সরকার বাহাদুর, রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে ভারসাম্য চাই

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: শুক্র, ২১/০৬/২০১৩ - ১২:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাজনীতি এবং প্রশাসন একদম বিপরীতধর্মী দুইটি আর্ট।

একটির মূলে আছে গণসংযোগ, আরেকটির জননিয়ন্ত্রণ। একটিতে ক্ষমতাহীন অনেক মানুষ মিলে, অনেক শ্রমের বিনিময়ে, সমাজকে অনেক জোরে নাড়া দিয়ে ছোট্ট একটু পরিবর্তন ঘটায়। অন্যটিতে খুব সীমিত কিছু মানুষের সিদ্ধান্তে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে, স্বল্পতম প্রয়াসে অনেক বড় পরিবর্তন ঘটানো হয়। একটি মেঘের মতো বিশাল ও গম্ভীর, অন্যটি বজ্রপাতের মতো তীব্র ও ধারালো।

এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে না পারলে যেকোনো শাসনব্যবস্থাই এক পর্যায়ে পঙ্কিল হয়ে যায়। বিগত চার বছরের শাসনকালে দল বা সরকার হিসাবে আওয়ামী লীগ এই সমস্যায় ভুগছে। ইতিহাস বলে, এরকম ভারসাম্যহীনতা সমাজে মৌলিক-কিন্তু-অপ্রয়োজনীয় কিছু বিভক্তি সৃষ্টি করে, দীর্ঘ মেয়াদে যা রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলোয় ফাটল ধরায়। সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

জাতি হিসাবে বাঙালিরা সৃজনশীল, শান্তিপ্রিয়, ও ধীমান হওয়ার একটি বড় কারণ তার বহুমুখিতা, তার একই দেহের মধ্যে অগণন আত্মা ও পরিচয়ের সংমিশ্রণ। আমরা সেই জাতি, যারা “মুসলমানের দেশ” পাকিস্তান তৈরির জন্য লড়েছে, আবার সেই লড়াইয়ের মাত্র ২৪ বছর পর একই প্রজন্ম লড়াই করে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়েছে। এতে কারও ধর্ম-ধ্বংস হয়নি। আজ “বোলগার” প্রজন্মে বহু বিচ্ছু-বজ্জাত-নাস্তিক থাকলেও অর্ধ শতাব্দি আগের বাংলাদেশ খুবই রক্ষণশীল ও ধার্মিক ছিলো। সেই ধার্মিক প্রজন্মই অসাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করে গেছে যে সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা কিংবা রাষ্ট্রের চোখে সকল ধর্ম সমান হওয়ার নীতিগুলোর সাথে ধর্মহীনতার কোনো সম্পর্ক নেই। সেই নীতির উপরই এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত।

অনভ্যাসে সকল বিদ্যাই নাশ হয়। অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষাও তেমনই একটি ব্যাপার, এবং এখানেই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা। এই প্রজন্মের অনেক তরুণই “আই হেট পলিটিক্স” নীতিতে বিশ্বাসী, অনেক সুশীলই রাজনীতির সাথে পাপাচার গুলিয়ে ফেলে গালমন্দ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু তবুও রাজনীতি প্রয়োজন, কারণ রাজনীতির অনেক রূপ থাকলেও তার মূল সুর একটাই – গণসংযোগের মাধ্যমে কিছু মৌলিক শিক্ষা চিরজাগ্রত রাখা। রাজনীতির অভাবে মানুষ ভুলে যায় কোন্‌ উচ্চ আদর্শের প্রেক্ষিতে আজকের সমাজ গঠিত হয়েছে। রাজনীতির অভাবে মানুষ ভুলে যায় কোন মহত্ত্বের ডাকে সে প্রবৃত্তিগত হিংস্রতা ছেড়ে রাষ্ট্র নামের সামষ্টিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। রাজনীতির অভাবে মানুষ ত্যাগের উদ্দেশ্য ভুলে যায়, মত্ত হয়ে উঠে একের পর এক ব্যাক্তিকেন্দ্রিক দাবিতে। যারা রাজনীতি করেন, তারা চুরি-ডাকাতিও করেন। কিন্তু সেই ভ্রষ্টাচারের পরও তাদের প্রতি আমাদের দাবি থাকে নৈতিক অবস্থানগুলো সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যার। ঠিক এই জায়গাটিতেই আওয়ামী লীগ সরকার খুব দৃষ্টিকটূ ভাবে ব্যর্থ।

