পায়ের তলায় বিপদ

শামীম এর ছবি
লিখেছেন শামীম (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/০১/২০১১ - ৭:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার দাদাবাড়ির উঠানে একটা ইন্দিরা বা কূঁয়া ছিল। সেই ইন্দিরার বাঁধানো পাড়ে পা পিছলে আছাড় খাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে। শীতের সকালে কূঁয়ার পানি থাকতো কুসুম গরম। এদিকে কেচ্ছা কাহিনী শুনতাম যে রাজার বাড়ির কূঁয়ার ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ থাকতো, যা দিয়ে নদীপথে নৌকায় করে পলায়ন করা যেত আক্রমনের শিকার হলে শেষ উপায় হিসেবে। আমাদের দেশে নাকি মাটির নিচে পানির অভাব নাই, পানির উপর দেশ ভাসতেছে। হাকলবেরি ফিনের গল্পেও আমাজান নদীতে ভাসমান দ্বীপের কথা পড়েছিলাম। দুইয়ে দুইয়ে চাইর মিলাতে সময় লাগে নাই ... ... নির্ঘাৎ আমাদের কূঁয়ার পানিও নদীর সাথে সংযুক্ত, নাইলে এ্যাত পানি আসে কোত্থেকে।

ভাবতাম, বাবারে কী ভয়ের ব্যাপার। মাটির তলায় অমন পানি ছল ছল করলে তো বিপদ। হঠাৎ যদি কোন গর্ত দিয়ে পড়ে যাই তাইলে নদীতে লাশ ভেসে উঠা ছাড়া গতি নাই, কারণ সাঁতার তো পারি না। কাউকে জিজ্ঞেসও করতে সাহস পেতাম না। আবার এই নিয়ে কাউকে ভয় পেতেও দেখতাম না - তাজ্জব ব্যাপার। অনেক দিন লেগেছিলো ঐ ভয় কাটতে। পানির তলে মাটির কণার ফাঁকে থাকা ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যাপার স্যাপার বুঝেছিলাম অনেক বড় হয়ে - আর মনে মনে নিজের বোকামির কথা মনে করে হেসেছিলাম, আজও হাসি।

কিন্তু সেই হাসিও ইদানিং নিজের কাছেই একটু বোকা বোকা লাগছে। কারণ ল্যান্ড সাবসিডেন্স এবং সিঙ্কহোল নামক দুটি বিষয় যা আগে জানা ছিল না।

আমাদের রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখা যায় হঠাৎ করে এক জায়গায় দেবে গেছে। তারপর ওখানে বিরাট গর্ত, সহৃদয় কেউ হয়তো একটা গাছের ডাল পুতে দিয়ে চলাচলকারীদেরকে সতর্ক করেছে। রাস্তার নিচের বালুর স্তর আন্ডারগ্রাউন্ড সুয়ারেজ লাইনের কোন একটা ফাটল দিয়ে ধুয়ে চলে গেলে এমন ফাঁকা জায়গা তৈরী হয় রাস্তার নিচে। রাস্তার নিচে তেমন গভীর বালুর স্তর দেয়া হয় না বলে গর্ত সেরকম বড় হয়না হয়তো। কিন্তু পৃথিবীর সব জায়গায় এমন সহজ হয় না .... আস্ত গাড়ি গিলে ফেলার মত গর্তও হতে পারে এভাবে। আর এমন বড় গর্ত হলে আশেপাশের বাসাবাড়ির ভিতও নাড়িয়ে দিতে পারে। নেট থেকে পাওয়া কয়েকটা ছবি দেখুন।


একই রকম ব্যাপার ঘটতে পারে অন্য জায়গাতেও। মাটির তলে প্রায় সবখানেই পানি আছে, কিংবা অন্তত বৃষ্টির সময়ে পানি যায়, কাজেই নিচের মাটি বা অন্য খনিজ পদার্থ গলে গিয়ে ফাঁকা স্থান তৈরী হতে পারে যে কোনখানেই। স্বাভাবিক উপায়ে এমন না ঘটলেও সুয়ারেজ লাইন থাকলে (এবং তাতে ফুটা থাকলে) গলে যাওয়া পদার্থ সহজেই নিষ্ক্রান্ত হতে পারে।

চায়নাতে কারবারটা দেখেন। একটুর জন্য বেঁচে গেছে এই বাড়িটা। রাতের আঁধারে কয়েকটা ফলগাছসহ হুড়মুড় করে ফুস -

খবরের লিংক

আরেকটু হলেই পুরা তলিয়ে যাইতো এই বাড়িটা:

এই বাড়ির লোকজন অতটা ভাগ্যবান ছিল না:

