ছাত্রজীবনে একদা বিক্ষিপ্তভাবে ডায়েরি লিখতাম। স্কুল পাশ করে কলেজে ওঠার পর পৃথিবীর নানান দিকে চোখ খুলতে থাকে। বিচিত্র সব ভাবনারা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতো। সেগুলো কখনো ডায়েরি, কখনো চিরকুট, কখনো পুরোনো খাতার শেষদিকে লিপিবদ্ধ হতে থাকে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই। বলে রাখা ভালো- আমি বারো ক্লাস পর্যন্ত বিজ্ঞানের ছাত্র থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু হয় বাণিজ্যের পথে। কিন্তু বিজ্ঞানের ভুত আমার পিছু ছাড়েনি কখনোই। সেই সময়কার একটা অদ্ভুত ভাবনার চিরকুট। এই যুগে এসেও প্রাসঙ্গিক কিনা ভাবছিলাম।
পুরোনো চিরকুট থেকে:
এখনো পর্যন্ত পৃথিবী ছাড়া মহাবিশ্বের আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। যদিও বিজ্ঞানের দেখার চোখ এখনো অতি সীমিত। মহাবিশ্বের অতি সামান্যই দেখেছে মানুষ। তবে সৌরজগত এবং আশপাশের নক্ষত্রজগতে মানুষের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিমান টেলিস্কোপ চষেও এখনো কোথাও প্রাণের নড়াচড়া মেলেনি। বিপুল বিশাল নিষ্প্রাণ মহাজগতের মধ্যে প্রাণে ভরপুর পৃথিবী যেন একটা আচমকা দুর্ঘটনা। ভীষণ বিরল প্রায় অস্বাভাবিক একটি ব্যাপার। পৃথিবীতে প্রাণের সূত্রপাতকে অস্বাভাবিক বলতে হচ্ছে কারণ জগতে সংখ্যাগরিষ্ঠের রীতিনীতিই প্রতিষ্ঠিত সত্য বলে ধরে নেবার নিয়ম। এখনো পর্যন্ত জানা জগতের প্রায় সবটুকুই যখন নিষ্প্রাণ, সেটাই জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। হঠাৎ করে একটি জায়গায় প্রাণ সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিক। পৃথিবীতে প্রাণের সূত্রপাত হওয়াটাকে অস্বাভাবিক প্রকৃতিবিরুদ্ধ ঘটনা বললে এই গ্রহের প্রাণীজগতের বিরুদ্ধবাদী বলে অভিযুক্ত হতে হবে কিনা জানি না। কিন্তু এই বিরল ব্যাপারটি মহাবিশ্বের আর কোথাও ঘটেছে কিনা সেটা জানার জন্য মানবজাতিকে হয়তো আরো বহুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু প্রাণের প্রচলিত সংজ্ঞাটাকে কী পুরোপুরি বিশ্বজনীন বলা যাবে? আমাদের সাধারন চোখে প্রাণ মানে হলো জীবন। প্রাণের হিসেবে আমাদের চেনা জগত দুই ভাগে বিভক্ত। জীব এবং জড়। জীবনের প্রাণ আছে, জড় পদার্থের প্রাণ নেই। কিন্তু জড়পদার্থের প্রাণ নেই কথাটা কতটা সত্যি? প্রাণ বলতে আমরা যাকে বুঝি সেটা জীবের প্রানস্পন্দন, জীবকোষের গতিপ্রকৃতি, বংশবিস্তারের ক্ষমতা। আমরা ধরেই নিয়েছি জীবকোষের কর্মপ্রক্রিয়াই হলো প্রাণ।
এই বদ্ধমূল ধারণটা বদলে যেতে পারে যদি আমরা পদার্থের অনুপরমাণুর ভেতরের ইলেকট্রন প্রোটনের কর্মপ্রক্রিয়াকে প্রাণের অস্তিত্ব হিসেবে গণ্য করি। সাধারণ জ্ঞানে আমরা বুঝি নিষ্প্রাণ মানে নট-নড়নচড়ন, কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা। জগতের কোন কাজে তার ভূমিকা না থাকা। কিন্তু পদার্থের অভ্যন্তরভাগ কী সেরকম? শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে জগতের সবকিছুই নড়ছে, এক মুহুর্ত বসে নেই। পদার্থের সুক্ষ্ণ কণাগুলো ক্রমাগত ঘুর্ণনের মধ্যে থাকে। সেই ঘুর্ণন অতি সুক্ষ্ণ, নির্দ্দিষ্ট, নির্ধারিত, প্রবলভাবে রুটিনবদ্ধ। গঠন অনুযায়ী যে পদার্থের কণা যেই গতিতে ঘোরার কথা সেই গতিতে ঘুরছে। কোন ব্যতিক্রম নেই। তাহলে সেই পদার্থগুলোকে নিষ্প্রাণ বলা যায় কী?