প্রতিটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে। যেই দল আইন ও শাসনযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়োগ ঘটিয়ে প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে, তারাই শ্রেষ্ঠ প্রশাসক। স্বল্প প্রয়াসে অধিক অর্জনের এই তরিকা সফল হওয়ার পেছনে মূল নিয়ামক হলো সক্রিয় রাজনীতি ও গণসংযোগ। দেশ পরিচালনার অংশ হিসাবে প্রশাসন যেই সিদ্ধান্ত নেয়, জনমানুষের কাছে তার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ক্ষমতাসীন দল। জনগণ যদি যুগোপযোগী না হয়ে থাকে, তাহলে তাদের আলোকিত করার দায়িত্বেও থাকে রাজনৈতিক দল।

পরিতাপের বিষয় হলো, সরকার বাহাদুর সেই কাজটি একেবারেই করেননি। তারা একের পর এক আপাতদৃষ্টিতে-উদ্দেশ্যহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবং পরবর্তীতে প্রতিক্রিয়া সামলাতে না পেরে গায়ের জোরে পুরো সমস্যাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলাফলস্বরূপ দেশ অকারণে বিভক্ত হয়েছে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে ধর্ম এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই পরিস্থিতির দায় শুধুই সরকারের। ক্ষমতার কাণ্ডারিদের কাছে অধমের সনির্বন্ধ অনুরোধ, রাজনীতি ও প্রশাসনের মাঝে দয়া করে ভারসাম্য আনুন। শুকনো কথায় চিড়া ভিজে না, তাই কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। আশা করি বিবেচনায় নেবেন।

শুরুতেই তাকাই ৫ই মে দিবাগত রাতে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার দিকে। সেই রাতে পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবি মিলে কঠোর ভাবে হেফাজতে ইসলামকে হঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, দিগন্ত টিভির প্রচার স্থগিত করা হয়েছে। প্রশাসনিক দিক থেকে দেখলে এই উচ্ছেদ অভিযান অবশ্যই যৌক্তিক, ঠিক যেমন যৌক্তিক ছিলো মধ্যযুগীয় হলেও হেফাজতে ইসলামের দাবি-দাওয়া রাজনীতির ময়দানে পেশ করতে দেওয়া। একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রে কোটি কোটি টাকা ক্ষয় করা ধ্বংসযজ্ঞ উপেক্ষা করার মতো না। রাতের অন্ধকারের কৌশলগত সুযোগ নেওয়া, ছত্রভঙ্গ করতে লাঠি-টিয়ারগ্যাস-রাবারবুলেট ব্যবহার, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে গণমাধ্যমকে প্রবেশাধিকার দেওয়া, ইত্যাদি অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু শুধু সেটুকুই কি যথেষ্ট?

হেফাজতে ইসলাম যখন তাদের উদ্ভট এবং অগ্রহণযোগ্য দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হয়, তখন কোথায় ছিলো ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামের রাজনৈতিক দলটি? কেন তাদের শীর্ষ নেতৃবর্গ সমস্বরে সমর্থন জানিয়ে গেছেন সেই দাবিগুলোর প্রতি? তখন কেউ বলেছেন হেফাজত করা রেখেছে, কেউ বলেছেন হেফাজতকে ধন্যবাদ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একটি একটি করে ১৩ দফা পড়ে সেগুলো মেনে নেওয়ার দাবি করেছেন। দল ও দেশের নীতি ভুলে তারা অবলীলায় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ লেবাস ধারণ করেছিলেন সেই সময়ে। তাদের দৃষ্টিতে জনগণের সাথে এই ধাপ্পাবাজিটাই হয়তো “রাজনীতি”, তাই স্বীয় নীতিতে স্থির থেকে গণসংযোগের পরিবর্তে হাওয়া বুঝে পাল তোলার নীতি নিয়েছিলেন দলীয় সিদ্ধান্তে।

একই ঘটনা দেখা গিয়েছিলো শাহবাগের গণজাগরণের সময়ও। যেই প্রধানমন্ত্রী হেফাজতের দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, তিনিই তখন ছোট্ট শিশুর হাতে প্রতিবাদের মোম তুলে দেওয়ার ছবি তুলেছেন। যেই শাহবাগের আন্দোলনে ভর দিয়ে বিরোধী দলকে তুলা-ধূনা করেছেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে সেই গণজাগরণ মঞ্চকেই পদে পদে লাঞ্ছিত করেছেন। দুষ্টু লোকে এটাও বলে যে গ্রামে-গঞ্জে গণজাগরণ মঞ্চ তাদের জামায়াত নিষিদ্ধ করার আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার সময় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগেরই নেতাদের হাতে।

