বর্তমানে পৃথিবীতে দ্রুততম প্রসারী ধর্মটির নাম সম্ভবত অ্যান্টি-আমেরিকানিজ্ম্। দুই মহাসাগরের মাঝের প্রচণ্ড ধনী একটি দেশ বাদে সবার ভেতর শুধু একটাই চিন্তা, আমেরিকান পাওয়ামাত্র ‘ধর তক্তা, মার পেরেক!’ অন্যদিকে আপাতদৃষ্টিতে স্বার্থপর, নির্বিকার এই দেশটির লোকেরাও যেন উষ্কে দিচ্ছে সব বিরোধের আগুন। আসলেই কি তাই?
ব্যক্তিগতভাবে আমার রাজনৈতিক মত যেমনই হোক না কেন, আমার যাবতীয় কথা ও কাজের প্রকার ও উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, কিছু মানুষ ঠিকই এই লেখার ভেতর কিছু ষড়যন্ত্র খুঁজে পাবেন। আমির থেকে ফকির পর্যন্ত সবাই একমত হবেন যে পুঁজিবাদের দলে দালালের সংখ্যা আরও একটি বাড়ল। পৃথিবী নামের একটি গ্রহ যে ঐক্যের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে, এই মহাসত্য ক্ষণিকের জন্য হলেও আড়াল হয়ে যাবে। ধারণাতাড়িত বিশ্বাস, আর বিশ্বাসতাড়িত এই ‘সত্য’ শুধু দূরত্বই বাড়াবে। মেরুকরণের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষগুলোর জীবন থেকে যুক্তির বিচ্ছেদ শুধুই বাড়াবে। সাথে অপঘাতে মৃত্যুর আধুনিক সংস্কৃতির কথা নাহয় উহ্যই থাকল। তর্কের রাজ্যে এই পরিস্থিতি যতই খোরাক যোগাক, সাধারণ্যে শুধু দুর্ভোগই আনবে। এই লেখায় তাই খুব সরল, সাধারণ কিছু ‘নাগরিক মন্তব্য’কে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। আশা করি অতিসাধারণ কোন বিশ্লেষণ জুড়ে দেওয়া হবে না এর সাথে।
রাজনীতি নীতিহীনদের রাজ্য, তাই ও-পথে আগাবো না। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, আমরা এত পেছনে কেন? একযোগে সবাই এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমেরিকা’। ভাবতে অবাক লাগে। মনের কোণে এক ধরণের অধম হিংসাও সুরসুর করে। আবার মুদ্রার অপর পিঠটাও উপেক্ষা করতে পারি না। ‘চাহিবামাত্র ১৪ কোটি মানুষের দণ্ডমুণ্ড অধিকার করিতে বাধ্য থাকিবে’ কথাটা অনেক খুঁজেও কোন মার্কিন ডলারে পাইনি। যেমনটা পাইনি প্রকাশ্য অন্ধ বিদ্বেষ। তবে আমি কেন মেনে নেবো প্রচলিত সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব? কী করে মেনে নেবো যে বিধাতা বুদ্ধি দিয়েছেন বিশ্বাসের জন্য, বিবেচনার জন্য নয়?
বাংলাদেশ ডুবছে, এটা এখন সবাই জানেন। তবে কেউ জানেন না এই ডুবে যাওয়া কিসের জলে। পলিকাতর বঙ্গোপসাগরের, উন্নয়নের জোয়ারের, নাকি আর্তের কান্নার? এ-প্রশ্নের জবাব রাজনীতিতে নেই, আছে ব্যক্তির উপলব্ধিতে। ঘাটতি আমাদের ওখানেই। আমাদের বিশ্বাস আছে, ভক্তি আছে, আবেগ আছে, আক্রোশ আছে। নেই শুধু উদ্যোগ আর উপলব্ধি। বোধ করি আমাদের অসহায়ত্ব আর অসহিষ্ণুতার উৎসও তা-ই। দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘যত ব্যস্তই থাকো না কেন, নিজেকে স্বেচ্ছায় অজ্ঞতার কাছে সমর্পণ কোর।’ উদ্দেশ্যটা একেবারেই সরল। আত্মোপলব্ধি। আজকে আমাদের জীবনে এই একটি দিকে বড়ই দৈন্য। অস্থির জীবনে তাই একটাই সান্তনা, “সব দোষ আমেরিকার”!
