(সতর্কতা:এই গল্পে এমন কিছু রক্তাক্ত সত্য বিবরণ আছে যা দুর্বল হৃদয়ের জন্য সহনশীল নাও হতে পারে)
দেশকালসময় সবকিছুর উর্ধে চলে যাবার পরও ক্ষীরোদরঞ্জন নাথ কিছুতেই দৃশ্যটা ভুলতে পারছেন না। নিরবালা দেবী তাঁর স্ত্রী হলেও তার মাথার উপর নিজের কাটামুণ্ডুটি এভাবে হাজির হবে ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তখনো তার চক্ষু মুদে আসেনি। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন কয়েক সেকেণ্ডের সচেতন অচেতনের মাঝামাঝি ভাষাতীত এক মুহুর্ত ছিল সেটি। কাট্টলীর নাথ পাড়ার সবগুলো প্রাচীন বৃক্ষ, সমুদ্রের হাওয়া, চৈতালী ঝড় ক্ষীরোদরঞ্জনের সাথে একমত। তাঁর কোন অভিযোগ নেই কারো কাছে। তবে সেই ঘটনার পর থেকে তিনি শুধু ঘুরে ঘুরে সেই খুঁটিটার কাছে ফিরে আসেন। যে খুঁটির নীচে ঠেস দিয়ে বসে ছিল নিরবালা দেবী। আসলে ঠেস দেয়নি, একটা পাটের দড়িতে বাঁধা ছিল নিরবালা দেবীর শরীরটা।
প্রতি বছর মধ্য চৈত্রের এই দিনে ক্ষীরোদরঞ্জন ফিরে আসেন নাথপাড়ার এই খুঁটির কাছে। তাঁর এই ফিরে আসাটা এতটাই আড়ালে ঘটে যে নাথপাড়ার কোন মানুষ টের পায়
না তিনি এসেছেন। কিন্তু এ পাড়ার প্রাচীন বৃক্ষ, সমুদ্রের হাওয়া, চৈতালী বাতাসের সাথে লোহার পাইপের মরচে ধরা খুঁটিটাও টের পায় ক্ষীরোদ রঞ্জনের উপস্থিতি। ফিরে না এসে উপায় কী? তাঁর নিজের স্ত্রীর সামনে এতটা অসম্মানিত হওয়া, একটা বিবর্ণ অপরাধবোধ নিরন্তর গ্লানি তাঁকে গ্রাস করে রেখেছে কয়েক দশক ধরে।
দক্ষিণ কাট্টলীস্থ নাথপাড়ার ক্ষীরোদরঞ্জন নাথ বরাবরই নির্বিবাদী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বৃদ্ধ পিতা হরিরঞ্জন নাথও কারো সাতেপাঁচে থাকতেন না। কিন্তু ক্ষীরোদরঞ্জনের স্ত্রী নিরবালা দেবীর সাহস একটু বেশী ছিল। উনিশশো একাত্তর সালে এমন কিছু অদ্ভুত দুঃসাহসী মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল গাঙ্গেয় মোহনার এই দেশটিতে। নিরবালা দেবীর এই সাহসিকতার প্রভাব পড়েছিল জ্যৈষ্ঠ সন্তানদ্বয় বাদল এবং দুলালের মধ্যেও। কলেজে উঠার পর থেকে বাদল আর দুলাল অনেক বেশী স্বাধীনচেতা হয়ে গেছে। নিজেদের স্বাধীনতা ছাপিয়ে তারা শেখ মুজিবের দলে ভিড়ে দেশের স্বাধীনতা নিয়ে মাতামাতি করে পাড়ার লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ক্ষীরোদরঞ্জন যে কোন রকম ঝুট ঝামেলা রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন, কিন্তু স্ত্রী নিরবালা হলো বিপরীত। তিনি তাঁর ছেলেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে গর্ব করেন।
হাইস্কুল পড়ুয়া দুই কন্যা খুকু আর স্বপ্নাও দাদাদের সাথে পোস্টার লিফলেট নাড়াচাড়া করে। পাশে বসে চুপচাপ দেখে ছোট দুই ভাই। ক্ষীরোদরঞ্জন মাঝে মাঝে খুব উৎকন্ঠা বোধ করে এদের জন্য। দেশের অবস্থা ভালো নয়। কখন কী ঘটে যায়।
শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের আগ থেকেই চট্টগ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছিল। মার্চের শুরুতেই পাহাড়তলীর ওয়ারলেস কলোনীতে বিহারী-বাঙালী দাঙ্গা লাগলো, তখন অনেক বাঙালীকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়। সেই সংবাদ যখন কাট্টলীর নাথ পাড়ায় এসে পৌঁছায়, তখন সকলেই আতংকে নীল হয়ে গিয়েছিল।
ক্ষীরোদরঞ্জন একবার ভাবলেন এখান থেকে সরে যাই। কিন্তু পরিবারের কোন সমর্থন পেলেন না। যাবেন কোথায়, সারা দেশটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। শেষমেষ দশজনের যা হবে আমাদেরও তাই হোক- ভেবে রয়ে গেল।
২৫শে মার্চ রাতের পর থেকে ভয়াবহ সব সংবাদ এসে ক্ষীরোদরঞ্জনের দম আটকে ফেলছিল। কিন্তু নিরবালা দেবী কেমন নির্বিকার দুঃসাহস নিয়ে কাজ শুরু করেছে ছেলেদের উৎসাহ যুগিয়ে। হালিশহরে ইপিআরের সাথে পাকিস্তানীদের কয়েকদিন যুদ্ধ চলার পর ৩০শে মার্চ পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। পাকিস্তানীরা ঢাকা থেকে সৈন্য এনে ইপিআর বাহিনীকে পরাজিত করলে বাঙালী সৈন্যরা পালিয়ে এদিক সেদিক আশ্রয় নিতে থাকে। তাদেরই একটা দল এসে পড়ে নাথ পাড়ায়। নিরবালা দেবী নিজের ঘরে আশ্রয় দিলেন কয়েকজনকে। তাদেরকে রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্ব তিনি নিজেই নিলেন।
কিন্তু সংবাদ পেয়ে পরেরদিন বিহারীদের সাথে নিয়ে পাক বাহিনী নাথ পাড়ার দিকে আসতে শুরু করলে সমস্ত পাড়ায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। লুকিয়ে থাকা ইপিআর বাহিনী বের হয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সীমিত অস্ত্রবলের কারণে। ইপিআর বাহিনী পিছু হটে যাবার পর বিহারী ও পাকিস্তানী বাহিনীর যৌথ আক্রমনে সমগ্র নাথ পাড়া ছারখার হতে থাকে। একের পর এক লাশ পড়তে থাকে প্রতিটি বাড়িতে। কোন বাড়ি রক্ষা পায় না। কোন পরিবার পালানোর সুযোগ পায় না।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় ক্ষীরোদরঞ্জন ঘরের মধ্যে বৃদ্ধ বাবাকে পাশে নিয়ে বসে থাকেন। নিরবালা দেবী রান্নাঘরের উনুন নিভিয়ে মেয়েদেরকে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখে। কলেজ পড়ুয়া দুই সন্তান বাদল ও দুলালকে লুকিয়ে রাখেন অন্য ঘরে।
পাড়ার উত্তরদিক থেকে শুরু হওয়া ধারাবাহিক হত্যাযজ্ঞে একসময় ক্ষীরোদরঞ্জনের বাড়ির পালা আসে। বিহারীদের পুরোনো ক্ষোভ এই বাড়ির উপর। শেখ মুজিবের ৬ দফা নিয়ে, ইলেকশনে নৌকা নিয়ে, জয় বাংলা নিয়ে মাতামাতি করা বাদল আর দুলাল এই বাড়িরই সন্তান। এবার যাবি কোথায়? ‘বেরিয়ে আয়’ বলে গর্জে উঠলো বিহারীর দল।
তারপর পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে দরোজায় লাথি মেরে ঘরে ঢুকে ক্ষীরোদরঞ্জন আর তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে মারতে মারতে উঠোনে এনে ফেললো।
নিরবালা দেবী বাধা দিতে গেলে তাঁকে অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং টেনে হিঁচড়ে ধরে এনে উঠোনের একটা মোটা খুঁটির সাথে বেঁধে ফেললো।
