কাব্য চুপচাপ স্কুলের মাঠের পাশের বড় গাছটার নিচে বসে আছে। সে মাঝে মাঝেই এমন করে; একা একা গাছের নীচে এসে বসে থাকে। কাব্য বসে বসে দেখে গাছের উপর কাকেরা উড়ে এসে বসে, আবার কিছুক্ষণ পর চলেও যায়। এর মধ্যে একটা কাক আবার ল্যাংড়া; খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। কাব্য সব দেখে। মাঝে মাঝে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘদের চলাচল দেখে। গাছের ছায়া দেখে। গাছের পাতা ঝরতে দেখে। বাতাসের শব্দ শুনে। ওর খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আবার সে নিজে নিজেই কথা বলে। নিজে নিজে কথা বলাতে কত মজা। কত রাজ্যের চিন্তা যে মাথায় আসে তার।
“ তুমি এখানে কি করছ? ” আচমকা এই প্রশ্নে কাব্য চম্কে পিছন তাকাল। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বি সেকশনের একটা মেয়ে অথৈ। নামে চিনে কিন্তু কোন দিন খুব একটা কথা হয় নি। কাব্য খুবই বিরক্ত হল।
অথৈ আবার জিজ্ঞাসা করল, “ তুমি এই ভর দুপুরে একা একা বসে কি করছ? ”
কাব্য চশমার ওপর দিয়ে অনেকটা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “ এমনি বসে আছি, তুমি এখানে কি করছ? ”
“ আজ স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। বাবা আসতে আরো ঘণ্টা খানেক বাকি। তাই ঘুরাঘুরি করে সময় পার করছি। ”
“ আচ্ছা কর, অপেক্ষা কর ” কাব্য অন্যমনস্কভাবে বলল।
“ তোমার পাশে একটু বসি ”; বলতেই অথৈ কাব্যর কিছু বলার আগেই পাশে বসে গেল।
কাব্য একটু অস্বস্তিবোধ হল। কাব্য আবার মেয়েদের সামনে একদম সহজ হতে পারে না। কাব্য একটু সরে বসল।
“ আগেও দেখেছি টিফিনের সময় তুমি এখানে একা একা বসে থাক। তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেল না কেন? ”
“ হ্যাঁ, আমার মাঝে মাঝে একা থাকতে ভাল লাগে। তুমি দেখি অনেক কিছু খেয়াল কর। ”,
অথৈ হেসে বলল। “ আমরা মেয়েরা অনেক কিছু খেয়াল করি। আমারও না জান তোমার মত মাঝে মাঝে একা থাকতে ইচ্ছে করে। যখন বাবা বা টিচার বকা দেয়। যখন আমার মন খারাপ হয়, কান্না পায় তখন। মা বলেছে আমি এখন বড় হয়ে গেছি। মেয়েরা যখন বড় হয়ে যায় তখন তারা সবার সামনে কান্না করে না। তখন কান্না করতে হয় অন্ধকারে বা বাথরুমে দরজা বন্ধ করে ”।
“ না। আব্বু বা টিচার বকা দিলে আমার মন খারাপ হয় না। কিন্তু এখন আমার মন খারাপ। খুব খারাপ”।
“ উমা কেন? তোমার মন খারাপ কেন? ”
“ কারণ গাছটারও যে আজ মন খারাপ। তাই আমার মন খারাপ”।
“ গাছের আবার মন আছে নাকি? ”
“ থাকবে না কেন? সব কিছুর মন আছে । ওই যে গাছে যতগুলো পাখি বসে আছে তাদেরও মন আছে ”।
“ গাছের মন খারাপ তুমি বুঝলে কীভাবে? ”
“ আচ্ছা আস তোমাকে শিখিয়ে দেই ”।
