৈন, বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মন্য ধর্ম নিয়ে সংক্ষেপে বলা হয়েছে। তবে হিন্দু ধর্মকে ব্রাহ্মন্য ধর্ম বলার অর্থ বোঝা গেল না।
পাঠ-৭, প্রাচীন বাংলাদেশের গৌরব : বিনোদন সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা
পাঠ-৮, প্রাচীন বাংলাদেশের গৌরব : ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা
পাঠ-৯ : মধ্যযুগে বাংলাদেশ
পাঠ-১০ : আধুনিক যুগে বাংলাদেশ
পাঠ-৭ ও পাঠ-৮ পর্বে অল্প পরিসরে মোটামুটি গোছানো তথ্য দেয়া হয়েছে। অন্ততঃ আগের অধ্যায়ের তুলনায় ভাল বলতে হয় এই অংশটিকে। কিন্তু মধ্যযুগের বাংলাদেশ অংশে ভয়ানক বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে ১৬১০ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা হারিয়ে মোগল শাসনের অধীনে যায়। আবার বলা হয়েছে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত পরোক্ষভাবে মোগল শাসনে থাকে। দুটি তথ্যই মারাত্মক ভুল। ১৯৭১ সালের আগে পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামের কোন রাষ্ট্র ছিল না। শুধু বাংলা লিখলে এই সমস্যা হতো না। মোগল শাসন সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া হয়েছে সেটা একেবারে গ্রহনযোগ্য নয়। বাংলা মোগলদের প্রত্যক্ষ শাসনেই ছিল বরাবর।
যাই হোক, প্রথম অধ্যায় এখানেই শেষ। এবার আসি প্রশ্ন ও পরীক্ষা অংশে। এখানে প্রথমে কিছু সংক্ষিপ্ত নির্বাচিত প্রশ্ন আছে। তারপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশ সৃজনশীল প্রশ্ন। এই অংশে দুটি তথ্য দেয়া থাকে, তারপর ৪টি প্রশ্ন থাকে। প্রথম দুটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন থাকবে সরাসরি সেই অধ্যায় থেকে। পরের দুটি প্রশ্নটি হলো সৃজনশীল। প্রদত্ত দুটো তথ্য হবে অধ্যায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। শিশুকে সেই অপ্রাসঙ্গিক তথ্যের সাথে এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর মধ্য থেকে খুঁজে বের করে তার উত্তর লিখতে হবে।
এখানে দুটো সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা দেয়া হলো পাঠ্যপুস্তক থেকে। প্রতিটি পরীক্ষায় এরকম ১০টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়
তথ্য- ১. প্রধান ফসল ধান। প্রচুর ধান উৎপাদন। রপ্তানী দ্রব্য চিংড়ি ও ব্যাঙ।
তথ্য- ২. আকাশ পথে আমেরিকায় তৈরী পোষাক রপ্তানী। পাঠজাত দ্রব্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।
ক. কোন সম্রাট ৫০টি বৌদ্ধ বিহার নির্মান করেন?
খ. টোল বলতে কী বোঝায়?
গ. তথ্য-১ এর মতো বাংলাদেশের গৌরবময় ক্ষেত্রটি ব্যাখ্যা করো
ঘ. তথ্য-২ এ উল্লিখিত বিষয়গুলো বাংলাদেশের প্রাচীন গৌরবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ - মতামত দাও
ক এবং খ এর উত্তর বইতে আছে, সেটা নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু গ এবং ঘ হলো সৃজনশীল প্রশ্ন। শিশুদের কথা বাদ দিলাম। আমি নিজে উত্তর লিখতে গেলে কী করতাম?
গ প্রশ্নের তথ্য-১ এ লেখা আছে “প্রধান ফসল ধান। প্রচুর ধান উৎপাদন। রপ্তানী দ্রব্য চিংড়ি ও ব্যাঙ”- এই তথ্যগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের অতীত থেকে গৌরবময় ক্ষেত্র খুঁজতে হবে। আমি এই অধ্যায়ে পড়লাম পড়লাম সিন্ধু সভ্যতা, মৌর্য যুগ, উয়ারী বটেশ্বর, গুপ্ত শাসনামল, পালরাজবংশ, কৈর্বত বিদ্রোহ, সেন রাজবংশ, বিনোদন-সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা ইত্যাদি। এখন আমাকে বলা হচ্ছে ধান উৎপাদন, রপ্তানী পন্য ইত্যাদি বিষয় দিয়ে অতীতের গৌরব খুঁজতে। কিসের মধ্যে কী এসে গেল এখানে? অতএব আমি গ প্রশ্নের উত্তর লিখতে ব্যর্থ হলাম।
এবার ঘ প্রশ্নে যাই। তথ্য-২ এ লেখা আছে “আকাশ পথে আমেরিকায় তৈরী পোষাক রপ্তানী। পাঠজাত দ্রব্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত”- সেই একই ঝামেলা এখানেও। আমি পড়লাম সেই সিন্ধু সভ্যতা, মৌর্য যুগ, উয়ারী বটেশ্বর, গুপ্ত শাসনামল, পালরাজবংশ, কৈর্বত বিদ্রোহ, সেন রাজবংশ, বিনোদন সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা। এখানে বাংলাদেশের প্রাচীন গৌরবের সাথে গার্মেন্টস রপ্তানী কিভাবে সম্পৃক্ত হতে পারে সেটা বুঝতে আমার মতো চোদ্দ ক্লাস পাশ লোকেরও বেদিশা অবস্থা হয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারলাম না। সৃজনশীল পরের প্রশ্নের ২য় পর্বে আসা যাক এবার।
উদ্দীপক : “আধুনিক ইতালির জনক ছিলেন কাউন্ট ক্যাভুর। ইতালির স্বাধীনতা ও ঐক্য অর্জনে তাঁর অবদান ছিল সর্বাধিক। অন্যদিকে যোসেফ মাৎসিনি ইতালির যুবশক্তিকে সংঘবদ্ধ করেন। যুব সমাজ অত্যাচার, অবিচার, কারাবাস প্রভৃতির ভয়ভীতি না করে দলে দলে তাঁর সংঘে যোগ দেয়। তাঁর নেতৃত্বে ইতালির জনগণের মধ্যে এক ব্যাপক জাগরণের সৃষ্টি হয়”।
ক. পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব কত মাইল?
