আমার বাবার নাম আব্দুর রউফ। সরল, সাধারণ, জৌলুসহীন একটি ইসলামিক নাম। অর্থটাও বেশ সরল, আল্লাহর বান্দা। আজকাল নামের বাজারে নতুন নতুন পণ্যের ভীড়ে কিছুটা বেমানান। বাঙালির নামকরণের অভিধানে বাজার-চলতি প্রায় সব শব্দই ঢুকে গেছে। ধর্মীয় নাম গেছে, প্রাকৃতিক নাম গেছে, বাঙালি নাম গেছে, বাঙালি নামকে হিন্দুয়ানি বলে দাবি করে বিবিধ ভাষা ও ধর্ম থেকে ধারে নেওয়া নাম গেছে। বিন-লাদেন, সাদ্দাম থেকে শুরু করে আরাফাত-অমর্ত্য পর্যন্ত সব নাম গেছে। এত নামের ভীড়ে আমার বাবার নামটা একটু সাদামাটাই।
কথাটা এক যুগ আগের। তখনও শহীদ বলতে মাতৃভূমির জন্য জীবন উৎসর্গ করা মহান যোদ্ধাদের বোঝাতো। তখনও বাংলাদেশে বীরশ্রেষ্ঠের সংখ্যা মাত্র সাত জন ছিল। তারচেয়েও বড় কথা, সংখ্যাটা সাতেই সীমিত ছিল। এমনকি ক্ষমতার রাজনীতির প্রয়োজনেও এর অন্যথা করার কথা কেউ বলত না। ন্যূনতম সাধারণ জ্ঞানটুকু বালক থেকে বিরোধীদলীয় নেত্রী পর্যন্ত সবার মধ্যেই ছিল। সীমান্তে গোলাগুলিতে নিহত বিডিআর সেনাদের কেউ ক্ষমতায় গেলে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করার ঘোষণা দিত না, দিলেও ক্ষমতায় গিয়ে তাদের কথা বেমালুম ভুলে যেত না। দেশ বিক্রি হয়ে যাওয়ার জুজুর ভয় তখনও ছিল, ছিল না ইতিহাসের রাস্তায় উল্টোযাত্রা।
আরও অনেক কিছুই ছিল না সেই সময়। যত বিরোধই থাকুক না কেন, কেউ দালালদের দালালি করতেন না। কেউ করলেও দেশের বাকি জনগণ চেয়ে চেয়ে দেখতেন না। চাপা ক্ষোভটুকু হলেও প্রকাশ করতেন। গণমাধ্যমে তখন নিরপেক্ষতা নামে কোন ভূত ছিল না। ভাল আর খারাপের মাঝের স্পষ্ট তফাৎটুকু ব্যবসার খাতিরে ঘোলা করার মিশনে নামেনি তখনও গণমাধ্যমগুলো। মানুষ নিরপেক্ষ বলে কোন শব্দ জানতো না, তবে ভাল আর মন্দ বুঝতো, মন্দকে পরিহার করতো, আর গ্রহনযোগ্য সকল পক্ষকে সমান চোখে দেখতো, নিরপেক্ষভাবে সামলাতো। বাংলাদেশ তখনও কৃষক-মজুরের ঘামে গড়া, আর রক্তচোষা দেশপ্রেমিকদের লুটপাটে রিক্ত একটি দেশ ছিল। তখনও এদেশ দারিদ্র্য বেচে চলতো, ঋণ করে ঘি খেতো, ছাত্রদের অর্ধেক জীবন বিশ্ববিদ্যালয় নামক কারাগারে আটকে রাখতো, উৎসনির্বিশেষে সকল অর্থের উপাসনা করতো। তবুও কেন যেন মনে হয়, সেই দিনগুলোই উত্তরপ্রজন্মকে গর্ব করে শোনাতে পারবো। আমাদের আমলে ৭ বছরে বিএ পাশ করতাম আমরা! আমরা বিনা বোমায় স্বোপার্জিত স্বাধীনতার তলায় সন্ধ্যা কাটাতাম! আমাদের কালে বছরে মাত্র ৭০ দিন হরতাল হত! একদিন বুলেটপ্রুফ ভেস্ট ছাড়াই মানুষ পথ চলতে পারতো!
