চৌকির সাথে খাটের যে সম্পর্ক কিংবা কাঁথার সাথে লেপের যে সম্বন্ধ- আলামিনের সাথে ইদ্রিস মওলানার সম্পর্কটা ঠিক সেরকম না হলেও খাট চৌকির বিরোধের কারণে দুজনের সুসম্পর্কটা ভেস্তে গেল দুদিনের মাথাতেই। আলামিন যে মসজিদে আজান দেয়, ইদ্রিস মওলানা সেই মসজিদের ইমাম। ঘটনার সুত্রপাত গত বছরের প্রথম দিকে হলেও আমাদেরকে আরো ছমাস পেছনে যেতে হবে।
দাখিল পাশ করা আলামিন তখন কুতুবদিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের মসজিদে আজান দিতো। সংসারে একমাত্র উপর্জনক্ষম পুরুষ হিসেবে অল্পবয়সে গুরুদায়িত্ব কাঁধে পড়লেও গ্রামের মসজিদে আজান দিয়ে সংসার চলছিল না। গ্রামের প্রভাবশালী খন্দকার বাড়ির বদান্যতায় শহরের কাজীবাড়ি মসজিদে চাকরীটা পাবার পর আলামিনের পরিবারে একটা বিরাট স্বস্তি আসে। সাড়ে চার হাজার টাকা বেতন খুব বেশী না। কিন্তু এখানে থাকার জন্য কোন খরচ লাগতো না। ইমামের জন্য মসজিদের লাগোয়া একটা ঘর আছে। ইমাম সাহেবের নিজের বাসা আছে শহরে, তাই ঘরটা আলামিনের দখলেই ছিল। খাওয়ার খরচও তেমন ছিল না। প্রায়ই নানান ধর্মীয় কর্মসূচীর উসিলায় ইমাম সাহেবের সাথে তারও দাওয়াত থাকতো।
গত বছরের শুরুতে কাজি বাড়ির ভাইদের মধ্যে মসজিদ পরিচালনা বিষয়ক একটা ঝামেলা হওয়ার পর ইমাম হাসমত আলী একদিনের নোটিশে চাকরী ছেড়ে চলে যান। বেকায়দায় পড়ে আলামিনকে ইমামতি করতে হয় কয়েকদিন। তারপর নতুন কমিটির তাগিদে জরুরী ভিত্তিতে যোগাযোগ করে তাদের গ্রামের আধা মওলানা ইদ্রিসকে নিয়ে আসে। শীতকালে গ্রামে গ্রামে ওয়াজ করে বেড়ায় বলে সে ‘ওয়াজী ইদ্রিস’ নামে পরিচিত। কোন প্রতিযোগিতা ছাড়াই সাড়ে আট হাজার টাকা বেতনে কাজিবাড়ির নতুন ইমাম হিসেবে যোগ দিল মওলানা মোহাম্মদ ইদ্রিস ওরফে ওয়াজী ইদ্রিস। আপাতত কাজ চালিয়ে নেবার জন্য যে কোন একজনকে পেয়েই কমিটি খুশী। মসজিদ কমিটি খুশী হলেও আলামিনের জন্য ব্যাপারটা অচিরেই গলার কাঁটা হয়ে উঠলো। কমিটিকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে সে যেন খাল কেটে কুমীর ডেকে আনলো নিজের জন্য।
খাট চৌকির বিরোধের সুত্রপাত ওখানেই।
ইমামের ঘরের মধ্যে একদিকে একটা ডাবল খাট, অন্যদিকে একটা সিঙ্গেল চৌকি। যেহেতু আগের ইমাম এখানে থাকতেন না, এতদিন আলামিন খাটে ঘুমাতো। ওয়াজী ইদ্রিস আসার পর প্রথম দুদিন দুজনে একসাথে গল্প করে খাটেই ঘুমিয়েছে। কিন্তু ইমাম হিসেবে দায়িত্ব নেবার পরের দিনই ওয়াজী ইদ্রিসের খোলস পাল্টে যায়। রাতে শোবার সময় আলামিনকে খাট থেকে চৌকিতে চলে যাবার নির্দেশ দেয়। প্রথমে বিশ্বাস হতে চায়নি নিজ গ্রামের মানুষ হয়ে ওয়াজী ইদ্রিস এমন কিছু করতে পারে- যাকে সে নিজে ডেকে এনে চাকরী পেতে সাহায্য করেছে। মেনে নিতে না চাইলেও কোন উপায় থাকে না আলামিনের। পদাধিকার বলে ইমামই তার কর্তা, তার কথামত তাকে চলতে হবে। সুতরাং নতুন ব্যবস্থাটা চুপচাপ মেনে নিল আলামিন।
খাটের ব্যবস্থাটা উন্নত। তোষক, কম্বল, পরিষ্কার চাদর সব আছে। মশারী খাটানোর ব্যবস্থাটা সুন্দর- স্ট্যাণ্ডে ভাঁজ করা থাকে, ঘুমানোর সময় একটানে ঝপ করে ফেলে শুয়ে পড়া যায়। কিন্তু চৌকিতে তোষক-টোষকের বালাই নেই, কেবল একটা মাদুর বিছানো। তার উপরে শক্ত রকমের কাঁথা। যে মশারীটা আছে সেটায় কয়েক ডজন ছিদ্র এবং টাঙানোর জন্য সুবিধামত পেরেক নেই দেয়ালে। সুতলি জোড়াতালি দিয়ে কোনমতে টাঙিয়ে ব্যাঙের মতো শুয়ে থাকতে হয়। চৌকির উপর যে কাঁথাটা বিছানো আছে সেটা কোন সুদূর কালে পরিত্যক্ত। ওখান থেকে যে বিকট ছুঁচোর গন্ধ বের হয় বালিশে মাথা রাখলে নাকের ছিদ্র খোলা রাখা দায় হয়ে পড়ে।
