পৃথিবীর সবচেয়ে মৌলিক ও অবধারিত ব্যাপারগুলোর মধ্যে বিদায় একটি। মন না চাইলেও তাই সব বিদায়ই এক সময় সয়ে যায়। আমার নিজের কাছে এই দিক থেকে বিশাল এক ব্যাতিক্রম আমাদের জুবায়ের ভাই। এই মানুষটা নেই, সেটা মন মানতে চায় না। শেষবার কথা হওয়ার সময় যেই কণ্ঠ শুনেছি, সেটা আজও কানে বাজে। জালাল ভাইয়ের ফোনে যখন জুবায়ের ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পাই, আমার মনের একটা অংশ ঠিক সেই মুহূর্তটাতে আটকে আছে। জুবায়ের ভাই তাই আমার কাছে স্মৃতি নন। আমি ওনার জন্ম-মৃত্যু এলে স্মরণ করি "আহা, অনেক দিন জুবায়ের ভাইয়ের সাথে কথা হয় না" বলে। আজও denial-এর পর্বই পার হতে পারি নাই, তাই জুবায়ের ভাই সম্পর্কে লিখি না তেমন একটা। তাঁকে যে ব্যাক্তিগত ভাবে চেনে না, সেই অভাগাকে বোঝানোর মতো ভাষাশৈলী ঈশ্বর আমায় দেননি।
আজ জুবায়ের ভাইয়ের জন্মদিনে পোস্ট লিখছি তাঁরই একটি অসমাপ্ত গল্প প্রকাশ করার জন্য। মিমি ভাবী আমার অতি, অতি, অতি আপন একজন মানুষ। তিনি যে কেন এত মানুষ থাকতে আমাকেই এই শাস্তিটা দিলেন, সেটা ভাবীকে জিজ্ঞেস করতে হবে কাল ফোন করে। জুবায়ের ভাইয়ের লেখাটা পড়ছিলাম আর ঘুরে-ফিরে মনে হচ্ছিলো সেই পুরনো দিনের কথা, নিয়মিত ফোনালাপের কথা। কতো অসামান্য একজন মানুষ, অথচ কতো দ্রুত চলে গেলেন!
যেমনটা প্রায় পাঁচ বছর পুরনো এক লেখায় বলেছিলাম, জুবায়ের ভাই ছিলেন আমাদের "হেডমাস্টার"। বাংলা ব্লগ তখন বেশি দিন হয়নি শুরু হয়েছে, সচলায়তনও হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে বেড়ে উঠছে। সেই সময়ে আমাদের সবার মাথার উপর ছায়াতরু হয়ে ছিলেন জুবায়ের ভাই। বিভিন্ন ব্লগ তখন নিজের চরিত্র গড়ে নিচ্ছে, সেই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় অনেক ঝগড়া-বিরোধ লেগে আছে। মূলধারার অনেক রথী-মহারথী ব্লগ নামের এই নতুন প্ল্যাটফর্মে এসে নিজের সেলিব্রিটি দেখাতে চাইছেন, পরক্ষণে আমজনতার কাছে ই-ধোলাই খেয়ে বিদায়ও নিচ্ছেন। ব্লগের কারণে লেখার সুযোগ পাওয়া অগণিত মানুষেরও তখন একটু ছন্নছাড়া অবস্থা।
এই রকম একটা সময়ে মুহম্মদ জুবায়েরের মতো একজন মানুষ খুব প্রয়োজন ছিলো। জুবায়ের ভাই খুব নিষ্ঠার সাথে সাহিত্যচর্চা করতেন। আপোষহীন ভাবে লিখতেন, দ্বিধাহীন ভাবে লিখতেন। কোনো প্রকার ফাঁকি দিতেন না, অন্যদেরও ফাঁকি দিতে দিতেন না। নবীন লেখকদের কারও মধ্যে তিল পরিমাণ সম্ভাবনা দেখলেও সেটাকে খুব যত্নের সাথে লালন করতেন। নিয়মিত লিখতে তাগাদা দিতেন, লেখায় ভুল-চুক থাকলে ধরিয়ে দিতেন। অথচ এর মধ্যে এক বিন্দু পরিমাণ ঔদ্ধত্ব বা আত্মম্ভরিতা ছিলো না। ছোটো-বড় নির্বিশেষে সবাইকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে কথা বলতেন, এত গুরুজন হয়েও "আপনি" বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর কাছ থেকে কঠিন সমালোচনাও ছিলো বড় ভাগ্যের ব্যাপার, বরং সেই সমালোচনাগুলোর কারণেই ফিরে ফিরে যেতাম আমরা তাঁর কাছে। এই ছিলেন আমাদের জুবায়ের ভাই। আমাদের বড় ভাই, আমাদের অভিভাবক, আমাদের সহ-ব্লগার।