কাব্য উঠে দাঁড়াল। তারপর গাছের কান্ডটাকে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল। অথৈও কাব্যর দেখাদেখি তাই করল। অথৈয়ের হাত কাব্যর আঙ্গুল স্পর্শ করল। কাব্য দ্রুত লজ্জা পেয়ে হাত সরিয়ে নিল। কই কিছুই তো বুঝি না। সশশশ। কথা বল না। গাছের গায়ে কান পাত। ওর মনের কাছাকাছি আস।
অথৈ বলল, “ বুঝতে পারছি। গাছটা বলছে তার মন খারাপ ”।
কাব্য খুশি হয়ে বলল, “ বলেছিলাম না ”।
কাব্য অথৈ আগের জায়গায় এসে বসল,“ তুমি কিন্তু খুব অদ্ভুত। সবার থেকে আলাদা ”।
“ সবাই কি এক রকম হবে নাকি! ”
“ তুমি খুব বই পড় সেটাও দেখেছি। পড়ার বই না সেটাও বুঝি। কেউ পড়ার বই এত আগ্রহ নিয়ে পড়ে না। তোমার ব্যাগে মোটা বইগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখি? ” বলেই অথৈ একটা বই তুলে নিল, Principia Mathematica, স্যার আইজাক নিউটনের লেখা।
“ তুমি এই সব বই পড়। তুমি মজার কোন বই পড় না ”।
“ পৃথিবীতে অঙ্কের থেকে মজার কিছু আছে নাকি! সব জায়গায় আছে অঙ্ক, প্রকৃতিতে আছে অঙ্ক, অ্যালজেবরায় আছে মজা...”
“ আমার কাছে ম্যাথ খুব বাজে লাগে ”
“ অনেক লেখক আছে অঙ্ক নিয়ে গল্প লিখেন, অনেক কবি আছেন অঙ্ক নিয়ে গান লিখেন, কবিতা লিখেন, অনেক পেইন্টার অঙ্ক নিয়ে ছবিও আঁকে "।
“ বাপরে আমি এই সব বুঝি না। কিন্তু অঙ্কের টিচারকে আমার খুব ভালো লাগে। সব সময় খুব মজা করেন ”
“ আমারো খুব মজা লাগে। আমার ইচ্ছা করে সারা দিন খালি অঙ্ক করি ”
“ আচ্ছা তুমি কোন মেয়ের সাথে কথা বল না কেন? ”
“ মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না তাই ”
“ ওমা তুমি খুব লাজুক। আচ্ছা তুমি আমার নাম জান ”
“ জানি তোমার নাম অথৈ ”
“ বাহ, আর তুমি ক্লাসের ফাস্ট বয়। সবাই তোমার নাম জানে। অবশ্য তোমার আরেকটা নামও আছে। কানা শিয়াল” কথাটা শেষ করেই অথৈ বাচ্চাদের মত হি হি করে হাসতে শুরু করল।
এতে এত হাসার কি আছে কাব্য ধরতে পারল না।
অথৈ শেষ পযন্ত হাসি থামিয়ে, চোখ মুছে বলল, “ আচ্ছা পণ্ডিত সাহেব, তোমাকে দুটা খবর দেই। বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে গেছে। এই স্কুলে এটাই কিন্তু আমার শেষ সপ্তাহ। শনিবার আমার জন্মদিনও। আমাদের বাসায় আসতে পার। লামিয়া, কান্তা, নিবিড়, আরমান, আতশিরাও আসবে ।”
“ তাই নাকি? শুভ জন্মদিন। তবে পার্টিতে যেতে আমার ভালো লাগে না। আর তোমাদের ক্লাসের কারো সাথে আমার খুব একটা বন্ধুত্ব নেই ”
অথৈ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, " তাতে কি? কিন্তু আমার মনে হয় আমার মনে হয় তুমি আমার জন্মদিন আসতে আসতে ভুলে যাবে।”
“ না ভুলব না। প্রতিটা সংখ্যা মনে রাখার কিছু আমার নিজস্ব ট্রিক আছে। যেমন শনি বার হল ১৫ই মার্চ, মানে ১৫৩। ১৫৩ হল হ্যাপিকিউব।”
