লুইস, হায় লুইস

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: রবি, ১৫/০৭/২০০৭ - ২:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত সাড়ে তিন বছর ধরে বসবাস আমার লুইজিয়ানায়। দেশ থেকে দূরে, তবু যেন দেশেই ছিলাম। গরম, গরীব, গতানুগতিক। বরফ পড়েনি এখানে কখনও। চামড়া পোড়ানো গরম। আর্দ্রতা কম বলে ঘাম কিছু কম হয়, এটাই পার্থক্য। আরও একটা পার্থক্য আছে। শীতল বাতাস দেহ জুড়ায় যেকোন দালানে ঢুকলেই, এটা বড় সুবিধা। আমি খুব সাধারণ, ভেতো বাঙ্গালি। শীতের চেয়ে গরম সয় বেশি। আমার হতাশা অন্য।

এখানেও পথহারা পথিক পথে বসে থাকে। জীবনযুদ্ধে শ্রান্ত, পরাজিত মানুষ খুব একটা দুর্লভ না এখানে। বিদেশে একটা দেশ-দেশ ভাব থাকা ভাল। প্রাথমিক ধাক্কাটা সইতে সহজ হয়। আমার জন্যও ব্যাপারটা সেরকম ছিল। ব্যাটন রুজে আছি শুনে লোকে ঠাট্টা করে বলতো, গ্রামে আছি। তেমন কোন হাই-রাইজ নেই। স্কাই-স্ক্রেপার নেই। সাবওয়ে তো দূরের কথা, ইজ্জতসম্পন্ন একটা বাস সার্ভিসও নেই। বড় ফ্র্যাঞ্চাইজ নেই। বিনোদন নেই। হোটেল নেই। পার্ক নেই। স্থাপত্য নেই। যাদুঘর নেই। টুকটাক বার আছে, তবে একটা স্ট্রিপ ক্লাবও নেই! নেই বলেই লুইজিয়ানাকে ঘিরে আমার এত স্বপ্ন। কারণ এই নেইগুলোর জন্যই লুইজিয়ানা আমার কাছে বাংলাদেশের প্রতিভূ। এখানে যা সম্ভব, তা বাংলাদেশেও সম্ভব। আকার এক রকম, পরিবেশ এক রকম, সামর্থ্য এক রকম, মানুষ এক রকম। দুঃখের কথা, রাজনীতিকগুলোও এক রকম। এই চাঁড়ালগোত্রীয়দেরই কিছু কথা জানাই।

টেক্সাস আর লুইজিয়ানা পাশাপাশি অঙ্গরাজ্য। আকারে দুটোই বেশ বড়। লুইজিয়ানাকে ফ্রান্সের কাছ থেকে কেনা হয় ১৮০৩ সালে। এই ক্রয়ের প্রধান কারণ ছিল নিউ অর্লিয়েন্সের নৌবন্দর। মিসিসিপি নদী এদেশের অর্থনীতির প্রাণ। তাই সেই নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ পেতে নিউ অর্লিয়েন্সকে নিয়ন্ত্রণে আনা। আজও এই বন্দর ভৌগোলিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবু কত মলিন, কত অযন্তলালিত এই শহর, তা সবাই দেখেছেন হারিকেন ক্যাটরিনার পর। কারণ, অব্যাবস্থাপনা। অপরপক্ষে পাশেই গ্যাল্ভাস্টোন বন্দর কাজে লাগিয়ে টেক্সাস এগিয়ে গেল।

টেক্সাস ও লুইজিয়ানায় একই সময়ে বিপুল পরিমাণ তেলের সন্ধান মেলে। টেক্সাস সেই তেলের টাকায় বিশাল সব রাস্তা বানায়, ট্রান্সপোর্টেশন ইন্সটিটিউট তৈরি করে, পাবলিক এজুকেশন রিফর্ম করে, এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। তাকিয়ে দেখুন ফলাফল টুকু। পাশেই লুইজিয়ানা সেই টাকা খাটায় একের পর এক ক্যাসিনো বসিয়ে। কারণ, অদূরদর্শিতা।

