প্রথম যাযাবর - ১

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: বিষ্যুদ, ১০/০১/২০০৮ - ২:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[আজকে দেশান্তরের চার বছর পূর্তি। দিনটা এমনি এমনি করেই কেটে গেল। অনেক কিছু মনে পড়ছিল। পৃথিবী গোল কিনা তা আজও তর্কাতীত নয়, তবে এই চার বছরের অভিজ্ঞতায় নিশ্চিত ভাবেই জানি যে জীবন গোল। কেন এবং কীভাবে, তা অন্য কখনও।

দেশ ছাড়ার সময়কার ডায়েরিটার কথা মনে পড়লো বহুদিন পর। প্রবাসের মোহে দেশকে ভুলে যাবার ভয়ে লিখে রেখেছিলাম তাৎক্ষণিক অনুভূতিগুলো। সাথে ছিল লে-ওভারের বিষাদ ও তিক্ততা ভুলে থাকার অক্ষম প্রয়াস। কিছু পাতা তুলে দিলাম। দুঃখের মাঝে অক্ষম প্রবোধের চেষ্টাগুলো দেখে নিজেরই হাসি পাচ্ছিল খুব।]

জানুয়ারি ০৯, ২০০৪
১৯:০১
এই মুহূর্তে বসে আছি ব্যাংকক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। এখানকার সময় ঢাকার চেয়ে ১ ঘন্টা এগিয়ে (২০:০১)। পথে যেতে যেতে আরো দু’বার সময় ঠিক করতে হবে, তাই কষ্ট করে আর ঘড়ির কাঁটা নাড়ালাম না। সেই স্কুল ফেয়ারওয়েলের দিন থেকে ঘড়িটা পড়ছি, কিন্তু এতদিন ঘড়িটার টুয়েন্টিফোর আওয়ারস ডায়ালটার ব্যবহার বুঝিনি। আজকে বুঝলাম। বেশ কাজে দিচ্ছে।

যাঁরা নিয়মিত ডায়েরি লেখেন, তাঁরা কীভাবে সারাদিনের আবেগ সামলাম, জমিয়ে রাখেন, আবার নির্দিষ্ট সময়ে জাবর কাটার মত করে তা রিভাইজ করেন, সেটা বুঝে উঠতে পারিনি কোনদিন। আজও পারছি না। প্রতি বছর আমার একটা করে ডায়েরি পাওয়া হয়। ডায়েরিটার গন্ধ শোঁকা হয়, পাতা ওলটানো হয়, প্রথম কিছুদিন ধরে প্রচন্ড আবেগে আর “যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা”র সাথে অনেক কথা লেখা হয়। তারপর জীবন জাপটে ধরে, মোহ ছুটে পালায়। প্রতিদিনের জীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলো হয়ে যায় “অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল”! ডায়েরি লেখাটা তাই এক ধরনের ‘অবান্তর অভ্যাস’ বলে মনে হয়। জীবনের আবেগ, অবদান, আর অবমাননাগুলো যদি ধরে না-ই রাখা গেল, তাহলে অযথা সময়ের বিপরীতে ঘটনা লিখে রেখে নিজেকে মানুষ(?) থেকে যন্ত্রের পর্যায়ে নামাবার কী অর্থ হয়? কথাগুলো সত্য এবং সুচিন্তিত। সমাধানও চোখের সামনেই ভাসছে – যখনকারটা তখন লিখে ফেললেই হল!

দুঃখের বিষয়, এই কাজটাই আমার করা হয় না। ঘটনা যখন ঘটে, তখন মনের একটা অংশ ব্যস্ত থাকে তাকে অনুভব করতে। আর বাকি অংশটা প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় ঐ অনুভূতিগুলো আড়াল করতে। সংক্ষিপ্ত, সংশোধিত(?), বা পরিমার্জিতভাবে সেটা লিখে রাখার ক্ষেত্রে ডায়েরির ভূমিকা আছে জানি, কিন্তু তাতে নিংড়ে দেওয়া আবেগটুকুর নিরাপত্তা আছে কিনা জানা নেই। এই একটা কারণেই মূলত ডায়েরি লেখা হয়নি এতকাল।