একথা ঠিক যে জগতজুড়ে যতসব অপ্রাণ বস্তু আছে তারা বংশবিস্তার করে না। কিন্তু কেউ চুপচাপ স্থির বসে নেই। সবাই ঘুরছে চরকির মতো। এই ঘুর্ণনকে যদি আমরা প্রাণের উচ্ছ্বাস হিসেবে দেখি তাহলে সমস্ত মহাজগত নিষ্প্রাণ কথাটি মানা যায় না। প্রাণ সর্বত্রই আছে, সেই প্রাণের চেহারা আলাদা। যা কিছু সঞ্চারমান তাহাই প্রাণ। আমাদের চেনা জগতে এমন কোন পদার্থ কী মিলেছে যার মধ্যে ইলেকট্রন প্রোটনের এই ঘুর্ণন নেই? মেলেনি। তাহলে মহাবিশ্ব প্রাণহীন এই কথাটি বোধহয় সঠিক নয়।
আমাদের জানা জগতের মৌলিক পদার্থের মোট সংখ্যা আমরা জানি। তাদের ধর্ম, চরিত্র সবই মোটামুটি জানি। কিন্তু এর বাইরে আর কোন মৌলিক পদার্থ আছে কিনা, আমাদের চেনা জগতের বাইরে বহুদূরের কোন গ্যালাক্সিতে নতুন কোন চরিত্রের পদার্থ থাকলেও তো থাকতে পারে। অজানা জগতের সবটা না জেনে সেই সংখ্যাটাই যে চরমভাবে সত্যি তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। অজানা জগত থেকে নতুন চরিত্রের নতুন কোন মৌলিক পদার্থের কথা জানা যেতে পারে। আমরা পদার্থের যে চরিত্রগুলোর কথা জানি সে চরিত্র থেকে ওটা ভিন্ন কিছুও হতে পারে। পদার্থের গঠন সম্পর্কে আমরা এখন যা জানি, তখন সেটা বদলেও যেতে পারে। অজ্ঞাত সেই জগত নিয়ে কোনরূপ অনুমান সম্ভব নয়। কিন্তু অজ্ঞাত জগত থেকে অজানা তথ্য উদ্ভাসিত হবার সম্ভাবনাকে আমরা নাকচ করে দিতে পারি না।
[জুন ১৯৯২]
মন্তব্য
হয়ত!