পুরো আমেরিকায় লুইজিয়ানার খ্যাতি আছে এর জোচ্চোর রাজনীতিবিদদের জন্য। টেক্সানরাও বেশ খ্যাত, তবে গোঁয়ার ও মাথামোটা হিসাবে। কিছুদিন আগে লুইজিয়ানার ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান জেফারসনের অফিসের ফ্রিজ থেকে এক লাখ ডলার পাওয়া গেছে। তদন্ত চলছে। এর মাঝে নির্বাচন হয়েছে। তিনি পুনর্বার জয়ীও হয়েছেন। টাকা কোথা থেকে এসেছে তিনি জানেন না, তবে এটুকু জানেন যে টাকাগুলো পবিত্র। লুইজিয়ানাকে আজ বাকি আমেরিকা টাকা দিতে চায় না দুর্নীতির ভয়ে। কারণ, রাজনীতিকের অস্বচ্ছতা।

পরের ঘটনা এই সেদিনের। ধর্মান্ধ রিপাবলিকানদের দল থেকে সমকামীতাবিরোধী ও গর্ভপাতবিরোধী এক কট্টর সিনেটর ডেভিড ভিটার ফেঁসে গেছেন নেগোশিয়েবল ভালবাসায় গা ভাসানোর দায়ে। তিনি নির্বাচনের সময় নিজেকে আর দশজন মানুষের চেয়ে অতি উচ্চ মূল্যবোধের বলে দাবি করে অপদস্থ করেছেন অনেককে। সেই তাঁরই নাম ফাঁস করে দিয়েছে ল্যারি ফ্লিন্টের হাসলার ম্যাগাজিন। ভিটার ১৯৯৯-২০০০ সালে নিউ অর্লিন্সের এক বিশেষ শ্রেণীর সমাজকর্মীনীদের নিয়মিত সেবা করতেন, নিতেন। তিনি এতই উঁচু মাপের সমাজঅন্তপ্রাণ ছিলেন যে তাঁকে ব্যাক্তিগত সেবা দিতে সমাজকর্মীনির দল প্রায়ই লটবহর সহ চলে আসতেন গাড়ি করে। এই খবর বের হবার পর তিনি বলেন, এই পাপের জন্য তিনি তাঁর স্ত্রী এবং ইশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, এবং দুজনের কাছেই ক্ষমা পেয়েছেন। মানুষ হিসেবে আমি এমনিতেই নাফারমান। ভাবছি ইশ্বরের সাথে এই সুবাদে আমিও একটু সাক্ষাৎ করে ফেলি। লুইজিয়ানাকে কেউ গুরুত্বের সাথে দেখে না। কারন, ভণ্ডামি।

এক কালে বন্ধুমহলে বলেছিলাম, নারীমাত্রই দেবী, দেবীমাত্রই আরাধ্য, আরাধ্যমাত্রই দ্রষ্টব্য, আর দ্রষ্টব্যমাত্রই ধর্তব্য। সেই আমিই ভাগ্যের ফেরে লুইজিয়ানায় এলাম কিছুকাল পর। এখানকার রাজনীতি দেখে বন্ধুদের বলা কথাটাই আমিও বললাম সেদিন মনে মনে। লুইস, হায় লুইস।

এই হল আমার আবাস। আমেরিকার মধ্যেও ছোট্ট এক টুকরো বাংলাদেশ। এত কিছুর পরও জায়গাটা ভাল, এখানকার জীবনটা ভাল, সাধারণ মানুষগুলো ভাল। এখানেই লুইজিয়ানায় বসে আমার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা। বাংলাদেশ যদি অন্তত লুইজিয়ানা হত!


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

পড়ে মজা পেলাম। বাঙ্গালী কিরকম ওখানে?