খ. পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল কেন? ব্যাখ্যা কর।
গ. কাউন্ট ক্যাভুরের মধ্যে কোন মহান নেতার প্রতিচ্ছবি লক্ষ করা যায়? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. মাৎসিনির মতো উক্ত নেতার নেতৃত্বের ফলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল- মূল্যায়ন করো।
এখানে ক ও খ এর উত্তর লিখে আমি বোকার মতো বসে থাকলাম। গ এবং ঘ সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নাই। কাউন্ট ক্যাভুর কিংবা মাৎসিনির নাম এই প্রথম শুনলাম আমি। তাদের কোন কাহিনী জানা নেই আমার। এই অধ্যায়ে তাদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। অথচ তাদের সাথে তুলনা করে এদেশের দুজন নেতার নাম আমাকে লিখতে হবে। এদেশে আমার জানামতে মুক্তিযুদ্ধের নেতা একজনই। তিনি শেখ মুজিব। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে দুজনের নাম লিখতে। আমি ক্যাভুরের মধ্যে শেখ মুজিবকে দেখলে শুদ্ধ হবে নাকি মাৎসিনির মধ্যে দেখলে শুদ্ধ হবে- এটা নিয়ে একটা ভেজালে পড়ে গেলাম। একজন যদি শেখ মুজিব হয় অন্যজন কে? তাজউদ্দিন নাকি সৈয়দ নজরুল, নাকি আমু তোফায়েল রাজ্জাক এদের মধ্যে কেউ। তথ্য নিয়ে চরম বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গ ও ঘ প্রশ্নের উত্তর লিখতে আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম।
সুতরাং ক্লাস সিক্সের পরীক্ষা দিতে গেলে আমি শতকরা ৪০ ভাগ নম্বরও তুলতে পারবো না। কিন্তু, যদি আমি কোন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতাম এবং এমন সমস্যাগুলো নিয়মিত চর্চা করতাম তাহলে হয়তো পারতাম। এভাবেই পারছে শিশুরা। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থাটা এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যেন ছাত্রছাত্রীরা কোচিং টিচার গাইড ইত্যাদের সাহায্য ছাড়া পাশ করতে না পারে। কারণ এমন উদ্ভট বিষয় শিশুর অভিভাবকও বুঝিয়ে পড়াতে পারবে না।
উদাহরনটা মাত্র একটা অধ্যায়ের। এই বইতে আরো যেসব অধ্যায় আছে সেগুলো দেখে আমি আতংকিত বোধ করেছি। এই স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। শুধু প্রতিটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর তালিকা দিলাম, সম্ভব হলে একবার নজর বোলাতে পারেন।
বাংলাদেশ ও বিশ্বসভ্যতা
ভারত উপমহাদেশের নগর সভ্যতা
উয়ারী বটেশ্বর
মহাস্থানগড়
প্রাচীন বিশ্বসভ্যতা
মেসোপটেমীয় সভ্যতা
চীন সভ্যতা
পারসীয় সভ্যতা
গ্রীক সভ্যতা
রোমান সভ্যতা
(এই বিষয়গুলো প্রথম অধ্যায়েও ছিল, আবারো এখানে দেয়া হয়েছে বিস্তৃতভাবে)
বিশ্ব-ভৌগলিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ
মহাদেশের ভৌগলিক পরিচয়
এশিয়ার ভৌগলিক অবস্থান ও আয়তন
ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু
এশিয়ার জনসংখ্যা, অর্থনীতি, ধর্ম
এশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশের অবস্থান
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ
পৃথিবীর মহাসাগরের অবস্থান ও গুরুত্ব
বাংলাদেশের জনসংখ্যা পরিচিতি
জনমিতির ধারণা
জনসংখ্যা পরিবর্তনে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান
জন্মহার তারতম্যের কারণ ও প্রভাব
মৃত্যুহার তারতম্যের কারণ ও প্রভাব
স্থানান্তর তারতম্যের কারণ ও প্রভাব
বাংলাদেশের সমাজ
সমাজের ধারণা
সমাজ জীবনে প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক পরিবেশের প্রভাব
সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তর : শিকার ও খাদ্যসংগ্রহ, উদ্যানকৃষি ও পশুপালন সমাজ
সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তর : কৃষি, শিল্প ও শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সমাজ
বাংলাদেশের সমাজের প্রকৃতি
বাংলাদেশের সংস্কৃতি
সংস্কৃতির ধারণা