দয়া করে কেউ ভেবে বসবেন না যে আমি নগ্ন আগ্রাসনের সাফাই গাইছি। আমি শুধু এই বিশ্বাসটুকুই প্রকাশ করতে চাইছি যে আমাদের বৃহৎ ও বিশদ উন্নয়নগুলো আমাদেরই দোষে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর পিছনে কোন জাতীয় বা আন-র্জাতিক অপশক্তির চেয়ে ব্যক্তিগত ঔদাসিন্য দায়ি বেশি। আমরা যতই নির্ধন হই না কেন, আমাদের সত্যিকার দুর্বলতাগুলো অনুভূতির রাজ্যে। নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করা এক আনুষ্ঠানিক অস্তিত্বে সীমিত হয়ে বেঁচে আছি আমরা আজকে। পরের আগ্রাসন নিয়ে আমরা যতটা চিন্তিত, নিজের ঔদাসিন্য নিয়ে আমরা ঠিক ততটাই নির্বিকার।
দূর প্রবাসে এই মার্কিন মুল্লুকে দিন কেমন কাটে, এটা জানতে চান অনেকেই। সবার প্রশ্নগুলোই একটু আগ্রাসী। কেউ সরাসরি প্রশ্ন করেন, বাদামী চামড়ার জন্য পথ-ঘাটে কী ধরণের ‘বিশেষ যত্ন’ পেতে হয়। কেউ আরেক কাঠি সরেস। প্রথম সুযোগেই ঢালাও ভাবে বিবিধ স্রষ্টা, ধর্ম, আর জাতি তুলে বিষোদগার শুরু করেন। তবে অধমের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে যে এই ধরণের সাধারণীকরণ নিজেকে সীমায়নেরই নামান্তর।
প্রতিটি রাষ্ট্রের চরিত্রেই কিছু দ্বিত্য আছে। কারণ রাষ্ট্র একাধারে অনেক রকম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়। রাষ্ট্রের কার্যকলাপ তাই সমগ্র জনগণের মানসিকতার প্রতিফলক হিসেবে সব ক্ষেত্রে সঠিক না। জাতির সাথে রাষ্ট্রের পার্থক্য শুধু কাঠামোতে নয়, চেতনায়ও। এই সহজ সত্যটি অনেক সমালোচকই ভুলে যান। কারও অপকর্মের সাফাই গাওয়া নয়, এই লেখার উদ্দেশ্য নিজেদের এই পথভ্রান্তিকে যথাসম্ভব সীমিত করা। যেকোন যন্ত্রের মত মানবজীবনও সময় ও সুযোগে সীমিত। যে-ধরণের সমস্যা নিয়ে আমরা অন্যকে শাপ দিয়ে নিজের সময় নষ্ট করছি, সেই সময় ও তার সুযোগ-ব্যায়ের দায় পর-প্রজন্ম মিটাতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই কারও।
আমাদের মুখ্য সমস্যাগুলো নিহিত এই সামগ্রিক উন্নাসিকতা আর অযৌক্তিক সাধারণীকরণেই। বঙ্গের ইতিহাস যেমন তৃণমূল থেকে নেতৃত্বের জন্ম দেওয়ার, তেমনি ব্যক্তির অনুসরণে গোষ্ঠির উন্মেষেরও। আজ সময়টা শুধু অসাধারণের অপেক্ষায় থাকার না, অসাধারণের জন্ম দেওয়ারও। এই মহাযোগের প্রথম পদক্ষেপই সাধারণ সচেতনতা। কিন্তু সাধারণ তো দূরে থাক, আমরা কি আদৌ ব্যক্তিগত পর্যায়েও এর চর্চা করছি? শুধু দোষারোপ আর অভিসম্পাতের সংস্কৃতি এক দিকে যেমন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বিশ্লিষ্ট করছে, তেমনি ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে উগ্র, ধর্মীয় অর্থোডক্সির প্রসারের। ভেদাভেদ ভুলে এদেশের অসামপ্রদায়িক মানুষগুলো হঠাৎ এক হয়ে যাবে, এমনটা আশা করা বাতুলতা মাত্র। একারণেই আজকে ব্যক্তিগতভাবে সরব হওয়ার গুরুত্ব এত বেশি।