জন্মদিনে অনেক শুভেচ্ছা রইলো, জুবায়ের ভাই। আপনার স্নেহধন্য হওয়া আমার পরম পাওয়াগুলোর একটি। আপনার সাথে শুধু কথা হওয়াটাই আমার জন্য অনেক গর্বের। অপেক্ষায় আছি, সান্নিধ্যও পাবো কোনোদিন। নাহয় ডালাসের চেয়ে একটু বেশি দূর যেতে হবে।
[ জুবায়ের ভাইয়ের ব্লগ ]
[ জুবায়ের ভাইয়ের উপর বিভিন্ন লেখা ]
[ পাঠক আগ্রহী হলে "মুহম্মদ জুবায়ের স্মরণে" গ্রুপটিতে যোগ দিতে পারেন ]
==================
"পলিনা" -- মুহম্মদ জুবায়ের
==================
আমার নাম জামান। নাকি মুকুল বললে চিনবে? এতোদিন পরে কোন নামে চিনবে বুঝতে পারছি না।
এক মুহূর্ত নৈঃশব্দ। আপনাকে কি আমি চিনি?
এখন মনে না-ও থাকতে পারে, তবে কিন্তু একসময় চিনতে।
পুনরায় নৈঃশব্দ।
হ্যালো, শুনতে পাচ্ছো?
হ্যাঁ। আমার ফোন নম্বর কে তোমাকে দিলো?
জাহানের কাছ থেকে নিয়েছি।
ওর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?
ঠিক যোগাযোগ বলা যায় না। তোমার বন্ধু বেলার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ওকে একদিন ফোন করেছিলাম বছরখানেক আগে। বকুলের সঙ্গেও একদিন ফোনে কথা হলো, জাহান ওর নম্বর দিয়েছিলো। তা প্রায় বছরখানেক আগের কথা।
জাহান বলেছিলো তুমি ওকে ফোন করেছিলে।
তখনই ও আমাকে তোমার ফোন নম্বর দিতে চেয়েছিলো। আমি নিতে চাইনি।
কেন?
তা-ও ওকে বলেছিলাম। তোমাকে ফোন করা আমার উচিত হবে কি না, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। আমি ওকে বলেছিলাম আমার ফোন নম্বর ইমেল যেন তোমাকে জানিয়ে দেয় যাতে ইচ্ছে হলে তুমি যোগাযোগ করতে পারো। এক বছর অপেক্ষা করলাম, ফোন এলো না। ইমেলও না।
জাহান যখন বললো তুমি আমার খোঁজ করেছেন আমি ওর কাছে তোমার ফোন নম্বর চেয়েছিলাম। ও বললো, কোথায় লিখে রেখেছে খুঁজে পাচ্ছে না। পরে দেবে বলেছিলো, আর দেয়নি।
বকুলের কাছেও আমার বৃত্তান্ত দিয়ে রেখেছিলাম তোমার জন্যে।
তা আমি অবশ্য জানি না।
কেমন আছো? কেমন ছিলে এতোদিন তুমি?
তুমি কি আসলেই মুকুল বলছো?
সন্দেহ হচ্ছে?
একটু তো হচ্ছেই। এতোদিন পরে কী মনে করে ফোন করলেন, বুঝতে পারছি না। আর তোমার গলাও কেমন অচেনা শোনাচ্ছে।
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলে কোরো, কিন্তু এতো বছরে এমন দিন খুব কম গেছে আমার জীবনে যেদিন আমি তোমাকে ভাবিনি। যোগাযোগ করতে ইচ্ছে হয়েছে। নিজেকে সামলেছি এই কারণে যে তোমার জীবনে কোনো অশান্তির ছায়া ফেলতে আমি চাইনি। জাহানের কাছে জানলাম, তোমার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তখনি মনে হলো, ফোন করা উচিত।
কিন্তু তোমার গলা এরকম শোনাচ্ছে কেন?
আসলে বয়স তো হচ্ছে, তাই না? থাইরয়েড তোমাকে যেমন ভোগাচ্ছে, আমিও এই ভাঙা গলা নিয়ে ভুগছি প্রায় পাঁচ মাস। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার খুঁজে পেয়েছে, অ্যাসিড রিফ্লাক্স নামের একটা অসুখের কারণে গলা ভেঙে আছে। তবে ডাক্তার আমাকে খুব হতাশ করেছে, জানো?