বাংলাদেশের সংস্কৃতির উপাদান
বাংলাদেশের সংস্কৃতির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধরণ
ব্যক্তি ও গোষ্ঠীজীবনে বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রভাব
বাংলাদেশের অর্থনীতি
অর্থনৈতিক জীবনধারা
বাংলাদেশের গ্রামীন অর্থনীতি
গ্রামীণ অর্থনীতির গুরুত্ব
বাংলাদেশের শহুরে অর্থনীতি
শহুরে অর্থনীতির গুরুত্ব
বাংলাদেশের অর্থনীতির খাতসমূহ
অর্থনৈতিক খাতসমূহের অবদান
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা
উন্নয়নের পূর্বশর্ত : দক্ষ জনশক্তি
মানবসম্পদ সৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও জনগণের ভূমিকা
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নাগরিক
রাষ্ট্রের ধারণা
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ
নাগরিক ও নাগরিকত্বের ধারণা
নাগরিকত্ব লাভের নিয়ম
জন্মসুত্র নীতি
জন্মস্থান নীতি
অনুমোদনসুত্রে নাগরিকত্ব লাভ
দ্বিনাগরিকত্ব
দেশের উন্নয়নে নাগরিকের ভূমিকা
বাংলাদেশের পরিবেশ
মানুষ ও পরিবেশ
পরিবেশগত সমস্যা : কারণ ও প্রভাব
বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে করণীয়
বাংলাদেশের শিশু অধিকার
শিশু অধিকার
জাতিসংঘ স্বীকৃত শিশু অধিকার
বাংলাদেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতি
বাংলাদেশের শিশুর বেড়ে উঠা ও প্রতিবন্ধকতা
সামাজিকীকরণ ও সমাজজীবনে এর প্রভাব
সামাজিকীকরণের মাধ্যম ও এর গুরুত্ব
শিশুশ্রমের ধারণা, কারণ ও প্রভাব
শ্রমজীবি শিশুর প্রতি আমাদের মনোভাব
শিশু নির্যাতনের প্রকৃতি, কারণ ও প্রভাব
শিশুপাচার, কারণ ও প্রতিরোধ
বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক সহযোগিতা
আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব ও এর ক্ষেত্র
উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাসমূহ
সার্ক গঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য
আসিয়ান গঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য
ইইউ গঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য
সার্ক ও আসিয়ান কোন কোন কাজগুলো করতে পারে
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট(এসডিজি)
টেকসই উন্নয়ন
মিলেনিয়াম ডেভেলাপমেন্ট গোল এমডিজি
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা লক্ষ্য এসডিজি
অবশেষে তালিকা শেষ হলো। এখানে এই একটা বইতে যা আছে তাতে পৃথিবীর আর কোন বিষয় বাকী আছে? বিষয়বস্তুর তালিকা দেখে মনে হতে পারে এটাই একজন মানুষের শিক্ষার শেষ ধাপ। এর পরে আর কিছুই শেখার নেই। এই ক্লাসেই পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে ফেলতে হবে। তাও সেটা আবার সহজ পন্থায় নয়। সৃজনশীল নামক জটিল একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শুধু এই একটা পুস্তকেই কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সমাজতত্ত্ব অনুষদের সবগুলো বিভাগের তথ্যসংক্ষেপ ধারণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকী অংশ ধারণ করবে অন্য পুস্তকগুলো।
কী আশ্চর্য একটা ব্যাপার। যারা এই বিষয়গুলো নির্বাচন করেছে তারা তো মানুষই। তাদের এটুকু ধারণা নেই কোন বয়সী শিশু কতটা তথ্য হজম করতে পারবে। শুধু কী বিষয়বস্তু? ভাষার চেহারাও ভয়ানক। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ের বিবরণই শিশুদের অনুপযোগী ভাষায় লেখা। যেসব তথ্য জটিল ভাষা প্রয়োগে উপস্থাপন করা হয়েছে তা শিশু দূরে থাকুক একজন পূর্ন বয়স্ক মানুষও বহন করতে সক্ষম নয়। প্রতিটি অধ্যায়েই আবার সেই শিশুটিকে বিদঘুটে সৃজনশীলতার মোকাবেলা করতে হবে।
