প্রবাসের কথোপকথন - ১১

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: সোম, ১০/১২/২০০৭ - ১:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“এত দেরি যে? ফোন পাসনি নাকি?”
- পেয়েছিলাম, কিন্তু একেক জন একেক জায়গায় ছিলাম। এক গাড়িতে আসলাম দেখে একটু সময় লেগে গেল। তার উপর ডাউনটাউনে ফায়ার সার্ভিসের দুইটা ট্রাক রাস্তা বন্ধ করে গান গাচ্ছে। ঘুরে আসতে হল অনেকটা পথ। এখনো কি ওটি-তে আছেন, নাকি বের হয়েছেন?

“ভাই-ভাবি দু’জনাই কেবিনে এখন। ভাইয়ের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, আর ভাবি খুব শকড মনে হচ্ছে।”
- স্বাভাবিক। অ্যাক্সিডেন্ট জিনিসটা একটু আপসেটিং এমনিতেই। তার উপর এটাই তো বোধহয় প্রথমবার। ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে হয়েছে শুনলাম অ্যাক্সিডেন্ট?

“হ্যাঁ। ভাবি টার্ন নেওয়ার সময় নাকি ভাই বকছিলেন। ওতে নার্ভাস হয়ে গ্যাসে পা পড়ে গেছে। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা খেয়েছে একটা গাছে। দু’জনের কারোই জ্ঞান ছিল না। পুলিশের গাড়ি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে ৯-১-১ কল করেছে।”
- আউচ। আগলি অ্যাক্সিডেন্ট। তো আপনারা খবর পেলেন কীভাবে?

“পুলিশ ওনাদের বাড়ি গিয়েছিল। বাচ্চারা আমাদের ফোন করে দিলো, তখন পুলিশের কাছে শুনলাম।”
- বাসায় বড় কেউ ছিল না? সে কী কথা, ভাইকে কাজ থেকে আনতে ভাবি যাবেন, ভাল কথা, কিন্তু বাচ্চাদের ঘরে রেখে যাবেন কেন? আপনার বাচ্চাও ছিল? আপনিও কীভাবে রেখে গেলেন গিয়ে?

“আমি তো জানি না যে উনি বাইরে যাবেন। আমি নিজেই ছিলাম হাসপাতালে। ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। ডাক্তার আমার অবস্থা দেখে ধরে-বেঁধে ভর্তি করিয়ে দিল। এর মধ্যে এই হাঙ্গামা। এই যে দেখো, স্যালাইন ধরে ধরে ঘুরছি। পুলিশ নাকি জিজ্ঞেস করেছিল বাসায় বড় কেউ নেই নাকি। তখন একজন বলে ফেলেছিল যে প্রায়ই এভাবে রেখে চলে যায় বাইরে।”
- পুলিশ এটা নোট করে নিয়ে গেছে? তাহলে তো সমস্যা হবে পরে অনেক। না, শেরিফের মর্জির উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই এই মুহূর্তে। কোন যুক্তি দিয়েই এটা মানানো যাবে না। তের বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের একা রেখে গেলে বাচ্চার কাস্টডিই তো নিয়ে নেবে পুলিশ। সবচেয়ে বড়টা তো মনে হয় নয় বছরের ছিল। ঝামেলা হয়ে গেল। চিকিৎসার ধকল কাটলেই এই ধাক্কাটা আসবে। ওনাদের কিছু বলেননি তো এখনো, নাকি?

“নাহ, মাথা খারাপ? এমনিতেই তো বেশ নাজুক অবস্থা। অ্যাক্সিডেন্ট তেমন মেজর ছিল না। গাছে বাড়ি খেলেও মূল সমস্যা হয়েছে এয়ারব্যাগে। ওটার প্রেশারে মুখের বিভিন্ন জায়গায় ফেটে গেছে। ভাইয়ের তো মুখ-ঠোঁট ফেটে গেছে অনেকটা। ভাবির চেহারা দেখেও চেনার উপায় নেই। অয়েন্টমেন্ট দিয়ে রেখেছে। ভাই একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, তবে ভাবি বেডে।”
- একটু শেকেন-আপ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। পুরো শহরই তো দেখি চলে এসেছে দেখতে। কী অদ্ভুত না এই ব্যাপারটা? দেশে একবার রাস্তার পাড়ে একটা লোককে খুলি-ফাটা অবস্থা পরে থাকতে দেখেছিলাম। নির্বিকার ভাবে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেছিলাম। অথচ সাপের খেলা দেখতে দাঁড়িয়ে যেতাম যত্রতত্র।