কাছাকাছি সময়ে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনার মধ্যে আছে অপসাংবাদিক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে ‘আমার দেশ’ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া, “নাস্তিক” ব্লগারদের ভুয়া অভিযোগে জেল-জুলুম করা, ইউটিউব বন্ধ করা, এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে যথাযথ সাহায্য না করা। একাদিক্রমে দেখি একটু ভিন্ন ভাবে ব্যাপারগুলো সামলানো যেত কি না।

‘আমার দেশ’ পত্রিকা যখন নিরন্তর গুজব রটিয়ে যাচ্ছে, মিথ্যাচার করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (একতরফা অত্যাচারকে “দাঙ্গা” বলা যায় কি?) বাধাচ্ছে, তখন সরকার কোন্‌ রোয়াকে রোদ পোহাচ্ছিলেন? কেন প্রতিটি মিথ্যা সংবাদের জন্য বিশাল অংকের জরিমানা করা হয়নি? অনেক অনেক প্রাণহানির পর প্রশাসন অবশেষে উদ্যোগী হয়েছেন, কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। যেই সময়ে মিথ্যা সংবাদের জন্য এই পত্রিকাকে দৈনিক জরিমানা করা প্রয়োজন ছিলো, সেই সময়ে গোয়েন্দা সংস্থার আইন-বহির্ভূত রেকর্ডিং বাজারে পেয়েছি, জানতে পেরেছি শাহবাগে কত ইঞ্চি “গ্রীন” কিংবা মাহমুদুর রহমান সাহেবের পেট খারাপ হলে দফাপ্রতি কত ছটাক বর্জ্য। মানুষ মরেছে, রাজনীতি হয়েছে, প্রশাসন হয়নি।

প্রশাসন যখন অবশেষে নড়লেন, তখন ভুয়া অভিযোগে কিছু ব্লগারকেও গ্রেফতার করে রিমান্ডে ভরলেন। যাদের ধরা হলো, দেখা গেল তারা সবাই সরকারবিরোধী হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, নাস্তিক হলেও ধর্মবিদ্বেষী নন। অভিযোগের সংখ্যার সাথে গ্রেফতারকৃতের সংখ্যাও মিললো না। দিনের পর দিন কেটে গেলেও কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। বরং সন্দেহজনক ভাবে কারাবন্দী অবস্থায় তাদের ব্লগ-ফেসবুকে আনাগোনা দেখা গেল। প্রশাসনিক জগাখিচুড়ির পাশাপাশি রাজনীতির অনুপস্থিতি আবারও লক্ষণীয়। কাঠমোল্লাদের দাবি (এবং কথিত তালিকা) অনুযায়ী এই বেশুমার গ্রেফতারবাজি করার পরিবর্তে উচিত ছিলো একটু গণসংযোগ করা, অবোধ মানুষজনকে বুঝিয়ে বলা।

একই কাজ করণীয় ছিলো ইউটিউব নিষিদ্ধ করার সময়ও। কোথাকার কোন জেল-খাটা ঠগবাজ একটু পরিচিতির লোভে নাম ভাড়িয়ে, অভিনেতাদের সাথে মিথ্যা বলে একটা জঘন্য চলচ্চিত্র বানিয়েছে, তার জন্য বাংলাদেশে ইউটিউব নিষিদ্ধ থাকলো মাসের পর মাস। এই যুগে ইউটিউব-ফেসবুক-গুগুল নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া এবং আরিচা ঘাট বন্ধ করে রাখা সমতুল। এই দেশের মানুষ কি এতটাই নিরেট মূর্খ যে “কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়” বললে বুঝবে না? দাঙ্গা এবং অস্থিরতার আশংকায় সরকার কয়েক ঘন্টা, কিংবা বড় জোর কয়েক দিনের জন্য গণমাধ্যম বন্ধ রাখতে পারে। উষ্কানি এবং অতি-উত্তেজনার যুগে এটুকু সুশাসনের জন্যই প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে এত মাস? এই সময়টুকুতে কি একবারও জনগণকে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তাদের উদার ও ধৈর্যশীল হতে বলা হয়েছে? এই সু-রাজনীতি তো হয়ই নি, বরং আরও ক্ষতিকর কিছু ব্যাপার ঘটেছে। চিরকাল বাম রাজনীতি করা তথ্যমন্ত্রী মস্ত আলেম হয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে। পাশাপাশি, তথাকথিত “ফিল্টার”-এর জন্য চলেছে গোপন দরপত্র আহ্বান। নিজে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বলে জানি, এই যুগে এসব কত সহজে ফাঁকি দেওয়া যায়। একই কারণে আশংকা করি যে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই হাতিয়ার বাংলাদেশেও আমদানি হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি, ঘর-পোড়া গরুর মতো ভয়ে ভয়ে হিসাব করি কী বিশাল আর্থিক অপচয় ঘটছে এর নামে।