খাট পালঙ্কের বাইরে দ্বিতীয় একটা সমস্যা দেখা গেল। তাকে এখন রান্না ও বাজার দুটোরই দায়িত্ব নিতে হলো। আগের ইমাম এখানে থাকতো না বলে রান্নাটা ছিল ঐচ্ছিক। তাছাড়া অধিকাংশ সময় দাওয়াতেই কেটে যেতো। ওয়াজী ইদ্রিস আসার পর দাওয়াতের পরিমান কমে গেছে। কাজিবাড়ির নিজেদের মধ্যে ঝামেলার কারণে কেউ ইমাম মোয়াজ্জেনের প্রতি আগের মতো খেয়াল খাতির করছে না। আগের কমিটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত মোতওয়াল্লী যেরকম উদার এবং অতিথিপরায়ন ছিলেন, বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত মোতওয়াল্লী তার ধারে কাছেও নেই। বেতনের বাইরে যেসব বাড়তি সুযোগ সুবিধা ছিল সেটা প্রায় বন্ধ।
তৃতীয় অসুবিধা টিউশানির ভাগ নিয়ে। আলামিনের একটা বাড়তি আয় ছিল সকালবেলা পাড়ার ছেলেদের কোরান শিক্ষার আসর থেকে। আগের ইমাম সেখানে ভাগ বসাতেন না। কিন্তু ওয়াজী ইদ্রিস এসে ওই কাজটা পুরোপুরি ছিনিয়ে নিল। এখন সেই আয়ের মাত্র এক দশমাংশ পায় আলামিন।
ওয়াজী ইদ্রিস শুরুতে এই চাকরী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও মাসখানেক যাবার পর আলামিনের কাছ থেকে আগের ইমামের সময়কার সুখ সুবিধার বিষয়ে জানার পর তুলনামূলক অতৃপ্তিতে ভুগতে শুরু করে। শুধু বেতন দিয়ে মওলানার পেট চলে না, এটা কে না জানে। তাছাড়া আগের ইমামের অর্ধেকেরও কম বেতনে তাকে চাকরী করতে হচ্ছে এটা জানার পর সে আরো দমে গেল। কুতুবদিয়ায় তার পরিবারও অভাব অনটনে আছে। মাসিক বেতনের অর্ধেক পাঠিয়ে দিলেও টানাটানি হয়। রোজার দিনে আগের ইমামের সময় আশপাশের বাড়ি থেকে ইফতারীর ঢল নামতো। গত রোজায় একসপ্তাহ কেটে গেলেও কোন বাড়ি থেকে ইফতারী আসলো না।
মনঃক্ষুন্ন হয়ে ওয়াজী ইদ্রিস এক জুম্মার দিনে সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে মুখ ফুটে জানিয়ে দিল কথাটা। মসজিদ হলো আল্লার ঘর, এই ঘরের কথা ভুলে গেছে আজকের নাদান মুসলমান। রোজার দিনে দান খয়রাত করলে, মসজিদে ইফতারী বিলালে, ইফতারের দাওয়াত দিলে অসীম সওয়াবের ভাগীদার হওয়া যায় । অথচ এই রমজানে কেউ সেই সুযোগ নিচ্ছেন না বলে দুঃখ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করল ওয়াজী ইদ্রিস।
এই মসজিদের মুসল্লীরা পূর্বেকার কোন ইমামের মুখ থেকে এরকম নির্লজ্জ আহ্বানের সাথে পরিচিত ছিল না। তারা গুঞ্জন করতে শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওয়াজী ইদ্রিস সাথে সাথে একটা আরবী লাইন সুর করে ওয়াজগীতি গাইতে শুরু করলো।
ওয়াজী ইদ্রিস গ্রামে গঞ্জের মাহফিলে রাত বিরেতে গলা ফাটিয়ে ওয়াজ করে। যে কোন কথা সুর করে বয়ান করতে পছন্দ করে সে। মাঝে মাঝে এমন কিছু সুর তার ওয়াজে চলে আসে যেগুলা সাম্প্রতিক মুক্তি পাওয়া কোন হিন্দি সিনেমার গান। আলামিন নিজেও বিব্রত হয় তার ওসব গানের সুরে। কিন্তু ইদ্রিস মওলানার মোনাজাতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো গানের সুর। খোদার কাছে তার প্রার্থনা পৌঁছাবার জন্য কান্নাকাটির যে ভাণ করে তার মধ্যেও সুর চলে আসে। কাঁদতে কাঁদতে ফরিয়াদ করে, ‘দে দে পাল তুলে দে, যাবো আমি সোনার মদিনায়….’। আলামিন দুয়েকবার সংশোধন করে দেবার চেষ্টা করেছে ইমামকে। এসব ওয়াজ গণ্ডগ্রামে চললেও এখানে তা লোক হাসাহাসির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আলামিনের পরামর্শ কূল পায় না। কারণ ওয়াজী ইদ্রিসের পেটে আর কোন বিদ্যা নাই।
অন্যন্য মসজিদের মতো এই মসজিদে দানবাক্স সিস্টেম নাই। শুক্রবারেও এখানে চাঁদার বাক্স ঘোরে না। এটা নিয়ে আলামিনের তেমন কোন আপত্তি না থাকলেও ওয়াজী ইদ্রিস অসন্তুষ্ট। শুক্রবারের এই ইনকাম পুরা সপ্তাহের হাত খরচ। একবার মোতওয়াল্লীর সাথে এক বৈঠকে এটা নিয়ে একটু কথা তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে ওয়াজী ইদ্রিসের চাকরী চলে যাবার অবস্থা হয়েছিল। সেই মুশকিল আসান করার জন্য তাকে অভিনব একটা ফন্দীর আশ্রয় নিতে হয়।
আলামিনের কাছে শুনেছিল এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা কয়েক শতক আগে মোগল আমলের মানুষ। তাঁর পূর্বপুরুষ আরব দেশ থেকে এই দেশে এসেছিলেন।
