দেশ ছেড়েছি প্রায় ছয় বছর হতে চললো। প্রবাসে এসে অবধি এখানে-সেখানে কাটছে যাযাবরের মতো। ইতোমধ্যে ভিন্ন স্বাদের তিনটি শহরে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকা হয়ে গেছে, সাকুল্যে ডজন খানেক ঠিকানা হয়েছে। পশ্চিমের কিছু অঙ্গরাজ্য বাদ দিলে আমেরিকায় ঘুরে বেড়িয়েছি প্রায় সব কোণে। সেই সূত্রে পথ চলতে দেখা হয়েছে কিছু অসামান্য মানুষের সাথে। এঁরা মানবের অবয়বে দেবতা, এঁদের সান্নিধ্যসুখ পাওয়ায় আমি নিজের জীবনকে ধন্য ও পূর্ণ মনে করি। তেমনই একজন মানুষ হলেন লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-গবেষক ডঃ ভব রঞ্জন সরকার –সবার ভব দা’, আমার ভব আঙ্কেল।
ইচ্ছা ছিলো জীবনের শেষাংশে উপনীত হয়ে আমার দেখা কিছু অসামান্য মানুষকে নিয়ে লিখতে, যাতে উত্তরপ্রজন্ম ভবেশ রায়ের ‘মনীষীদের কথা’-য় বর্ণিত দূর অতীতের কিছু মহামানবের পরিবর্তে আমার জীবদ্দশায় দেখা মহামানবদের সম্পর্কে জেনে বড় হয়। ভব আঙ্কেলের অসামান্য কৃতিত্ব সেই অবসর দিলো না।
খবরটা ফেসবুক মারফত পেলাম ছোট ভাইয়ের কাছে। Production and Operations Management –এর উপর গত পঞ্চাশ বছরে প্রায় ৬৩ হাজার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে। সেগুলোর উপর ভিত্তি করে গবেষকদের উৎপাদনশীলতার সমীক্ষা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে ডঃ ভব রঞ্জন সরকারের অসামান্য কীর্তির কথা।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত অর্ধশতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রকাশিত গবেষণাপত্রের তালিকায় তিনি প্রথম ২০ জনের একজন। শুধুমাত্র গত দশ বছর বিবেচনায় নিলে তাঁর অবস্থান ৬ষ্ঠ। সমীক্ষাটি প্রকাশিত হয়েছে International Journal of Production Economics -এ। এক সহকর্মী জানানোর আগ পর্যন্ত কাজপাগল, নিভৃতচারী মানুষটি জানতেনও না এই খবর।
আগ্রহী কেউ বিস্তারিত সংবাদ পড়তে পারেন এখানে।
শুধু গবেষণার সংবাদ দিয়ে এই মহামানবকে চেনা অসম্ভব। ভব আঙ্কেল ও লোপা আন্টি ছিলেন লুইজিয়ানায় থাকাকালীন আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি।
আমার ছোট ভাই এদেশে আসার পর তাকে ভর্তি হতে হয় বাড়ির পাশের খুব নিম্নমানের একটি স্কুলে। ভাই আমার আফসোস করে বলেছিলো, বাংলাদেশেও ও এর চেয়ে ভালো স্কুলে পড়াশুনা করেছে। লোপা আন্টি এই স্কুলে ভর্তির খবর জেনেই আমার ভাইকে নিয়ে গেলেন ব্যাটন রুজ ম্যাগনেট হাইস্কুলে। স্কুলটি আমেরিকার সবচেয়ে মানসম্পন্ন সরকারী হাইস্কুলগুলোর একটি। লোপা আন্টি না থাকলে আমার ভাই ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় না, দু’বছর যাওয়ার পর স্কলারশিপসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে না।
২০০৮-এর শুরুতে আমার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে-সময় তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, শুশ্রুষা ও সঙ্গ দেওয়া, ইত্যাদি সব করেছেন লোপা আন্টি। একই দেশে থেকেও আমি পাশে থাকতে পারিনি, কিন্তু মন নির্ভয় ছিলো শুধু তাঁদেরই ভরসায়। আমার সহপাঠী, বন্ধু, ও সহ-সচল পুরুজিত ব্যাটন রুজ আসবার পর লোপা আন্টি ওকে কিছুদিন নিজের বাসায় রেখেছিলেন। বুয়েট থেকে মাঝপথে চলে আসা পুরুজিতকে স্কলারশিপ যোগাড় করে দিতে নিজে ধর্ণা দিয়েছেন প্রফেসরদের কাছে। সেই সময়ের বিস্তারিত নাহয় পুরুজিতের জন্যই রেখে দিলাম।