" হ্যাপিকিউব মানে? " চোখ বড় বড় করে অথৈ জানতে চাইল।
কাব্য খুব আগ্রহ নিয়ে বলল “ দাঁড়াও তোমাকে বোঝাচ্ছি। তোমার নোটবুকটা দাও। তোমাকে কিছু গনিতের ম্যাজিক দেখাই।
১৫৩ হচ্ছে সবচেয়ে ছোট সংখ্যা, যার অঙ্কগুলোর ঘনফলের যোগফল এই ১৫৩-এর সমান যেমন: ১৫৩ = ১৩+৫৩+৩৩ = ১+১২৫+২৭ = ১৫৩৷ এই মজার সম্পর্কের জন্য ১৫৩ কে হ্যাপিকিউব বলা হয়৷”
“তাই নাকি। জানতাম না ত?” অবাক হয়ে অথৈ বলল।
“আরও শুনবে ১৫৩টি ১ থেকে ১৭ পর্যন্ত সব সংখ্যার যোগফলের সমান৷ ১৫৩ = ১+২+৩+৪+৫+৬+৭+৮+৯+১০+১১+১২+ ১৩+১৪+১৫+১৬+১৭৷ এজন্য ১৫৩কে বলা হয় সপ্তদশ ট্রায়াঙ্গুলার নম্বর৷ যেহেতু ৩৫১ সংখ্যাটি ১৫৩-এর উল্টো সংখ্যা, এবং ৩৫১ সংখ্যাটিও একটি ট্রায়াঙ্গুলার নম্বর৷ সেহেতু ১৫৩কে একটি রিভার্সিবল ট্রায়াঙ্গল ধরা যায়৷
১৫৩ সংখ্যাটির তিনটি অঙ্ক ১, ৫ ও ৩-কে একসাথে নিয়ে ওলটপালট করে সাজিয়ে যে ৬টি সংখ্যা পাওয়া যায় সেটি নিচের সমীকরণ মানে : ১৫৩+৩১৫+৫৩১ = ৩৫১+১৩৫+৫১৩।মজা না? "
অথৈ মুগ্ধ হয়ে বলল, “ ওরে বাবা, তুমি এত কিছু জান কীভাবে। নিজে বের করেছ ”
“ না বই পড়ে জেনেছি ”
“ আচ্ছা জান আমার না স্কুল ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছে। তুমিও তো ক্লাস সিক্সে উঠে অন্য স্কুলে চলে যাবে। তোমার এখানের বন্ধুদের জন্য মন খারাপ করবে না। ”
“ হয়ত একটু একটু হবে। তবে বন্ধুদের জন্য না। এই গাছটার জন্য, এই কাকগুলোর জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি নতুন বন্ধু পেয়ে যাব। ”
অথৈ তখন বাবাকে রিকশা থেকে নামতে দেখে। মন খারাপ করে বলল “আমার বাবা চলে এসেছে । তুমি এত সুন্দর করে কথা বল। ইস্ তোমার সাথে আগে কথা বললাম না কেন। ”
“ আবার দেখা হলে কথা হবে। আমিও বাসায় যাচ্ছি। ”
অথৈ চোখ কেমন জানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “ বাসার ফোন নাম্বার দেই? তোমার নিউটনের বইতে লিখে দেব? ”
“ না । বইটা আমার না। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে নেওয়া।"
“ আচ্ছা তাহলে তোমার হাত দাও। ” বলতেই অথৈ কাব্যর হাত টেনে নিল। কাব্যর খুবই লজ্জা লাগল। একটা মেয়ে তার হাত ধরল প্রথম। কলম দিয়ে নাম্বার লিখতে লিখতে অথৈ বলল ‘ তোমার হাতে আমার নাম্বার লিখে দিলাম। ফোন কর কিন্তু। "
এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে কাব্য বলল, “ তোমাদের বাসার নাম্বার ৬৩৮৮৩৬ । এটা দেখি প্যালিনড্রমিক সংখ্যা। প্যালিনড্রমিক সংখ্যা হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের সংখ্যা, যার অঙ্ক গুল উল্টো করে লিখলেও সংখ্যাটি একই থাকে। ৬৩৮৮৩৬ এরকম একটি সংখ্যা।প্যালিনড্রমিক শব্দটি প্যালিনড্রম থেকে এসেছে, যা সেই সমস্ত শব্দকে বুঝায়, যাদেরকে উল্টো করে পড়লেও শব্দটি একই থাকে। যেমন বাংলায় আমরা বলি রমাকান্তকামার।