ব্যস। এই তথ্যের সুত্র ধরে সে এই বংশের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে আরো খোঁজখবর নিতে গিয়ে মোতওয়াল্লীর সাথে আলোচনা করতে বসলো একদিন। আলোচনার নানান কথার সুত্রে মোতওয়াল্লী সাহেব তাদের পূর্ব পুরুষ যে আরব দেশ থেকে এসেছিলেন এবং সেখান থেকে আগত খান্দানী লোকদের সাথে নবীর বংশলতিকার সম্পর্ক সেটা নিয়ে একটু ইঙ্গিত দিলেন। সেই ইঙ্গিতটা ওয়াজী ইদ্রিসের পরিকল্পনাকে আরো ফকফকা করে তুললো। সে তার চিরাচরিত কৌশল প্রয়োগ করে সেখানে আরো নানান সমীকরণ যুক্ত করে এক ঘন্টার মধ্যে মোতওয়াল্লী সাহেবকে দিয়ে স্বীকার করালেন যে তাঁরা আসলে খোদ মহানবীর বংশধর। সেই বংশের মর্যাদা কিভাবে পুনরুদ্ধার করা যায় তার দায়িত্ব যখন ওয়াজী ইদ্রিস নিজেই নিলো, তখন মোতওয়াল্লী সাহেবের তাতে আপত্তি করার কোন কারণ ছিল না। বরং ওয়াজী ইদ্রিসের প্রস্তাব শুনে মোতওয়াল্লী সাহেব চাঁদার বাক্স সংক্রান্ত রাগটা ভুলে গিয়ে নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন এবং তার বেতন আরো দেড় হাজার টাকা বাড়িয়ে দশ হাজারে উন্নীত করলেন। মোয়াজ্জিন হিসেবে আলামিনের বেতনও পাঁচশো টাকা বাড়লো এই উপলক্ষে। সুতরাং সেও ওয়াজী ইদ্রিসের খাট থেকে বিতাড়িত হবার দুঃখটা খানিক মোচন করতে সক্ষম হলো।
সামনে ঈদে মিলাদুন্নবী। মুসলমানদের নবী এই দিনে জন্মেছিলেন বলে সুন্নী মুসলমানেরা দিনটা বেশ আনন্দ উৎসবের সাথে পালন করে। শহরে বিশাল জশনে জুলুশের মিছিল বের হয়। সব মসজিদে বিশেষ আয়োজন থাকে। এবারের মিলাদুন্নবী কাজীবাড়ির জন্য বিশেষ ব্যাপার। মসজিদকে বিশেষভাবে সাজানো হবে সে কারণে। সুদূর অতীতে যে ঐতিহ্য ছিল সেটাকে নতুন করে তুলে এনে পর পর দুই জুমায় ওয়াজ করলো নতুন ইমাম ওয়াজী ইদ্রিস। কাজিবাড়ির পূর্ব পুরুষেরা যে মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, সেই মর্যাদার অংশীদার বর্তমান পুরুষেরাও। কাজিবাড়ির মসজিদ এবং কাজিবাড়ির লোকেরা সেই মর্যাদার দাবীদার। যে মর্যাদা সম্পর্কে তিনি এতকাল অসচেতন ছিলেন, ওয়াজী ইদ্রিস সেটাকে শহরবাসীর চোখের সামনে তুলে আনার কাজে নামলো।
ঈদে মিলাদুন্নবীর সময় সমস্ত মসজিদ সবুজ পতাকায় ছেয়ে গেল। রবিউল আউয়াল মাসের এক তারিখ থেকে রাতের বেলা পুরো মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থান অলিগলি রংবেরং-এর বাতিতে আলোকিত হয়ে গেল। মসজিদের বাইরে আরো চার খানা মাইক লাগিয়ে ওয়াজ শুরু হলো মিলাদুন্নবীর দুদিন আগ থেকে। শহরের লোকেরা আগে এটাকে শুধু ‘কাজিবাড়ি মসজিদ’ নামে চিনলেও এবার শুনতে পেল মসজিদের নতুন নাম - ‘ঐতিহাসিক কাজীবাড়ি শাহী জামে মসজিদ’।
নামের সাথে ‘ঐতিহাসিক’ এবং ‘শাহী জামে’ যুক্ত হওয়াতে কাজিবাড়ির লোকেরা যে বিশেষ তৃপ্ত হলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দানবাক্স চালু না থাকলেও মিলাদুন্নবীর রাতে ভালো চাঁদা উঠলো চাদরে চাদরে ভর করে। এই দিনে দান খয়রাতের সওয়াব কতগুন বেশী সেটা গত দুই জুম্মাতে বোঝাতে গিয়ে অন্য কোন বয়ান করা হয়নি খোতবার সময়ে। মসজিদের উন্নয়নে কাজিবাড়ির লোকেরা বাইরের কোন দান খয়রাত গ্রহন করে না বলে পুরো টাকাটাই ওয়াজী ইদ্রিস আর আলামিনের মধ্যে ভাগ হয়ে গেল ৭০-৩০ অনুপাতে। চাঁদার রুমাল নিয়ে মুসল্লীদের মাঝে চক্কর দেয়া দুই কিশোর অবশ্য পাঁচশো টাকা করে পেল।
প্রথম মিশন সফল হবার পর ওয়াজী ইদ্রিসের কপাল খুলে গেল। প্রত্যেক চন্দ্রমাসের বিশেষ মর্যাদা হিসেব করে একেকটা দিনে নিয়মিত মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতে থাকে সে। যথারীতি রুমাল চাদর ঘুরে মিলাদের মধ্যে। সওয়াবের সুযোগ গ্রহন করে মুসল্লীরা দশ বিশ টাকা দিয়ে। প্রত্যেক ওয়াজে পঞ্চাশ থেকে একশোবার ‘ঐতিহাসিক কাজীবাড়ি শাহী জামে মসজিদ’ এবং নবীর বংশধর উচ্চারিত হয় এবং মর্যাদা বুঝে কাজিবাড়ির লোকদের নাম উচ্চারণ করে দোয়া পড়া হয়। কাজিবাড়ির লোকদের দরকার সওয়াব, ওয়াজী ইদ্রিসের দরকার টাকা। দুই পক্ষই সন্তুষ্ট হলো এই ব্যবস্থায়। কিন্তু তাদের কেউ খেয়াল করেনি, শিক্ষিত শ্রেণীর লোকেরা ওয়াজী ইদ্রিসের অশিক্ষিত বয়ানের উৎপাতে এই মসজিদে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। কমিটির তাতে কোন লাভক্ষতি নেই। তবে শিক্ষিত শ্রেণী কমে যাওয়াতে মওলানা খুশী। শিক্ষিত লোকদের এমনিতেই অপছন্দ ওয়াজী ইদ্রিসের, তারা ওয়াজের মর্ম বোঝে না। অশিক্ষিত মুসল্লীরাই হলো ওয়াজের মূল সমঝদার।