কি রকম?
আমি তো ভাবছিলাম, ক্যানসার-ট্যানসার কিছু একটা বলবে। তা না কোথাকার কি অ্যাসিড রিফ্লাক্স। কোনো মানে হয়?
এইসব কী বলো? ক্যানসার হলে খুশি হতে?
নিশ্চয়ই। মরতে তো একদিন হবেই, তাহলে ডিসেন্ট্রিতে মরে কি হাতি-ঘোড়া হবে আমার? ক্যানসারের মতো বড়োসড়ো কিছু একটা হলে
ভালো হয়।
তুমি যে মুকুল, তাতে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই আমার।
কেন?
তুমি ছাড়া এইসব অলক্ষুণে কথা আর কে বলবে?
জানো, এককালে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নাকি নিয়ম ছিলো, কেউ গরুগাড়ির নিচে চাপা পড়লে তাকে জরিমানা করা হতো। তো, আমার কাছে জ্বর-আমাশায় মরাও অনেকটা ওইরকম মনে হয়।
তুমি কি কোনোদিনই একটুও বদলাবে না?
বদলালে খুশি হতে? আমি হতাম না, সেইজন্যেই বদলাইনি। তাহলে আমি কি আর আমি থাকতাম?
এটাও ঠিক তোমার মতোই কথা।
তোমার শরীর ভালো যাচ্ছে না শুনলাম। সেসব বলো, শুনি।
ওসব আর বলার কি? বয়স তো হলো, অনেক রকমের রোগবালাই লেগেই আছে। তুমি কিন্তু আমাকে বিয়ে না করে বেঁচে গেছেন। একটা পোকাধরা বউ পেতেন।
আমি তোমাকে বিয়ে করিনি, তা তো নয়। তুমি ভালোই জানো। আসলে সুযোগটা কি আমি পেয়েছিলাম?
পুনরায় নৈঃশব্দ।
মন্তব্য
ভাল লাগলো
পড়তে গিয়ে ২০০৬-০৮ এর অনেক স্মৃতি মাথায় চেপে বসলো। পৌরুষ উপন্যাসের প্রতি পর্বের জন্য অপেক্ষা, মন্তব্য।।।
শুভ জন্মদিন, জুবায়ের ভাই!
শুভ জন্মদিন
শুভ জন্মদিন জুবায়ের ভাই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
facebook
শুভ জন্মদিন জুবায়ের ভাই।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
শুভ জন্মদিন জুবায়ের ভাই।আমার গুরু।
শুভ জন্মদিন জুবায়ের ভাই।
সারাদিনের সব কাজের ঝামেলা শেষ করে, এই রাত দুপুরে সময় পেলাম তোমার লেখাটা পড়বার। শুধু ভালো হয়েছে বললে অবিচার করা হবে। এককথায় প্রকাশ করার মতো ...
মানুষ মারা গেলে তারা স্মৃতি হয়ে যায়। এক সময় বিস্মরণে হারিয়ে যায়। কিন্তু জুবায়ের মারা গিয়ে তোমাদের কাছে, ওঁর বন্ধুদের কাছে, পরিচিত জনদের কাছে আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তোমার লেখার প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি লাইনে সেটাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। “ আমার না থাকাটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় থাকা”। নিজের অগোচরেই তোমাদের কথা ভেবেই হয়ত জুবায়ের এই বাক্যটি লিখেছিলো ওর এপিটাফের জন্য।
অনেক হেসে, অনেক কথা দিয়ে চেষ্টা করি জীবনের বাস্তবতাকে, কালো মেঘটাকে আড়াল করতে। কিন্তু বছরের এই দুটো দিনে এক্কেবারে অসহায় হবে পড়ি। জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়, হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। তখন তোমরা ছাড়া আর আমার উপায় কী বলো? তোমাদের হেডমাষ্টার ও গল্প-দাদুর সান্নিধ্য পেতে তোমাদের দ্বারেই কড়া নাড়তে হয় যে!
লেখা ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ।
facebook
কষ্টটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না আসলে, ভাবী। আপনাকে কী বলবো, আপনি তো আমাদের সবার চেয়েই ভালো জানেন।
শুভ জন্মদিন জুবায়ের ভাই।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
নতুন মন্তব্য করুন