৯ মাসের স্বাধীনতা, ৪২ বছরের বিজয়

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: শনি, ১৪/১২/২০১৩ - ৩:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১/ “ইট ইজ হোম”

আজ প্রায় দশ বছর হতে চলছে আমার প্রবাস জীবনের। এই দীর্ঘ সময়ে জীবিকার দায়ে অনেক কিছু করেছি। স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় অনেকের জীবন আয়েসে শুরু হয়, আমার হয়েছে একদম ঘুঁটেকুড়ানি অবস্থায়। আক্ষরিক অর্থেই তাই।

এক মাসের বাড়ি ভাড়া এবং এক সিমেস্টারের টুইশনের পর বাড়তি মাত্র ১০০ ডলার ছিলো হাতে। সেই সময়টায় রবিবার সকালে বার-এর বাইরে পরে থাকা পয়সা কুড়িয়েও দিন কাটিয়েছি। কিছুদিন যাওয়ার পর প্রথম চাকরি পেয়েছিলাম এক রেস্টুরেন্টের পার্কিং লট ঝাড়ু দেওয়ার। প্রথম দিকের সেই দিনগুলোর তুলনায় শপিং মল-এ কাজ পাওয়া আমার জন্য ছিলো বিশাল এক অভিজ্ঞতা। আমার বৌ আজও বুঝে পায় না আমি ছেলে মানুষ হয়েও শপিং মল নিয়ে এত আসক্ত কেন। মুচকি হেসে চেপে যাই প্রায়ই, নিরবে স্মরণ করি পুরনো দিনের কথা।

মল অফ লুইজিয়ানায় একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম আমরা তিন জন -- আমি, মা, আমার ছোটো ভাই। পালা করে কেউ না কেউ ফুড কোর্টে দাঁড়িয়ে স্যাম্পল সাধতাম। পাশেই থাকতো ভিন্ন দেশের কিছু অভিবাসী। এক শব্দ ইংরেজি না জানা এক বৃদ্ধ দম্পতি ছিলো ঝাড়ুদারের কাজে। বিশালদেহী এক আফগান ছেলে ছিলো, যার বয়স শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি এই পাহাড় এখনও টিনেজার। আর ছিলো ফিলিস্তিনের এক লোক, পাশের দোকানের হয়ে স্যাম্পল বিলি করতো। দুই ম্যানেজার ভিতরে গেলে আমরা প্রায়ই অল্প-স্বল্প আলাপ করতাম, কাজের শেষে শ্রান্ত পা দুটোকে বিশ্রাম দেওয়ার সময়েও আলাপ করতাম। সেই লোকের সাথে এক আলাপের সময় তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “এই যে এত বছর ধরে তোমাদের সংগ্রাম চলছে, ঘর-ছাড়া হয়ে অন্য দেশে ছোটো কাজ করছো, তার চেয়ে দ্বি-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটা মেনে নিলে পারো না তোমরা? কতগুলো প্রাণ বেঁচে যেতো, কত সংঘাত কমে যেতো।”

Claude Debussy-র একটা উক্তি আমার খুব পছন্দের -- “Music is the silence between the notes.” মনের ভাব প্রকাশের ব্যাপারটাও সেরকম। আমরা শব্দ ব্যবহার করে অনেক কিছুই বলি, কিন্তু গভীরতম আবেগগুলো প্রকাশ পায় নিঃশব্দে, চোখ থেকে পড়ে নিতে হয় সেই ভাষা। জীবনে এরকম মুহূর্তের সম্মুখীন হয়েছি অল্প কয়েকবার, তার মধ্যে একবার ছিলো সেই প্রশ্নের জবাবে। খুব অবাক, প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর তিন শব্দের এক বাক্যে যেই জবাব দিলো, সেটা আজ ১০ বছর পরও একই ভাবে অনুরণিত হয় আমার মনে -- “ইট ইজ হোম!”