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এ-যুগে আমাদের অর্জনগুলো প্রসারিত করে দেবার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ কতটুকু? জ্ঞানভিত্তিক শ্রেণিবিভাজনের নব্য বাস্তবতায় পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কথা বাদ দিলাম। শিক্ষিত বাঙালির দেশাত্মবোধ আজ কতটা জাগ্রত? ঘটে যাওয়া অগণন অপকর্মের প্রতি নির্বাক সমর্থনের দায় কি অন্যের ঘাড়ে চাপানোর জো আছে? মার্কিন ‘ষড়যন্ত্র’ যদি থেকেও থাকে আমাদের বিপর্যয়ের জন্য, তাকে কি সর্বতোভাবে দায়ী করা যায় আমাদের ঔদাসিন্য আর বিফলতার জন্য? রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের জন্য সমগ্র জাতিকে দায়ী করাই বা কতটা ন্যায্য?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আজ সভ্য ও বুদ্ধিমান প্রতিরোধের অনেক উদাহরণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘ষড়যন্ত্র’ গুলো তাদের ক্ষেত্রে কিছুমাত্র নমনীয় নয়, যেমন নমনীয় নয় তাদের প্রতিযোগী মনোভাব। শত্রুতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিার গুণগত পার্থক্য এখানেই। শত্রুকে শুধু ঘৃণাই করা যায়, কিন্তু যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বড় প্রশিক্ষক দুর্লভ। তাই সময়টা প্রতিহিংসাকে প্রত্যয়ে রূপান্তরের। পরের আদর্শ থেকে পরিশ্রম আর নিয়মানুবর্তিতা ধার নেবার, নিজের আদর্শ থেকে সহনশীলতা আর সততা তুলে ধরার। ওতেই মন, ওতেই মানুষ।
ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০০৫
মন্তব্য
ঠিক আছে।
-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...
এই লেখায় প্রথম পাঁচ, দ্বিতীয় মন্তব্য দিতে পেরে আমি রীতিমত গর্বিত।
সুউউউউপার!! দারুণ!
ঠিক এরকমই একটা লেখা লিখবো ভাবছিলাম। এখন তো দেখলাম রিডানড্যান্ট!
পিলখানায় ঘটে যাওয়া একাধার বিদ্রোহ, খুন আর রাহাজানির ঘটনার পর বিভিন্ন মহলের অভিনব বিশ্লেষনের ভিরে যেই বার্তাটি খুজে পাইনি সেটা হল বিডিয়ার কর্মীদের ক্ষোভের আপেক্ষিক গুরুত্ব। আস্তে আস্তে হারিয়ে গেছে সেটা ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ভীরে। সেই মুহূর্তের অস্থিরতায় এই সচলে আমার প্রথম পোস্টটি লিখি অনেকটা নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। কতজনইত কতকিছু লিখলেন - কিন্তু কাজের কাজ কি হল? এখন বিডিয়ারের প্রধান দাবি জানাচ্ছেন যাতে বিডিয়ার সদস্যদের নির্বিচার শাস্তি দেয়া যায়। যাই হোক আমার মনে হয় আমাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পছন্দ করার প্রবনতাটি এখনো ব্যপকভাবেই সাধারন। এটা থেকে বের হয়ে আমরা যদি পরস্পরকে বিশ্বাস করতে না পারি তাহলে আমাদের পশ্চাদ্গতি থামান অদূর ভবিষ্যতে বোধহয় হয়ে উঠবেনা।
নতুন মন্তব্য করুন