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এক কালে আমরা ২০-২৫ জন ছাত্র ছিলাম। এখন ছাত্র মাত্র ৪-৭ জন। ভিসা দেয় না তেমন একটা আর। এখানে টিউশন অনেক কম ইন্টারন্যাশনালদের জন্য। এই জন্য অনেকেই আসতো। কমিউনিটি মেম্বার শ'খানেক হবে। নিউ অর্লিয়েন্সের কথা আলাদা। ওখানে অনেক বাঙ্গালি। মূলত পেশাজীবি।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আমার এক বন্ধু আছে লুসিয়ানায়। নাম ব্র্যাড। কাসেলে আসছিল এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসাবে। ছেড়াবেড়া বড়লোক। অনেক কাহিনি শুনছিলাম লুসিয়ানার চোর-ছ্যাচ্চরদের নিয়া।
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমার এক নাইজেরিয়ান বন্ধু বলেছিলো, তাদের দেশে যার আছে তার সব আছে, যার নাই তার কিছুই নাই। লুইজিয়ানাকে আমি আমেরিকার নাইজেরিয়াও বলি এই জন্য। প্ল্যান্টেশনের মালিক ছিল সব সাদাই। রাস্তায় বিএমডব্লিউ ভরা। আসলেই ছেড়াবেড়া রকম বড়লোক সাদাগুলা। রেডনেকের কিস্যা শুনাবো পরের দফায়।

অমিত এর ছবি

এত কাছে থাকলাম, আর মার্ডি-গ্রাতে যাওয়া হল না কখনো। অবশ্য বউ সংগে থাকাও এর একটা বড় কারণ।টেক্সাস থেকে ফ্লোরিডার ট্রিপটাতে লুইজিয়ানার উপর দিয়ে যেতে হইসিল আই ১০ ধরে।অন্য রকম লেগেছিল।

_____ ____________________
suspended animation...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

একই আফসোস আমারও। যে ক'দিন একা ছিলাম, তখন গাড়ি ছিল না। যখন গাড়ি হল, তখন মা সাথে! তবে যেকোন উৎসবেই প্যারেড হয় বেশ। মানুষগুলা অতিরিক্ত রকম ফ্রেন্ডলি। এটা আমি আর কোথাও পাই নাই আমেরিকায়।

??? এর ছবি

অভি, চালায়া যান। আরো আরো লুইজিয়ানা স্টোরি শুনতে চাই।

"লুসিয়ানা স্টোরি" নামে একটা ক্লাসিক ডকু দেখছিলাম বহু আগে। তবে ঐ লুসিয়ানা মনে হয় স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কোনো খানে। মনে নাই।

তিমুর এর ছবি

ইউএস সুপ্রিম কোর্ট সম্বন্ধে ফ্লিন্ট সাহেবের বক্তব্য ভোলার নয়!

দিলে ব্যান খাবো কিনা জানি না তাই দিলাম না!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ল্যারি ফ্লিন্টকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে। লোকটার জীবন বেশ মজার। কষ্টেরও। তবে সুপ্রিম কোর্টকে ব্যাটা যেভাবে নাচাইসিলো!

??? এর ছবি

ঐ যে... কী এক পর্ণো ম্যাগাজিনের সম্পাদক তো? মুভিটার নাম যেন কী? ভুইলা গেছি।

অমিত এর ছবি

_
the people vs larry flint

______ ____________________
suspended animation...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমার বেশ মজা লাগসে মুভিটা দেখে। জেরি ফল্ডওয়েলকে যেভাবে পঁচালো, সেভাবে যদি আমাদের দেশে কেউ সাঈদীকে পঁচাতো!

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

পড়ছি ... চালায়া যঅ দোস্ত হাসি

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

যঅ ইকুয়েলটু যাও হাসি

দ্রোহী এর ছবি

এল.এস.ইউতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ওহাব সাহেব আমার খালু শ্বশুর।

চিনেন নাকি?


কি মাঝি? ডরাইলা?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

চিনি তো! খুব ভাল মত চিনি। অস্ট্রেলিয়া ছিলেন, আবার আসলেন কিছুদিন আগে। আন্টি ভাল গান করেন, তবে কথা ভুলে যান মাঝেমধ্যে। হাসি

সিরাত এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।