সুখের সময় যখন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন একদিন আচানক নতুন বিপদ এসে উপস্থিত হলো। সারা পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস আক্রমণ করেছে। বাংলাদেশেও মহামারীটা এসে পড়েছে। মাত্র কয়েকশো আক্রান্ত হয়েছে, তবু সরকার স্কুল কলেজ অফিস আদালত সব বন্ধ করার পর মসজিদে নামাজ পড়াও নিষিদ্ধ করলো।
লকডাউনের কয়েক সপ্তাহ আগ থেকে শোনা যাচ্ছিল এরকম কিছু হতে পারে। তখন থেকে ওয়াজী ইদ্রিস সতর্ক অবস্থানে গিয়ে কঠোরভাবে হুংকার দিয়ে বলতে শুরু করে -’নাউজু বিল্লাহ। সব ইহুদি নাসারার চক্রান্ত। মুসলমানকে কখনো এসব করোনা স্পর্শ করতে পারে না। কারণ মুসলমানেরা পাঁচ ওয়াক্ত অজু করে। ইসলাম হলো পবিত্র ধর্ম। সেখানে কখনো কোন জীবাণু ঢুকতে পারবে না। আল্লার ঘর মসজিদে কোন ভয় নাই। আপনারা ওসব গুজবে কান দেবেন না ভাইসব। আমাদের সাথে আল্লা আছে। ঠিক কিনা বলেন?’ মুসল্লীরা অবশ্য কোন জবাব না দিয়ে ঝিমধরা মুরগীর মতো বসে থাকলো।
সত্যি সত্যি যখন লকডাউন ঘোষণা করা হলো বাজ পড়লো ওয়াজী ইদ্রিসের মাথায়। এতকাল আজান দিয়ে সবাইকে মসজিদে আহবান করা হতো। এবার আজান দিয়ে লোকদের বলতে হবে - আপনারা কেউ মসজিদে আসবেন না। কেয়ামতের বাকী নাই। কী দিন এসে গেল! মুসল্লী না আসলে আল্লার ঘর কাঁদবে। সে কান্নার শব্দ শুনে আল্লার আরশ কেঁপে উঠবে। হায় মুসলমান। কোথায় তোমাদের ঈমানের জোর! সব ইহুদি নাসারার ষড়যন্ত্র। প্রকাশ্যে এসব কথা কাউকে বলারও উপায় নাই। আলামিনই একমাত্র শ্রোতা। সরকারের ঘোষণা শুনে খোদ কাজিবাড়ির লোকেরাই মসজিদে আসা বন্ধ করে দিল। দুজনে মিলে জামাত করতে হবে! কী লজ্জার কথা। মাটিতে মিশে যায় ওয়াজী ইদ্রিস। আলামিন লা জওয়াব হয়ে আছে। এমন দশা সে কল্পনাও করেনি কোনদিন। মসজিদে নামাজ না হলে তার চাকরী থাকবে কিনা সেটা নিয়ে বেশী চিন্তিত হয়ে পড়লো।
প্রথমে মনে হচ্ছিল সপ্তাহখানেক বন্ধ থাকবে। বড়জোর পনেরদিন। কিন্তু দেখতে দেখতে মাস পার হয়ে গেল তবু খোলার নাম নাই। মহামারীটা ছড়াতে ছড়াতে চট্টগ্রামেও এসে গেল। ভয়ানক আতঙ্কিত জনপদ। রাস্তায় কারফিউর মতো অবস্থা। মধ্য দিবসেও রাস্তায় কাকপক্ষী নেই। কারফিউ হরতালের দিন যেন। রাতের বেলা এত নিস্তব্ধতা কুতুবদিয়ার গণ্ডগ্রামেও দেখা যায়নি। ওয়াজী ইদ্রিস ভেঙ্গে পড়েছে। আলামিন ভাবলো গ্রামে চলে যাবে কিনা। কিন্তু যাতায়াতের সব ব্যবস্থা বন্ধ। গাড়িঘোড়া জাহাজ নৌকা কোথাও কিছু নেই। বেতনটা এখনো দিয়ে যাচ্ছে কাজিবাড়ি থেকে। কিন্তু বাকী সব দাওয়াত মিলাদ মাহফিল বন্ধ। নিজের টাকা দিয়ে চলতে হচ্ছে পুরোপুরি। বাড়িতে পাঠানোর জন্য তেমন কিছু থাকে না। এসবের মধ্যে আলামিনের কাজটা সবচেয়ে কষ্টকর। তাকে আজান দেবার জন্য ঠিকই উঠে যেতে হয় অন্ধকার থাকতেই। ভোর হবার অনেক আগে উঠে অজু করে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আজান দেবার পর আবারো বলতে হয় - ‘সম্মানিত মুসল্লীবৃন্দ, করোনা ভাইরাস নামক মহামারীর কারণে জনসমাগম এড়াতে, বর্তমান সরকারের নির্দেশের প্রতি সম্মান দেখাতে মসজিদে না এসে বাসাতেই নামাজ আদায় করার জন্য আপনাদের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাইতেছে।’
কথাগুলো বলতে আলামিনের কী পরিমান কষ্ট হতো তা ওয়াজী ইদ্রিস বাদে আর কেউ বুঝবে না। প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করতে আলামিনের বুক ফেটে যেতো। মাঝে মাঝে মাইকের মধ্যে উচ্চারিত শব্দগুলো কান্নার মতো শোনাতো। তবু গৎবাধা বুলিগুলো প্রবল অনিচ্ছার মধ্যে মাইকে জানাতে হতো দিনের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ দুগুনে দশ বার।
