অফিসে নতুন একজন জয়েন করেছে। তার কাছে গিয়ে একটু গুরুগিরি ফলাচ্ছি, এমন সময়েই ফোনটা এল। চিকন মিষ্টি একটা মেয়েকন্ঠ গলায় যতটা সম্ভব মধু ঢালা যায় তার সবটুকু ঢেলে জানাল যে আমার রাত আড়াইটার কোলকাতার ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কক থেকে ফ্লাইটটা ঢাকায় আসার কথা ছিল কিন্তু টেকনিক্যাল অসুবিধার কারনে সেটা আর আজ আসবে না। আমি কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কাল-পরশুর মধ্যে একটা ব্যবস্থা হবে কি না? সে পূর্বাপেক্ষা আরও একটু মধু গলায় ঢেলে বলল, নো স্যার, আপনি চাইলে আট তারিখে যেতে পারেন, আর ফ্লাইটের টাকা রিফান্ড চাইলে আজকে ছয়টার মধ্যে টিকেট ক্যান্সেল করুন। আমার কনফারেন্স আট তারিখে, চার তারিখ রাত্রে আমার হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপার কথা। এরা বলছে আট তারিখের আগে যাওয়া যাবে না। কখন কোলকাতা যাব কখন আর কন্যাকুমারিই বা যাব কখন? মুর্হূতের মধ্যে জীবনটা বিষিয়ে উঠল। এ জীবনে একটা কাজও কি ঠিকঠাক হবে না!
ব্যক্তিগতভাবে আমি সন্দেহবাতিকগ্রস্তদের দলে পড়ি। যে কোন কিছুতেই মনে একটা কুঁ- ডাক দেয়। সতের দিনের জন্য একা ভারতে যাব, প্লেন- ট্রেন- বাস- হোটেল এসবের কত হিসাব! সুতরাং টিকেট কাটা থেকে শুরু করেই মনের মধ্যে অজস্রবার কুঁ-ডাক ডেকে যাচ্ছিল। হয়ত এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখব ভিসা ঠিকঠাক দেয়া হয় নি, ট্রেনে উঠে শুনব জাল টিকেট (এজেন্টের কি ভরসা?), কোন একদিন হোটেলে ফিরে দেখব পাসপোর্টসমেত লাগেজগুলোই হাওয়া হয়ে গেছে এইসব কুঁ-ডাক আর কি! তো শেষমেষ তাহলে একটা সত্য হল। সুকন্ঠী তরুণীর কথামত প্লেন তাহলে আজ আর আসছে না। প্ল্যান-প্রোগ্রাম সব গুলিয়ে উঠতে লাগল। এজেন্টকে ফোন দিলাম। এজেন্ট বলল, 'না, এরকম তো হওয়ার কথা না। এরকম কিছু হলে তো আমি জানতাম আর প্লেন তো আসার কথা সিংঙ্গাপুর থেকে, ব্যাঙ্কক থেকে না। আপনার নাম্বারই ওরা পাবে কিভাবে, আমি তো কোথাও আপনার নাম্বার দেই নি।' এজেন্ট আরো নানারকম সাত-পাঁচ বোঝাচ্ছিল, আমার মাথায় আর কিছুই ঢুকছিল না, কারন আমি বোকা হলেও ততক্ষণে একটা সত্য জেনে গেছি। আজ পয়লা এপ্রিল, আজ বোকাদের দিন!
এপ্রিল ফুল ডের হিসাবটা আমার মাথায় সকাল থেকেই ছিল। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে একজনের সাথে আলোচনা করছিলাম কাকে কিভাবে বোকা বানানো যায়। কিন্তু কথায় যে বলে অতি চালাকের গলায় দঁড়ি, এটা তো আর এমনি- এমনি কেউ বলে না। দুপুর শেষ হওয়ার আগেই তাই নিঁখুতভাবে ফেঁসে গেলাম। টেবিলে বসা আমার সেই সহকর্মী এবং অফিসের আমার আরও দু'চারজন শুভাকাঙ্খী(!) মিলে আমাকে ফাঁসির দঁড়িতে নিয়ে যাওয়ার এই প্লটটা পেতেছেন। আর সেই সুকন্ঠী তরুণী হল ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া আমাদেরই এক সহকর্মী, তার কাজই সিষ্টেমের সাপোর্ট দেয়া। সুতরাং সুন্দর করে ইংরেজীতে ক্লায়েন্টকে বোঝানো তার দায়িত্বের মধ্যেই পরে, এটা না করতে পারার তার কোন কারন নেই। সে পেরেছেও বেশ, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
২.
