লোকগুলোর সাথে আমাদের দেখা হয় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সূরা মসজিদে । তিনজন লোক , সবাই মধ্যবয়স্ক । মসজিদের সামনের বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে বসে হয়ত বাতাস খাচ্ছিলেন তারা । আমরা গিয়েছি মসজিদটা দেখতে । অনেক পুরানো ঐতিহাসিক মসজিদ যেটা ঠিক কখন তৈরী হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না । স্থানীয়দের সাথে এ মসজিদটা নিয়ে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হল আমাদের । লোকগুলোকে দেখে আমাদের ভালই লাগল যাক বেশ হল আমারাও ওনাদের সাথে তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেই আর গল্প করি । আমিই প্রথম কথা বলতে শুরু করি তাদের সাথে
-আপনারা কি এই গ্রামেরই ।
-হ্যাঁ , এখানকারই । ঐ পাশে বাড়ী ।
একটা লোক ইশারা করে সবুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওনাদের বাড়ি দেখিয়ে দেয় আমাদের । আমি একজনের হাতে একটা নাইলনের ব্যাগ দেখি ভিতরের কি জানি কুঁ-কুঁ আওয়াজ করছে । কৌতুহল হয় ভিতরে কি আছে জানার । আমি আবার জিজ্ঞাসা করি
-ব্যাগের ভিতরে কি ?
লোকগুলোর মধ্যে একটা কেমন যেন অস্বস্থিভাব দেখতে পাই । একজন মৃদুকন্ঠে জবাব দেয়
-ইঁদুর
বুঝতে বাকি থাকে না লোকগুলো সাঁওতাল আর এরা এগুলো খাওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে । তারপরও জিজ্ঞাসা করি
-এগুলো তো খাবেন তাই না ?
লোকগুলোর মধ্য অস্বস্থিভাবটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে যদিও আমার জিজ্ঞাসা করার মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা ছিল না ।
-হ্যাঁ , খাব । আমরা আদিবাসি ।
মুখ শুকনো করে বলে একজন । তাদের মুখ থেকে আমরা তাদের আসল পরিচয়টা পাই কিন্তু পুরোটা পাইনা । তারা হয়ত এটা বুঝতে শিখেছে সাঁওতাল বলার চেয়ে আদিবাসী বলাটা আমাদের মত ভদ্র পোশাক-আশাক পরা লোকের কাছে অনেকটা শোভন । আমি জিনিসটা আরেকটু নাড়াতে চাই
- সাঁওতাল তাই না ?
-হ্যাঁ ।
লোকগুলোর মুখ আরো শুকনো হয়ে ওঠে । একজন আবার বলে এখন সাঁওতাল আর অন্য সমাজের (পড়ুন হিন্দু বা মুসলমান সমাজ) মানুষের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই , সবাই ক্ষেত-খামারের কাজ করছে একসাথে , আগের মত বন-জঙ্গলও নেই শিকার-টিকারও নেই । আমাদের মত ভদ্রস্থ শার্ট-প্যান্ট পড়ে আসলে নাকি আমরা তাদের চিনতেই পারব না তারা সাঁওতাল আরেকজন বলে । লোকগুলো তাদের গা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাঁওতাল গন্ধ মুছে ফেলতে চায় , যত তাড়াতাড়ি পারে মিশে যেতে চায় সাধারণের মাঝে যাতে তাদের হঠাৎ করে সাঁওতাল বলে তাদের আলাদা করা না যায় । সাঁওতালদের একটা নিজস্ব কৃষ্টি আছে , কালচার আছে । কি এমন কারন যার জন্য একটি সম্প্রদায়কে তাদের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করতে হয় , প্রজন্মকে ভুগতে হয় আত্বপরিচয় বিষয়ক সংকটে ? আমরাও কি এর বাহিরে আছি ?
-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।
মন্তব্য
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এমন আচরণ যেন খুব স্বাভাবিক লাগে আজকাল। আদিবাসী শুনলে যে অনেকে নাক সিটকাবেনা তা তো আমরা বলতে পারিনা। তখন ওদেরই অসুবিধে। এমন ধরনের মানসিকতা হয়তো প্রবাসী বাঙ্গালীদের মাঝেও কাজ করে কিছুটা।
তাইতো অনেকেই দেখি বাঙ্গালীয়ানা ঝেড়ে ফেলতে চায়। পুরোদস্তুর নাগরিক হবার সে কি বাসনা !!!
--------------------------------------------------------
"এমন ধরনের মানসিকতা হয়তো প্রবাসী বাঙ্গালীদের মাঝেও কাজ করে কিছুটা।
তাইতো অনেকেই দেখি বাঙ্গালীয়ানা ঝেড়ে ফেলতে চায়। ""
এজন্যই লিখলাম
"আমরাও কি এর বাহিরে আছি"
ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির কয়লা খনির বিরুদ্ধের আন্দোলনে কাজ করতে গিয়ে ফুলবাড়ী থানার বুকচি গ্রামে গিয়েছিলাম কয়েকবার। অতি দরিদ্র গ্রাম। তিন বেলা খেতেও পায় না। একসময় বন-জঙ্গল কেটে তারা এখানে আবাদ বসতি করেছিল বাঙালিদের সঙ্গে মিলে। আবার বাঙালিদের সঙ্গে মিলেই ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট তারা বিডিআরের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিল। মারা গিয়েছিল তিন বাঙালি কিশোর।
নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে এত ভেদ নাই। বাঙালি-সাঁওতাল সেখানে একাকার।
না, ওপরে একটা কথা ভুল বলেছি, ঐ এলাকাটা আগে সাঁওতালদেরই ছিল। বাঙালিরা পরে এসেছে। শিকার বৃত্তির সাঁওতালরা জমি রক্ষার কলাকৌশল জানে না, তাই এখন অতি সামান্য জমি নিয়ে তাদের চলতে হয়। বেশিরভাগই অন্যের জমিতে মজুরি খাটে। তারপর যখন সেটাও থাকে না, চলে যায় দূর-দূরান্তে। কচ্ছপ, পাখি, ইঁদুর এসব ধরতে। আগে ওদের চায়ের দোকানে ঢুকতে দিত না। অনেক বাদ-প্রতিবাদের পরে এখন পারে কোথাও কোথাও।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
এসব বৈষম্য তৈরী করেছি আমরাই। তাদের মনে বিশ্বাস জাগাতে পারিনি যে আমাদের দিয়ে ওদের কোনো ক্ষতি হবে না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ঠিকই বলেছেন ,আমাদের মাঝে এ বোধটা আরো বেশী করে থাকা উচিত ।
আসলেই কি আমাদের কে দিয়ে ওদের ক্ষতি হয় না ? একটু মনে হয় ভুল হয়ে যাচ্ছে । ওদের জন্য সমস্য কারা তৈরী করছে ? আমরাই তো, তাইনা ? তাহলে কিভাবে বিশ্বাস করবে ?
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
নতুন মন্তব্য করুন