সর্বপ্রথম এই ব্যাপারগুলো আমার উপলব্ধিতে আসে যেই খবরটা দেখে তা ছিল গুয়েতেমালায় (যারা জানেন না: এটা একটা দেশের নাম, কোন গন্ধযুক্ত শিল্প নহে) হঠাৎ হওয়া একটা বি-শা-ল সিঙ্কহোল। প্রায় ২৫ মিটার চওড়া আর ১০০ মিটার গভীর গর্ত এটা। এটার গভীরতায় দুইটা স্ট্যাচু অব লিবার্টি লম্বাভাবে এটে যাবে এর ভেতরে।

আমাদের দেশেও ঢাকা শহর প্রতি বছর একটু একটু করে ডুবতেছে সেটা মাহফুজ খান (অতিথি) ভাইয়ের একটা পোস্টে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এছাড়া পত্র পত্রিকায়ও মাঝে মাঝে কোনো কোনো এলাকা ৮/১০ ফুট দেবে যাওয়ার খবর দেখি - মূলত আশেপাশে নদী বা জমি থেকে মাত্রাতিরিক্ত বালু আহরন করার ফলে ফাঁকা জায়গা পেয়ে উল্লেখিত জমির নিচের বালুগুলো ঐদিকে ধুয়ে যাওয়ার ফলেই এমন দেবে যায় (রাস্তার গর্তের মত)। এছাড়া খনি এলাকার আশেপাশেও জমি দেবে যাওয়ার সহজবোধ্য খবরও দেখি।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভুমিকম্পে দেবে যাওয়ার আশঙ্কা। ভূমিকম্পের সময় কায়দামত চাপ উৎপন্ন হলে পায়ের তলের মাটিও চোরাবালির মত আচরণ করে। এটার টেকনিক্যাল নাম সয়েল লিকুইফ্যাকশন। এমন হলে বিল্ডিং মাটিতে গেড়ে যায়, ডুবে যায়। জাপানের নিগাতার এই ছবিটা উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া - ভবনগুলোর একদিক অমন ভাবে ডুবে যাওয়াতে পুরা ভবন কাইত।

এ্যাতদিন পর আবার ফুস করে ডুবে যাওয়ার ভয়টা ফেরৎ এসেছে ভেতরে। প্রতি পদক্ষেপেই একটু ভয়, কখন না ফুস ...

--------------------------------------------------------------------------------------
উইকিপিডিয়ায় সিঙ্কহোল (ক্লিক করুন): পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরটা ৬৬২ মিটার গভীর!!
সিঙ্কহোল কেমনে তৈরী হয় তার সচিত্র বর্ণনা আছে এই লিংকে:
লিংক ১
লিংক ২

গুগলে সিঙ্কহোল লিখে একটা সার্চ দিলে অনেক ছবি দেখা যায়।


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ভয়াবহ ব্যাপার! মাহফুজ খানের পোস্টটা মনে আছে। বিষয়টা পুনরায় আলোকাপাতের জন্য ধইন্যা। আমেরিকায় শীতকাল পেরিয়ে যাবার মত রাস্তা ঘাটে তুলনামূলকভাবে খুবই ছোট আকারে পটহোল তৈরী হয়। সেগুলো মনে হয় একটু ভিন্ন প্রক্রিয়ায় তৈরী হয়।

পাঁচাইলাম।

কৌস্তুভ এর ছবি

ডরাইলাম! আমেরিকাতেও রাস্তাঘাটে?

শামীম এর ছবি

গুগলের লিংকটার বেশিরভাগ ছবিই মনে হয় আমেরিকার - রাস্তাঘাটের ছবিও আছে। কিছু আছে নির্মান কাজের ত্রুটির কারণে ফুটা - যা এমন ঘটনার পেছনে দায়ী। আর কিছু আছে প্রাকৃতিক। যেমন ডেনভারের কাছে সকালে ড্রাইভে গিয়ে এটা আবিষ্কার হল। ছবির উপরের ডান কোনায় গাড়ির আকার দেখলে এই গর্তটার বিশালত্ব বোঝা যায়!

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

এরকম না। আরো ছোট। এবং ফর্মেশনটাও ভিন্ন। এখানে একটা ভিডিওতে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা আছে।

http://www.dot.state.mn.us/information/potholes/index.html
http://en.wikipedia.org/wiki/Pothole

শামীম এর ছবি

হ্যাঁ বোঝা গেল। হাটাহাটি করার সময় অন্তত ওগুলোতে ফুস হওয়ার চান্স নাই।

Potholes can grow to feet in width, though they usually only become a few inches deep, at most. If they become large enough, damage to tires and vehicle suspensions occurs. Serious car accidents can occur as a direct result, especially on motorways where vehicle speeds are greater. They are frequently almost invisible to drivers.

