বহুদিন পর জুম্মায় যাওয়া হল আজকে। জীবনকে সুন্দর, স্বাভাবিক, ও নির্ভার রাখতে বিশ্বাসের ভূমিকা আমি কিঞ্চিত অনিচ্ছার সাথে হলেও মেনে নেই। আঘাত, হতাশা, আর ব্যর্থতাগুলো অন্যের মর্জির উপর চাপিয়ে নিজের মত জীবন চালাতে পারা নিঃসন্দেহে যেকোন সচেতন মানুষের পরম আরাধ্য। ধর্ম যার যা-ই হোক না কেন, প্রতিটি মানুষই ধার্মিক। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লে দুষবার মত কাউকে খুঁজে বেরানোতে ধর্ম মিশে আছে। বিয়ান রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বিরক্তির ঝাপটা কারো উপর দিয়ে চালাতে চাওয়া ধর্মের শিক্ষা। অন্ধকারে হাতরে পথ চলতে গেলে প্রতিটি অবয়বের মাঝে সুরাসুরের প্রতিভূ তৈরি করে নেওয়াও ধর্মেরই উপজাত অনুভূতি। জীবনের স্তরে স্তরে তাই সব মানুষই ধার্মিকভাবে কোন না কোন কাজ করে নিজের ক্ষুদ্রতাগুলো ভুলে থাকতে। আমিও ব্যাতিক্রম নই। কেউ হরেক রঙের তিলক দেয়, কেউ সেজদা দিতে দিতে কপালে তিলক এঁকে ফেলে, কেউ হুমায়ূনীয় কায়দায় কাগজ ছেড়ে, কেউ বৌ পেটায়, কেউ গাছের সাথে কথা বলে, কেউ গুনগুন করে। আমি ঘুমাই।
শীবের গীত ছেড়ে এবার ধান ভানায় ফিরি। ক্লাস, কাজ, ঘুম, ইত্যাদির আবেদন অগ্রাহ্য করে সপ্তাহ তিনেক পর আবারো জুম্মায় সামিল হলাম। শীতের ছুটিতে অনেকেই শহরে নেই। মেক-শিফট খতিবের খুতবা শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে ঝিমাচ্ছিলাম। চলছিল কথা ধর্ম নিয়ে। কীভাবে যেন মাঝে ঢুকে গেল ভারতে গরু-পূজা। এর মাঝেই গোবরের ইংরেজি ভুলে ‘আউটকাম অফ দ্য কাউ’ বলে নৌকা ভাসালেন খতিব সাহেব। এমন সময় পাশ থেকে এক বড় ভাই এগিয়ে দিলেন একটি বই। আমেরিকার মসজিদে বাংলা বই দেখে অবাক এবং খুশি হলাম বেশ। লেখক জি, ডব্লিউ, চৌধুরী নামক এক ব্যক্তি। কভার ফ্ল্যাপের ভেতরে প্রথম বাক্যেই পুরো বইটির মেজাজ বর্ণিত -- ‘কেন পাকিস্তান একটি জাতীয় সত্ত্বা অর্জনে ব্যর্থ হল?’ এই ঘরানার বই নিয়ে আমার আগ্রহে কমতি নেই কোনদিন। ইতিহাসের সুদীর্ঘ পরিসরে মানবমনের ভাল-মন্দ সব রকম প্রবৃত্তিই প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের মত এত কম সময়ে নয়। শুরু করলাম পড়া।
সামনের ফ্ল্যাপে সরাসরিই দাবি করা হয়েছে যে ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও আধুনিক যুগে এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি শেখ মুজিব ও জুলফিকার আলি ভুট্টোর সন্দেহজনক ভূমিকার জন্য। পড়ে অবাক বা আহত হইনি। সামরিক সরকারের সাবেক মন্ত্রীর দৃষ্টিকোণ থেকে দাবিটা অযৌক্তিক নয় মোটেও। কিন্তু কিছু পরেই বের হতে থাকলো আসল রূপ। আইয়ুবীয় গণতন্ত্রের বুনিয়াদ গঠনে বাঙালিদের কোন ভূমিকা না থাকার কারণেই এই বিভাজন। কৌতূহল থেকে পড়ার গতি বেড়ে গেল অনেক।
বক্তব্যগুলো খুব প্রচলিত প্রোপাগান্ডা। শেখ মুজিবকে সরাসরি দেশদ্রোহী, দালাল, আর বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে ডাকা হয়েছে। না, এতেও আমার কোন খেদ নেই। শেষের ফ্ল্যাপের একটি বাক্যে বইটির সারমর্মও নিহিত ছিল -- ‘ইহা কি বাংগালীদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী-দাওয়া মেটাতে অপর্যাপ্ত ছিল, নাকি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংগালীরা ইতিমধ্যেই স্বাধীন রাষ্ট্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল?’