আগের একটি পোস্টে লিখেছিলাম যে, জাপানে সব শিল্পপণ্যতেই একটা অতিরিক্ত যত্বের ছাপ দেখা যায় যেটা উৎকর্ষবাদীতার একটা লক্ষণ। আরো যে জিনিষ দেখা যায়, সেটা হলো যে কোন বর্ণনার ক্ষেত্রে ডিটেইলিঙের পরিমান। সামান্য একটা কথাকেও এরা অত্যন্ত বিস্তারিত ভাবে উপস্থাপন করে - যে কোন অনভিজ্ঞ লোকও সেটা সহজেই বুঝতে পারবে।
যেমন, কিছুদিন আগে একটা বুলেট ট্রেন (শিংকানসেন) লাইনচ্যূত হয়েছিল ভয়ঙ্কর এক ভুমিকম্পের সময়ে। সাধারণত ভূমিকম্প এলেই লাইনের ভিত্তি বা খুটিগুলোথেকে ভূ-পৃষ্ঠের অনেক গভীরে প্রবেশ করানো সেন্সর থেকে সেটার খবর পেয়ে যায় একটা যন্ত্র এবং সেই খবর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐ লাইনে চলাচলকারী এবং কম্পনের উৎসের কাছাকাছি বুলেট ট্রেনে পৌছিয়ে যায়, ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেনের ব্রেক চালু হয় এবং সেটা থেমে যায়। এই বিশেষ ট্রেনটা লাইচ্যূত হওয়ার কারণ হলো ভূমিকম্পটার উৎসের খুব কাছে হওয়াতে সময় না পাওয়া। যখন ট্রেনে খবর পৌছালো, প্রায় ৩০০-৩৫০ কি.মি./ঘন্টা বেগে চলমান ট্রেন তখন থামা শুরু করেছে। আর সবচেয়ে দ্রুত হারে থামতে হলেও সেই প্রক্রিয়াতে সময় লাগে কিছুক্ষণ। ট্রেনটি যখন লাইনচ্যূত হয় (শুধু লাইন থেকে চাকাগুলো পাশে নেমে গিয়েছিলো) তখন এর গতিবেগ ছিল ১০০ কি.মি./ঘন্টা এর মত। পুরা ব্যাপারটাকে সংবাদে এ্যাত বিস্তারিত দেখানো হল যে আমার মত জাপানী-নাবুঝদেরও বুঝতে তেমন সমস্যা হয়নি। খবর বয়ানের পাশাপাশি এ্যানিমেশনের মাধ্যমে পুরা প্রক্রিয়াটা - ভূমিকম্প থেকে শুরু করে, এর সেন্সর, খবর, ব্রেক, লাইনচ্যূতি - দেখানো হল। সাথে সমস্ত তথ্যও। এর সাথে সাথে একজন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ভূমিকম্পের মূল ব্যাপার, এর বিভিন্ন রকম তরঙ্গ ও ওগুলোর গতিবেগ ইত্যাদি বিষয় সহজ ভাষায় এবং চিত্র ও এনিমেশনের সাহায্যে বুঝিয়ে দিল।
আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে, এটি আমার দাদাবাড়ীর। ওখানে সেচকাজের জন্য অনেক দাম দিয়ে জাপানি ইয়ানমার মেশিনযুক্ত পাম্প কেনা হয়েছিলো। একই সময়ে চীনের ডংফেং মেশিনের দামের চেয়ে এটা ৩ গুন বেশি দামী। কিন্তু চাচার কাছে শুনলাম যে এই ইয়ানমার মেশিন চলছে এখনও, যেখানে ডংফেং কিনেছিলো যারা তাদের পাল্টাতে হয়েছে কয়েকবার। কারণ, ইয়ানমারে একটা কিছু সমস্যা দিলে এটার বিকল্প আরেকটা ব্যবস্থা মেশিনের মধ্যেই করা আছে ইত্যাদি।
শেষ যে ঘটনাটা বয়ান করছি সেটা আমাদের বাসার। বাসায় গ্রামের একটা ছেলে থাকতো। কাজ করতো। ও একটু বড় হওয়ার পর ওকে এস.ও.এস. স্কুলে ট্রেড কোর্সে ভর্তি করা হল। সফলভাবে ওটা সম্পন্ন করার পর ৬ মাস এটলাস বাংলাদেশে (হোন্ডার ডীলার) শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ করল। তারপর, চাকরী পেল মেনোকা মটরস-এ। এই কম্পানী ভারতের বিভিন্ন মটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ এনে দেশে সংযোজন করে। ওর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা হলো, প্যাঁচ কাটা। ও হোন্ডার আন্দাজে ক্রু টাইট দিতে গিয়ে প্যাঁচ কেটে ঢুকে গেল - খালি হাতেই ক্রু-ডাইভার চালিয়েছিল। ধাতুর মানে এতটাই পার্থক্য।
জাপানের মাঙ্গা খুব বিখ্যাত। এগুলো কার্টুনের বই। যে কোন কাহিনীই এখানে ছবিময়। ফলে ব্যাপারটা ভিজুয়ালাইজ করা যায় সহজে।
শিরোনামে সমস্যা বলেছিলাম। কেন সেটা বলি -
সবকিছু এ্যাত সহজে পাওয়া অভ্যাসে পরিনত হওয়াতে এদের জটিল জিনিষ বোঝার ক্ষমতা মারাত্নকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ডিটেইলিং ছাড়া নিজ বুদ্ধি খরচ করে কোন জিনিষ এরা বুঝতেই চায়না। বাঙালীকে যেমন ক বললেই কলিকাতা বা কলা বা কমলা -- ঠিকভাবেই বুঝে নেয়। ওদের ক্ষেত্রে ক বললে তো হবেই না, কলা বললেও হবে না, কলার ছবি এঁকে পাশে লিখে তারপর মুখে বলে দিতে হবে। চাই কি, ছবিতে একটু কলার ফ্লেভার/গন্ধও যোগ করে দিতে হতে পারে!