অথচ “বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়” বিষয়টি হওয়া উচিত একটা সংক্ষিপ্ত তথ্য ভাণ্ডার। এখানে সহজ ভাষায় প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় রাখা উচিত ছিল যা দিয়ে শিশুরা সাধারণ জ্ঞান অর্জন করতে পারে। তাদেরকে তত্ত্ব গেলাতে হবে কেন? আর এমন বিষয়ে কেন সৃজনশীলতার প্রয়োজন? ইতিহাস ঐতিহ্য এসব তো কেবলই শেখার বিষয়, এখানে সৃষ্টিশীলতার অবকাশ কোথায়? এখানে মূল লক্ষ্য হতে হবে এই অধ্যায় থেকে সে কত সহজে কী কী বিষয় শিখতে পারে? সারা পৃথিবীতে শিশুদের বইগুলো সেই যত্নেই লেখা হয়। কিন্তু এদেশে শিক্ষার সহজ পথ বাতলানোর চেয়ে কতটা কঠিন করা যায়, জ্ঞানের পথে কত বাধা সৃষ্টি করা যায় সেই চেষ্টাই করা হয়েছে বলে মনে হয়।
আরো তামাশা হলো যেসব বিষয় এই ক্লাসে রাখা হয়েছে সেই একই বিষয় নিয়ে তাকে উপরের ক্লাসেও পড়তে হবে। আরো কঠিনভাবে পড়তে হবে ৭ম, ৮ম, ৯ম, ১০ম ক্লাসেও। পড়তে পড়তে পরীক্ষা দিতে দিতে সে তিতিবিরক্ত হবে শিক্ষাজীবনের প্রতি। এই জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে বিরূপ হয়ে বেড়ে উঠছে অনেক শিশু। শিক্ষা থেকে আনন্দ বঞ্চিত শিশুরা কতটা মানসিক বৈকল্যের শিকার হচ্ছে কিনা সেই হিসেব কেউ রাখছে না।
শিক্ষা যদি হয় জ্ঞানার্জনের পথ, সেই শিক্ষা এমনভাবে দিতে হবে যাতে করে সহজে শিশুরা জ্ঞানের আলো স্পর্শ করতে পারে। তাদের সামনে নানান বিজাতীয় সিস্টেম অপরিকল্পিত পদ্ধতি উপস্থাপন করে জ্ঞানের পথটাকে রুদ্ধ করার কোন মানে হয় না। অথচ এদেশে এখন তাই ঘটছে প্রতিনিয়ত। সিস্টেমের গিনিপিগ হয়ে গেছে সদ্য শৈশব পেরুনো বাচ্চাটাও।
এখন আসি বই প্রসঙ্গে। দেশে একটা শিক্ষানীতি আছে, স্কুলে কী কী বই পড়ানো হবে তার নির্দেশনা আছে। দেখা যাক সরকার কী কী বই পড়ানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন স্কুলগুলোকে। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর বোর্ডের বইয়ের একটা তালিকায় নজর বোলানো যাক। এখানে যেসব বই পড়াতে বলা হয়েছে তা হলো-
চারুপাঠ
বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি
English for Today
English Grammar and Composition
গণিত
ধর্মশিক্ষা
বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়
সাধারণ বিজ্ঞান
চারু ও কারুকলা
কৃষি শিক্ষা
গার্হস্থ্য বিজ্ঞান
শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা
৬ষ্ঠ শ্রেণীতে বোর্ড নির্দেশিত ১৪টি বই! কেন এতগুলো বই? আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি বোর্ডের এই ১৪টি বইয়ের মধ্যে অন্তত ৬টি বই একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এখানে অন্তত একটা অপশন থাকতে পারতো। যেমন মূল বই হতে পারতো ৬টি( বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ইত্যাদি নিয়ে)। এর বাইরে পছন্দমত যে কোন একটি বা দুটি বিষয় বেছে নেবে ছাত্রছাত্রীরা। কৃষি, গার্হস্থ্য, শরীরচর্চা, চারুকলা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, কর্মমূখী শিক্ষা সবকিছু একসাথে গুলে খেতে হবে কেন এই বয়সী একটা শিশুকে? এতে শিশুর মানসিক বিকাশ হবে নাকি শিক্ষাদীক্ষার উপর তিতিবিরক্ত হবে তা কী ভেবে দেখেছেন কর্তারা? সবাইকে কেন সবগুলো বিষয়ে জ্ঞানী হতে হবে? একই মানুষ কৃষি, রান্না, চারুকলা, তথ্যপ্রযুক্তি শিখে কোথায় পৌঁছাবে? প্রতিটি শ্রেণীতে এতগুলো অপ্রাসঙ্গিক বই ঠেসে গেলাবার পেছনে বই বাণিজ্যের বিষয় জড়িত থাকলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এগুলোই শেষ কথা নয়। এই বইয়ের সাথে স্কুল থেকে আরো দু চারটি বাড়তি বই যোগ করা হয় অনেক স্কুলে। কেননা তাদেরও বাণিজ্য আছে।
বইয়ের নাম নিয়েও কথা আছে। উপরের তালিকা দেখে বলতে পারবেন কোনটি বাংলা বই? পারবেন না। বাংলা বইয়ের নাম রাখা হয়েছে ‘চারুপাঠ’। বাংলাবইয়ের নাম কেন চারুপাঠ? যেখানে ‘চারু ও কারুকলা’ নামের আরেকটি শিল্পকলা সংক্রান্ত বই আছে। বাংলা বইয়ের এই বিভ্রান্তিকর নামকরণের হেতু কী? এখানেও সৃজনশীলতা?