সবচেয়ে কষ্ট হলো শবে মেরাজ এবং শবে বরাতের সময়। এই দুটো দিন মুসলমানদের বিশেষ ইবাদতের দিন এবং সওয়াব হাসিলের সুযোগ। মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিনরা এই দিনে দানবাক্সে বিশেষ হাদিয়া পেয়ে থাকে। এবার দুটো দিবসই গেল একেবারে খালি হাতে। আশেপাশের বস্তি থেকে দুচারটা বাচ্চা এসেছিল মিলাদের জিলাপির লোভে। কিন্তু জিলিপি নিয়ে কেউ আসেনি। শুকনো মিলাদ পরানো হলো ভেজা কান্নাকাটি দিয়ে।
সাধারণত মিলাদে হুজুরের কান্নাকাটিগুলো মেকি হলেও এবারের কান্না ছিল সহি। আয় উন্নতির সব পথ বন্ধ করে করোনা নামক অভিশাপ বুকের ভেতরে ঘা মেরেছে সেজন্য ওয়াজী ইদ্রিস আকুল হয়ে কাঁদলো। মুখে বললো, আল্লার ঘর কাঁদছে মুসল্লীদের জন্য। কবে এই মসজিদে আবারো সিজদা দেবে আল্লার বান্দারা সেই আশায় হাত পেতে আছে দরবারে। আলামিনের চোখও ভিজে গেল হাত তুলে মোনাজাত করতে গিয়ে । বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারেনি গত মাসে। মায়ের হাত খালি। গাড়িঘোড়া বন্ধ কিভাবে যাবে। নৌপথে কোন ব্যবস্থা করে যাবার চেষ্টা করতো, কিন্তু গেলে আর কবে ফিরতে পারবে, ফিরে আসলে চাকরী থাকবে কিনা সে জানে না। এই ভয়েতে বাড়ির কথা ভুলে থাকলো আলামিন। মসজিদে আজান দিতে গিয়ে কান্না চলে আসে তার।
দেখতে দেখতে রমজান মাস এসে গেল। মনে পড়লো গত রোজায় ইফতারী দেবার জন্য ওয়াজী ইদ্রিস এলাকাবাসীকে কতভাবে আহবান করেও বশ করতে পারেনি। এবার ইফতারী দূরে থাক, মুসল্লীই নাই। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী তারাবী পড়তে হবে চারজনকে নিয়ে। শুরুতে যখন মসজিদে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তখন সারা দেশে দৈনিক দেড়শো দুশো মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল। এখন তো হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিদিন। এরকম চললে গোটা বছরটাই বন্ধ থাকবে মসজিদ। ভাবতে গিয়ে হু হু করে উঠলো আলামিনের বুক। ওয়াজী ইদ্রিস কোথাও চলে গেছে তাকে নামাজের দায়িত্ব দিয়ে। মুসল্লী বিহীন মসজিদে নামাজ পড়ানোর কোন আরাম নাই। কিন্তু আলামিন কী নামাজ পড়াবে। সরকার চারজনকে নিয়ে নামাজ পড়তে বলেছে। বাকী তিনজন যোগাড় করতেও হিমশিম খায় প্রতি ওয়াক্তে । অনেক বুঝিয়ে পাশের বস্তি থেকে এসির ঠাণ্ডা বাতাসে নামাজ পড়ার লোভ দেখিয়ে তিনজনকে ভিড়িয়ে আনলো। ফজরের সময় তো কাউকে পাওয়া যায় না। তখন সবার আরামের ঘুমের সময়। সে ঘুম পাড়ানোর জন্য স্বয়ং শয়তান জড়িত। সে কারণে ফজরের আজানে একটা বাড়তি লাইন যোগ করা হয়েছে ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ অর্থাৎ ‘ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম’। কিন্তু এমনিতেই সব শয়তানের চেলা, ফজরের নামাজে লোক পাওয়া যায় না, আর এখন তো নিষিদ্ধ সময় চলছে। আজান দিয়ে মুখস্থ সরকারী ঘোষণাটা রোবটের মতো মাইকে উচ্চারণ করে একা একা নামাজ সেরে নেয় সে। তারপর টানা ঘুম। কদিন ধরে ওয়াজী ইদ্রিস গায়েব থাকাতে তার খাটে ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছে সে। রোজার দিনে সেহরী খেয়ে নামাজ পড়ার পর আর কোন কাজ থাকে না। বেকার সময় কাটে না বসে থাকতে থাকতে। একটা রেডিও টেলিভিশন থাকলেও কিছু সময় কাটানো যেতো।
রোজার এক সপ্তাহ পার হতেই ওয়াজী ইদ্রিস ফিরে এলো এক বিকেলে। কোথায় ছিল, কী করতে গিয়েছিল, কিছুই বললো না। এসেই জানালো সুখবর আছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে সরকার মসজিদ খুলে দিচ্ছে। সেই সাথে দোকানপাট মার্কেট। আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছে অবশেষে। আল্লার উপর বিশ্বাস রাখতে হয় বুঝলি আলামিন!