অনেকেই দাবি করেন যে রাজাকারদের বিচারের মতো বিষয় নিয়ে অহেতুক হৈ-চৈ না করলেই বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাবে। এই দাবি শুনলে নিজের ভেতর সেই ফিলিস্তিনি বন্ধুর প্রতিফলন খুঁজে পাই। হাজারও চাপের মুখে সে যেমন “ইট ইজ হোম” বলে, আমরাও সেভাবেই বলি “আমার মাটি আমার মা, পাকিস্তান হবে না।”

২/ দুর্গের ভাঙন

বৈষয়িক জীবনের হিসাব-নিকাশ যা-ই বলুক না কেন, মানুষ কিছু আবেগ ও মূল্যবোধ দ্বারা চালিত বলেই সে মানুষ। আমরা রক্ত-মাংসের কল্যাণে মানুষ না, আমরা আমাদের বিবেকের কারণে মানুষ। আমরা বন্য পশু নই যে বাবাকে হত্যা করে মায়ের সাথে সংগমে লিপ্ত হবো। আমরা হিংস্র শ্বাপদ নই যে ক্ষুধা লাগলেই অপত্যকে গ্রাস করবো।

এই ধ্রুব সত্য যুগের পর যুগ ধরে মুখ থুবড়ে পড়েছে জামায়াত-শিবির নামক নরপশুদের সামনে। আমরা জাতি হিসাবে ফুলে-ফেঁপে বড় হয়েছি। দালান হয়েছে, ব্রিজ হয়েছে, রাস্তা হয়েছে, স্কুল হয়েছে, ব্যাংক হয়েছে, জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু মানুষের অনুপাত কমেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে “জয় বাংলা” হারিয়ে গেছে, ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যার হোতাদের নাম হারিয়ে গেছে “হানাদার” সর্বনামের আড়ালে, এবং সবচেয়ে অক্ষয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠেছে জামায়াত-শিবির।

এক সময় যাঁর বজ্রকণ্ঠকে শ্লোগানে শ্লোগানে স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা গেছে। জাতীয় চার নেতাকে বিনা বিচারে জেলে হত্যা করা গেছে। সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা গেছে। কোর্ট মার্শাল করে সামরিক বাহিনীতে হাজার হাজার জওয়ান মেরে ফেলা গেছে। প্রবল প্রতাপশালী জিয়াউর রহমানকেও মেরে ফেলা গেছে। কিছুদিন বেশি সময় লাগলেও বিশ্ববেহায়া স্বৈরাচারি এরশাদকে গদিচ্যুত করা গেছে। খালেদা জিয়ার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারকে আস্তাকূঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা গেছে। স্বৈরতন্ত্র ও গণতন্ত্র শুধু নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা গেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তি কোনো না কোনো সময় শীর্ষে উঠেছে, আবার অবধারিত পতনের স্বাদও পেয়েছে। শুধু আঙুল তোলা যায়নি জামায়াতের দিকে। যারা ভোটের বাক্সে শতকরা সমর্থনের হার দিয়ে জামায়াতের ক্ষমতা নিরূপণ করেন, তাদের বোধোদয়ের জন্য এই তথ্যকণাটুকুই যথেষ্ট হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়, এবং পরবর্তীতে সেই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জামায়াতের দুর্গে অবশেষে ভাঙন ধরানো গেছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধ বিচারে যত আদালত গঠিত হয়েছে, তার কোনোটি এত বড় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যহিত পরবর্তী সময়ে নাৎসি বাহিনীর সাথে জড়িত সবার বিচার হয়েছে, মূল হোতা থেকে পাতি নেতা পর্যন্ত প্রায় সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। শুধু তাই না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যাকে অস্বীকার করা আইনত দণ্ডনীয় করা হয়েছে। নাৎসি মতধারার রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সমগ্র ইউরোপের কোনো গহিন কোণের স্থানীয় নির্বাচনেও নাৎসিপন্থী কেউ জয়ী হলে তাকে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়েছে। আজ আটষট্টি বছর পরও সন্ধান পাওয়ামাত্র নাৎসিদের বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬ বছরে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিলো, আমরা মাত্র ৯ মাসে হারিয়েছি ৩০ লক্ষ প্রাণ। অথচ এই গণহত্যার বিচার করতে গেলে আজও দেশে-বিদেশে সবাই তেড়ে আসে। পশ্চিমা দেশগুলো চায় ১৯৭১ সালে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কথা উঠে না আসুক। মুসলিম বিশ্ব চায় না এই সত্য প্রচার পাক যে মুসলমানদের উপর সবচেয়ে বড় গণহত্যা কোনো খ্রীষ্টান, হিন্দু, বা ইহুদির হাতে হয়নি, হয়েছে মুসলমানদেরই হাতে। বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন জারজদের প্রসঙ্গ বাদই দিলাম।