যতদিন ধরে ভব আঙ্কেল ও লোপা আন্টি আমেরিকায়, তার প্রতি বছরেই কেউ না কেউ তাঁদের বাসায় ছিলেন। দেশ থেকে নতুন কেউ এলেই তাঁদের বাসায় প্রথম আশ্রয়। নিজ গরজে তাঁরা সবাইকে কাজ খুঁজে দিয়েছেন, স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন, নিজেদের কাজ-কর্ম ফেলে এদিক-ওদিক নিয়ে গেছেন। তাঁরা শিক্ষকতার সীমিত উপার্জনের তিল পরিমাণ অর্থ অপচয় করেন না, বরং মানুষের লেখাপড়ার পেছনে খরচ করেন। বছর বছর দেশে গিয়ে বিনা পয়সায় পড়িয়ে আসেন, দেশ থেকে নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রী আনেন। অপূর্ব উদারতার সাথে ছাত্রদের বুকে আগলে রাখেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে অকৃপণ ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন নিয়মিত। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, ২০০৫-এর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ভব আঙ্কেলকে বলা হয়েছিলো বাংলা নিয়ে কিছু বলতে। দূরে বসেই গবেষণা করে তিনি বক্তৃতা তৈরি করেন। আমি আজও সাথে রেখে দিয়েছি অভিসন্দর্ভতুল্য সেই লেখার একটা কপি।
বলতে থাকলে লেখা আরও বড় হতেই থাকবে। হয়তো কোনোদিন লুইজিয়ানার ব্যাটন রুজে ছোট্ট একটা ফলক স্থাপন হবে, বেড়াতে গেলে বাঙালিরা সেখানে পা রাখবেন; ঠিক যেভাবে আমরা সাগরদাড়ি বা জোড়াসাঁকো বেড়াতে যাই। ইচ্ছা ছিলো লেখাটা সেদিনই লিখবো, সেদিনই ডঃ ভব রঞ্জন সরকার ও লোপা সরকারকে পরিচয় করিয়ে দেবো সবার সাথে, গর্ব ভরে বলবো এই মানুষগুলোকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম। নাহ, আঙ্কেল সেই সুযোগ দিলেন না। তাঁর জীবদ্দশায়ই লিখতে হলো, তাঁর চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়টা বুকে নিয়েই।
নিভৃতিচারী এই মনীষীকে অনেক, অনেক অভিনন্দন।
মন্তব্য
শ্রদ্ধা ...
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...
উনার এই সাফল্যে আমিও গর্বিত। ধন্যবাদ, ইশতিয়াক। এই খবর ব্লগে আনার জন্য।
আরে!! আপনারা দেখি (আমেরিকায়) আমার দেশের লোক!! কবে থেকে আছেন? ব্যাটন রুজেই? ছোট্ট পৃথিবী। অধমকে ডাকনামে (অভি) চেনে ওখানকার পুরনো লোকেরা। অর্ণবের বড় ভাই।
অসামান্য অর্জন
অসীম ভালবাসা এই মনীষীর প্রতি।
অসামান্য---
এঁদের মত কিছু মানুষ আছেন বলেই হয়ত শেষ পর্যন্ত মাথা উঁচু করে বাঁচতে ইচ্ছে হয়---
ধন্যবাদ ইশতি, এই জ্ঞান-তাপস কে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।
উনার জীবনবৃত্তান্তে একটা জিনিষ লক্ষ করলাম। উনি ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক হবার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্রকৌশলে স্নাতক হয়েছেন। অর্থাৎ সেসময় একই সাথে দু'টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়া যেত। আহা! আমরা সেই সুযোগটা পেলাম না। একজন বাঙালী হিসেবে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে অধ্যাপক ভব রঞ্জন সরকারের কৃতিত্বে আমিও গর্বিত। উনার সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও কর্মচঞ্চল জীবন কামনা করছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
প্রায় প্রতি শীতেই দেশে যান বুয়েটে পড়িয়ে আসতে। এবারও যাচ্ছেন কিছুদিনের মধ্যেই।
পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, মনীষী'তো- স্ব আভা ছড়াবেই। ইশতিকে ধন্যবাদ।
এস হোসাইন
---------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
________________________________________________
হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে
________________________________________________
হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে
শ্রদ্ধা...