হেদায়েত করলো সুযোগ পেয়ে। কিন্তু আল্লার উপর বিশ্বাস বন্ধক রেখে এই কদিন কোথায় গায়েব ছিল সেটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না আলামিনের। গত কদিন খাটে শুয়ে আরামে ঘুমিয়েছিল সেটা আর হবে না, ভাবতেই তেতো হয়ে উঠলো তার মন। মসজিদের রুমাল চাঁদার ভাগ নিয়ে ওয়াজী ইদ্রিসের সাথে মন কষাকষি চলছিল আগ থেকেই। নিজের ভাগটা ৩০% থেকে বাড়িয়ে ৪০% করার জন্য আলামিন বেশ কিছুদিন পীড়াপীড়ি করছিল। তাছাড়া মসজিদে কোরান শিক্ষার আসরটা আবার চালু হলে তাতে আধাআধি ভাগ চায় আলামিন। ওয়াজী ইদ্রিস কোন প্রস্তাবেই রাজী ছিল না।
এখন তার হাতে একটা সুযোগ এসেছে। সে এবার বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিল খাট পালঙ্কে ঘুমানো বিষয়ে। ছেঁড়া মশারি আর দুর্গন্ধময় চৌকির বিছানায় শুতে আলামিন রাজী নয় আর। বিশেষ করে গত কদিনের অনুপস্থিতিতে আলামিন নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে কাজি পরিবারের কর্তাকে বশ করে। সেটা প্রকাশ পেলো রাতে শোবার সময়।
খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানা করার সময় ওয়াজী ইদ্রিস পাশের চৌকিতে গিয়ে শুতে বললো আলামিনকে। কিন্তু আলামিন ঘাড় বেঁকিয়ে মোতওয়াল্লী সাহেবের নতুন নির্দেশের কথা জানিয়ে দিল ইদ্রিস মওলানাকে । মোতওয়াল্লী সাহেব বলেছেন নতুন একটা সিঙ্গেল খাট কেনা হবে মুয়াজ্জিনের জন্য। তার আগ পর্যন্ত দুজনকে এই বিছানা ভাগাভাগি করতে হবে। আলামিনের কথার সুর আর চোখের বাঁকা চাহনী থেকে ওয়াজী ইদ্রিস বুঝে গেল গত কয়েকদিনের অনুপস্থিতির খেসারত এটা। আপাতত মাতব্বরী খাটবে না এখানে। বেজার মুখে শুয়ে পড়লো এক পাশে।
রমজানের শেষভাগটা ভালোই কাটলো। প্রতিদিন মুসল্লীদেরকে সওয়াব অর্জনের উত্তম সুযোগ গ্রহন করার জন্য প্রলোভন এবং গরীবের হক আদায় না করার শাস্তির ভয় দুটোই দেখানো হয়। পবিত্র রমজানে দান ছদকার চেয়ে উত্তম কিছুই হতে পারে না।
ফলে রমজানের প্রথমার্ধে মসজিদে তেমন কেউ ইফতারী না পাঠালেও দ্বিতীয়ার্ধে আস্তে আস্তে পাঠানো শুরু করে। কিন্তু পরিমানে কম দেখে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলো ওয়াজী ইদ্রিস। আলামিনকে নতুন ঘোষণা দেবার নির্দেশ দিলেন তিনি। সেই ঘোষণায় বলা হলো - ‘আপনাদের পাঠানো ইফতারী এলাকার দীন দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে, সুতরাং আপনারা বিকেল চারটার মধ্যে ইফজার সামগ্রী পৌঁছে দেবার চেষ্টা করিবেন’।
দীন দুঃখীর কথা বলার পরদিন থেকে ইফতারের পরিমান বেড়ে গেল। মনে মনে ওয়াজী ইদ্রিসের বুদ্ধির তারিফ করলো আলামিন। এত খাওয়ার লোক নাই মসজিদে। মসজিদে জামাত বন্ধ হবার পর থেকে সত্যিকারের দীন দুঃখীরা বেশীরভাগ হাট বাজারের দিকে চলে গেছে। মসজিদে লোক না থাকলেও বাজারে লোকের ভিড়। লকডাউন সময়ে লোকজন খালি খায় আর ঘুমায়।
শবে কদরের রাত আসার আগ থেকে ওয়াজী ইদ্রিস প্রতি ওয়াক্তের সময় মাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে শুরু করেছে এই দিনের বিশেষ ফজিলত সম্পর্কে। এই দিনটা পাওয়ার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় মানুষকে। এই দিনে কোরান নাজিল হয়েছিল। মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র দিন। এই দিনে এবাদত করলে হাজার রাতের সওয়াব পাওয়া যাবে। এই দিনে দান করলে হাজারগুন ফেরত পাওয়া যাবে। মুসল্লীরা সবাই যেন এই দিনে মসজিদে হাজির থাকে এবং পকেটে করে যথেষ্ট ‘নগদ’ নিয়ে আসে।
পকেটে ‘নগদ’ নিয়ে আসার এই ঘোষণাতে আলামিন মৃদু আপত্তি করেছিল ওয়াজী ইদ্রিসের কাছে। কারণ এভাবে কোন মসজিদে খয়রাত চাওয়া ঠিক না। ইমাম মোয়াজ্জিনের ইজ্জত থাকে না। কিন্তু ওয়াজী ইদ্রিস ঠোঁটকাটা। সে বুঝে গেছে পাবলিকের পেটে গুঁতো না দিলে টাকা বের হয় হয় না। পাবলিক দশবিশ টাকা দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। শুধু তাই না জুমার খোৎবার আগে সে ঘোষণা দিল কেউ যদি খতম শেষ হবার আগে ভাগেও টাকাটা দিতে চায় তাতেও কোন সমস্যা নাই। কারণ খোদাতালা মানুষের নিয়তের উপর ভিত্তি করে পুণ্য বিতরণ করে। সেই সাথে এও বলা হয়েছে শবে কদরের পবিত্র রাতে খতম তারাবী সমাপ্ত হবে। সে উপলক্ষে দান করার আরো বড় সুযোগ আছে। সেখানে ন্যুনতম অংকটাও বলে দেয়া হলো এক ফাঁকে- ‘খেয়াল রাখবেন আপনারা সবাই চেষ্টা করবেন খতমের জন্য কমপক্ষে ৫০০ টাকা করে যেন দিতে পারেন। বেশী দিলে তো কথাই নাই। আল্লার দরবারে পৌঁছে যাবে আপনার দানশীলতার কথা।’
আলামিন এবার একটু আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখলো। মোতোয়াল্লীকে জানিয়ে এমন ব্যবস্থা করলো যেন সমান সমান ভাগ পায় দুজনে। পবিত্র শবেকদরের রাতে রুমালী চাদরে বেশ ভালো টাকা উঠলো। আলামিন কল্পনাও করেনি এই মসজিদে একদিনে পঞ্চাশ হাজার টাকা উঠতে পারে। সেই টাকা দুই হাফেজ এবং ইমাম মোয়াজ্জিনকে সমান সমান অংশ দেয়া হলো। প্রত্যেকে দশ হাজার টাকা করে পেল। বাকী টাকা মসজিদের অন্যন্য খুচরা কর্মীদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হলো।