কৌতুহলি চিন্তাভাবনা। তবে প্রাণের ব্যাপারে আপনার চিন্তাটার ঝামেলা হইলো আপনি প্রাণকে শুধু ঘূর্ণন বা নড়নচড়নে আটকে রেখে ভেবেছেন যে সবকিছুতে প্রাণ আছে, কারন ইলেক্ট্রণ ঘূর্ণায়মান। প্রাণের সংজ্ঞা দেয়াটা কিছুটা কঠিন হলেও শুধু নড়াচড়ায় কেউ আটকে রাখেনাই। একটা স্বয়ম্ভর ব্যবস্থা যা বংশবৃদ্ধি করতে পারে এবং ডারউইনিয় বিবর্তন মেনে চলে - এমনটা বললে প্রায় সম্পূর্ণভাবে প্রাণকে বোঝা যায়। এখানে শুধু পরমাণুর অভ্যন্তর না, আরও কয়েক স্তরের জটিলতা আছে। পরমাণুর পর্যায় জৈব অজৈব ভাগ করা যায়না, সেটা তো জানেনই। যখন অণুর পর্যায়ে আসে তখন কিছু অণু যদি সংয়সম্পূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে যারা বংশবৃদ্ধিতো করতে পারেই, তার ওপর সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে তাদের প্রাণ আর বাকিসবকে অপ্রাণ বলা চলে। সেই হিসেবে পৃথিবীর বাইরে আমরা এখনও প্রাণের সন্ধান পাইনাই। তবে জৈবাণুর হদিস পাওয়া থেকে লোকে ধারণা করছে যে অন্যকোথাও ও পৃথিবীর মতো প্রাণ তৈরি সম্ভব। মনে রাখা দরকার, প্রাণের সংজ্ঞাটা পৃথিবীর প্রাণের ওপর ভিত্তি করে দেয়া।
আমি আরেক ঝামেলার কথা ভাবছি। অন্য জায়গার প্রাণের জীয়নকাঠি আর গঠন হয়তো আমাদের মতো নাও হতে পারে। কার্বন-ভিত্তিক প্রাণ হওয়াট খুব স্বাভাবিক হলেও (কার্বন অণুর গুণের কারনে) জিনগত উপাদান, দৈহিক গঠন ডিএনএ আর প্রোটিন-স্নেহ না হলে অবাক হওয়ার কিছুই নাই। ঝামেলা মনে করছি অন্য জায়গায়, পৃথিবীর সংজ্ঞার ভিত্তিতে অন্যজায়গার প্রাণকে আমরা নাকচ করে দিতে পারি কিনা।
আমার কাছে যেটা ঝামেলাজনক মনে হচ্ছে তা হল - "প্রাণ" জিনিসটাই একটা পার্থিব ধারনা বা প্রত্যয়। সুতরাং যেখানেই আপনি এটা প্রয়োগ করতে বা খুঁজতে যান না কেন, সেটা পৃথিবীর সংজ্ঞার ভিত্তিতেই করতে হবে। এই সংগার বাইরে অন্য সিস্টেমকে আপনি যদি প্রাণ বলতে চান তাহলে আপনাকে হয় সম্পূর্ণ নতুন সংগা সৃষ্টি করতে হবে, ইন ফ্যাক্ট সেটাকে "প্রাণ" না বলে হয়তো একটা নতুন নামই দিতে হবে!!
****************************************
এটাই মুশকিলের কথা। প্রাণ নিয়ে আমাদের বর্তমান ধারণাটা আমাদের জগতকেন্দ্রিক। অন্য একটা জগতে সেটা এরকম নাও হতে পারে। এখনো পর্যন্ত মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের জানার পরিধি অতি সীমিত। মানুষ আলোর গতিতে ভ্রমণ করতে পারলেও অন্য কোন গ্যালাক্সি দূরে থাক এমনকি নিজের গ্যালাক্সিতেও অনুসন্ধান করতে পারবে না এই আয়ুষ্কাল নিয়ে। কিন্তু আরো কয়েকশো বছর পর সেটা অসম্ভব থাকবে না হয়তো। আর কিছু না হোক বর্তমানে নাসার কাছে মহাকাশ দেখার যেসব যন্ত্র আছে সেই প্রযুক্তির আরো অনেক উন্নতি ঘটবে নিশ্চিতভাবেই। তখন হয়তো এসব অতিকল্পনাগুলোর চেয়েও বিচিত্র কোন সত্য আবিষ্কৃত হয়ে যাবে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
বিচিত্র কোন সত্য আবিষ্কৃত নিশ্চয় হবে । কিন্তু প্রানের উদ্ভব এবং বিকাশের জন্য পারিপার্শ্বিক মানদণ্ড কোনটা? যেহেতু শুধু আমাদের জগতেই প্রানের উদ্ভব এবং বিকাশ হয়েছে, তাই বিজ্ঞানীরা এই জগতের উপর ভিত্তি করেই মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান করছেন । অন্য কোন পরিস্থিতিতে প্রাণের উদ্ভব হবে কিনা অথবা হলেও সেই নিয়ামকগুলো কেমন হতে পারে তার কোন যৌক্তিক ব্যখ্যা আছে কি?
নাজমুছ ছাকিব
নতুন মন্তব্য করুন