সবশেষে বলি হতাশার সবচেয়ে গভীর কারণটার কথা – যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। নিজ দেশের ঘটনা হওয়ায় আমরা কেউ এর মূল্য বুঝি না, কিন্তু বাস্তব বিচারে এটি পৃথিবীর ইতিহাসে কঠিনতম কাজগুলোর একটি। গণহত্যা ও গণধর্ষণকারী কোনো শক্তি আইনের মুখোমুখি হওয়ার সময় এতটা শক্তিশালী ছিলো না কোনো দেশে। কোথাও তাদের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য ছিলো না। কোথাও তাদের অপরাধকে ধর্মের আবরণে আড়াল করার প্রয়াস ছিলো না। সেই বিচারে হাত দিলেও সরকার যথাযথ প্রস্তুতি নেয়নি। বাকি বিশ্বের কাছে এর স্বরূপ তুলে ধরেনি। বিদেশি গণমাধ্যমে নিরলস অপপ্রচারের জবাব দেয়নি। যখন আদালত এবং বিচারপতির নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হয় তখন তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এক্ষেত্রে প্রশাসন পর্দার আড়ালে যৎকিঞ্চিত কিছু করে থাকলেও রাজনীতির ময়দানে অনুপস্থিতি ছিলো লক্ষণীয়।

এই প্রসঙ্গগুলো নিয়ে দেরিতে হলেও সরকারী দল মুখ খুলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বৈদেশিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সংসদে বিভিন্ন রকম মিথ্যাচারের বিবরণ দিয়েছেন। দুঃখের ব্যাপার হলো এই বোধোদয়ের বহু আগেই সব দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বাসি খবর দেখে উত্তেজিত হওয়ার মতো হাস্যকর হয়ে গেছে পুরো ব্যাপারটা। প্রধানমন্ত্রী যেই বক্তব্য দিয়েছেন বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে, তা দেওয়ার কথা ছিলো মন্ত্রীপরিষদের অন্য কোনো সদস্যের। যুদ্ধাপরাধ, রানা প্লাজা, কিংবা পদ্মা সেতু নিয়ে তিনি যেই ধামকি খেয়েছেন বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে, তা যেকোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য পীড়াদায়ক। একই ভাবে, অনলাইনে গুজব ছড়িয়ে সয়লাব করে দেওয়ার প্রায় দেড় মাস পর তিনি সংসদে পরিবেশন করলেন বিভিন্ন দেশের ছবি বাংলাদেশের ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার কথা।

এই বক্তব্যগুলো ভুল সময়ে কিংবা ভুল মানুষের মুখ থেকে এসে থাকতে পারে, কিন্তু এটাই গণসংযোগ। এটাই সময়ের এক ফোঁড় হতে পারতো, অনেক ভ্রান্তি ঠেকাতে পারতো। আমাদের সরকার বাহাদুর সেটা করেননি, সরকারী দল সেই পথে হাঁটেননি। যদি সেই পন্থা অবলম্বন করতেন, তাহলে দায়িত্ব পড়তো তাদের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর উপর। যখন সাধারণ মানুষ বিবেকের তাড়না থেকে প্রতিটা রটনা ঠেকিয়েছে, তখন সরকারী দলের রাজপুত্রেরা হানাহানি করেছে, ডাকাতি করেছে, দখলবাজি করেছে।

এক পর্যায়ে এই নাগরিক প্রয়াসগুলো থেমে যেতে বাধ্য। সেদিন উদার, গণতান্ত্রিক, এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের শিক্ষাটাও হারিয়ে যেতে শুরু করবে। তাই সরকার বাহাদুরের কাছে পিলিজ লাগে, একটু রেহাই দেন। রাজনীতি এবং প্রশাসনের মধ্যে একটু ভারসাম্য দেন।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো বিশ্লেষণ করেছেন ইশতিয়াক রউফ ভাই! সরকার সব কিছুতেই এত দেরিতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে যে, তা এক কথায় হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

সময় গেলে যে সাধন হবেনা

তা সরকার বেমালুম ভুলে গেছে! একটার পর একটা প্রতিপক্ষ দাড় করিয়েছে আগ-পিছ চিন্তা না করে এবং পুরনো প্রতিপক্ষকে সমূলে উত্পাটন না করেই! এই ভুলগুলো তারা আগামী ছয় মাসে শোধরাতে পারে কিনা দেখা যাক!