এই দৃশ্যটা ক্ষীরোদরঞ্জন এখনো স্পষ্ট দেখতে পান। বাবা এত আঘাত পেয়েও মুখ দিয়ে টুঁ শব্দ বের করেননি। সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। ক্ষীরোদরঞ্জন মারের চোটে ব্যথাকাতর হলেও বয়োবৃদ্ধ নিরীহ নির্বিবাদী বাবার উপর এমন আক্রমণ দেখে নিজের ব্যথা ভুলে গেলেন।
সবচেয়ে আশ্চর্য লাগলো নিরবালা দেবীর সাথে ব্যবহারটা। তাকে অমন করে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখলো কেন? মেয়েমানুষকে এত ভয় কিসের? এখন কী করবে তাদের? বিহারীদের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্রপাতিগুলো চিনতে পারলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে উদ্যত অগ্নেয়াস্ত্রের সাথে পরিচয় নেই তাঁর। এগুলাকে স্টেনগান বলে নাকি মেশিনগান কে জানে। এমন ভয়াবহ কালো কুচকুচে ভয়ানক দর্শন অস্ত্র খাকি পোষাকের পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে। ভয় পেতেও যেন ভুলে গেছেন ক্ষীরোদরঞ্জন। নিরবালার দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ হতে থাকেন। মেয়েমানুষের এত সাহস কেন। একটু কম সাহসী হলে তো আরো আগে পালিয়ে বাঁচতে পারতাম। এখন বোঝো ঠেলা! মনে মনে যেন তিরস্কারের ভাষা খুঁজে বেড়ান ক্ষীরোদরঞ্জন।
কিন্তু সেই ক্ষোভটা কয়েক মিনিটও টিকতে পারেনি। ক্ষীরোদরঞ্জন ও তার পিতার ভাষা এবং চেতনা পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়ে যায় পরবর্তী দৃশ্যটি দেখে। পৃথিবীর কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সেটা হজম করা সহজ নয়।
কয়েকজন বিহারী হুংকার দিয়ে ক্ষীরোদরঞ্জনের পাশের ঘরটি থেকে বাদল ও দুলালকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে উঠোনে ফেললো। উঠোনের মাঝখানে কয়েকজন মিলে চেপে ধরলো তাদের। দুই হাত, দুই পা ধরে থাকলো চারজনে। তারপর একজন এসে তরতাজা ছেলে দুটোর শরীরের উপর মাংস কাটার ধামা কিরিচ দিয়ে কোপ দিতে শুরু করলো। জ্যান্ত পাঠা বলি দেবার মতো প্রথমে দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলল, তারপর দুই পা, সব শেষে তাদের তড়পাতে থাকা দেহ দুটো পাশাপাশি রেখে এক কোপে মাথা দুটো বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। প্রতিটি শরীর ছয় টুকরায় বিভক্ত করার পর কর্তিত অংশগুলো একটা একটা করে নিরবালা দেবীর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলতে লাগলো, ‘৬ দফা চাইছিলি না? এই নে তোদের ছয় দফার ছয় টুকরা’।
এই দৃশ্য দেখার পর নিরবালা দেবীর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা লেখার কোন অর্থ হয় না। দৃশ্যমান ব্যাপারটাকে শুধু এটুকুতে বিধৃত করা যথেষ্ট যে নিজের সন্তানের কর্তিত দেহের টুকরা থেকে নির্গত হওয়া রক্তে ভিজে সপসপে হয়ে আছে তাঁর সমস্ত শরীর।
নিরবালা দেবীর চেয়ে ক্ষীরোদরঞ্জনের ভাগ্য ভালো। তিনি সন্তানদের উপর প্রথম কোপ পড়ার সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। কিন্তু নিরবালা দেবী কোন এক দুর্ভাগ্যজনক কারণে জ্ঞান হারাতে পারেননি বলে চোখের সামনে এই ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখতে হলো।