আরো একটা ব্যাপার খুব বিরক্ত করতো। প্রতিটা পৃষ্ঠার উপরের তারিখগুলো খুব চোখে লাগত। একেকটা ফাঁকা পৃষ্ঠা যেন কটাক্ষ করে বলত, “দেখ, তোমার জীবন কত শূন্য!” এমনি করেই অনেকগুলো দিন গেল। ২১ বছর ৪১ দিনের মাথায় দাঁড়িয়ে আজকে মনে হচ্ছে উলটো কথা। আমার জীবনে অনেক ঘটনা আছে। অনেক বাঁক, উক্তি, আনন্দ, আর সিদ্ধান্ত আছে। আজকে আমি শুধু “কী”টুকুর জবাব জানি, “কেন”টুকু কোন এক কালে জানতাম, আজ মনে নেই! যেমন মনে নেই কেন আজকে দুপুরে কাঁদিনি।

একেবারে কাঁদিনি বললে ভুল হবে। মা’কে শেষ আলিঙ্গন থেকে ছেড়ে আসার সময় চোখটা কেঁপে উঠেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সামলে নিয়েছিলাম। কায়দাটা সহজ। চোখ সরিয়ে নাও, অপ্রাসঙ্গিক কিছু ভাবো, আর প্রচন্ড জোরে চোয়াল কামড়ে রাখো। কায়দাটা প্রত্যেকের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় খাটলেও মা’র বেলায় খাটেনি। অনেক চেষ্টা করেও সিকিউরিটি গার্ডটার দিকে তাকাতে পারিনি, শচীনের ওয়ান ডে সেঞ্চুরির সংখ্যা মনে করতে পারিনি, আর চোয়াল শেষ কবে এত জোরে চেপে রেখেছি জানি না। কাঁদিনি সত্যি, তবে বুকটা যেন কেমন করেছে! মনে হয়েছে এক মুহূর্তে আমার সবকিছু বদলে গেল। সমস্ত আত্মসম্মানবোধ এক মুহূর্তে ছুটে গেল। নিজেকে আর কোনদিন এতটা অপরাধী মনে হয়নি। প্রথমবার নিকটজনদের বাঁকা কথা, আর দ্বিতীয়বার বন্ধুদের সামান্য ‘অমিতাচার’ – এইটুকুই তো ছিল যাবতীয় ঘটনার মূল! তার জন্য শাস্তিটা বেশিই হয়ে গেল হয়তো। এতটুকু অভিমানের দায় যে এত বড় দায়িত্ব, সেটা কি আর আগে জানা ছিল না? যাক, কোন ধরনের রিগরেট কাজ করছে না। বরং এই ক্ষুদ্র(?) অপরাধবোধটুকুই আমাকে শেষ অবধি চালাবে, এটাই বিশ্বাস। আমি ফর্চুন, রেসিডেন্স, ফেইথ, ফেইম, কিংবা অপর্চুনিটির জন্য কোন স্বপ্নের দেশে যাচ্ছি না, আমি ইচ্ছাপূরণের দেশে যাচ্ছি স্বেচ্ছানির্বাসনে। পিছুটান শুধু একটাই – এই চোখের পানির দাম শোধ।