দুই হাফেজ ভাগের টাকা বুঝে নিয়ে চলে যাবার পর আলামিন ঘরে ফিরে টাকাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। আনন্দ আপ্লুত হয়ে আছে মনটা। এই প্রথমবার ওয়াজী ইদ্রিসের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো সে।
কিন্তু আলামিনের জন্য ব্যাপারটা যতটা সুখের- ওয়াজী ইদ্রিসের কাছে ব্যাপারটা ততই মনঃকষ্টের। তার ওয়াজের কারণেই এতগুলো টাকা উঠলো অথচ সে বাড়তি কিছুই পেল না। আলামিনের সমান টাকা দেয়া হলো তাকে, এটা সে কিছুতে মেনে নিতে পারলো না। মোতওয়াল্লীকে কিছু বলার সাহস নেই, তাই ঝালটা সে আলামিনের উপর ঝাড়ার উপায় খুঁজতে থাকলো।
ঈদের ছুটিতে আলামিন বাড়ি যাবার আবদার করেছিল। তাকে ছুটি দেয়া হলো। কিন্তু ওয়াজী ইদ্রিস ছুটিতে গেল না। জানালো সে ছুটি কাটিয়ে এসেছে আগে। এখন আলামিন ঘুরে আসুক। দীর্ঘদিন সে বাড়িতে যায় না। তার মা ছেলের মুখ দেখতে আকুল।
আলামিন দেরী না করে ঈদের পরদিন সকালেই কুতুবদিয়াগামী একটা নৌযানে চড়ে বসলো। কতদিন পর এই পথে যাত্রা করছে ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন করছে। গ্রামে যায়নি গত ছমাস। চিরচেনা এই সমুদ্রপথকে মনে হচ্ছে অচেনা কোন যাত্রা। বেশী যাত্রী নেই নৌকাতে। ভেতরে পাটি বিছানো থাকলেও অধিকাংশ যাত্রী ছাদে। সমুদ্র গরম থাকে এই ঋতুতে। সমুদ্রপথে যাতায়াত এই সময়ে নিরাপদ নয়। একটানা গরগররর শব্দে ইঞ্জিনের নৌকাটা চলছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আকারে মোটামুটি বড় হলেও উত্তাল ঢেউয়ের নাচনে নৌকাটাকে কলার মোচার খোলের মতো তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু এই পথে অভ্যস্ত যাত্রীরা এসবে গা করে না। নৌকার ঢালু ছাদেও নির্বিকার আড্ডাবাজি করে যাচ্ছে।
আলামিনও এই পথের অভ্যস্ত যাত্রী, তবু আজ তার ভয় করছে। ভয়ের কারণ আকড়ে ধরা ব্যাগের মধ্যে থাকা আঠারো হাজার টাকার বাণ্ডিলটা। এত বড় অংক সে কখনো দেখেনি। তার পরিবারে কখনো এতগুলো টাকা একসাথে আসেনি। মায়ের হাতে সবগুলো টাকা তুলে না দেয়া পর্যন্ত তার ভয় করবে। কেউ কেড়ে নেয় যদি। পথে পড়ে যায় যদি। নৌকাডুবি হয় যদি। এরকম অনেকগুলো যদির সমষ্টি তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। বরাবর সে ছাদের খোলা বাতাসে বসে যাতায়াত করলেও এখন সে জড়ো সড়ো হয়ে বসে আছে কাঠের নৌকার ভেতরের অন্ধকার কোণটিতে। ধুঁকতে ধুঁকতে নৌকাটা অবশেষে নিরাপদেই পৌঁছে গেল কুতুবদিয়া জেটিতে। ঘাটে নেমে রিকশায় উঠে আলামিন নিশ্চিন্ত। বাড়ি পৌঁছাতে আর কোন সমস্যা হলো না।
দুই সপ্তাহ পরিবারের সাথে আনন্দে পার করে শহরে ফিরে এল আলামিন। এবার সে নতুন একটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে। যদিও অনেকদিন পর গ্রামে গিয়ে আরামে কাটানোর কারণে তাকে একটু আলসেমিতে পেয়ে বসেছে। বিশেষত ফজরের আজান দেয়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য। তার অনুপস্থিতিতে নতুন যে ছেলেটা আজান দিতো, মাঝে মাঝে ফজরের আজানের কাজটা তাকেই দেয়া হচ্ছিল। ছেলেটার গলা ভালো হলেও দ্বীনি পড়াশোনা কিছু নেই। তবে সরকারী ঘোষণাটা সে ভালোই পড়তে পারে।
আলামিন ছুটিতে যাবার পরে সরকারী ঘোষণার ভাষাটা একটু বদলে দিয়েছে ওয়াজী ইদ্রিস। আলামিনের এখনো মুখস্ত হয়নি সেটা। ‘বাসা থেকে অজু করে, মাস্ক পরে, তিন ফুট দূরত্ব মেনে সামাজিক দূরত্ব রেখে নামাজ পড়তে হবে…..’ এরকম কিছু অংশ যোগ করা হয়েছে আগের ঘোষণার সাথে। যেটা পড়তে গিয়ে একটু গুলিয়ে ফেলে আলামিন। পুরোনো ঘোষণাটাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন, কোনমতে সামলে নিয়ে আবার পড়েছে। নাকাল হওয়া থেকে রক্ষা পেতে সে আজান দেবার পর ঘোষণাটা নতুন ছেলেটাকে দিয়ে পড়ায়।
আলামিনের এই ছোটখাট ব্যর্থতার খবরগুলো ওয়াজী ইদ্রিস কাজিবাড়ির যথাস্থানে পৌঁছে দেয় যত্ন করে। তবু আলামিনের বিরুদ্ধে কোন জোরালো অভিযোগ দাঁড় করানো সম্ভব হয় না।
সেদিন আছরের নামাজের আজান দেবার জন্য দাঁড়িয়েছিল আলামিন। দুপুরে খাওয়া সেরে ঘন্টাখানেকের ভাতঘুমের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল ছুটির সময়। জোর করে ঘুম তাড়িয়ে উঠে এসেছে। আজান দিতে দাঁড়িয়ে ঘুমের রেশ তাড়াতে জোর চেষ্টা করে সে। সে জানে নামাজের সময় ঘুম ডেকে আনা শয়তানের কাজ। কিন্তু ঘুমের চেয়ে নামাজ অবশ্যই উত্তম। আজানের সুর টানতে টানতে বোধহয় আনমনা হয়ে পড়েছিল একটু। শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার তাগিদেই হয়তো আজানের মাঝখানে তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল - “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম….”