বাসায় ফিরে দেখি দু'জন বন্ধু বসে আছে, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দেবে বলে। আমি অবশ্য ওদের বলিনি, বোধহয় আব্বা বলে দিয়েছেন। যাওয়ার আগে আব্বা ফোন করে জানতে চাইলেন এতদিন একা একা থাকব, ভালো লাগবে তো? একা একা আমি অবশ্য আরও একবার বেড়িয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, ভালো লাগে নি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরুর জন্য অপেক্ষা করছি। সাগরটাও দেখা হয় নি তখন পর্যন্ত। আমরা উত্তর বাংলার মানুষ, সাগর আমাদের কাছে বহু দূরের পথ। তখন বয়সও মাত্র সতের কি আঠারো, হাতে গুনে সেলুনে গিয়ে এক-দুইবার শেভ করেছি মাত্র। তাছাড়া প্রায় পুরো সময়টাই মফস্বলে কাটিয়েছি, এতদূরে একা একা আমায় যেতে দেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, এমনিতেই আব্বার সাথে প্রতিটা বিষয়ে আমার মতভেদ। কিন্তু এবার কোন এক অজ্ঞাত কারনে আব্বা রাজী হয়ে গেলেন।
পকেটে হাজার চারেক টাকা নিয়ে আমি প্রথমে চট্রগ্রাম চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি কিছু ভাল লাগে না, শহরের তেমন কিছুই চিনি না। বুদ্ধি- বিবেচনা করে যেখানেই যাই সেখানেই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। রেলস্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে উঠেছিলাম। চট্রগ্রাম শহরে আমার সময় কাটল রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে বসে ট্রেন থেকে নেমে আসা যাত্রীদের ব্যস্ততা দেখে, প্লাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে। বুঝলাম, আমি মানুষ, সমাজবদ্ধ প্রাণী, এভাবে একা একা এসে ইবনে বতুতাগিরি করতে আসা চরম বোকামি হয়েছে। চট্রগ্রামে তবু একরকম ভাল-মন্দ মিশিয়ে কাটল, আসল বিপত্তিটা বাঁধল কক্সবাজারে এসে। গরম মাত্র শুরু হয়েছে, সব হোটেল ফাঁকা, তবুও কেউ রুম দিতে চাচ্ছে না। সবার এক প্রশ্ন আমি একা কেন? তাদের দোষ দেয়া যায় না। প্রায় দাড়ি-গোঁফ না ওঠা একা একটা ছেলে আসলে তারা রুম ভাড়া দেবে কোন যুক্তিতে। এক হোটেলওয়ালা আমাকে বাগে পেয়ে তাদের পাশের হোটেলে একলা আসা এক যুবকের আত্নহত্যার কাহিনী শুনিয়ে দিল। যাই হোক, অনেক চেষ্টা করে, সদ্য ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিনও ক্লাস না করে সেটার ছাত্র পরিচয় ভাঙিয়ে এবং স্বাভাবিকভাবেই উচ্চমূল্যে একটা রুম পেলাম বটে কিন্তু সত্যি কথা বলতে কক্সবাজার একা একা একেবারেই ভাল লাগল না। শুধুমাত্র বিকেলটা কোনরকম সাগরতীরে কাটিয়ে, এমনকি সাগরের পানিতে পা পর্যন্ত না ছুঁইয়ে কক্সবাজার থেকে পরদিন সকালেই চট্রগ্রাম রেলস্টেশনে পৌছে ট্রেনের টিকেট কেটে ফেললাম এবং অতিঅবশ্যই স্টেশনের ব্যস্ততা দেখতে লাগলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্বাভাবিকভাবেই আর কোথাও অন্তত বেড়াতে একা যাই নি, বন্ধুরা মিলে হৈহুল্লোর করে গিয়েছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ দিয়ে চাকুরী জীবনে আরও একবার গিয়েছিলাম, সেই কক্সবাজারেই, একা। কিন্তু অবাক বিষয় এবার আর প্রথম বারের মত মুহূর্তের জন্যও খারাপ লাগে নি। একাকিত্বটা বেশ ভালই লেগেছে, উপভোগ করতে পেরেছি। ভেবে দেখলাম জীবন কত অদ্ভুদ! এক সময় মানুষ অসহ্য একাকিত্বটাকেও কত সুন্দর মানিয়ে নেয়, ভালবাসতে পারে। তাই আব্বার সন্দেহ থাকলেও আমি নিশ্চিত ছিলাম একা একা আমার ভালই লাগবে। তাছাড়া একা একা থাকলে বাহিরের দু-চার জনের সাথে কথা বলা যায়, মেশা যায়, শেখাও যায় অনেক কিছু। একটা দলের মধ্যে থাকলে, এমনকি দুজন একসাথে বেড়াতে গেলেও সে সম্ভাবনাটা কমে যায় অনেকাংশে। আমার ধারনাটা অমূলক ছিল না, আদতে হয়েছিলও তাই। সেই গল্পগুলোই করব।
৩.
