সুন্দর, হে সুন্দর

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: সোম, ১৭/০৯/২০০৭ - ১১:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
বাবা-মা চেষ্টার অন্ত করেনি। ছেলে যাতে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে, তা নিশ্চিত করতে গৃহদাহের ঝুঁকি নিয়েও আমার মায়ের বাচন ঠিক করতো আমার বাবা। করসি নয়, করেছি। রাধসি নয়, রেঁধেছি। গেসিলাম নয়, গিয়েছিলাম। এরকম আরো অনেক কিছু। ছেলে একজন শুদ্ধ ও পরিপূর্ণ মানুষ হবে, সেই ইচ্ছা থেকেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারেও অসীম মনোযোগ ছিল তার। বিশেষ যত্ন ছিল ভাষার দিকে। জন্মদিনের উপহার ছিল আনন্দবাজার থেকে প্রকাশিত বাংলা বানান ও প্রুফরিডিং নিয়ে বই, নয়তো সংসদ বাংলা অভিধান। কোনদিন খেলনা বন্দুক হাতে নিতে দেওয়া হয়নি আমাদের দুই ভাইকে। আব্বু কোনদিন আধোআধো ভাষায় কথা বলতো না আমাদের সাথে। হাতে ধরে লেখা শেখানো হয়েছিল আমাদের। খাতা পয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে রেখে লিখলে দ্রুততম এবং সুন্দরতম হয়, শেখানো হয়েছিল। স্কুলের আগে সিঁথি সোজা করে চুল আচড়ে দেওয়া, জুতার ফিতা বেঁধে দেওয়া, জুম্মাবার আসলে সময় মত গোসল ও নামায নিশ্চিত করা, ঈদের আগে পায়জামা-পাঞ্জাবী ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখা, ছুটির দিনে জুতা কালি করে রোদে শুকানো, আরো অনেক কিছু। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার আগ পর্যন্ত বাসায় কেবল টিভি আসেনি, পড়া নষ্ট হবে দেখে। আব্বু সিগারেট ছেড়ে দেয় আমি সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পরপর। কারণ একটাই, নিজে মশাল ফুকলে ছেলেকে মানা করতে পারবে না। এত ত্যাগে লাভ কী হল বুঝলাম না। আয়নায় নিজের দিকে তাকালে খুব লজ্জা লাগে। কী হতে পারতাম, আর কী হলাম। বন্ধুর ভাষায় ‘বিবর্তন থেকে দূরে’ ও রুক্ষ একজন মানুষ ছাড়াও বিশাল কিছু ফাঁক চোখে পড়ে। ছেলেবেলার স্মরণ তাই অনেক লজ্জার আমার কাছে। এত যত্ন, এত ভালবাসা, এত মনোযোগ যেন পথেই হারিয়ে গেল। ছেলেবেলা তাই আমাকে নস্টালজিয়া বা দুষ্ট আনন্দের চেয়ে হতাশা দেয় বেশি। অন্তরের ত্রুটি অন্দরেই থাক, আমি বেঘোরে মরলেও সনাক্ত করার মত একটা বাহ্যিক ত্রুটির কাহানি লিখি এই বেলা।

২।
ভদ্রভাষায় যাকে সৌন্দর্যের উপাসনা বলে, সেই আদিম রোগটি আমার বেশ পুরনো। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়তাম ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। কো-এডুকেশন স্কুল। ছাত্র ভাল ছিলাম, কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব দুরন্ত ছিলাম। বয়স তখন হিরোইজমের। হিরোর মত ঘন্টাখানেক ছোটঘরে ক্রিকেট খেলি, নিয়ম করে ফুলবাবু সাজি, হাঁটার পথ লাফিয়ে পার হই। এই উঠতি হিরোইজমের দায় মিটালাম উপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত খুইয়ে। ডাক্তারি ভাষায় সম্ভবত আপার ইনসিজর বলে ওগুলোকে।