গোটা সমাজের মত আমাদের প্রজন্মের উঠতি শিশুদেরও অন্য রকম একটা আবেগ ছিল দেশকে ঘিরে। বীরশ্রেষ্ঠদের নাম শুনলেই নত লোমগুলো গর্বে উঠে দাঁড়াতো, চিরশান্ত রক্তে উন্মাদ আনন্দের মাদক ছোটাছুটি করত। সেরকমই এক দুপুরে পড়ছিলাম বিজয়ী বীরদের আত্মত্যাগের কথা। তখনও শিক্ষকরা পাঠ্যবহির্ভূতভাবে হলেও বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প করতে পারতেন। আমরাও শুনতাম। একদিন বীরশ্রেষ্ঠদের নাম বলতে গিয়ে শ্রদ্ধেয়া শিক্ষিকা ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রবকে ভুলে আব্দুর রউফ বলেছিলেন। মুহূর্তে আমার দিকে ঘুরে তাকানো পুরো ক্লাসের সেই দৃষ্টি আমি আজও ভুলতে পারি না। না, সেই বীরশ্রেষ্ঠের নাম আব্দুর রউফ না। আমার বাবাও নিহত নন। কিন্তু তাতে কার কী আসে যায়! শতবার বলার পরও সবার এক কথা। নাম একই নাহোক, ক্ষতি নেই। মিল তো আছে! ১০ বছরের এক ঝাঁক বালকের সেই ভুল যে আজ এতদিন পরও শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের এত বড় উৎস হবে, তা কি তখনও জানতাম? হয়তো এমন মন্তব্য করাটা বেশ বড় মাপের ধৃষ্টতা হয়ে যাবে, তবু না বলে পারছি না। মনে হয় শত শত পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র, দিবসভিত্তিক সরকারি বার্তা, কিংবা বেলুন-ওড়ানো দেশপ্রেমের চেয়ে মুহূর্তের সেই ভুলই বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রবকে গভীরতর শান্তি দিয়ে থাকবে। ব্রিটিশবিরোধী এক ভাষণে নেতাজি সুভাষ বসু একবার বলেছিলেন, স্বাধীনতা হল ভুল করার অধিকার। আমাদের সেই ভুলের অধিকারের জন্যই তো শহীদদের প্রাণ দেওয়া।
সামনেই স্বদেশের ৩৪তম জন্মদিন। হতাশা আর বেকারত্বে জর্জরিত যুবকের বেশে আরো একটি বছর পার করে দেবে সে। মানুষের অসাম্প্রদায়িকতা আর অহিংসার কাছে তার আর কোন আবেদন নেই। যান্ত্রিকতা, ষড়যন্ত্র, আর দুর্নীতিতে তার দেহ-মন ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রতি পলে। ধর্মের নামে নিজের ভাইদের কণ্ঠরোধ করে করে তার হৃদয় আজ শতখণ্ডে খণ্ডিত। ধর্মেরই দোহাই দিয়ে নিজের বোনদের সম্ভ্রমহানিও আজ তাকে বিব্রত করে না। অন্যায় হত্যাকাণ্ড, অন্ধ বিদ্বেষ, কিংবা ভেদবুদ্ধি এখন তার কাছে ভাত-মাছের মতই। তবুও নিজেকে হারিয়ে খোঁজা এই যুবক আজও হয়তো স্বপ্ন দেখে। আজও হয়তো সে অতীতকে স্মরণ করে অহংকার আর আত্মপরিচয়ের তাগিদে। হয়তো এমন দিনগুলোয় একবার হলেও কৃতকর্মের জন্য তার মনে রাজ্যের লজ্জা ভীড় করে। হয়তো এখনও তার একটি অংশ রাত জেগে বসে থাকে সূর্য দেখবে বলে। এখনও হয়তো সেই যুবক যুদ্ধ করে, একটি ফুলকে বাঁচাবে বলে।
আজ জন্মদিনের শুভেচ্ছা সেই যুবককে, আর বাকি সকলের কাছে একই সাথে গর্বিত আর লজ্জিত হওয়ার আহ্বান। আজ যে আমাদের সবকটা জানালা খোলার অধিকার আছে, কিন্তু ওরা আসলে, দেবার মত কিছু নেই!
শুভ জন্মদিন, স্বদেশ!
(মার্চ ২৭, ২০০৫)
মন্তব্য
রউফ ভাই,
খুব ইন্সপায়ার্ড ফীল করছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু সবাই তাদের নিজেদের লেখা প্রথম পেইজে দেখতে চায়। তাই পরপর দুতিনটা লেখা না লিখে, সময় নিয়ে পোস্ট দিন। আর খসড়া এবং শিডিউলে লেখা প্রকাশের সুবিধা তো আছেই। আরো জানতে প্রায়শ জিজ্ঞাস্যতে ক্লিক করুন।
আশা করি আমার এ কথায় মাইন্ড করেননি।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
মনে করার কিছুই নাই। আমিও একি কথা ভাবছিলাম। পুরান লেখাগুলো কনভার্ট করছিলাম বিজয় থেকে। বাকিগুলো অলরেডি খসড়ায়।
-------------------
প্রবাসী,ছাত্র,দুস্থ,দেশপাগল
-------------------
পাতি।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
নতুন মন্তব্য করুন