“বিদেশের বাড়িতে তো স্বদেশী মানেই আত্মীয়। আমরা একজন আরেকজনের দুঃখ-কষ্টে পাশে না দাঁড়ালে তো চলে না। না রে, ভাবি তো বেশ কিছুদিন ধরেই চালান। খুব একটা আনাড়ি ড্রাইভার না। নতুন শিখছিলেন আর কি। এখনো ফুল লাইসেন্স নেননি। কিছুদিনের মধ্যেই নিতে যাবার কথা। এখন তো আর মনে হয় না ও’পথে পা বাড়াবেন।”
- ভাই বকছিলেন বললেন। কী নিয়ে বকছিলেন?

“টার্ন নেওয়ার সময় এক হাতের উপর দিয়ে আরেক হাত আনা না কী নিয়ে যেন বকছিলেন। আচ্ছা গাড়িটা ঘুরলেই তো হল, নাকি? এর মধ্যে এত ঝক্কি করা কেন?”
- এবার বুঝেছি। ভাইয়ের জায়গায় আমি থাকলে আমিও বলতাম ওটা নিয়ে। মেয়েদের শেখাতে গেলে এই সমস্যাটা হয় প্রায়ই। টার্ন করার সময় এক হাতে হুইলটা ঘুরিয়ে অন্য হাতে ওটা টেনে আনলে কন্ট্রোল বেশি থাকে। বিশেষ করে হাইস্পিডে। ছেলেরা এক টানে এই কাজটা করে, মেয়েরা বেবি-স্টেপস নিয়ে একটু একটু করে হুইল ঘোরায়। রাস্তার সব গাড়ি তো আর এক তালে চলে না। আচমকা হর্ন খেলে তখন নার্ভাস হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। এই গলদটা গোড়ায় না শুধরালে পরে সমস্যা হয়।

“তুইও? তোদের সমস্যাটা কী বলতো? ড্রাইভিংয়ের সময় এভাবে একটা মানুষকে ধমকের উপর রাখলে সে চালাবে কীভাবে?”
- ধমক আলাদা ব্যাপার। আমি টেকনিকের কথা বলছিলাম। ধমকাধমকি হয় বরের কাছে ড্রাইভিং শিখতে গেলে। এজন্য আজকাল মেয়েরা অন্য কারো কাছে শেখে ড্রাইভিং। এক আন্টির কথা জানি যিনি রাস্তার মাঝে নেমে গিয়ে বলেছিলেন যে ড্রাইভিং শিখলে সংসার টিকবে না, এর চেয়ে উনি টাকা দিয়ে শিখে নেবেন বরং। শেষতক তাই করলেন।

“একদম ঠিক কাজ। এইটাই দরকার। হাসব্যান্ডের কাছে কিছু শেখা মানেই ঘরে অশান্তি। কত আশা নিয়ে শিখতে যাই, কিন্তু বকাঝকার চোটে পুরো দিনটাই মাটি হয়ে যায়। সবটাতেই শুধু ভুল ধরা আর বকা দেওয়া। আরে বাবা, আমরা ড্রাইভিং জানি না দেখেই তো শিখতে চেয়েছি, নাকি? এর মধ্যে এত তুলকালাম করার কী দরকার?”
- আপনার রাগের কারণটা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার বৌয়ের সাথে আমিও হয়তো একই কাজ করে বসবো। ব্যাপারটা এত খারাপ ভাবে না দেখলেও চলে। সব বরই চায় তার বৌ সব দিক থেকে পারফেক্ট হোক। এই চিন্তাটা এপ্রিশিয়েট করলে পারেন। তবে হ্যাঁ, আমি নিজেও এখন বলি যেন ভাবি-বৌদিরা বরের বদলে আমাদের কাছে শেখেন। লাভের মধ্যে আমরা কিছু বাড়তি খানা-পিনা পাই, আপনাদেরও বকাঝকা শুনতে হয় না।

“এই দিকে আজমীর সবচেয়ে ভাল। ওর গাড়িতে শেখার সময় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেলেও ও খুব শান্ত থাকে। একবার তো এক বৌদি রাস্তা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আরেকজন তো পার্কিং লটেই আরেক গাড়িতে মেরে দিলেন। তবুও ও একদম শান্ত ছিল।”
- শয়তানের নাম নিতেই হাজির! জ্বী, পরে কথা হবে। আমি ওদিকে যাই। কী হে বান্দা, তুমি তো দেখি বেশ পপুলার ইন্সট্রাক্টর। সবাই তোমার শেখানোর নাম করে এত। তিন তিনটা রেকলেস ড্রাইভিংয়ের টিকেটের কথা জানে না নাকি কেউ?