বটতলার উকিল।

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক , সহমত

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

অনভ্যাসে সকল বিদ্যাই নাশ হয়। অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষাও তেমনই একটি ব্যাপার, এবং এখানেই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা।

চলুক

হুঁকো মুখো হ্যাংলা এর ছবি

"এটাই সময়ের এক ফোঁড় হতে পারতো, অনেক ভ্রান্তি ঠেকাতে পারতো। আমাদের সরকার বাহাদুর সেটা করেননি, সরকারী দল সেই পথে হাঁটেননি। যদি সেই পন্থা অবলম্বন করতেন, তাহলে দায়িত্ব পড়তো তাদের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর উপর।"

স্ট্যান্ডাপ-কমেডিয়ানের দায়িত্ব পালনে তারা অবশ্য অবহেলা করেন নি।

রাহী এর ছবি

আমি এই মাসেই দিনাজপুর গিয়েছিলামঃ সেখানে চায়ের দোকানে শুনলাম তারা এখনো মনে করে রাতের অন্ধকারে মতিঝিলে আসলেই হাজার হাজার মানুষকে মেরে গুম করে দেয়া হয়েছে। তাদের এই ভুল ভাঙ্গার কোন উপায় আছে কিনা জানিনা।কিন্তু এই ভুলের মাসুল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলকেই হয়তো গুনতে হবে।

শাহবাগ আন্দোলন দমাতে পেরে সরকার এখন হয়তো যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নিয়ে আর ভাবছেই না। আফসুস!

তারেক অণু এর ছবি
ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

রাষ্ট্রে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কোনটা কার হাতে আছে সেটা বুঝতে হবে। জনগণ ও প্রশাসনের সাথে জনপ্রতিনিধিদের যে ক্ষমতাসম্পর্ক আছে সেটা অবরোহী। জনগণের সাথে প্রশাসনের যে কর্তৃত্বসম্পর্ক আছে সেটাও অবরোহী। জনপ্রতিনিধিদের সাথে প্রশাসনের কর্তৃত্বসম্পর্কটা কখনো বৃষ প্রকৃতির আর কখনো সারমেয় প্রকৃতির (বঙ্কিমের কাছ থেকে ধার করলাম)। একই কথা প্রযোজ্য প্রশাসনের সাথে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাসম্পর্কের ক্ষেত্রে। তাই প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের কোন পক্ষ এমন কিছু করবে না যাতে তাদের ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে বা জনগণের হাতে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের ভাগ যায়।

বাস্তবে সকল ক্ষেত্রে জনগণের হাতে লবডঙ্কা। নির্ধারিত সময় পর পর জনগণ ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের এক হাত নিতে পারে এই ব্যাপারটা একটা আইওয়াশ। এখানেও জনগণকে একটা কাম্য ফলের দিকে পরিচালিত করা হয়, প্রয়োজনে অসদুপায় অবলম্বন করা হয়। প্রশাসন সকল সময়েই জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসনকে 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি' হিসাবে অভিহিত করা জনগণের প্রতি একটা নির্মম রসিকতামাত্র। সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার পথ এতো জটিল ও অস্বচ্ছ যে আইনগুলো কেবল বইয়েই থেকে যায়। বিচারব্যবস্থাকে এমন জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী করা হয়েছে যে ন্যায়বিচার পাবার আশা সুদূরপরাহত।

ছাত্র রাজনীতিকরা প্রশাসনে যায়, আবার অবসরপ্রাপ্ত আমলারা রাজনীতিতে যোগদান করেন। তাই তারা হরিহর। এটা একটা সিমবায়োটিক ব্যবস্থা। সহসা এর পরিবর্তন হবে না। কোন পক্ষ এর পরিবর্তন করবে না।

হ্যাঁ, স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসাবে জনপ্রতিনিধি আর প্রশাসন নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভারসাম্যের পাল্লাটা কখনো সখনো একটু এদিক ওদিক করেন বটে, তবে পরিণামে যেই লাউ সেই কদু।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৌরভ কবীর এর ছবি

গুরু গুরু

__________________
জানি নিসর্গ এক নিপুণ জেলে
কখনো গোধূলির হাওয়া, নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নার ফাঁদ পেতে রাখে

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

চলুক

মেহবুবা জুবায়ের এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------------------------------

অতিথি লেখক এর ছবি

সহমত

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
- একলহমা

মাহবুব মুহাম্মদ এর ছবি

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কি এ বছর হবে ?
নাকি সেটা আগামী নির্বাচনের ইশতেহার হিসেবে ব্যবহৃত হবে?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।