হাউন্ড অফ দ্য হোমলেস - ৩

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: রবি, ২৬/০৮/২০০৭ - ৯:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শ্রেণী ব্যাপারটা চিরকালই আমার কাছে একটু ধোঁয়াশা। ছেলেবেলা থেকে শিখে এসেছি, সবাই সমান। ঈদ এলে নিয়ম করে গ্রামে গিয়েছি, চলতি পথে কোথাও ফকির দেখলে সালাম দিয়ে মাফ চেয়েছি, লুলা-ল্যাংড়া দেখলে বাবার চোখ রাঙ্গানি এড়ানোর জন্য হলেও হাসি চেপে, মায়া করে কথা বলেছি। কালে মাজেজা বুঝিনি, অকালে বুঝেছি। তবে সেই বুঝের সাথে সাথে জীবনটাও অহেতুক অনেক জটিল হয়েছে।

আগে গ্রামে গেলেই উত্তর পাড়ার জ্যাঠাদের বাড়ি দৌঁড়ে যেতাম। ঐ বাড়ির দাদার প্রিয় ভাস্তের বড় ছেলে আমি, আদরের তো অভাব হত না। চাচাতো ভাইটা বয়সে আমার সমসাময়িক। তার সঙ্গসুখের ব্যাপারও ছিল। বালক হলেও নির্মোহ ছিলাম না। সেই বাড়িতে টিভি ছিল। রাতে আন্টেনা ঘুরিয়ে ম্যাকগাইভার দেখা যেত। দাদা খুব আদর করতেন, মৃতপ্রায় শরীরের শেষ শক্তিটুকু খরচ করে তাঁর বড় ভাইয়ের কথা বলতেন, বলতেন আমি যেন আমার দাদার নাম রাখি। ভাল লাগতো শুনে। আমার কাছে আকর্ষণ বলতে ছিল এগুলোই।

গ্রামের আর সবার চেয়ে আলাদা আরো কিছু ব্যাপার ছিল উত্তর বাড়িতে। আলাদা করে বাঁধানো ঘাট ছিল। ল্যাট্রিনটা কাঁচা হলেও একটু অবস্থাসম্পন্ন ছিল। চাল টিনের হলেও রান্নাঘর বাদে সবটাই পাকা ছিল। টুকিটাকি ব্যাপারগুলো ততটা গেঁয়ো ছিল না। শ্রমের ধরন আর আয়ের উৎস একই রকম হলেও জীবনযাত্রার মানের দিকে মনোযোগ একটু বেশি ছিল। একটা সময় আবিষ্কার করলাম, কিছু দিকে আমরাও আলাদা। আত্মীয়তার বন্ধনটা সৌভাগ্যক্রমে বিভেদের উর্ধ্বে ছিল। তবে বিপরীতটা দেখে এসেছি আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে। অজস্র পারিবারিক সম্পর্ক হারিয়ে যেতে দেখেছি শ্রেণীবিভেদের কারণে। মার্ক্স ঠিক হলে এই ঘটনা তো উন্নত বিশ্বে হওয়ার কথা। যেই সমাজে প্রাচুর্যে খুবএকটা তফাৎ নেই, সেখানে কেন এমন ঘটনা দেখা যাবে? শিল্পায়ন যেখানে প্রাচুর্যের দামে মনুষ্যত্ব কেড়ে নিয়েছে সেই সমাজেই তো সম্পর্কের আঠাগুলো একটু একটু করে ক্ষয়ে যাবার কথা। আমার আশ্চর্য হওয়াটা এখানেই।