থাই এয়ারওয়েজের টিজি ৩২২’তে চড়ে ব্যাংকক এসেছি। ১৩:১০ এর ফ্লাইট ১৩:৪৫’এ ছেড়েছে। টেক অফ করেছে ঠিক দুপুর ১ টা ৫৫ তে। আর পারিনি, চোখের পানিগুলো ছাড়তে হয়েছে। দুই চোখ থেকে এক ফোঁটা করে দুই ফোঁটা অশ্রুর বিনিময়ে আমি সহ্য করেছি সবক’টা বন্ধন একসাথে ছেঁড়ার যন্ত্রণা। এ যে কেমন যন্ত্রণা! এই আগুন আমি নেভাবো কীভাবে! নিজেরই ভাষায় বলতে গেলে “পালিয়ে বিয়ে করা মেয়ে”র মত বিদায়ের আসরে কান্না আটকে রেখেছিলাম। কেন? কীইবা এমন হত নিজেকে নিজের রক্তের কাছে হারতে দিলে? আগামী অনেক দিন কাঁদতে পারবো না। মনটাই মরে গেছে, কান্না আসবে কোত্থেকে? এক সময় নিজেকে “শক্ত” ভেবে খুব গর্ব হত, আজকে মনের একটা অংশ ঐ চিন্তাকেই ধিক্কার দিতে চাইছে। যাক, যা হবার হয়েছে। মেল্টিং পটে যাবার আগে আর সবার মত আমিও একটু তরল হলাম আর কি! এবার নিজেকে সামলাতে হবে। জীবনের অনেক ধাক্কা খেলেও কোনদিন হারিনি। এবার তো হারার প্রশ্নই ওঠে না। অনেকদিন ধরে জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়েছি, এবার পুনর্জন্মের পালা।

ব্যাংককের সময় অনুযায়ী রাত ১২:৫০’এ কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের কেই ৬৫২’তে সৌল যাবো। মাঝে প্রায় সাড়ে আট ঘন্টা বসে থাকতে হবে। বেকুবের মত ঘন্টাখানেক এদিক-ওদিক হাঁটলাম, বিশাল শপিং মলের মত এই এয়ারপোর্টটায় ঘুরলাম, অনেক খুঁজে একটা ফোন বুথ বের করলাম। জিজ্ঞেস করে শুনি ১০০ বাথের কার্ড কিনে কল করতে হবে। আমার আবেগ শুকালেও(?) আমার মা’র আবেগ শুকায়নি। প্রথমবার বের হলাম, তাও আবার একা, অপরিণত, আর অসম্মত পরিবেশে। একটা ফোন তো করা দরকার! ঐ দিকে আবার তিন ডলার লাগবে কল করতে। সাত-পাঁচ (অ্যাকচুয়ালি, ১১৪-৩ ভাবতে ভাবতে... ১১৪ বাথ = ৩ ডলার!) ভাবতে ভাবতে পায়চারি করছিলাম। হঠাৎ, সামনে দেখি ঐশী!

এই বোঁচা নাক আর ভাঙা ইংরেজির দেশে ঐশী কেন? একটু পরে ব্যাপারটা খোলাসা হল। এতক্ষণে হালকা চালের চিন্তাগুলো ফিরে আসলো, মাথাটাও ঘুরতে শুরু করলো। মনে হল, ডলারের চেয়ে মায়ের দাম বেশি। ডলার ভাঙিয়ে বাসায় ফোন করলাম, অর্ণব আর মা’র সাথে কথা বললাম। ১০০ বাথের আর ১১ বাথ বাকি। পারলে যাওয়ার আগে ফোন করবো। এখানেই পানিরও অনেক দাম, তাই টয়লেটের কলের পানি দিয়েই পিপাসা মিটালাম।

ঐশীর ব্যাখ্যা দিয়েই শেষ করি। হাঁটতে হাঁটতে একটা খাবারের দোকান পড়েছিল সামনে। বি-শা-ল। নামঃ ঐশী টেকঅ্যাওয়ে স্ন্যাক্স অ্যান্ড সুশি। পরশু রাতে কথা বলার সময় ও মাত্র(?) ১২ বার খাবার-দাবারের কথা বলেছিল। আড়াই ঘন্টায় ১২ বার, গড়ে প্রতি ১২ মিনিটে ১ বার। কাকতালীয়? আশা করি, তবে ঠিক নিশ্চিত না। দোকানটা সেকেন্ড ফ্লোরে (সম্ভবত), ব্যাংকক মিলিটারি ব্যাংকের ঠিক উলটো দিকে। বাংলায় ঐশী খুব সুন্দর নাম, থাই ভাষায় পাপড় ভাজা কিংবা বেগুনের হালুয়া(?) টাইপ কিছু কিনা কে জানে! জেনে আসা যায়।

দোকানটা থার্ড ফ্লোরে। শুধু স্ন্যাক্স অ্যান্ড সুশি না, ঐটা একটা বার। শব্দটাও থাই না, জাপানি। অর্থ হল সুস্বাদু, ডেলিশিয়াস। জানলাম। শিখলাম। দোকানটা থেকে একটা খালি বাক্স চেয়ে নিয়েছি। এভিডেন্স!