এটুকু বলেই আলামিন থতমত খেয়ে গেল। সে তো আছরের আজান দিচ্ছে, কিন্তু ভুল করে ফজরের আজানের অংশ পড়ে ফেলেছে। নাউজুবিল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ! সে নিজেই শয়তানের কবলে পড়ে গিয়েছিল। আজানের বাকী অংশ কোনমতে শেষ করে মাথা নীচু করে জিব কাটতে কাটতে মনে মনে তওবা করতে করতে বেরিয়ে এলো আজান ঘর থেকে।
কিন্তু সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। ওয়াজী ইদ্রিস এটার অপেক্ষায়ই ছিল। আলামিনের চাকরির কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিল সে।
ওই রাতেই এশার নামাজের পর আলামিনের ডাক পড়লো কাজিবাড়িতে।
***
পরদিন দুপুরে আলামিনকে দেখা গেল কুতুবদিয়াগামী নৌকার ছাদে - মাত্র পনের দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো এই পথে। ফজরের নামাজের পরপর মসজিদ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সে। উপকূল থেকে মাইলখানেক দূরত্ব বজায় রেখে কাষ্ঠ নির্মিত নৌযানটি চলছে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ দিকে। ডানদিকে অসীম সমুদ্র দিগন্তে বিলীন। সেই দিগন্ত থেকে আলামিনের স্বপ্ন, আশা, মগ্নতা, বৈকল্য, অবসাদগ্রস্থতার এক জগাখিচুড়ি দরিয়ার কালো ঢেউয়ের মতো দিগভ্রান্ত হয়ে নৌযানের প্রবল ঘুর্ণায়মান পাখনায় খাবি খেতে থাকে। উত্তাল ঢেউ এসে মাঝে মাঝে্ই বেসামাল ধাক্কা দিচ্ছে নৌকার তলায়। সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় উড়ছে আলামিনের খুচরো দাড়ি। মাথার টুপিটা খুলে নেবার পর চুলগুলোও উড়তে থাকলে মাথায় একটা আরামদায়ক সুড়সুড়ি বোধ হয়।
একটা মাছ ধরার বড় ট্রলার পাশ দিয়ে ভটভট করে চলে যাবার সময় ঢেউয়ের ধাক্কা এসে পড়লো নৌকার উপর। সেই ধাক্কাটা আলামিনের এতক্ষণের নির্জীব অনুভূতির উপর ঘষা দিলে তার মনে পড়ে গেল বিশেষ ব্যাপারটা। চোখ বন্ধ করে ব্যাগের ভেতর হাত গলিয়ে সোনার চুড়ি দুটোর অস্তিত্ব অনুভব করলো সে। এক জোড়া চুড়ির জন্য সালমার সাথে তার বিয়েটা আটকে ছিল। সালমার বাবার শর্ত ছিল এক জোড়া সোনার চুড়ি দিতে হবে পাত্রকে।
ওয়াজী ইদ্রিসের কাছ থেকে চুড়ি দুটো সংগ্রহের পন্থাটা বৈধ কি অবৈধ ছিল- এখন সেটার চেয়ে সালমার গোলগাল মাখনের মতো চেহারাটা ভাবতেই বেশী ভালো লাগছে তার।
মন্তব্য
একটু পড়বো ভেবে শুরু করেছিলাম। শেষ না করে থামতে পারলাম না। সমসাময়িক বাস্তবতার দারুণ ভাষ্য। অবশ্য সাবলীল ভাষার কারণে ‘প্রায় চিত্রায়ণ’ হয়ে উঠেছে।
মানুষের মানবিক সীমাবদ্ধতার ফাঁদে যে কেউ পড়তে পারে। বাহ্যিক লেবাস যা-ই হোক না কেন। এই সহজ সত্যটা না বুঝে, আমরা লেবাসের মাহাত্ম্যে আক্রান্ত হয়ে অনেক সময়ই ভুল জায়গায় সম্মান জানিয়ে ফেলি। এমনকি মানুষের শিক্ষাগত জ্ঞানের উচ্চতার সাথে তার ব্যাক্তিগত সততার গভীরতার যে কোন সম্পর্কই নেই, এটা বুঝতে জীবনের দীর্ঘ সময় পার করে ফেলেছি।
আপনার লেখায় সেতাই আরেকবার প্রতিফলিত হতে দেখলাম। খুব ভালো লাগলো।
তাই প্রথমে অনুভূতি জানানোর লোভটা সামলাতে পারলাম না। হোম অফিসের কিছু সুবিধা তো নিতে হবে!
স্বরূপ-সন্ধানী
---------------------------------------
অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালো
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
মানবিক সীমাবদ্ধতা থেকে আমরা কেউ বাইরে নই। তার উপর একই মানুষের ভেতর কয়েক রকমের মানুষের বসবাসের কারণে আমাদের সমাজে সাধু আর চোর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এত দীর্ঘ গল্প ধৈর্য ধরে পড়তে পেরেছেন সেজন্য অনেক ধন্যবাদ স্বরূপ-সন্ধানী।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সেই ত, মানুষকে ত তার সীমাবদ্ধতা নিয়েই চলতে হয়। কি করে সে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সীমাবদ্ধতাই জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই গল্প লিখতে গিয়েও সীমাবদ্ধতার যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
একশোতে একশো গল্প, একটানে পড়ে ফেললাম!
..................................................................
#Banshibir.
সর্বনাশ একশোতে একশো!! দুয়েক নাম্বার মার্জিনের বাইরে রাখা দরকার ছিল না?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ সাক্ষী
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
বাহ্ !!!! গল্পটা খুব ভালো লাগলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা সোহেল ইমাম
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
পুরো গল্পটা বর্তমানকে খুব ভালভাবে ফুটে উঠেছে।লেখকের জন্য শুভ কামনা রইলো।
অধীতি
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ অধীতি। শুভকামনা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আগেও বোধহয় পড়েছি
নতুন মন্তব্য করুন