। খুনে, বর্বর, মনুষ্যকূলে-অপাঙ্কতেয় জানোয়ারদের সাথে আলাপচারিতার দায়ে আমি এত ত্যাগের পরও শেখ মুজিবের উপর অভিমান করি। বুকটা বরং হালকা হচ্ছিল। বহু আগে থেকেই ভারতের সাথে যোগাযোগ, চীন-পাকিস্তান-আমেরিকা আঁতাত সম্পর্কে সজাগ করে দেওয়া, বাড়াবাড়ি রকম দেরি ও ঝামেলা হবার আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য প্রত্যাশা না করা, ইত্যাদি ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতিগুলো অনেকটাই মুছে দিল সেই জ্বালা।
খতিব সাহেব গরুর পিন্ডি চটকাতে একটু বেশিই ব্যস্ত ছিলেন। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে নামাযের সময় পেরিয়ে এগিয়ে চলছে। ঢুকে পড়লাম বইয়ের ভেতর। হাইলাইটার দিয়ে দাগিয়ে দাগিয়ে পড়া। দেখে ভালই লাগলো। ভিন্ন মতের বইগুলো খুঁটিয়েই পড়া উচিত। এই ঘি বেশিক্ষণ সইলো না। ভেবেছিলাম কোন পাগলা জেনারেলের সিএসপি সাগরেদের আত্মজীবনী স্রেফ অনুবাদ করেছেন কেউ। ভেতরে অনুবাদকের কথা পড়ে সেই ভুলের পাহাড় ধূলায় মিশে গেল। শুরুতে বলা হল পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানী তথা বাঙালি মুসলমানদের অধিকতর ভূমিকা রাখার কথা। তারপর শুরু হল ধোলাই। একজন ‘সাধারণ বাংলাদেশী’ নাকি প্রোপাগান্ডার চাতুরিতে এটুকুই জানেন যে ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া এবং ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের ‘পৈশাচিক আক্রমণের ফলেই’ বাংলাদেশের জনগণকে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হয়েছিল। মূল বইটি পড়ে অনুবাদকের উপলব্ধি হয়েছে যে ‘বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্বন্ধে যে লেখকই যাই লিখুন না কেন তা ভরপুর থাকে প্রবল ভাবাবেগ রসে’। আরো কিছুদূর এগিয়ে তিনি খোশমেজাজে জানান দিলেন যে ‘লেখকের এ বইটি পড়ে [তাঁর] মনের অনেক প্রশ্নেরই সমাধান হয়েছে’। আমিও তৎক্ষণাৎ নিজের মনে গোলাম ওয়াহিদ চৌধুরী সাহেবের কোন এক নিকটাত্মীয়ার উপপতি থেকে খুশি মনে সিদ্দীক সালাম সাহেবের অন্ত্র-বিশেষ আলোকিত করতে লেগে গেলাম।
শেষ পর্যন্ত অনুবাদক সবক দিলেন যে ‘ঐতিহাসিক ঘটনাকে সত্যতার সাথেই জানতে হয় তা তিক্ত হলেও’। আরো জানালেন যে তিনি পাঠক হিসেবে তাঁর ‘তৃষ্ণা’ নিবৃত্ত করতে সক্ষম হয়েছেন এই বই পড়ে। শেষ ডিসেম্বরে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আমি মনে মনে বললাম শুধু, তোর তৃষ্ণা কীসে মিটেছে তা গলা থেকে বের করে দেখ্, ছাগল।
বইটি ১৯৮৯ সালে লিখিত। ‘হক কথা প্রকাশনী’ নামক কোন এক আস্তাকূড় থেকে প্রকাশিত ১৯৯১ এর জানুয়ারিতে। কোন এক সচেতন বাঙালি কালের প্ররোচনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এক সাজানো গৃহযুদ্ধের ইতিহাস উন্মোচিত করেছেন। হাজার রঙে দাগিয়ে এই বই পড়েছেন আরেক সহৃদয় বাঙালি। বিশ্বাসের গতি-জড়তায় যদি এর কিছুমাত্রও গিলে ফেলি, সেই আশায় পাঠ শেষে অত্যন্ত উদার ভাবে তা গছিয়ে রেখে গেছেন মসজিদের লাইব্রেরিতে।
বইটি জ্যাকেটের ভেতরে করে নিয়ে এসেছি। খোদার ঘরে মনে মনে বলাৎকার করেছি। তাও আবার বেগানা পুরুষ মানুষকে ভেবে। দেবার জায়গা থেকে চুরি করে ভেগেছি। বিনিময়ে যেই নরক-যন্ত্রণা কপালে জুটালাম, তা অমৃত-সমান হবে; যদি পরবর্তীবার কোন বুকশেলফের সামনে গেলে আপনারাও খুঁজে দেখেন এমনি করে ঘাপটি মেরে থাকা কোন বই আছে কিনা।
মন্তব্য
আমিন!