ঢাকা-ব্যাংকক অংশটুকু আসতে ২ ঘন্টার কিছু বেশি লেগেছে। সামনের পথটুকু (ব্যাংকক-সৌল) যেতে প্রায় সোয়া ৭ ঘন্টা লাগবে। এয়ারপোর্টে বসে বসে শুকনো খাবার পেলেও পানি পেলাম না। ২ ঢোক পানির দাম যদি ৩০-৪০ বাথ হয়, তাহলে কি আর তেষ্টা মেটে? কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের কেই ৬৫২র জন্য চেক-ইন করে টয়লেটে গেলাম। ছাড়তে না, খেতে (থুক্কু, “পান করতে”)। হাত-মুখ ধুয়ে কয়েক ঢোক গিলতেই দেখি পাশের বেসিনে এক লোক পা ধুচ্ছে! এবারের মতও মন ভরে পানি খেতে পারলাম না। এখন ১১:৩৬ বাজে। আরও ঘন্টা খানেক সময় আছে। চেষ্টা করে দেখবো আরেকবার। প্লেনে উঠে বোতল চাবো।

পথ চলতে চলতে আরো কিছু নাম চোখে পড়লো। ঢাকায় এক লোক লাগেজে ব্যাটন রুজ দেখে সেধে কথা বললো। বললো তার নাম সনেট। আমাদের ক্লাসে ঐ নামে একটা ছোটখাটো ছেলে ছিল। আর এই এয়ারপোর্টের টয়লেটের অটো-ফ্লাশ সিস্টেমের ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির নাম ‘সানা’। ডিবেট বিডি, ডিবেট্রিক্স, গ্রুপ অফ ডিবেটারস, আর আইবিএ’র সানা ভাই। আম্মু ফোন ধরলে চিরকাল “ছানা” শুনতো।

পাসপোর্ট রাখার পাতলা প্যাকেটটা ছিড়ে গেছে। চোখের প্রেসক্রিপশনের প্যাকেটে রেখেছি।

(চলবে)


মন্তব্য

শেখ জলিল এর ছবি

ডায়েরীকথন বেশ ভাল্লাগছে।
চলুক আরও...

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

অসাধারণ হচ্ছে ইশতিয়াক। চালিয়ে যান।
চোখের পানি আটকানোর কৌশলটা দিয়ে ভালো করেছেন। যা লিখেছেন সেটা পড়ে পানি আটকানোটা জরুরী হয়ে পড়ে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

পুরনো ডায়েরি আসলে সঞ্চিত পুরনো মোহরের মতো। বাক্স খুলে বের করলে আলো ঠিকরে বেরোতে থাকে। আরো দেখার (পড়ার) অপেক্ষায় থাকছি।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নিঝুম এর ছবি

অনেকদিন ধরে জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়েছি, এবার পুনর্জন্মের পালা।

খুব ভাল্লাগ্লো পড়তে।
কি এত দুঃখ জিজ্ঞেশ না করি...
যুদ্ধে জিততে হবেই।
এই চাই,এই কেবল কামনা।

মঙ্গল হোক আপনার।
---------------------------------------------------------
যাগায় খাইয়া যাগায় ব্রেক...

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

কনফুসিয়াস এর ছবি

কান্না চেপে রাখার আইডিয়াটা ভাল তো।
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে। বাকিটা আবার নিজের ঘরে ফিরে তুলে দিবো। আপাতত দিন তিনেক বিগ অ্যাপলে মাছি মেরে নেই।

নিঘাত তিথি এর ছবি

খুব ভালো লাগছে পুরনো ডায়েরী-কথন। চলুক আরও।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

সিরাত এর ছবি

অতি জোস। খুব ভাল লাগলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।