সারসংক্ষেপ: ক্রমবর্ধিষ্ণু চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পানিসরবরাহের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর থেকে যে পরিমান পানি সংগ্রহ করা হয়, স্বাভাবিক উপায়ে সেটা পূরণ বা পূণঃসঞ্চিত হয় না। ফলশ্রুতিতে পানির স্তর নিচে নেমে বিভিন্নরকম অসুবিধার সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটি উপায় হল ভূ-গর্ভে কৃত্রিম উপায়ে পানি সঞ্চিত করা যেন তা পানি সংগ্রহে হারানো পানির অভাব পূরণ করে। এই প্রবন্ধে কৃত্রিম উপায়ে ভূ-গর্ভে পানি সংগহ করার উপায়ের উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় শব্দ তালিকা: পানিস্তর, পূণঃসঞ্চয়ী কূপ, পানি সঞ্চয়
পরিভাষার তালিকা: Aquifer – পানিস্তর; Underground – ভূ-গর্ভ; Groundwater recharge – ভূ-গর্ভে পানিসঞ্চয়; Reservoir – জলাধার; Recharge well – পূণঃসঞ্চয়ী কূপ
ভূমিকা
ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় নিত্যব্যবহার্য পানির মূল উৎস ভূ-গর্ভস্থ জলাধার বা আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার। কিন্ত অতিব্যবহারে এই প্রাকৃতিক জলাধার শূন্য হতে চলেছে এবং পানির স্তর আরও গভীরে চলে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে পানিস্বল্পতার কারণে এবং পানিস্তরের গভীরতা বৃদ্ধিজনিত ব্যয়বৃদ্ধির কারণে এই উৎস হতে পানি সংগ্রহ হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
মনে হতে পারে যে কোন জলাধার থেকে পানি নিলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ভূ-গর্ভের প্রাকৃতিক জলাধারের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণ হল যে পরিমান পানি এখান থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে সেই পরিমান পানি স্বাভাবিকভাবে এতে সঞ্চিত/সংগৃহীত হতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
এ ধরণের প্রাকৃতিক সম্পদের (Resource) ক্ষয় (Depletion) কারো কাম্য নয়। এই ক্ষয় রোধকল্পে এই পানিস্তর থেকে পানি সংগ্রহের পরিমান এতে পানি সঞ্চিত হওয়ার হারের সমান অথবা এর চেয়ে কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। দৈনন্দিন জীবনে পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প ব্যবস্থা না করে পানি সংগ্রহের পরিমান কমানোও প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া পানি সংগ্রহের পরিমান কমিয়ে দিলেও একাজে ব্যবহৃত স্থাপনাগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকবে যা সম্পদের অপচয় হিসেবেই গণ্য হবে। তাই, বর্তমান পানি সংগ্রহের পরিমান না কমিয়ে বরং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে পানি সঞ্চয়/সংগ্রহের পরিমান বাড়ানোর উপায় বিবেচনা করা প্রয়োজন।
এই প্রবন্ধে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে পানির সঞ্চয়ের উপায় হিসেবে কৃত্রিমভাবে ভূ-গর্ভে পানিসঞ্চয় (Artificial groundwater recharge) বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
ভূ-গর্ভস্থ প্রাকৃতিক জলাধারের বৈশিষ্ট
ভূপৃষ্ঠের গভীরে বালু বা এর চেয়ে বড় আকারের মাটির কণার স্তর রয়েছে। এই কণাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে অনেক ফাঁকা জায়গা (Pore space) থাকে। এই জায়গাগুলোতেই পানি সঞ্চিত থাকে যা নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলন করা যায়। সাধারণত বালুর স্তরগুলোতে আয়তনের শতকরা ৩৫-৪০ ভাগ জায়গা ফাঁকা থাকে যা পানি দিয়ে পরিপূর্ণ ভর্তি থাকে। এই জলাধারে প্রাকৃতিক ভাবে বিভিন্ন উপায়ে পানি সংগৃহীত হয়। এই ভূ-গর্ভস্থ পানিবাহী স্তরের সঞ্চিত পানির একটি মূল উৎস হল ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত জলাশয় (নদী, খাল, পুকুর ইত্যাদি) থেকে চুঁইয়ে আসা পানি। যে অঞ্চলে পানি সংগৃহীত হয় সেখানকার আশে পাশের অঞ্চলের পানিধারী স্তর থেকে পানি প্রবাহিত হয়ে আসে। এছাড়া, বৃষ্টিপাতের পানি, সেচের পানি ভূ-পৃষ্ঠে আসার পর উপরের মাটির স্তরগুলো ভেদ করে ধীরে ধীরে চুঁইয়ে নিচের স্তরে জমা হয়।
ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্য
বিভিন্ন কারণে ভূ-গর্ভস্থ স্তরে কৃত্রিমভাবে পানি সঞ্চিত করা হয়। যেমন -
কৃত্রিমভাবে ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয় করার উপায়
মূলনীতি
ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চিত করতে হলে প্রথমত ভূমির উপরে জমানো পানি থাকতে হবে এবং জমানো পানিকে ভূ-গর্ভে পৌছাতে হবে। জমানো পানির উৎস হিসেবে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম জলাশয় ব্যবহৃত হতে পারে। এছাড়াও বন্যার পানি কৃত্রিম জলাশয়ে জমিয়ে রেখে কিংবা প্রবাহিত নদী/খালের নাব্যতা বাড়িয়ে ওখানে পানি জমিয়ে এ কাজ করা যায়। তাছাড়া জলীয় পয়ঃবর্জ্য বা সুয়ারেজের পানি পরিশোধন করেও এ কাজে ব্যবহার করা যায়। বৃষ্টিপাত বা অন্য কোন উপায়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে সেই পানিকেও ভূগর্ভে পাঠানো যেতে পারে।
এ কাজে প্রাথমিক বাঁধা হিসেবে আছে আমাদের ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি এলাকায় মাটির স্তর বিন্যাস। ভূ-পৃষ্ঠের গভীরে অবস্থিত পানিধারক স্তর এবং ভূ-পৃষ্ঠের মাঝে পানি কুপরিবাহী এক বা একাধিক স্তর থাকতে পারে। পানি কুপরিবাহী স্তরগুলো সাধারণত খুব ক্ষুদ্র মাটিকণা দিয়ে তৈরী, সাধারণ ভাবে ওগুলোকে কাদা বা এঁটেল মাটি বলা হয়। সাধারণ অবস্থায় এই স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে পানি সঞ্চালনের হার অত্যন্ত কম। কাজেই ভূ-পৃষ্ঠে থাকা অতিরিক্ত পানিকে ভূ-গর্ভের পানিধারক স্তরে পৌছানোর জন্য এই সকল বাঁধা অতিক্রম করানোর মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।
এছাড়াও ভূপৃষ্ঠের পানি ভূ-গর্ভে পৌছে সঞ্চিত হওয়ার পেছনে অপর বাঁধা হল ভূ-স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে পানি সঞ্চালনের ধীর গতি। ফলে যে সময়ে সামান্য পরিমান পানি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ভূ-গর্ভে সঞ্চালিত হয়, সেই সময়ের মধ্যেই বৃষ্টিপাত বা অন্য উপায়ে আসা পানি গড়িয়ে কোন নালা/খাল/নদী দিয়ে চলে যায়। ফলে উদ্দিষ্ট জায়গায় ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চিত হতে পারে না।
পদ্ধতিসমূহ
নিম্নলিখিত বিভিন্ন উপায়ে ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয় বৃদ্ধি করা যায়।
বিবেচ্য বিষয়সমূহ
পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতি
যে সকল এলাকায় ভূ-গর্ভের পানিস্তর এবং ভূ-পৃষ্ঠের মাঝে একটি পুরু অপ্রবেশ্য স্তর থাকে সেসকল এলাকার জন্য এবং যে সকল এলাকায় জলাশয় তৈরীর মত যথেষ্ট জায়গা নেই সেসকল এলাকায় ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের জন্য পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতিটি সবচেয়ে লাগসই উপায়। এই পদ্ধতিটি নলকূপ দিয়ে পানি তোলার পদ্ধতির মতই। শুধুমাত্র নলকূপ দিয়ে পানি তোলার পরিবর্তে পানি ভূ-গর্ভে প্রবেশ করানো হবে।
এই পদ্ধতিতে যথেষ্ট দ্রুত ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয় করা যায়। তবে ফিল্টার পাইপ কোন কারণে বন্ধ হয়ে গেলে সঞ্চয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। চিত্র-১ এ পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতির সরল/সাধারণ রেখাচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে একটি নলকূপ ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর (aquifer) পর্যন্ত স্থাপন করা হয়। সাধারণ নলকূপের মতই সেই স্তরে ছাঁকন বা ফিল্টার পাইপ দেয়া হয়। শুধুমাত্র নলকূপের উপরের প্রান্তে পানি প্রবেশের জন্য হ্যান্ডপাম্পের বদলে আরেকটি ফিল্টার পাইপ লাগাতে হবে। প্রচলিত ধারণায় নলকূপের উপরের অংশে পানি তোলার জন্য স্থাপিত হ্যান্ডপাম্পটিকেই নলকূপ/টিউবওয়েল হিসেবে অভিহিত করা হয় – যেটা আদৌ সঠিক নয়। আসলে হ্যান্ডপাম্পের নিচের অংশে মাটির ভেতরে স্থাপন করা সম্পুর্ন পাইপ ও ফিল্টার পাইপগুলো একত্রে নলকূপ বা টিউবওয়েল গঠন করে।