এত অর্থ, এত শক্তি, এত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এই বিচার সম্ভব হয়েছে। জামায়াত ও তাদের শয্যাসঙ্গী বিএনপির ক্রমাগত প্রচারণায় আমরা অনেকটা ফ্যাশনেবল ভাবেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে উঠতে-বসতে সমালোচনা করি। কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই করি। অথচ এই ট্রাইব্যুনাল এবং এর রায় কার্যকর করা যে আমাদের কত বড় অর্জন, তা হয়তো আমরা নিজেরাও উপলব্ধি করি না।

৩/ শেখের বেটি হাসিনা

বাংলাদেশের মতো এমন দেশ বিরল যেখানে মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের দিনটাতে উল্লাসের চেয়ে বেদনা অনুভব করে বেশি। কী অবিস্মরণীয় ত্যাগের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, তা আমরা স্মরণ করি আমাদের বিজয় দিবসে। আমরা ৯ মাসে যতটা হারিয়েছি, অনেক দেশ এক প্রজন্মেও ততটা হারায় না। এই দুঃখের ভিতর আরও প্রোথিত আছে এক ধরনের অসম্পূর্ণতার অনুভূতি, আছে স্বাধীনতা পেলেও স্বাধীনতাবিরোধীদের কবল থেকে মুক্তি না পাওয়ার কষ্ট। আজ ৪২ মুক্তিসনে এসে সেই শূন্যতা কাটতে শুরু করলো অবশেষে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এই বিজয়ের পিছনেও ছিলো অগণিত মানুষ ও সংগঠনের নিরলস ভূমিকা। বাংলাদেশের জন্মের বিপক্ষে থাকা দল, বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো দল, বাংলাদেশের মা-বোনদের ধর্ষণ করা দল, বাংলাদেশের সংবিধান অস্বীকার করা দল, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ চালানো দল যে বাংলাদেশে বিচারের সম্মুখীন হবে, এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিলো। অথচ তারাই ছিলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ফলস্বরূপ বিভিন্ন সময়ে সবার মধ্যেই হতাশা নেমে এসেছে। কলহ হয়েছে, সন্দেহ এসেছে, দূরত্ব বেড়েছে। তবুও সবাই নিজের মতো কাজ করে গেছে।

এই আন্দোলন এবং কার্যক্রমগুলো যেন ছিলো সহস্র ছুরিকাঘাতে দানবের প্রাণ বধ করার প্রয়াস। হয়তো জামায়াত-শিবির ব্যতীত অন্য কোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে এই আন্দোলন হলে আরও দ্রুত সফলতা আসতো। কিন্তু এই বিষবৃক্ষের শিকড় কতটা গভীরে বিস্তৃত, তা বুঝতে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে সবাইকেই। এতগুলো বছর ধরে সবাই জামায়াতে ইসলামীকে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের উগ্র ইসলামপন্থীদের মদদপুষ্ট বলে জেনে এসেছি। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করতেই একে একে আরও অনেক ক্ষমতাকেন্দ্র স্পষ্ট হতে শুরু করে।

শুরুতেই ছিলো মানবাধিকার ব্যবসায়ী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন। আমেরিকার ড্রোন বোমা, সৌদি আরবের শিরশ্ছেদ উৎসব, কিংবা চীনের বেশুমার অত্যাচারের সামনে মুশিক হয়ে থাকা সব সংগঠন বাঘের ছাল গায়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের উপর। এই তালিকায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আছে, যাদের মুখপাত্র আব্বাস ফয়েজ মনে করেন সাম্প্রদায়িক উষ্কানি দেওয়া মাহমুদুর রহমান একজন সাহসী সম্পাদক। আছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, যাদের মুখপাত্র ব্র্যাড অ্যাডামস মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কিংবা জামায়াতি-হেফাজতিদের তাণ্ডব প্রতিরোধ করা খুবই নাহক কাজ। আছে ভূঁইফোড় অসংখ্য সংগঠন যারা ‘মানবাধিকার’ ও ‘জাস্টিস’ শব্দগুলো বিভিন্ন পার্মুটেশন-কম্বিনেশনে ব্যবহার করে লাগাতার প্রচারণা চালিয়ে গেছে। বিশেষ করে আছেন ওয়ান-ম্যান প্রিন্টিং প্রেস, বিদগ্ধ আইনজীবি ডঃ কামাল হোসেনের জামাই হওয়ার সূত্রে জাতির দুলাভাই, বিচ্ছু টুইটারুদের আদরের “ডাবিড”, এক এবং অনন্য ডেভিড বার্গম্যান। এই কৃতি সাংবাদিক তার অপপ্রচারে এতটাই সফল যে বিবিসি-র মতো সর্বজনবিদিত সংবাদ সংস্থা স্বাধীনতার ৪২ বছর পর হঠাৎ করে ছাপানো শুরু করলো যে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩ থেকে ৫ লাখ। এই আচানক পরিবর্তনের পিছনে রেফারেন্স হিসাবে কোনো গবেষণাপত্র নেই, আছে ডেভিড বার্গম্যানের ব্যাক্তিগত ব্লগ।