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ২য় কিংবা ৩য় বর্ষে এসে শিখলাম বিব-কক। এটা হলো পানির কলের ইঞ্জিনিয়ারিং নাম। যে কোন বইয়েই বিব-কক (bib-cock) লেখা থাকে। ট্যাপ লিখলে স্যারগণ মাইন্ড করে। অবশ্য এতে আমেরিকা ব্রিটেনের ইংলিশ গ্যাঞ্জাম থাকতে পারে (পীচ আর অ্যাসফল্ট আদতে একই জিনিষঃ পার্থক্য হলো পীচ ব্রিটিশ টার্ম আর অ্যাসফল্ট আমেরিকান টার্ম)। আমার কথা বিশ্বাস না হইলে গুগলে bibcock লেখে একটু ইমেজ সার্চ দিয়েন (সেফ সার্চ)। এই আনকমন টার্মটা সাধারণ মানুষ না জানলেও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙের সকল ছাত্র এবং পেশাজীবি জানেন বলেই আমার ধারণা ছিল। Guess what? আমার থিসিসের পরীক্ষক (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙের জাপানি প্রফেসর) ওটা জানেন না!
স্মৃতি মনে করে মেজাজ খারাপ করার আগেই লেখা বন্ধ করলাম।
(একই সাথে খিচুড়ী ব্লগেও প্রকাশিত)
মন্তব্য
হ, ওই দিয়াই বাইঁচা আছি।
------ooo0------
বিবর্ণ আকাশ এবং আমি ...
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
বক্তব্য পরিষ্কার না .... আমিও মুখে তুলে খেয়ে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছি
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
জাপানের প্রেমে পড়েছেন মনে হচ্ছে????
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
জাপানীরা আসলেই বস। টয়োটার ডিজাইন সাকসেস পড়তে গিয়ে তাদের সেট বেজড ডিজাইন পড়েছিলাম। প্রতিটা স্টেপ এতো ডিটেইলে করে যে কি হলে কি হতে পারে সব তাদের নখদর্পনে। তাই তাদের ডিজাইনে প্রাথমিক খরচ বেশী থাকলেও এক্সেলেন্ট গাড়ি তৈরী করার কারনে পরে তা পুষিয়ে যায়।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
থিসিসের প্রতিটি স্টেটমেন্টের সাথে এখন ফিগার দিয়ে বুঝাতে হচ্ছে ...
যাউগ্গা, গতকাল মেজাজ খুব খারাপ থাকলেও, টয়োটার মত ব্যবসা-সফল হতে এই কষ্ট করতে রাজি আছি
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
ভাল লাগলো। পড়তে ভালই লাগে, কিন্তু বাঙ্গালি জড়তা তো কাটবার না!
বিনয়ের অবতার যেন!
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
জার্মানরা মনে হয় পুরা উলটা।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
ধন্যবাদ; জানা থাকলো। কখনো জার্মান কারো সাথে পেশাগত বা অপেশাগত কোন কারণে যোগাযোগ বা ভাব বিনিময় করতে হলে ব্যাপারটা মাথায় রাখবো।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
অফ-টপিক: উৎকর্ষবাদিতা শব্দ নতুন পেলাম। উৎকর্ষতা বোঝাতে?
_____________________________
জিকোবাজি | ফটো গ্যালারি | ইমেইল
Perfectionism এর একটা পরিভাষা দরকার ছিল।
Perfectionist কথাটার পরিভাষা উৎকর্ষবাদী করলে হয়তো ঠিক খাপে-খাপ হয়না। কিন্তু এর চেয়ে যুৎসই কিছু লেখার ঐ মুহূর্তে খুঁজে পেলাম না।
পরিভাষা জানা থাকলে অকাতরে দান করার জন্য উন্মুক্ত আবেদন রইল।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
Boss, can't logon here due to some technical probs ... So, writing comments as Otithi ...
Great!! Congrats!!!
Main 'Pulsirat' is crossed safely, I guess.
Japanese detailing is so boring sometimes ... They start a TV manual with 'first, set the plug into the the consent on your wall' ....hahahahaha
-Mukit
অরূপ বা এস.এম৩ কে পত্রাঘাত করুন (মেইল দেন)। আপনার লেখা দেখতে চাই এখানেও
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
হাহ হাহ!!
জাপানীরা আসলেই ইউনিক!!
আমার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। অনেকেই হয়ত জানেন ব্যাকটেরিয়ার নাম অপরিবর্তনীয়। কিন্তু এরা সেটারও পরিবর্তন করে ফেলছে জাপানীতে তরজমা করতে গিয়ে। যেমন: ভিবরিও প্যারাহেইমোলাইটিকাস (পেটের ট্রাবলের জন্য দায়ী, বিশেষ করে শুসি জাতীয় খাবার খেলে) কে এরা বলে দাই চো কিন!!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
নতুন মন্তব্য করুন