" আচ্ছা শিয়াল সাহেব কত সময় বকবক করে কাটিয়ে দিলাম। বাবা দাঁড়িয়ে আছে । দেরি করলে রাগ করবে।বাই ”
“ বাই।”
রিকশা উঠে অথৈ পিছন ফিরে কাব্যর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাত নাড়ল।
পরের দিন কাব্য অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাকি সপ্তাহ আর স্কুলে জেতে পারে নি। অথৈ প্রতিদিন স্কুলে এসে ক্লাসে কাব্যকে খুঁজে। মাঠে খুঁজে, সেই গাছটার নিচে খুঁজে। কিন্তু কাব্যকে কোথাও খুঁজে পায় না। বাসায় মাকে, বূয়ার কাছে বার বার জানতে চায় তার কোন ফোন এসেছে নাকি। বুয়াকে শিখিয়ে দেয়। কেউ যদি ফোন করে অবশ্যই যেন তার নাম্বার রাখা হয়।
জন্মদিন চলে আসল। পরের দিন সকালে তারা চট্রগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে যাবে। অথৈ মন খারাপ । একবারও ছেলেটা তাকে ফোন পযন্ত করল না। মাঝে মাঝে সে কাব্যর হাতের লিখায় হাত বুলায়। কাব্য আসবে না জেনেও কেক কাটার আগে সে কেন জানি কাব্যর জন্য অপেক্ষা করল। বার বার দরজার দিয়ে তাকাল।
আরমানকে গিয়ে কাব্যর কথা জিজ্ঞাসা করল, “ কাব্যকে স্কুলে দেখলাম না ”
আরমান বলল, “ ওই পাগল ছেলেটা, যে গাছের নিচে বসে পাতা কুড়ায়। আর মোটা চশমা পড়ে পাখিদের সাথে কথা বলে ”
সবাই তার সাথে হাসতে শুরু করে দিল । কিন্তু অথৈর একদম হাসি পেল না। তার সাথে কাব্যর আর কোন দিন আর দেখা হবে না।
অথৈর কেন জানি খুব কান্না পেল।
চলবে...
মন্তব্য
ওরে সর্বনাশ । সচলায়তনে আরেক উপন্যাস ।
শুরুতেই সতর্ক করে দেই পাঠকদের পক্ষ থেকে । শেষ করতে হবে কিন্তু ।
চলুক
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
এটা কিন্তু দারুণ ব্যাপার!!!
এতোগুলো উপন্যাস ১ ব্লগে পাওয়া।
চলুক।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
জি ভাই...আশা করি শেষ করতে পারব। ধন্যবাদ
_____________________________
টুইটার
ইরতেজা ভাই, আমার কমেন্ট কই গেল?
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
তারেক আবার দে ভাই । ভুলে কাচি পড়ে গেছে
_____________________________
টুইটার
উপন্যাসগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে একটা বইয়ের মধ্যে রাখলে ফলো করতে সুবিধা হয়। কর্তৃপক্ষ???
"অথৈর কেন জানি খুব কান্না পেল।"
আসলে চোখের জলের অনেক রং। আমরা মাঝে আনন্দেও এটা ব্যবহার করি। তবে সব সময় এটার অর্থবহ ব্যাবহার হয়না। আর তাই অনেক সময় নিঃশব্দ কান্না বুকে ব্যাথা হিসেবে থেকে যায়, জানতে পারে না কেউ!
নতুন মন্তব্য করুন