সরকার এবং আদালত স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে এই শক্তিগুলোকে সামলে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বিচারকার্য। শেষ বেলায় এসে জানা গেল পর্দার আড়ালের আরও বড় বড় শক্তি সম্পর্কে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইরান, ও অন্যান্য প্রত্যাশিত নামের পাশাপাশি যোগ দিতে লাগলো মিশর ও তুরষ্কের মতো দেশ। এদের চাপ উপেক্ষা করেও বিচার এগিয়ে চলেছে, রায় হয়েছে, আপিল হয়েছে, রায় কার্যকর করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঠিক এই পর্যায়ে এসে একে একে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মুখোশও খুলতে শুরু করে। সংবাদপত্র ও ব্যাক্তিগত আলাপচারিতায় উঠে আসে ১৪টি পশ্চিমা দেশের নাম, যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চাপ প্রয়োগ করতে থাকে কাদের মোল্লার ফাঁসি রহিত করতে। বিশ্বমোড়ল আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো সরাসরি ফোনই করে বসলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। জাতিসংঘ থেকেও দূত এলো, ফোন এলো। স্বয়ং কাদের মোল্লাও ফাঁসির দড়িতে ঝুলবার আগে বারবার প্রশ্ন করেছেন তাকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘ ফোন করেছে কি না।

শেষ মুহূর্তে হোমড়া-চোমড়াদের এই তৎপরতায় দুইটি বিষয় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, জামায়াতের প্রভাব এবং তাদের প্রচারের সাফল্য মুসলিম বিশ্ব ছাড়িয়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, কানাডা, স্পেন, ডেনমার্ক, ইত্যাদি দেশেও ছড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে পারেন শুধু এবং শুধুই শেখ হাসিনা।

রাজনীতিক হিসাবে শেখ হাসিনার ত্রুটি অগণিত। শেখের বেটি বেশি কথা বলে। শেখের বেটি দুর্মুখ, মুখরা। শেখের বেটি ঘাউড়া, শেখের বেটি ঘাড়-ত্যাঁড়া। শেখের বেটি বদের লাঠি। শেখের বেটি ষড়যন্ত্রকারী, শেখের বেটি আঁতাতকারী। শেখের বেটি পুরানা জিনিস নিয়ে পড়ে থাকে, শেখের বেটি কারও কথা কানে তুলে না।

শেখের বেটির এত দোষ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া কোনো কুতুবের কাছে জন কেরি'র সরাসরি ফোন আসে নাই, এসেছে সেই শেখের বেটির কাছেই।

সেই মুহূর্তটিতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের বাদবাকি সব ক্ষেত্র অটুট-অটল থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধুই তাঁকে দিয়ে সম্ভব। আমরা যারা বড় হয়েছি সারা দুনিয়ার ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ইন্টারভিউ দেখে, তারা শেখের বেটির কাছ থেকে শেখ সাহেবের মতো একটু ঘাউড়ামির প্রত্যাশায় বসে ছিলাম। কারণ এই ঘাউড়ামির হাত ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এই ঘাউড়ামির পিঠে সওয়ার হয়েই বাংলার মাটিতে রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।

সেই ঘাউড়ামি তিনি শেষতক করেছেন। আমেরিকা বা জাতিসংঘের ফোনে কাজ হয়নি, ইংল্যান্ডের পাঠানো দূতে কাজ হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে এই বিচার বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এবং বাকি বিশ্ব নিয়ে নিরব থেকে বাংলাদেশের বেলায় এত নাক গলানো অগ্রহণযোগ্য।