শাহজালাল বিমানবন্দরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করতে হবে। এয়ার ইন্ডিয়ার সস্তা ফ্লাইট, সময়টাও এজন্য বিদঘুটে, রাত আড়াইটা। লাইনের অধিকাংশ লোক কোন এক অজ্ঞাত কারনে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা, গলায় আইডি কার্ড ঝুলছে। অবাক হলাম, এরা দল বেঁধে আইডি কার্ড পরে কোথায় যাচ্ছে? হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই সামনের এক লোক আমাকে জিজ্ঞেস করল,'কোন কোম্পানি?'। আমার অবাক হওয়ার পালা, কোম্পানি আসবে কোথা থেকে। আমি জানতে চাইলাম কোম্পানি মানে? লোকটি বলল, 'কেন? আপনি সিংঙ্গাপুর যাচ্ছেন না? কোন কোম্পানির হয়ে যাচ্ছেন?' পরিস্কার হল বিষয়টা। এরা সিংঙ্গাপুরে যাচ্ছে কোন এজেন্সীর হয়ে ওখানে কাজ করতে। এজেন্সী হয়ত বলে দিয়েছে এই সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে গলায় আইডি ঝুলিয়ে রাখতে। আমাকেও হয়ত সামনের লোক এরকমই ভেবেছেন। আমি নিজের দিকে তাকালাম, প্যান্ট-জুতা-গেন্জি পরে আছি। চোখে জ্ঞানীদের মত চশমাও আছে। বন্ধুর কথামত একটা ভাল মন্দ শার্ট পরে আচ্ছামতন একটা দামী বেল্ট দিয়ে প্যান্টে গুঁজে দিলেই বোঝানো যেত আমি হোয়াইট কলারের লোক! শেখ সাদীর সেই যুগ এখনো তাহলে আছে!
বোডিং পাস নিয়ে ভিতরে অপেক্ষা করছি। রাত বেশ গভীর হয়েছে, ভিতরে অনেক লোক বসবার জায়গাগুলোতেই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিছু লোক বেশ উচ্চস্বরে ফোনে কথা বলছে। সাদা চামড়ার কিছু মেয়ে মোটা মোটা বই পড়ছে। কেয়েকজনকে দেখলাম ল্যাপটপ ব্যবহার করতে, এরাও সাদা চামড়ার। আমার খেয়াল হল এখানে ওয়াই ফাই আছে, ফ্রী ব্যবহার করা যায়। সময় নষ্ট না করে আমিও ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম। ইন্টারনেট স্পীড ভালোই বলতে হয়, প্রায় একশো বিশ ত্রিশ কিলোবাইট পাওয়া যাচ্ছে। আমি বাসায় ব্যবহার করি দশ-বারো কিলোবাইটের লাইন। একশো বিশ ত্রিশ তো আমার জন্য অনেক, ঝটপট কিছু ছোটখাট ডাউনলোড সেরে নিলাম।
প্লেন ছাড়ল মিনিট পনেরো লেটে করে। আগেই বলেছি সস্তা এয়ারলাইন্স, বোঝাই যাচ্ছে সীটগুলো আরামদায়ক হওয়ার কোন কারন নেই, খাবারদাবারের তো প্রশ্নই ওঠে না। তিনজন কোন রকমে চাপাচাপি করে বসে আছি। আমি বসেছি মাঝে। আমার বামপাশে জানালায় বসেছেন যিনি তিনি পরে আছেন অদ্ভুদ একধরনের পোষাক। অজস্র ফাঁটা আর চুমকি দেয়া জীন্সের প্যান্ট, কয়েক কালারের শার্ট, যথারীতি এটারও কয়েক জায়গায় তালি দেওয়া। বাজারে গেলে কিছু কিছু পোষাক দেখে অনেক সময় মনে হয় টাকা দিয়ে এসব