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদি জ্ঞানার্জন হয়, সৃজনশীলতা তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সৃজনশীলতা মানে উন্মুক্ত সৃষ্টিশীল চিন্তা সুযোগ নয়। সৃজনশীলতা হলো কিছু নির্দিষ্ট ফরমেটের মধ্যে শিশুদের চিন্তাকে আটকে ফেলা। যেমন তাদেরকে একটা বিষয়ে কয়েক লাইন পড়তে দেয়া হয়। তারপর সেখান থেকে নির্দিষ্ট ফরমেটের কিছু প্রশ্ন দেয়া হয়। সেই প্রশ্নের উত্তর হতে হবে পূর্ব নির্ধারিত চারটি ফরমেটে। বিষয় যাই হোক না কেন ক, খ, গ, ঘ প্রশ্নগুলোর ধরণ থাকে একই, তাদের উত্তরের সাইজ, তাদের জন্য বরাদ্দ নম্বর সবই একই ফরমেটে। ওই ফরমেটের বাইরে গিয়ে, নিজের মতো করে গুছিয়ে কিছু লেখার সুযোগ নেই। ক নং প্রশ্নের জন্য বরাদ্দ ১ নম্বর, খ নং প্রশ্নের উত্তর ২ নম্বরের, গ নং প্রশ্নের উত্তর ৩ নম্বরের, ঘ নং প্রশ্নের উত্তর ৪ নম্বরের। অর্থাৎ চারটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে ৪টি আকৃতিতে। ছোট থেকে বড় হবে উত্তরগুলো। এভাবে পূর্ব নির্ধারিত ফরমেট দিয়ে কিভাবে সৃজনশীলতা হয় তা আমার মাথায় আসে না। যদি ২ নং প্রশ্নের উত্তর ৩ নং এর চেয়ে বড় হয় তাও চলবে না। এখন কোন বিষয়ের উত্তর কত সাইজের হবে, সেটা যদি আগে থেকে ঠিক করা থাকে, তাহলে রোবটের মতো পৃষ্ঠা ভর্তি করা ছাড়া শিশুদের কী শেখার আছে?
এই শিক্ষাপদ্ধতি কোথা থেকে আমদানী করা হলো তা আমার জানা নেই। কিন্তু এই পদ্ধতির কারণে সমগ্র দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। শিশুদের আনন্দের কোন সময় নেই, খেলাধুলার সুযোগ নেই, সকাল থেকে রাত অবধি কেবলি ছুটছে আর ছুটছে। সাথে ছুটছে পিতামাতা অভিভাবক। স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারের ভিড় বেশী। পকেট ফুলে ঢোল হচ্ছে কারো কারো। কারো আছে হাজার হাজার কোটি টাকার গাইড, কোচিং, বাণিজ্য। এই বাণিজ্য বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর কিনা জানি না, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার জন্য, দেশের ভবিষ্যতের জন্য একরাশ অন্ধকারই বয়ে আনবে।
মন্তব্য
এই বইতে যা আছে, সেটা ভেঙে ভেঙে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ালেও পারে। যেমন ক্লাস সিক্সে যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয় শেখে, ক্লাস সেভেনে পাকিস্তান আমল, ক্লাস এইটে ব্রিটিশ আমল, ক্লাস নাইনে মোগল আমল আর ক্লাস টেনে প্রাচীন বাংলা নিয়ে পড়তে পারে।
ক্লাস সিক্সে বরং একটা বাচ্চার শেখা দরকার সে কীভাবে রাস্তা পার হবে, ময়লা কোথায় ফেলবে, বিপদে পড়লে কার সাথে কীভাবে যোগাযোগ করে বিপদ থেকে বাঁচবে, কীভাবে অস্বাস্থ্যকর খাবার বা চর্চা থেকে দূরে থাকবে। এরকম বীভৎস পাঠ্যসূচির চাপে বাচ্চারা একেকজন নিরানন্দ মনোরোগীতে পরিণত হবে। এগুলো নামকাওয়াস্তে ছায়াশিক্ষা শিরোনামে কোচিং ব্যবসার মুরগি যোগানো ছাড়া অন্য কাজে আসবে না।
এটা বেশ ভাল একটা প্রস্তাব। কিন্তু এটা যাদের শোনা দরকার তাদের কাছে পৌঁছাবে না।
পাঠ্যপুস্তকগুলোতে লেখক তালিকার সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শিক্ষানীতির কমিটিগুলোতেও অধ্যাপক এবং আমলারাই থাকে। এখানে স্কুলের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক, অভিভাবকের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। হালকা পাতলা কোন লোকের মতামত থাকে না এসব বিষয়ে। ফলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই ভারী। ছাত্রছাত্রীরা একেকটা ভারবাহী গাধা হয়ে আছে।