পূণঃসঞ্চয়ী কূপের প্রবেশ অংশে পানি আসার আগে বিশুদ্ধতার স্বার্থে কয়েকটি পরিশোধন ধাপ পার হয়ে আসবে। সঞ্চয়ের জন্য সংগৃহীত পানির উৎস অনুযায়ী পরিশোধনের প্রয়োজনীয়তাও ভিন্ন হবে।
এছাড়া ফিল্টার বন্ধ হওয়া রোধ করার জন্য
কোথায় স্থাপন করা যেতে পারে
কোন জলাশয়ের পানি সঞ্চয়ের উপযুক্ত গুণাগুণ সম্পন্ন হলে পূণঃসঞ্চয়ী কূপগুলোকে জলাশয়ের মাঝেও দেয়া যায়। সরাসরি জলধারার মাঝে না দিয়েও ইনটেক অবকাঠামো বানিয়ে পাইপযোগে সঞ্চয়কূপের কাছে পানিকে নিয়ে আসা যায়।
শুধু বন্যার সময় জলমগ্ন হয় এমন এলাকায়ও এ ধরণের পূণঃসঞ্চয়ী কূপ স্থাপন করা যেতে পারে। এতে সুবিধা হল যে, অসুবিধা সৃষ্টিকারী অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হবে এবং পাশাপাশি সেটা ভবিষ্যতের প্রয়োজনে সম্পদ হিসেবেও সংরক্ষিত করা হবে।
ঢাকা শহরের যে সকল এলাকায় বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয় সে সকল এলাকায় এরকম পূণঃসঞ্চয়ী কূপ স্থাপন করলে এতে পানি আসার পথে কয়েকটি বালু/পাথরের ফিল্টার এবং সবশেষে সামান্য জীবানুনাশক দিলেই কাজ হবে বলে মনে হয়। এতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য অতিরিক্ত স্টর্ম সূয়্যারের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে।
ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের সুবিধাসমূহ
ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের অসুবিধাসমূহ
উপসংহার
টেকসই উন্নয়নের জন্য অতিব্যবহারে ভূ-গর্ভের প্রাকৃতিক জলাধার শূন্য হওয়া এবং পানির স্তর আরও গভীরে চলে যাওয়া রোধ করা দরকার। এজন্য ভূ-গর্ভের পানির বদলে ভূ-পৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটা অনেকক্ষেত্রেই অসম্ভব কারণ যেমন সবসময় ভূ-পৃষ্ঠের পানি পাওয়া যায় না তেমনি ভূ-গর্ভের পানি সংগ্রহের জন্য ইতিপূর্বে স্থাপিত স্থাপনা গুলো অকেজো হয়ে পড়ে সম্পদের অপচয় ঘটাবে। তাই কৃত্রিমভাবে ভূ-গর্ভে পানির সঞ্চয় বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
দেশে শুষ্ক এবং বৃষ্টির সময় প্রাপ্ত পানির পরিমাণের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে বিপুল পরিমান পানি বন্যা আকারে চলে যায়। এই পানিকে সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করার জন্য বড় বড় জলাশয়ের স্থান সংকুলান করা সম্ভব নয়, তাই এজন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে পানি সঞ্চয়/সংগ্রহের পরিমান বাড়ানোর উপায় বিবেচনা করা প্রয়োজন।
কৃত্রিমভাবে পানি সঞ্চয়ের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতিটি সহজবোধ্য এবং কম জায়গাতে করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে খুব দ্রুত পানি সঞ্চয় করা যায়, ফলে অতিবর্ষা বা বন্যার পানি সরে যাওয়ার আগেই সেখান থেকে যথেষ্ট পরিমান সঞ্চয় করা সম্ভব। তাই এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়।
পূণঃসঞ্চয়ী প্রকল্পের উদাহরণ
ভারত
[url=http://www.vatten.goteborg.se/prod/va/dalis2.nsf/vyFilArkiv/Artificial%2...$file/Artificial%20groundwater%20recharge.pdf]সুইডেন[/url]
অ্যারিজোনা
তথ্যসূত্র
মন্তব্য
পূর্বপ্রকাশিত পোস্ট জন্য ফ্রন্ট পেজে না দিয়ে শুধু নিজের ব্লগে রাখলাম। কেউ যদি কখনো ঘুরতে আসে .... চোখে পড়লেও পড়তে পারে।
ছাপার উপযোগি সংস্করণ পি.ডি.এফ. ফরম্যাটে ডাউনলোড করতে পারেন দৃষ্টিপাত ব্লগের এই লিংক থেকে।
ধন্যবাদ।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
এভাবে লুকায়ে পাবলিশ করলেন! এগুলাতো মানুষের চোখে আসতে হবে। ভাল হয়েছে।
ধন্যবাদ।
এখানে কপি রাখলাম। প্রথমে দৃষ্টিপাত ব্লগে দিয়েছি। তারপর, আমাদের প্রযুক্তি ফোরামে আর এখানে।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
দেশের বিভিন্ন অংশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে কমছে বলে শুনছি।
আচ্ছা, বাড়ির ছাদ থেকে রেইনপাইপ দিয়ে ভূগর্ভে পানি পাঠানোর কৌশলটিকে কি প্রতিটি বাড়ির নকশায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব?
নতুন মন্তব্য করুন