“আরে জানে, জানে। আমি তো বলেই দেই, আই ডোন্ট ড্রাইভ ফাস্ট, আই ফ্লাই লো। প্রথম দিকে পুলিশ কোথায় থাকে সেটা না বুঝেই টানতে গিয়ে টিকেট খাইলাম এত্তগুলা। এখন আর ভুল হয় না। শুনবা আমার ড্রাইভিংয়ের গল্প? শুনো তাহলে...”


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এই পর্ব অতিরিক্ত বড় করলাম না। আজমীরের কাহিনী পরের পর্বে। এত ঘটনাবহুল কাউকে আর কিছুর সাথে জুড়ে দেওয়া যায় না।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

হাজবেন্ড-ওয়াইফের ব্যাপারটা পড়ে হাসতে হাসতে শেষ। আমার ধমকানীর চোটে মৌটুসী আর গাড়ি চালানো শিখতে চায় না। একবার এরকম সানডে রাতে বেরিয়েছি। ধমকে ধামকে এক রাস্তা নিয়ে যাচ্ছি। বারবার গাড়ি এদিক ওদিক করাচ্ছিলাম, নাক বরাবর চলার জন্য। পিছনে ছিল মামু। দিলো আলো জালায়ে। থামানোর পর জিজ্ঞেস করে এসে কিছু পান করেছিলো কিনা। হাসি

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

হাহ হাহ। এখন তো কায়দা জানলেন। চ্যাংড়া গোছের কোন ছোট ভাই ধরে এক বেলা ভাত-ডাল খাইয়ে দিন। ব্যাস, গৃহসুখও থাকবে, ভাবীর ড্রাইভিংও শেখা হয়ে যাবে! আর নয়তো এনএফএস খেলতে বসিয়ে দিন!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

Interesting. Following... ..
আরেফীন

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ধন্যবাদ।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

দেশে একবার রাস্তার পাড়ে একটা লোককে খুলি-ফাটা অবস্থা পরে থাকতে দেখেছিলাম। নির্বিকার ভাবে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেছিলাম। অথচ সাপের খেলা দেখতে দাঁড়িয়ে যেতাম যত্রতত্র।

-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এই লেখাটা আমার বউকে দেখালে ভাববে আমি তার জীবনকাহিনীর ড্রাইভিং শিক্ষা পর্বটি আপনাকে বলে দিয়েছি। বলা বাহুল্য, তার ড্রাইভিং শেখা আমার কাছে হয়নি, খুব আপা-আপা করে এরকম একজনকে ধরে শিখেছিলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

মেয়েদের গাড়ি চালানো নিয়ে রুশরা মজা করে বলে, "মহিলা-ড্রাইভারের ডানদিকে যাবার সিগন্যাল দেয়ার মানে এই নয় যে সে বামদিকেই যাবে।"

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

হাসান মোরশেদঃ জীবনের গভীরতা আসলেই অস্বস্তিকর বেশি। ভাবলেই কেমন লাগে মাঝে-মধ্যে।

অলৌকিকঃ আমার ব্যাপার একদম উলটা। শিখেছি আমেরিকা এসেই। দেশে আব্বুর অফিসের সরকারী গাড়ি ছিল একটা। ওটায় টোকা লাগলেও সারাইয়ের টাকা নেই দেখে কোনদিন শেখা হয়নি। বন্ধু-আত্মীয়ের গাড়ির দাম তো আরো বেশি!

মুহম্মদ জুবায়েরঃ এই রকম কাহিনীগুলো খুব বেশি প্রচলিত আসলে। আজ পর্যন্ত একটাও জুড়ি পেলাম না যেখানে এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। যাক, আমিও তো আপনার দলেই। নিজের মা-ই ধমকের চোটে আমার কাছেও শিখলো না।

সন্ন্যাসীঃ আমার মা এই কাজ করতো। ডানে যেতে বললে বামে টান দিত... ওটাকে ডান দিক জেনেই টান দিতো। শেষদিকে হাতে বাড়ি দিয়ে বলতাম, এই হাতের দিকে ঘুরো!

ধন্যবাদ সবাইকে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।