তত্ত্বের কচকচি খুব একটা না বুঝলেও এটুকু বুঝি যে সমাজতন্ত্রের প্রাণভোমরা হল মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটানো এবং তা ধরে রাখা। লেনিন পরিবর্তনের অংশটুকু করেছিলেন, স্টালিন সেটা ধরে রাখার ধার দিয়েও যান নি, মাও সংস্কৃতি সজীব করার পথ সংক্ষিপ্ত করতে কাচ্চা-বাচ্চাদের বসিয়ে দিয়েছিলেন কোর্ট-কাচারিতে। অনিঃশেষ সাংস্কৃতিক বিপ্লব তাই অহেতুক উৎপাত থেকে গেছে সমাজতান্ত্রিক সমাজগুলোয়। সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আকর্ষন হল স্বার্থভিত্তিক ইতিহাস মুছে ফেলে সহমর্মিতাভিত্তিক ইতিহাস গড়ে তোলা। স্বপ্নময় এই প্রতিশ্রুতির টানেই পোকার মত ছুটে যাই আমরা এর আগুনের দিকে। ক্ষণিকের জন্য মন উন্নত হয়, মর্ম বিকশিত হয়, চিত্ত ভয়শূন্য হয়, শির উচ্চ হয়, কিন্তু ঘোর কেটে গেলে যেই কে সেই। স্বার্থচিন্তার পথে এই ফিরে আসা ঠেকাতেই তো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। চেনা ইতিহাস আমাদের মধ্যে বিশ্রী কিছু চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। আরেকজন মানুষ দেখলেই আমরা পাশে দাঁড়িয়ে মাপি, কে বড়। কেউ ধনে, কেউ ধর্মে বড়, কেউ বর্ণে। মানুষে মানুষে মিল খুঁজে, আত্মীয়তা গড়ে এই বিভেদ দূর করা সম্ভব। বিশেষ করে একই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় কেন যেন মনে হচ্ছিল যে ব্যাপারটা আসলে ঠিক তেমন না। সম্পর্ক সুন্দর রাখতে হলে সকলের একই বা সমতরঙ্গে থাকা আবশ্যক না হলেও উপকারী। শৈশব অভিজ্ঞতা থেকে সেটাই জেনেছি।

গ্রে হাউন্ডে আমার উপলব্ধি ছিল অনেকটা একই রকম। শ্রেণি, বর্ণ, এবং ধর্ম সম্ভবত মানুষকে বিভক্ত করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। রক-পেপার-সিজারের মত এই তিনটির কোনটি অন্যটিকে হারিয়ে দেয়, তা জানার কৌতূহল অনেক দিনের। এই যাত্রায় শ্রেণি বনাম বর্ণের দ্বন্দ্ব দেখলাম সচক্ষে।

নিউ অর্লিন্সের একটা অমিত সৌন্দর্য ছিল এর সাদা-কালো মিশ্রন। আদর করে ‘চকলেট সিটি’ বলতো একে কেউ কেউ। দুধের সাদা আর কোকোর কালো মিলে চকলেট শহর একটা। ক্যাটরিনার পর আমাদের নিচতলায় দুই শ্রমজীবী মহিলা থাকতেন। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন, অনেক কথা বলতেন। ভোর হলে পাখিদের পাউরুটি খাওয়াতেন, বিকেল হলে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের খবর নিতেন। প্রথম প্রথম বেখাপ্পা লাগতো, কিন্তু এক বিকেলের কথোপকথনে জানলাম তাদের কাহিনী। একটি সাধারন পাড়ায় সাদা-কালো মিলে থাকতেন। খেটে খেতেন, বিভেদ বুঝতেন না। দুঃখগুলোয় মিল থাকলেই শুধু সুখগুলোয় মিলে খুঁজে পায় মানুষ, উপলব্ধি করেছিলাম লিসাদের গল্প শুনে।

আমাদের পিছনের সিটে এক সাদা মহিলা বসেছিলেন। জিন্সের বিভিন্ন জায়গায় ছিটে ছিটে রঙ লেগে আছে। বোধহয় কাজ থেকে আসছেন। বলছিলেন নতুন নাতনি দেখতে ট্যালাহাসি (ফ্লোরিডা) যাচ্ছেন। সকালে বরকে কাজে নামালেন, তারপরে সৎ ছেলে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেল কোথায় যেন, আবার নিয়ে আসলো বাস স্টপেজে। সহাস্যে দিনের বিভিন্ন কথা বলছিলেন। আশেপাশের কালো যাত্রীরা বেশ উৎসাহ নিয়েই যোগ দিয়েছিলেন আলোচনায়। বই পড়ার ভান ধরে শুনছিলাম তাদের কথা। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না, চটকদার বা আকর্ষনীয় কিছুও না। সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনের সাধারণ কিছু কথাবার্তা। শুনতে শুনতে চোখ দূরে হারিয়ে যায়, পেশিগুলো শান্ত হয়ে আসে, উদ্বেগগুলো ভুলে যাই কিছু সময়ের জন্য। সবাই মানুষ, কেউ আমরা সাদা বা কালো বা বাদামি নই। আহ, কী শান্তি।