_________________________________________
সেরিওজা
আমেরিকা আসবার সময়ে আমার পরিকল্পনা ছিল আরিজোনাতে পড়তে যাবার। ঐ সময়ে ভব আংকেল আর লোপা আন্টি এত্ত সাহায্য করেছিলেন যে লুইজিয়ানা ছেড়েই আর নড়তে পারলাম না।
অনেক ভাল লাগলো খবরটা শুনে...
আন্টি ফোনে জিজ্ঞেস করছিলেন তোমার কথা আজকে। কল করেছিলাম বিকেলে। খুব একটা বিস্তারিত জানাতে পারিনি। পারলে জানিয়ে দিয়ো তুমিই কোনো সময়।
শ্রদ্ধা...
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
অভিনন্দন!
..................................................................
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।
গর্ব হলো, আনন্দ হলো, মাথা উঁচু হয়ে গেল।
পড়ে অনেক ভালো লাগলো।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
হিতৈষী মহামনীষী ভব স্যারকে অভিনন্দন, শ্রদ্ধা।
অভি, আপনাকে ধন্যবাদ।
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
তাঁকে কিভাবে যে শ্রদ্ধা নিবেদন করবো ! ড. ভব রঞ্জন সরকার-এর মতো মানুষরা যতকাল থাকবেন, ততকাল বাঙালির মাথা উঁচু হয়েই থাকবে।
তাঁরা আমাদের অহঙ্কার ! আমাদের গর্ব। হৃদয় খোলে শ্রদ্ধা জানাতে চাই তাঁকে।
ধন্যবাদ ইশতি কিংবা অভি ভাই, পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ধন্যবাদ ইশতি... এসব খবর কতোটা মনোবল বাড়ায় ভাবতে পারবেন না। মনটাই ভরে যায়...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমি মনে করি খবরটা মূলধারার কোনো পত্রিকা/মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার মতো। কিছু করতে পারেন কিনা দেখবেন? আপনার তো চেনা-জানার পরিধি অনেক বড়। মূল খবরের লিংক লেখাতেই আছে। ডিসেম্বরের ২৮ তারিখে তিনি বাংলাদেশে থাকবেন। চাই কি তাঁর সাথে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থাও করে দিতে পারি।
কি আর বলব? ভাল লাগল, অনেক অনেক ভাল লাগল। আমিও জানি - এরকম কিছু মানুষ আছেন, থাকবেন।
এরকম মানুষদের সান্যিধ্য সত্যিই গর্বের বিষয়। আমরাও সেই গর্বের খানিকটা ভাগীদার হলাম!
আপনি কেমন আছেন ইশতি? অনেকদিন পরে আপনার দেখা পাওয়া গেল
আছি ভালোই। কাজের চাপ বেশি। আর ৫ দিন বাকি সিমেস্টারের। দু'টা ফাইনাল, একটা পেপার। সব কিছু বাকি সেই সাথে যোগ হয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে পরিবার বর্ধন কর্মসূচি। জানেনই তো এমন সময় কেমন যায়।
সবসময়ই আগে আপনার প্রাণবন্ত হাসি হাসি ছবিটা দেখি তারপর লেখা। আমাদের আরো অনেক, অনেক গর্ব করার মত মানুষ দরকার যাতে পৃথিবীর কাছে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারি। লেখাটা ভাল লাগলো। ধন্যবাদ
অমাবস্যা
বুক ভরা ভালবাসা ছাড়া আর কিছু নেই।
বুনোহাঁস
শ্রদ্ধা জানালাম।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
যাঁরা পড়েছেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। অনুপ্রেরণাদায়ী এই সুসংবাদ সব দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।
ওরে রে!!! দারুণ খবর!!
শ্রদ্ধা...
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আমরা কেন এসব অনুপ্রেরণাদায়ী বাঙালিদের নিয়ে আরো লেখালেখি বা তাঁদের লোকসমক্ষে আরো আনার কথা ভাবছি না?
কেন আরো অনেককে অনুপ্রাণিত হওয়ার এবং উজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি না?
আমাদের মিডিয়াগুলো কি শুধু নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনেই রত থাকবে?
---মহাস্থবির---
আমি গর্বিত,
ধন্যবাদ লেখককে ব্যাপারটা দৃষ্টিগোচর করার জন্য।
============
আমি জানি না
নতুন মন্তব্য করুন