অসাধারণ লাগলো! এক্কেবারে অসাধারণ!
এই লেখাটা দিয়ে সকালের নাস্তা করলাম।
ব্রাভো, ইশতি, ব্রাভো!
হাঁটুপানির জলদস্যু
ধন্যবাদ। আমিও এই মন্তব্য দিয়ে সকালের নাস্তা করলাম!
খাসা পুস্তক!
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
এই "চুরি" আপনাকে বহু সওয়াব এনে দিয়েছে।
হককথা প্রকাশনী নাম দেখে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রকাশিত সাপ্তাহিক "হক কথা"-র কথা মনে পড়লো। জানামতে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম হলুদ সাংবাদিকতার নমুনা, এতো বেশি না-হক কথা তখন আর কেউ লেখেনি। এই দুই হক কথার মধ্যে সম্পর্ক আছে বলে ধারণা করি। কেউ সঠিক জানাতে পারলে ভালো হতো
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ক্রিসেণ্ট প্রিন্টিং প্রেস থেকে মূদ্রণ হয়েছে এটার। ৪৩৫ এলিফ্যান্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা ১২১৭। দেশে গেলে খোঁজ নিয়ে দেখার ইচ্ছা আছে। অবশ্য, গিয়ে দেখবো সেই জায়গা আধুনিক হতে হতে নতুন কোন কসাইখানা হয়ে গেছে!
এই রকম চুরি ফরজ
তবে আপনার প্রথম প্যারার বক্তব্য নিয়ে আমার বলা-বক্তব্য আছে।
"বিশ্বাস" বলতে আপনি যদি যে-কোনও ধরনের বিশ্বাস (ধর্মে অবিশ্বাসও কিন্তু এক ধরনের বিশ্বাস) বুঝিয়ে থাকেন, তাইলে কোনও কথা নাই। আর যদি বুঝাইয়া থাকেন ধর্মবিশ্বাস, তাইলে দুইখান কথা আছে
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
ভয় নেই, আমরা একই তরঙ্গের মানুষ। বিশেষ কোন ধর্মে বিশ্বাসের কথা বলিনি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কিছু নাস্তিক চিনি যারা অত্যন্ত ধার্মিকভাবে নাস্তিকতায় বিশ্বাস করেন। এক বড়ভাই বলেছিলেন একবার, চাকরির বাজারে সফল হতে হলে 'রিলিজিয়াসলি' খুঁজতে হয়। তখন থেকেই মাথায় গেঁথে ছিল কথাটা।
সচলের মার্ক টুয়েন !!
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
বইটা গায়েব করার জন্য জাঝা আর লেখার জন্য বিপ্লব দিলাম বস।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
লুৎফুল আরেফীন, তারেক, ঝরাপাতাঃ ধন্যবাদ।
থার্ড আইঃ বেশরমকেও লজ্জায় ফেললেন!
মগবাজার থেকে ! আগে বলবেন তো ।
এলিফ্যান্ট রোড আর বড় মগবাজার - মেলাতে পারছি না। অনেককাল দেশে যাওয়া হয়নি, ঢাকা শহরের ভূগোল এতো পাল্টে গেলো? কি জানি!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
একদম একই চিন্তায় আমিও ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। তবে এই বইয়ের পাতায় পাতায় এত বেশি খাবি খেয়ে যাচ্ছি যে প্রকাশকের ঠিকানার গরমিলটা তেমন একটা গায়ে লাগছে না।
নতুন মন্তব্য করুন