তখনো দেখার বাকী ছিল আরো। এটাও দেখলেন নিরবালা দেবী।
বিহারীদের একজন ক্ষীরোদরঞ্জনের ঘাড়ের উপর একটা কোপ দিয়ে মাথাটা আলাদা করে নিল। তিনি ছয়দফা করেননি বলে তাঁকে মাত্র একটি কোপ দিয়ে দয়া করা হলো। তারপর কর্তিত মাথাটি হাতে নিয়ে বিহারীদের একজন নিরবালা দেবীর দিকে এগিয়ে গেল। ক্ষীরোদরঞ্জনের কাটামুণ্ডুটা নিরবালা দেবীর মাথার উপরে ধরলো। মাথা থেকে ঝরে পড়া উষ্ণ রক্তের ধারায় লোহিত স্নান করানো হলো নিরবালা দেবীকে।
ক্ষীরোদরঞ্জন কখনো ভাবতে পারেননি শুধু একটি মাথা হয়ে তিনি স্ত্রীর মাথার উপর ঝুলে থাকবেন অন্য একজনের হাতে। এটা তাঁকে খুব ব্যথিত করেছিল। তাঁর বিচ্ছিন্ন ধড়টা উঠোনে নিজের রক্তে স্নান করছিল আর তিনি শুধুমাত্র একটি মুণ্ডু হয়ে স্ত্রীকে স্নান করাচ্ছেন নিজের রক্ত দিয়ে। বেশীক্ষণ না। মিনিটখানেকের মধ্যে রক্তের ধারা ফুরিয়ে আসলে কাটামুণ্ডুটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘাতকেরা।
ক্ষীরোদরঞ্জনের বাবাকেও একইভাবে কেটে মুণ্ডু আলাদা করা হলো। সেই মুণ্ডু থেকে নির্গত রক্ত দিয়ে নিরবালা দেবীকে আবারো রক্তস্নান করানো হলো। দু্ই সন্তান, স্বামী, শ্বশুরের রক্তে স্নান করেও নিরবালা দেবী কিভাবে বেঁচে থাকলেন সেটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার।
তখন থেকেই ক্ষীরোদরঞ্জনের আত্মাটা ঘুরে ঘুরে ডাকছিল নিরবালা দেবীকে- “আয় চলে আয়, তুই একা থেকে কী করবি। আমাদের সঙ্গে চলে আয়।”
কিছুতে সে ডাকে সাড়া দিলেন না নিরবালা দেবী। কারণ ইতিমধ্যে তাঁর দুটি কিশোরী কন্যাকে ঘরের দরোজা ভেঙ্গে বের করে আনা হয়েছে। তারা উঠোনে এসেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। নিরবালা দেবী বাকহীন হয়ে দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি ভাবতে চান না তার মেয়েদের নিয়ে এই নরাধমের দল এখন কী করবে।
নরকযজ্ঞের শেষ পর্বে ছিল দাহকার্য। হত্যাকাণ্ড শেষ করে ঘরের মধ্যে কেরোসিন ঢেলে দিল। একটা ম্যাচের কাঠিতে আগুন দিয়ে ছুড়ে দেবার পর দাউদাউ জ্বলে উঠল চৈত্রের বাতাস। আশেপাশের সব বাড়িতেই আগুন, একটিও রক্ষা পায়নি। সমস্ত নাথ পাড়া জ্বলছে লেলিহান শিখা উঁচিয়ে। সেই আগুনের মাঝখানে স্বজনদের রক্তে সিক্ত হয়ে নিরবালা দেবী স্তব্ধতা পরজন্মের প্রতীক্ষায় বসে থাকলেন।
এতগুলো বছর পরেও ক্ষীরোদরঞ্জন ভুলতে পারে না সেই দৃশ্যটি। তার আত্মা বারবার ফিরে আসে সেই খুঁটির উপর যেখানে নিরবালা দেবীকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। যেখানে তার কর্তিত মুণ্ডুটি নিরবালা দেবীকে স্নান করিয়ে দিয়েছিল আপন রক্ত দিয়ে। তিনি নিরবালাকে রাগী চোখে শাসন করেন। আয় চলে আয়, ওখানে থেকে কী করবি? আগেই বলেছিলাম মেয়েমানুষের অত সাহস ভালো না। ছেলেদের আশকারা দিস না। ছয়দফা ধুয়ে এখন পানি খাবি?