পটহোলে উপরের দিক থেকে মালমশলা হারাতে থাকে। আর সিঙ্কহোলে এই ঘটনা ঘটে চোখের আড়ালে - সাধারণত সবশেষে ফুস্ হওয়ার সময় দেখা যায়।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

তবে একবার ইন্ডিয়ানাপলিস থেকে ডেইটন, কলম্বাস হয়ে পিটসবার্গ আসার পথে এক পটহোলে ধড়াম করে আছাড় খাইছিল গাড়ি। আমার নতুন গাড়ির পেন্টুল খুলে যেতো আরেকটু হলে। ভয়ে রাস্তার শোল্ডারে গাড়ি থামিয়ে দেখতে নেমেছিলাম। সে যাত্রা কিছু হয়নি যদিও, তাও একটু ভয়ে ভয়ে থাকি।

কৌস্তুভ এর ছবি

চায়না, জাপান, গুয়াতেমালা - কোত্থাও যামু না!

igol এর ছবি

http://www.youtube.com/watch?v=DPL4guf4BV4

হে হে হে আমেরিকাতেও আছে। আমার তো মনে হচ্ছে এটা আরো বড়!

শামীম এর ছবি

বাংলাদেশ মূলত: পাললিক ভূমি। গলে যাওয়ার মত কিছু থাকলে সেটা পলি হিসেবে অধঃক্ষিপ্ত হইতো না। তাই এখানে ঐদিক দিয়ে একটু নিরাপদ মনে করা যায়।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ সয়েল লিকুইফ্যাকশন পড়েছিলাম, কিন্তু তার এমন ভয়াবহ বাস্তব উদাহরণ আছে জানতাম না। ভয়ংকর অবস্থা। অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ

অপ্রাসঙ্গিকঃ যদিও আগে থেকে জানতাম যে পানির উপরে ভাসছি, তবুও সে অনুভূতি হতনা কখনও। কিন্তু একবার মারাত্মক জ্বরে পড়েছিলাম। তখন ঘোরে খালি মনে হত যে দুলতেছি নৌকার উপরে। যেকোন মুহূর্তে তলায়ে যাব। ইয়ে, মানে...

-অতীত

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ঢেবে যাওয়ার কথা শুনেছিলাম আগে। এখন তো ছবি দেখিয়ে পুরোপুরি ভয় ধরিয়ে দিলেন! মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

খাইসে আমারে! দেশান্তরি হতে হবে দেখছি! সোজা হিমালয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ডেবে যাওয়া দেখে মন খারাপ কোথাওতো বাড়ী বানানোর নীতিমালা মানা হচ্ছে না। যে যেভাবে পারছি তলার উপর তলা গড়ে তুলছি শয়তানী হাসি । কবে আমাদের মতিগতি ঠিক হবে? চিন্তিত এরকম বিপদ যদি আসে, তাহলে কিন্তু ভয়াবহ অবস্থা হয়ে যাবে গোটা ঢাকা শহরে মন খারাপ

আরিফিন সন্ধি

অতিথি লেখক এর ছবি

মাবুদে এলাহী!! -রু

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ শামীম ভাই, বিষয়টি নিয়ে নতুন আঙ্গিকে লেখার জন্য। ঢাকা শহরে যে হারে নিম্নভুমি ভরাট করে বাড়ি তৈরি হচ্ছে তাতে কিন্তু সয়েল লিকুইফেকশনের ঝুঁকি বেড়েই যাচ্ছে দিন দিন, বিশেষ করে ঢাকার পুর্বাঞ্চলে এই ঝুঁকি অত্যান্ত বেশি। আর ঢাকার আশে পাশে ভুমিকম্প উৎপত্তিস্থলের কিন্তু অভাব নেই, যেমন চাঁদপুর, এবং মধুপুর ফল্ট। এটা ধারনা করা হচ্ছে যে ডিফরমেশনাল ফ্রন্ট (বাংলাদেশের পুর্বাঞ্চলের পর্বত শ্রেনীর সম্মুখ ভাগ যা ভূ-অভ্যন্তরে অবস্থিত) এখন চাঁদপুর বরাবর। সাম্রতিক কালে ঐ অঞ্চলে কিন্তু ভুমিকম্প হয়েছে। তাছাড়া মধুপুর ফল্টতো আছেই। কাজেই ঢাকার পুর্বাঞ্চলের হাউজিং গুলো কতটা নিরাপদ খোদা মালুম!

মাহফুজ খান

রানা মেহের এর ছবি

ভয়াবহ ব্যাপার

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।