ঠিক উল্টোটা দেখেছিলাম অ্যাটলান্টা (জর্জিয়া) পৌঁছে। এক কালো মহিলা সাদা এক মহিলার পাশে বসতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হলেন। সরব ভাবেই বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগটা জানিয়ে পেছনে হেঁটে গেলেন। সাদা মহিলার উপর খুব রাগ লাগলো, কিন্তু একটু পরেই দেখলাম টয়লেট থেকে এসে মহিলার বর পাশে বসলেন। তখন আবার ভাবছিলাম, এত ধৈর্য কীভাবে দেখালেন তিনি! হারিয়ে যাওয়া টেনশন আবার টের পাচ্ছিলাম বাসের পরিবেশে। আশেপাশে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, এই অবিশ্বাসের মূলে কি আদতে বর্ণ, নাকি শ্রেণী? অ্যাটলান্টায় ধনী-গরীবে বিভেদ অনেক বেশি। যত উত্তরে যাওয়া যায়, তত বেশিই এই হাল। ধনী আর সাদা এই দেশে সমার্থক। হয়তো সেকারণের যেই প্রশ্ন লুইজিয়ানা-অ্যালাবামায় হাসিতে নিরসন হয় সেটাই টেনেসি-জর্জিয়াতে এসে ক্ষোভের সঞ্চার করে।

কোন বিপ্লব পারে এই দূরত্ব ঘুচাতে? কোন সবক পারে এই সংক্ষুব্ধ মনগুলোকে প্রবোধ দিতে? অগণন উত্তরহীন প্রশ্নের মত এগুলোও খুব বিরক্ত করছিলো। আমি কেন এদের মত করে ভাবি না, তা ভাবছিলাম। তবু হিসেব মিলছিলো না। আরো অনেকেই তো একই বইগুলো পড়েছেন। অনেকেই তো বিদেশে এসে সুখ-দুঃখ সয়েছেন। অনেকেই তো আমারই মত অনেক প্রহর গল্প করে কাটিয়েছেন এদের সাথে। তবু কেন সবাই এত ঘৃনা আর অবিশ্বাসের স্রোতে ভাসেন, এই হিসেবটাই মিলছিলো না। জবাবটা মাথায় এলো আচমকাই। বাবা, আমার বাবা।

অনেক কাল পর সমাপ্তির আনন্দ বুকে নিয়ে চোখ বুজলাম।


মন্তব্য

ফারুক হাসান এর ছবি

খুব ভাল লেগেছে লেখাটা। ঝরঝরে গদ্য, চমত্কার ভঙ্গি, আর দারুন একটা বিষয় নিয়ে মজাদার লেখা। আপনার চিন্তার গভীরতাও লেখায় ফুটে উঠেছে।
হাতে সময় নেই, তাই বিষয়বস্তু নিয়ে মন্তব্য করতে পারছি না এখন।
-----------------------
জানেনিতো, ইহা নিতান্তই নিজস্ব মতামত

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ভাল লেখা দিছেন ভাই। পইড়া আনন্দ পাইলাম, আবার চিন্তার খোরাকও আছে। গ্রেহাউন্ডে একবারই চড়ছিলাম - জীবনের চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

মৌলিক অধিকার আর মানুষ হিসেবে বাঁচার সুযোগটুকু সমান সমান হলেই হয়। বিলাসিতার সাম্যটা কেউ চায় না।
তবে সমাজে অপচয়ের বিলাসিতা রুখতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মোড়কেই এসেছে গ্রিন রাশনালিজম। পরিবেশ রক্ষায় হয়তো অপচয়,বিলাসিতা ঠেকানো যাবে।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে। SMC ভাই তো ঝাঁঝরা করে দিলেন। ভয়ংকর রকম শার্পশুটিং। এই কয়টা লাইনে অনেক কিছু বলে ফেললেন।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

পড়লাম। তবে আমি আবার এক কঠিন কথা সহজে বুঝতে পারিনা। তাই মন্তব্যগুলো খালি পড়লাম; দিলাম না।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

হায় হায়, তাহলে তো মহাব্যার্থ লেখা!!

সিরাত এর ছবি

অসাধারণ লাগলো। একেবারে ন্যারেটিভ ক্লোজার যারে বলে! দেঁতো হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।