বাচ্চাদের স্কুলের ব্যাগ কেন এত ভারী সেটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু সেই ভার কমাতে হলে যে বইপত্রের সংখ্যা কমাতে হয়, অপ্রয়োজনীয় বই বাদ দিতে হয়, সেটা কেউ করতে এগিয়ে আসে না। কেন আসে না সেই বিষয়ে একটা ব্যাপার আছে। ছোট থেকে মাঝারি হয়ে বড় আমলা পর্যন্ত সবাই চায় সবাইকে খুশী রাখতে। এই স্যার ওই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেইটার বিরুদ্ধে মত দিয়ে স্যার ব্যথিত হবেন, এসব ভেবে অনেক দরকারী প্রস্তাবও পেছনে পড়ে থাকে। তেল-সুপারিশ যুগে কে চায় স্যারকে ক্ষেপিয়ে নিজের পদোন্নতির পায়ে কুড়াল মারতে। আমাদের চাকরী বহাল থাকুক। সবাই খুশী থাকুক।
দৈনিক ৬/৭ ঘন্টা স্কুলে কাটাবার পরও যদি একটা বাচ্চাকে আবারো কোচিং টিচার ইত্যাদির কাছে ছুটতে হয়, তাহলে স্কুলগুলো রাখার দরকার কী? পৃথিবীর কোথায় এমন নজির আছে যে বাচ্চাদের সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত স্কুল, কোচিং, টিচার, হোমওয়ার্ক ইত্যাদি নিয়ে খাবি খেতে হয়? সাথে খাবি খায় অভিভাবকরাও। এই ছোটাছুটিতে মানুষের কর্মসময়ের কতটা অপচয় হয় সেটার কোন হিসেব আছে?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এই স্যারদের ছেলেমেয়েরা সম্ভবত এখন আংরেজি মাধ্যমে পড়ে।
এই স্যারদের জন্য একশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিপিকায় "তোতা কাহিনী" গল্পটা লিখে গেছেন। এটার উপসংহারটা অভিভাবকদেরও পড়া দরকার।
সৃজনশীল পদ্ধতি আমার কাছে ঠিক বলে মনে হয়েছে। অন্য সব ধারণার মতো এই সৃজনশীলতার ধারণার প্রয়োগে সমস্যা রয়েছে। আমাদের খেয়াল রাখা দরকার বন্দুকটা যেন সঠিক ধারণার উপর না পড়ে প্রয়োগের সমস্যার উপর পড়ে।
আমি ইতিহাসের নিবিষ্ট পাঠক। আমি বাংলাদেশের (বলা উচিৎ বাংলাভাষীরা ভারতীয় উপমহাদেশের যে অঞ্চলে বাস করে) কোন সহজবোধ্য সময়রেখা দেখিনি। প্রচলিত লেখাগুলোতে সাল তারিখ নামের ভিড়ে কে কখন এসে কখন গেল সেটার তাল রাখা অসম্ভব।
ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মানে কি মনুর শাসন যারা মেনে চলে এরকম কিছু? এভাবে মুসলিমদের একসময় মোহামেডান বলা হতো। সংশ্লিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের যেভাবে পরিচয় দেয় সেটাই লেখা উচিৎ।
বাংলাদেশ শব্দটার বয়স দেড়শ বছরের কম বলে ধারণা করি। বাংলাদেশ নামে এখন যে ভূখণ্ড আমরা চিনি সেটা ১৯৭১ থেকে। এর আগে মধ্যযুগের ইতিহাস বর্ণনায় বাংলা নামটা ব্যবহার করলেও সমস্যা আছে। বাংলা নামটা মুসলিম শাসকদের দেয়া নাম। তারাও পুরো বাংলাভাষীদের অঞ্চল শাসন করতেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ অমূলক নয়।
আর বাংলাদেশ সবসময় মুঘলদের প্রত্যক্ষ শাসনে ছিল না। যেমন শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা মোগলদের নজরানা পাঠিয়ে নিজের পরিচয় পেশ করেননি। (এটা স্মৃতি থেকে লিখলাম। বিদ্যাসাগর এটা লিখে গিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের লেখা ইতিহাসের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়)। আর বরাবর বাংলাদেশ মুঘলদের শাসনে ছিল এটা বললে বরাবরটা কবে থেকে শুরু হয়েছে সেটা নির্দিষ্ট করে দেয়া দরকার। যদ্দুর মনে পড়ে আকবর জীবদ্দশায় বাংলাভাষীদের এলাকা পুরোটা দখল করতে পারেননি। সেসময় বারো ভূঁইয়ারা ছিল এ অঞ্চলে।
সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা হিসাবে যে পাতার স্ক্যান কপিটি দিয়েছেন সেটা পড়লাম। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই প্রশ্ন যে লিখেছে তার বাংলা জ্ঞান নিয়ে আমি সন্দেহ করছি।
উনি লিখেছেন,
সঠিকটা হবে এরকম কিছু,
তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব কত মাইল ছিল?