ঋণজর্জরিত, দারিদ্র্যপীড়িত, অনুদাননির্ভর একটি দেশের নেতার জন্য এত শক্ত অবস্থান নেওয়া খুবই দুরূহ। আমাদের অঢেল জাতীয় সম্পদ নেই যে কেউ একঘরে করে দিলেও বহুদিন চলতে পারবো। আমাদের আনবিক বোমা নেই যে প্রতিবেশিদের উড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পাত্তা পাবো। তবুও এক কালের “বাস্কেট কেস” বাংলাদেশ নত হয়নি। যাঁকে সবাই উঠতে-বসতে সমালোচনা করি, সেই শেখ হাসিনা অনেক প্রতিকূলতা সত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের তরী তীরে আনার জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসার দাবিদার। আরও অনেকের মতো আমিও সংশয়ে দুলেছি। ভেবেছি বিচার শুরু হলেও শেষ হবে না, গ্রেফতার হলেও রায় হবে না, রায় হলেও তা কার্যকর করা হবে না। প্রত্যাশার বাইরে কিছু ঘটলেই জামায়াত ও বিদেশি পরাশক্তির সাথে গোপন আঁতাতের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছি। বলেছি আওয়ামী লীগ ভিক্ষুকের ঘা-এর মতো করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে জীবিত রাখছে।

এই সংশয়, অনাস্থা, এবং সন্দেহ শেষত চূড়ান্ত ভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই এখন নিজেদের ভুল মেনে নিয়ে প্রাপ্য প্রশংসা দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ, আমরা এই প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছিলাম।


মন্তব্য

তানিম এহসান এর ছবি

চলুক চলুক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬ বছরে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিলো, আমরা মাত্র ৯ মাসে হারিয়েছি ৩০ লক্ষ প্রাণ। অথচ এই গণহত্যার বিচার করতে গেলে আজও দেশে-বিদেশে সবাই তেড়ে আসে। পশ্চিমা দেশগুলো চায় ১৯৭১ সালে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কথা উঠে না আসুক। মুসলিম বিশ্ব চায় না এই সত্য প্রচার পাক যে মুসলমানদের উপর সবচেয়ে বড় গণহত্যা কোনো খ্রীষ্টান, হিন্দু, বা ইহুদির হাতে হয়নি, হয়েছে মুসলমানদেরই হাতে। বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন জারজদের প্রসঙ্গ বাদই দিলাম।

মিজান, পিষে ফ্যালো

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

জাতি হিসেবে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েই উদাসীন এবং অসচেতন। তার মূল্য পরিশোধ করেছি আমরা পদে পদে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে শুরু, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামরিক কর্মকর্তাদের অনৈতিক শাসন সহ্য করে নেয়া, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সরাসরি বিরোধিতাকারী বেঈমান জামায়াতে ইসলামীকে অর্থনীতিতে এবং রাজনীতিতে সুসংহত অবস্থান তৈরী করতে দেয়া সবই একই ধারাবাহিকতায় এসেছে।

সময় এসেছে নৈতিক বিভেদের জায়গাগুলো পরিষ্কার করার। সময় এসেছে সার্বভৌমত্বের মূলনীতিগুলোতে সমগ্র জাতির ঐক্যমতে পৌঁছাবার, জামায়াতে ইসলামীর সমস্ত অপকর্ম নথিবদ্ধ করে সরকারীভাবে প্রচার করে সবাইকে জানিয়ে দেবার। সচেতনতা এবং কেবলমাত্র সচেতনতাই অন্ধকার দূর করতে।

শেখের বেটি অনেক ভুল করলেও, বাকিরা এমন কিছু শুদ্ধ করে নাই যে তাদেরকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসতে হবে। যোগ্য নেতৃত্ব তৈরী হবার আগ পর্যন্ত, শেখের বেটির হাতেই থাকুক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ভার।

রণদীপম বসু এর ছবি

এই সংশয়, অনাস্থা, এবং সন্দেহ শেষত চূড়ান্ত ভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই এখন নিজেদের ভুল মেনে নিয়ে প্রাপ্য প্রশংসা দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ, আমরা এই প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছিলাম।

অসাধারণ অনবদ্য লেখা ! চলুক

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

কারণ, আমরা এই প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছিলাম। চলুক
অসাধারণ লেখা! গুরু গুরু

- শ্রাবস্তী

হিমু এর ছবি

শেখের বেটিকে অভিবাদন।

রিসালাত বারী এর ছবি

তুমায় সেলাম হে শেখের বেটী,
চির উন্নত মম ঘেডী

ধুসর জলছবি এর ছবি

সেই মুহূর্তটিতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের বাদবাকি সব ক্ষেত্র অটুট-অটল থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধুই তাঁকে দিয়ে সম্ভব। আমরা যারা বড় হয়েছি সারা দুনিয়ার ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ইন্টারভিউ দেখে, তারা শেখের বেটির কাছ থেকে শেখ সাহেবের মতো একটু ঘাউড়ামির প্রত্যাশায় বসে ছিলাম। কারণ এই ঘাউড়ামির হাত ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এই ঘাউড়ামির পিঠে সওয়ার হয়েই বাংলার মাটিতে রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।