ঘটনা ১৯৯২-এর মে মাসের দিকের। টিফিন পিরিয়ডে চোর-পুলিশ খেলছিলাম সব ছেলেরা। পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য স্লাইড/স্লিপারের উপর উঠে বসলাম আমরা কয়জন। আমি একদম উপরে, পেছনে আরেক সহপাঠী। আচমকা পুলিশি আক্রমণে পড়লো আমাদের সেফ-হাউস। পেছন থেকে পুলিশ এগিয়ে আসতে দেখে আমরা পিছলে নেমে পড়তে গেলাম। আগেই তো বলেছি মনে হয়, আমরা তখন নিজের মনে উঠতি হিরো সবাই। আম-জনতার থেকে নিজেদের পৃথক করার অদম্য বাসনা আমাদের। পু্চ্ছে পিছলে তো মেয়ে থেকে মানুষ পর্যন্ত সবাই-ই নামে, ঐ কাজ কি হিরোর করা সাজে? আমি উলটো হয়ে নামতে থাকলাম। আজকে যাকে ডগি স্টাইল বলে বর্ণনা দিয়ে নিজেই হাসি, সেদিন সেটাই খুব নায়কোচিত ছিল আমার কাছে। আমি নেমে যেতেই উঠে এল আমার পরের জন, তার পেছন পেছন পুলিশ। আমি যদি হিরো হয়ে থাকি তো আমার বন্ধুটি ছিল সুপার-হিরো। আমি তবু উলটো হয়ে পিছলে নামছিলাম, ঐ বান্দা নিঃসঙ্কোচে লাফ দিলেন চূঁড়া থেকে। রিফ্লেক্স থেকেই মাথা সরিয়ে নিলাম ডান দিকে, বন্ধু আমার পড়লো আমার ঘাড়ের উপর, আমার মুখ গিয়ে বাড়ি খেল স্টিলের রডে। ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেলাম পাশ দিয়ে। শিউরে ওঠার কিছু নেই। গল্প এটুকু হলে আমিও দুঃখ পেতাম। আজও সেই দিনের কথা মনে করে হাসার কারণ ভিন্ন। সেই পর্বে আসি।

৩।
পড়ে যাবার পর মাথা কেমন যেন ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কোন অনুভূতি ছিল না। ব্যাথা নেই, বেদনা নেই, শুধু মুখের ভেতর কেমন যেন আরামদায়ক এক উষ্ণতা। খেয়াল করে দেখলাম নীল শার্ট ভিজে লাল হয়ে আছে। মুখে হাত দিয়ে টের পেলাম দাঁত দুটো একটু নড়বড়ে। কোন অনুভূতি ছাড়াই একে একে খুলে এল দুটোই। দৃশ্যমান অংশের আড়ালে দাঁতের বাকি দুই-তৃতীয়াংশ প্রথম দেখলাম। না, গল্প এখানেও শেষ না।

ফার্স্ট বয় হওয়ার সুবাদে ক্লাসসেরা সুন্দরীর পাশে বসবার সুযোগ হয়েছিল আমার। শিক্ষকেরা নিজেরা জোড়া বেঁধে বসাতেন ছেলে-মেয়েদের। ছাত্র হিসেবে যেমনই হই না কেন, আমার খোমাখানা বর্তমানের চেয়ে খুব একটা উন্নত ছিল না। সুন্দরীর সাথ পেলেও সঙ্গ অধরাই থেকে গিয়েছিল। দাঁত পড়বার পর কোন অজানা থেকে আচমকা সেই সুন্দরীর উদয় হল। হাত ধরে বললো, ‘তোমার দাঁত পড়ে গেছে?’ আমার স্তম্ভিত চোখ থেকে হ্যাঁ-সূচক জবাব ধরে নিলো। এরপর চললো অমৃতবর্ষণ। দাঁত নাকি কাকের চোখে পড়ে গেলে আর উঠে না। আমার দাঁত অতি-সত্বর ইঁদুরের গর্তে গলিয়ে দিতে হবে। চাইবার আগেই দিয়ে দিলাম দাঁতগুলো। হাওয়া থেকে উদয় হওয়া কন্যা হাওয়ায়ই যেন মিলিয়ে গেল। পাশ থেকে এক বন্ধু এসে বললো, ‘এই, তোর তো দুধ-দাঁত আগেই পড়ে গেছে, এখন কী করবি?’ আমি তখন সপ্তম স্বর্গে, এসব প্যাঁচালে কান দিলাম না।

ক্লাস শেষ হতে হতে ব্যাথা উঠে গেল। ছুটির পর নানার গাড়ির ড্রাইভার ভেতরে এসে দেখলো রক্তভেজা শার্টে বসে কাঁদছি। দ্রুত তুলে নিয়ে গেল বাসায়। মায়ের হইচই-পর্ব পার করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল। ডাক্তার বলে দিলেন, ঘন্টা তিনেক পর্যন্ত রক্ত গরম থাকে। এর মাঝেই দাঁত দুটো আনতে হবে।

দৌড়-ঝাঁপ দিয়ে সবাই মিলে স্কুলে ফিরলাম। পুরো মাঠ চষে মাত্র একটা দাঁত পাওয়া গেল। অতঃপর নকল ডেনচার পরে আমার দিনাতিপাত শুরু। সেই দিনের পর আর সেই স্কুলে যাওয়া হয়নি। যেটুকু সময় ছিলাম, তাতেও সুন্দরীর সাথে আর সাক্ষাৎ হয়নি। হয়তো কোনদিন পথে এক সুন্দরীর সাথে দেখা হবে। হয়তো তার আবর্জনার বাক্সে কোণাভাঙা ছোট্ট একটা দাঁত পাওয়া যাবে। আমি হয়তো তখন তাকে ভড়কে দিয়ে সবজান্তার মত তার গোপন কথা বলে দেবো। সবশেষে চিচিং ফাঁক বলে আমি আমার নকল দাঁত দেখাবো। নাহ, বয়সটা অনেক হয়ে গেছে। ছেলেমানুষীর দায় একবার মিটিয়েই খায়েশ মিটে গেছে।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

মজার ঘটনা। দারুন লেগেছে। ছেলেবেলার আর সব গল্প কই?