প্রশকর্তার বানান গঠন দেখে মনে হতে পারে পুর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান নামে স্বত্তাদুটি এখনো বিরাজমান।
(ক্রমশঃ)
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
১) সৃজনশীলতা সব বিষয়ের জন্য প্রয়োজন এটা আমি মানি না। আর এই পদ্ধতির সৃজনশীলতা কোন বিষয়েই্ উপকার করবে না। শিশুদের সামনে অপ্রয়োজনীয় চ্যালেঞ্জ এনে হাজির করে বাহাদুরির চেষ্টা মনে হয়েছে।
২) বাংলায় নিরংকুশ মোগল শাসন চালু হয় জাহাঙ্গীরের আমলে ১৬১০ সালে। তখন থেকে চট্টগ্রাম বাদে পুরো বাংলা ভাষী অঞ্চল মোগল শাসনে আসে । সেই শাসনটা প্রত্যক্ষ শাসনই ছিল। বাংলার উপর দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ কমে যায় মুর্শিদ কুলী খানের সময় থেকে। ফররুখশিয়ারের মৃত্যুর পর তিনি দিল্লীকে নজরানা দেয়া বন্ধ করে দেন। বাংলার স্বাধীন নবাবের যুগের সুত্রপাতও ওখান থেকে। মুর্শিদ কুলী খাঁর থেকে সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত শাসনকালে দিল্লীকে নিয়মিত খাজনা পাঠানো হতো না ঠিক, কিন্তু সেটা ছিল গায়ের জোরে, দিল্লীর অক্ষমতার কারণে। অথচ সকল রেকর্ডপত্রে বাংলাকে মোগল শাসনভুক্ত এলাকা বিবেচনা করা হয়েছে ১৭৬৪ পর্যন্ত। এমনকি বৃটিশরা ১৭৫৭ সালে বাংলা গ্রাস করলেও অফিশিয়ালি বাংলা অধিকার করে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের পর। ১৭৬৫ সালে দিল্লীর ফেরারী সম্রাট শাহ আলমকে বাধ্য করে একটা ফরমান আদায় করে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী, সরকারীভাবে তখন থেকে কোম্পানীর আমল শুরু। চরম বিশ্বাসঘাতক কুটনৈতিক বোলচালের কারণে ১৭৫৭-১৭৬৪ সময়কালকে দ্বৈত শাসন ধরা হয়। সুতরাং কাগজে কলমে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত সরাসরি মোগল শাসন আমল ছিল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
"স্বত্তা" না সত্তা?
****************************************
হরেক রকম বিষয়বস্তুর সন্নিবেশ দেখে মনে হয় এটা বিসিএস গাইডের ফার্স্ট পার্ট। সৃজনশীল প্রশ্নমালা তৈরী করার জন্য মুহাম্মদ জাফর ইকবালের প্রস্তাবনা ছিল স্ব স্ব ক্লাসের ছাত্রদের কাছে থেকে প্রশ্ন জমা নিয়ে সেটা দিয়ে প্রশ্নব্যাঙ্ক তৈরী করা হোক। কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্নগুলো দেখেই বোঝা যায় এগুলো তথাকথিত বিজ্ঞজনদের মস্তিস্কপ্রসূত। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ কিন্তু এইসব প্রশ্নের উত্তর লিখেই ৮০-৯০ শতাংশ নম্বর অর্জন করছে! কী ভাবে?
আমার নিজের পরিমন্ডলে কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী থাকায় আমাকে এসএসসি ও এইচএসসি'র সিলেবাস এবং বইগুলো একটু ঘেঁটে দেখতে হয়েছে। প্রথমে বেশ খুশী হয়ে উঠেছিলাম, কারন এখনকার পাঠ্য বিষয়বস্তুর মান ও গভীরতা আমাদের সময়ের তুলনায় অনেক উচ্চ, বাহ দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আতঙ্কের সাথে খেয়াল করে দেখলাম সিলেবাসের পাঠ্যসূচী ঠিক্মত আয়ত্ব করতে হলে কম করে পাঁচ বছর সময় প্রয়োজন, কিন্তু সময় বরাদ্দ সাকুল্যে দেড় বছর। তা সত্বেও ছেলে মেয়েরা কী ভাবে ৮০-৯০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করছে, আমার মাথায় ঢোকে না।
পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর দেখে আমরা প্রায়ই বিভ্রান্ত হই। দেখে মনে হয় শিক্ষার বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু নম্বর দেবার যে নীতি শুনেছি তা আরো মারাত্মক। খাতায় ভুল শুদ্ধ কী লিখেছে তা নাকি তেমন বিবেচ্য নয়। উত্তরপত্রের পাতা গুনে ভাল নাম্বার দিতে হবে। খারাপ নম্বর দেবার কারণে খাতা ফেরত দেয়া হয়েছে তেমন নজিরও আছে। কোচিং সেন্টারের একটা বড় ভূমিকাও আছে। কোচিং সেন্টারে মূলত দ্রুত সময়ে খাতা ভরানোর প্রশিক্ষণটাই হয়। শিক্ষার চেয়ে কৌশলটাই এখানে গুরুত্ব পায় বেশী।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
অভিভাবকরা দিনের পর দিন এইসব সহ্য করে যাচ্ছেন কেন? তারাও তো এক সময় ইস্কুলে পড়ালেখা করেই বড় হয়েছেন। এতসব হাতিঘোড়া না পড়েই তো তারা জীবনে যা হওয়ার হয়েছেন। নিজের বাচ্চাদের এই চাপে ফেলতে কেন রাজি হন তারা?