কে কিনবে? জানালার লোকটিকে দেখে আমার মনে হল, যাক দোকানিরা এসব এমনি এমনি দোকানে রাখে না, এসব কেনার লোকও আছে। প্লেন ছাড়ার পর থেকেই উনি অনবরত কথা বলতে লাগলেন। সিংঙ্গাপুর যাচ্ছেন পায়ের চিৎকিসা করাতে, মাঝে মাঝেই তাকে যেতে হয়, কোলকাতাও যান প্রায়ই, কিসের জানি ব্যবসা আছে- এসব তার মুখ থেকে শুনতে খুব বেশী দেরি হল না। একটু পরই বলে উঠলেন, 'এইতো পেরুলাম বাংলাদেশ, প্লেন উত্তর চব্বিশ পরগনায় ঢুকে গেল, আর অল্পক্ষণ, কোলকাতা এসে পড়ল বলে।' এয়ারপোর্টে প্লেনওয়ালারা ইমিগ্রেশনের ডকুমেন্ট দিয়েছিল, ওটা আর পূরণ করা গেল না, এরমধ্যেই দমদমের কাছাকাছি এসে পড়ল প্লেন। জানালা দিয়ে শুনশান পাড়া মহল্লা দেখা যাচ্ছে। চুমকি জীন্সের ভদ্রলোক বলেই চলেছেন,' এইতো মহল্লার উপর দিয়ে প্লেন এসে পড়ল, দেখছেন প্রতিটা বাড়িতে লাইট জ্বালানো আছে। আমাগো পাড়া-মহল্লার মতই। প্লেনের এই উঠা আর নামাতেই যা মজা, জানালা দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়।'
প্লেন আস্তে আস্তে নামতে থাকল, শক্তি-সুনীলদের শহরে প্লেন নেমে যাচ্ছে।
বি:দ্র: শিরোনামটা সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস থেকে নেয়া।
মন্তব্য
স্টার্টিংটা খুব সুন্দর হয়েছে। পরের পর্বের অপেক্ষায়...
আপনার ভ্রমন আনন্দময় হউক, কু-চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন, আনন্দে থাকুন।
পরের লেখাটা তাড়াতাড়ই দেয়ার চেষ্টা করবেন।
=============
আমি জানি না
সুনীলের শহরে প্লেন নামছে - খবর নিয়েছিলেন প্লেন ল্যান্ড করার আগে পাইলট ককপিট থেকে নীরার খবর নিয়েছিলেন কিনা?
দমদমে প্লেন নামবার আগেই ককপিট থেকে পাইলট জেনে নেন নীরা তুমি ভালো আছ তো?
সুনীলের শহরে গেলেন, নীরার দেখা পেয়েছিলেন?
সুনীলের শহরে নীরার দেখা পেয়েছিলাম কিনা সেটা জানার জন্য তো আপনাকে পরের পোস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে
বহুদিন পরে! ওয়েলকাম ব্যাক! সিরিজ দৌড়াক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এপ্রিল হচ্ছে নিষ্ঠুরতম মাস । আমি না ভাই; এটা কবি টি এস ইলিয়ট বলেছেন। তার বিখ্যাত কবিতা শুরু হয়েছে এপ্রিলের নিন্দা-বন্দনা দিয়ে:
APRIL is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.
Winter kept us warm, covering
Earth in forgetful snow, feeding
A little life with dried tubers.
সলট লেক এবং হাওড়া ব্রীজের সরস বর্ণনা চাই।
এম আব্দুল্লাহ
ভাল লাগছে ভ্রমনকাহিনী।
চমৎকার শুরু...পরের পর্বগুলোর অধীর অপেক্ষায়!
নতুন মন্তব্য করুন