ছেলে দুটোর ছয় টুকরো কখনো জোড়া লাগানো যাবে না বলে মনে কষ্ট লাগলো ক্ষীরোদরঞ্জনের ভাসমান আত্মাটির। ওরা কিভাবে দাঁড়াবে। কিভাবে হাঁটবে। মাথাটাও আলাদা, খাওয়াদাওয়া কিভাবে করবে কিছুতে হিসেব মিলাতে পারেন না তিনি। বাবা হিসেবে এই অক্ষমতা তাকে ভীষণভাবে পীড়িত করে। তখনো নিজের কথা মনে আসেনি ক্ষীরোদরঞ্জনের। তার মাথাটা থেকে দেহটা ওইখানে পড়ে আছে উঠোনের স্যাঁতস্যাতে রক্তের উপর।
প্রতিটি চৈত্র মাসে ক্ষীরোদরঞ্জন নাথ পাড়ায় ফিরে আসেন। কেউ দেখে না, তিনি নিজেই যেন এই দৃশ্যটার পুনঃ পুনঃ চিত্রায়ন করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে।
তাঁর কাটামুণ্ডুটা অন্তত একবার দেহের সান্নিধ্যে এসে পরিপূর্ণ হতে চায়। নিরবালা দেবীর শরীরের উপর যেসব রক্ত ঝরে ঝরে তাঁকে শূন্য করে দিয়েছে সেই রক্তের ধারা তিনি এখনো খুঁজে বেড়ান। তিনি নিরবালাকে জীবনে কখনো বড় কোন উপহার দিতে পারেননি। কায়ক্লেশে তিনি জীবনটা কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু জীবনের শেষদিনে তার মাথার উপর নিজের মূল্যবান রক্ত উপহার দেয়াটা তিনি কিছুতে মেনে নিতে পারছেন না। সেই উপহার তিনি দিতে চাননি। তিনি তার রক্ত ফিরে পেতে চান। কিন্তু কোথাও তার চিহ্ন না পেয়ে নিজের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সবচেয়ে বেশী রাগ নিরবালা দেবীর উপর। তার কথা শুনে পালিয়ে গেল না বলেই তো আজ তার বিচ্ছিন্ন মুণ্ডু নিয়ে অনাদিকাল ধরে ঝুলে থাকতে হচ্ছে। আর কতকাল….আরো কতকাল…..., ভাবতে ভাবতে হাঁপিয়ে উঠতে থাকেন তিনি।
অতঃপর তিনযুগ অতিক্রান্ত হবার পর একদিন নিরবালা দেবীর অবসর হলো দুঃসহ স্মৃতির ভারমুক্ত হয়ে উর্ধলোকে উত্তীর্ণ হবার। সেদিন থেকে ক্ষীরোদরঞ্জন নাথ স্ত্রীকে নিজের মুণ্ডসিক্ত রক্তস্নান করাবার দায় থেকে যেন গ্লানিমুক্ত হলেন। তিনি যে আর কখনো এ পাড়ায় আসবেন না সেটা জানে নাথপাড়ার প্রাচীন বৃক্ষ এবং উপকূলে ঘুরে বেড়ানো বঙ্গোপসাগর থেকে উড়ে আসা লোনা হাওয়া। কান পাতলে কেউ কেউ সেই হাওয়ার মধ্যে একটা সদ্য লুপ্ত দীর্ঘশ্বাসের সুর খুঁজে পেতে পারে।
[সমাপ্তি নোট : ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ চট্টগ্রামের দক্ষিণ কাট্টলীর নাথপাড়ায় সংঘটিত মর্মান্তিক সেই গণহত্যায় কয়েকশো মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। নিরবালা দেবী অভাবিতভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, বেঁচে ছিলেন আরো তিন যুগ। শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফি ২০০৬ সালে নিরবালা দেবীর এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ঘটনাটি জেনে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে গিয়ে ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধে নারী’ গ্রন্থটিতে। তার কিছুকাল পর নিরবালা দেবীর জীবনাবসান ঘটে ]
মন্তব্য
পড়লাম।
। বিষণ্ন হয়ে গেলাম।
আমিও বিষণ্ন হয়ে পড়লাম।
..................................................................
#Banshibir.
...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
...
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
স্তব্ধ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
মর্মস্পর্শী লেখনী।
প্রথম আলো দেখলাম নিরবালা দেবীর স্বামীর নাম লিখেছে - হরিরঞ্জন নাথ! আপনার লেখায় তো ইনি আসলে শ্বশুর, তাই না?
****************************************
নতুন মন্তব্য করুন