চলুক চলুক

রাজর্ষি এর ছবি

দল নির্বিশেষে শেখ হাসিনা অকুণ্ঠ প্রসংশার দাবিদার । আমরা এই প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছিলাম ।

রাজর্ষি

রণদীপম বসু এর ছবি

এই যে, আমরা যেইরকম প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলাম, তিনি সেইরকমই থাকবেন বলে কথা দিয়েছেন : http://bangla.bdnews24.com/politics/article714677.bdnews

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

এক লহমা এর ছবি

এক অসাধারণ দেশ আর তার অসাধারণ নেত্রীকে নিয়ে হৃদয় ভরানো অসাধারণ লেখা।

শেখ হাসিনাকে অভিবাদন।

অভিবাদন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

অনবদ্য লেখা। আইসিটি এক্ট ১৯৭৩, শেখ সাব করছিলো। তার বেটি রায় কার্যকর করা শুরু করলো ২০১৩ তে। শেখের বেটি সরকারে থাকলে বাকি রায়ও কার্যকর হবে। তত্ত্বাবধায়কের পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকার ছিল বলেই কাদেরারে এত সহসা ঝুলতে দেখলাম। পরবর্তী নির্বাচনেও তাই জামাত/জামাতের জোটকে ভোট না দেওয়ার দাবি জানাই সবাইকে! তাহলে সব রায় আগামী বছরই কার্যকর হয়ে যাবে। জনকেরিমেরি-নাভিগাভি-বানকিমানকিরে গদাম এবং মিজান, পিষে ফ্যালো !


_____________________
Give Her Freedom!

মনের রাজা টারজান এর ছবি

চলুক

আয়নামতি এর ছবি

উত্তম জাঝা!

বাকিগুলোকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতে হলে এই মুখরা ঘাড়ত্যাড়া মহিলাকেই তাই প্রয়োজন।

Emran  এর ছবি

চলুক

জাকারিয়া  এর ছবি

শুরুতে মনে দ্বিধা ছিল, ছিল অবিশ্বাস । জগত জুড়ে টাকার খেলা, ক্ষমতাবানের দাপট । ওদের হাজার হাজার কোটি টাকা, বিদেশী বন্ধু, আর শেখের বেটির ঘরে-বাইরে দেশী দালাল । এত কিছুর মাঝে হবে তো ? এমন প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছিলাম ।

স্যাম এর ছবি

অসাধারণ !!!

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

অসাধারণ লেখা রে ব্যাটা! তোমাকে কোলে তুলে নাচতে ইচ্ছে করছে! একটু্ও টেম্পার লুজ কর নি কোথাও। আশ্চর্য একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম।
আর শেখের বেটিকে অভিবাদন। স্যালুট।

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

নীলকান্ত এর ছবি

চমৎকার হয়েছে লেখাটা।
অফটপিকঃ এ্মডিজি-১ নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে বাংলাদেশ অর্জন করেছে, আর যত দূর জানি, এখন ৬% এর নিচে বিদেশি অনুদান নেওয়া হয়। বটমলেস বাস্কেট এখন উন্নয়ন এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণের রোল মডেল, আফ্রিকা এবং এশিয়ার জন্য।


অলস সময়

কড়িকাঠুরে এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

আমরা এমন শেখের বেটিই চেয়েছিলাম।

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

পৃথ্বী এর ছবি

এদেশের হাভাতের দল বাংলাদেশে কেন নেলসন ম্যান্ডেলা, চে গুয়েভারা, মাহাথির মোহাম্মদ, ফিডেল ক্যাস্ট্রো জন্মায় না তা নিয়ে কান্নাকাটি করে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলে। এসব নেতারা বাংলাদেশে জন্মায় ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের মত "ডার্টি পলিটিক্স" এর দেশে রাজনীতি করার অপরাধে তাদেকে খুন করে আমরা তাদের কবরের উপর নৃত্য করি।


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

অসাধারণ লেখা ইশ্তিয়াক ভাই।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

আমরা এমন প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছিলাম।

মাসুদ সজীব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।