অভিভাবকরা নিজেদের কোন ফোরাম তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সাথে বসলে এই বাচ্চারা বাঁচবে, নয়ত জম্বি হয়ে বড় হবে। এরা বড় হয়ে নিজেদের শৈশব কৈশরের স্মৃতি চারন করতে গেলে ইস্কুল-কোচিং-টিউটরের বাইরে আর কি পাবে?
ক্লাস এইট পর্যন্ত স্কুলে মাঝারি ফল করলে এমন কোন ক্ষতি নাই। এইসব ফালতু কোচিং এ বাচ্চাদের না দিয়ে তাদের খেলতে দেন, বই পড়তে দেন, কার্টুন দেখতে দেন, গান শিখতে দেন, ছবি আকতে দেন, কোচিং এ নষ্ট করা পয়সা বাচিয়ে বছরে একবার সুন্দর কোন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যান। ক্লাস নাইন থেকে অংক বিজ্ঞান কঠিন হওয়া শুরু করে, তখন ভাল টিউটর রেখে যত্ন করে পড়ান। বই পড়লে সিনেমা দেখলে বাংলা ইংরেজি এমনিতেই ভাল শিখে যাবে।
সামাজিক আড্ডায় এসব কথা তুললে সবাই একমত হয়। দেশটা রসাতলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে। ওইটুকুই। এর বাইরে আর কিছু নেই। এ ছাড়া আর করারই কী আছে। কার কাছে বললে কাজ হবে, কেউ তা জানে না। আমাদের স্কুলগুলো আগের সিস্টেমের সাধারণ পড়া চালাবার ক্ষমতাও রাখে না। নতুন এই পদ্ধতিগুলো তো বাড়তি গজব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রয়োগের মতো অবকাঠামো, শিক্ষক, মেধা কোনটাই নেই আমাদের।
শুধু একটা শহরের উদাহরণ দেই। ৫০ বছর আগে শহরের জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ। বলার মতো স্কুল ছিল মাত্র ১০টা। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে ৪০ লাখ মানুষ। গত পঞ্চাশ বছরে ওই দশটার মতো একটাও নতুন স্কুল হয়নি। যেসব স্কুল গড়ে উঠেছে সব বাসাবাড়ির চিপাচাপায় তৈরী স্কুল।
শিক্ষাদীক্ষার আধুনিক সিস্টেম গড়ে তুলতে হলে আগে স্কুল গড়তে হবে। তারপর বাকী শ্লোগান। আমরা শুধু শ্লোগানই দিয়ে গেছি, স্কুল বাড়াইনি, দক্ষ শিক্ষক তৈরী করিনি। ক্লাস ওয়ান থেকে বাচ্চাদের যদি কোচিং সেন্টারে ছুটতে হয়, স্কুলগুলোর প্রয়োজন কী? শুধু বই বাড়ালে, জিপিএ বাড়ালে দেশের শিক্ষার মান উন্নত হয় না। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করে বিদেশে পড়তে গেলে পার্থক্যটা খুব ভালোভাবে টের পাওয়া যায়।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার ধারণা সৃজনশীল পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য সাধনের পরিবর্তে আগের মতোই একটা সিস্টেম আয়ত্ব করে সেটার মাধ্যমে ভাল রেজাল্ট করার পদ্ধতিই বহাল আছে।
মানে এখানে ধরেই নেয়া হচ্ছে শ্রমজীবী শিশুরা এই বই পড়বে না। আদারিংএর প্রথম পাঠ।
বাংলাদেশে সাধারণ দক্ষতার মান এরকমই। দুঃখজনক বাস্তবতা।
১৪টা বই পড়ে ইউরোপিয়ান শিশুদের সাথে প্রতিযোগিতায় পারবে না। এর কারণ বলাইবাহুল্য। সিলেবাস বাড়ালেই বেশী শিখবে এই ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত আছে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
গত বছর থেকে জেএসসিতে ৬টা পরীক্ষা নেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তার মানে তারা নিজেও জানে বাকী বইগুলো অপ্রয়োজনীয়, বাহুল্য। সেই অপ্রয়োজনীয় খাতে যে বিপুল অংক ব্যয়িত হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ অপচয়। সেই টাকা দিয়ে কয়টা নতুন স্কুল তৈরী হতে পারতো তার হিসেব করা দরকার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যে নতুন নতুন স্কুল গড়তে হয় সেটা কেউ ভাবে মনে হয় না।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষাবিদ রয়েছে তাদের ছেলে মেয়েরা এদেশে লেখাপড়া করে না বলে আমার মনে হয়। এদের কারনে শিক্ষা ব্যবস্থা ধনী লোকের হাতে চলে গেছে। আমি সতল বিষয়ে সৃজনশীল দরকার আছে বলে মনে হয় না। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং,গাইড বই ও প্রাইভেট ছাড়া বাড়ীর কাজ করানো কঠিন। তারা কি সৃজনশীল পদ্ধিতে বড় শিক্ষিত হয়েছেন?
নতুন মন্তব্য করুন