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

মামু, এটাকে বই থেকে ব্লগ পোস্ট করে দেওয়া যায়?

মাশীদ এর ছবি

হা হা হা!
কঠঠিন কাহিনী!
প্রথমে পড়া শুরু করে ভেবেছিলাম উচ্চারণঘটিত কোন ঘটনার কথা লিখবি। নিজের কথা মনে পড়ছিল...আমার মায়ের আক্ষেপের কথা...ঠিক কেন বাসার আর সবার ভাষা এত ভাল থাকা সত্ত্বেও আমি যাচ্ছেতাই ভাষায় কথা বলি। অরূপের সাথে আমার মায়ের এই ভাবের মিলের কথাও মনে পড়ল। এই ব্যাটা তো একবার ফিল্ম শো এর সময় মুরসা আর অয়নকে জিজ্ঞেস করেছিল যে আমি ওদের সাথে এত সময় থাকি তারপরেও কেন আমার ভাষার এই হাল! জুনিয়রদের সামনে সেকি বেইজ্জিত! যাক, পরে পড়ে দেখি তোর লেখা দন্তবিষয়ক। ক্লাস টু'তে থাকতে আমিও উপরের পাটির সামনের দু'টো দাঁত ভেঙেছিলাম বাঁদরমীর খেসারত দিতে গিয়ে। তবে তোর মত প্রায় পুরো খুইয়ে ফেলিনি। আর তেমন কোন সুন্দর কারো ভূমিকা ও তার পরবর্তী রূপকথীয় পরিণতির আশাও নেই। তবে তুই হাল ছাড়িস না। কে জানে! সিন্ডারেলার জুতার মত তোর ভাঙা দাঁত মিলে রাজ্য-রাজকন্যা পেতে কতক্ষণ!


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

উচ্চারণ নিয়ে অনেক কিছুই লেখার আছে। সমস্যা হল, বানান তো সব গুলে খেয়ে বসে আছি। উচ্চারণ নিয়ে লেখায় যদি হাজার-একটা বানান ভুল থাকে, তাহলে বেইজ্জতির চূড়ান্ত হবে।

রইল বাকি রাজকন্যা। এটা তো বাকি পড়ে আছে আজকে প্রায় দেড় দশক ধরেই। আমার কপালে আসলে করিৎকর্মা বড় বোনের অভাব, নাহলে কি এভাবে দিন কাটে? চোখ টিপি

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

মজার গল্প। দাঁতের কথা আর কইয়েন না যদিও, আমারগুলা চিরকালই ত্যাড়া ব্যাড়া। আমার বাপ-মা'র আবার aesthetics-এর দিকে নজর কম ছিল। যেই বয়সে পোলাপান এইখানে ব্রেস পইড়া দাঁত সোজা করে, ঐ বয়সে ঐরকম কিছু করা-টরা হয় নাই। এখন বৈদেশে আইসা দেখি সবাইর দাঁত কি সোন্দর! চাকরির পয়সা খরচ করার তাই নতুন রাস্তা পাইছি - বুড়া বয়সে আমিও দাঁত মেরামত করতাছি!

আর শুদ্ধ ভাষা! জীব্বনেও না! এখনো বাসায় বোন যদি একটু সুন্দর করে কথা বলে বা বলার চেষ্টা করে, আমরা ভাইয়েরা টিটকারি দেই - 'কিরে, হেদ্দো কইরা কতা কস্‌ কিল্লেগা?' চোখ টিপি

আরিফ জেবতিক এর ছবি

এইটা হয় নাই।খেলবো না।আপনি মেইলে লেখা পাঠানোর কথা।
যাক,আমি আশাকরি যেসব পাঠক এই পৃষ্ঠা পড়ে ফেলেছেন,তারা অচিরেই ভুলে যাবেন।
এবং বইয়ে নতুন করে পড়বেন।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ক্ষমা করে দেন, বস। বইয়ের জন্য আরো কিছু যোগ করে দেবো নে। টানা দুই দিনেরও বেশি সময় ধরে ঘুমাই না। এর মধ্যে একরাতে তো সেপ্টেম্বরের শীতেই জমে যাচ্ছিলাম বাইরে। ইমেইল অ্যাড্রেস মুখস্ত ছিল না দেখে আর রাত না বাড়িয়ে বইয়েই যোগ করে দিয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। সেহরিতে উঠে মনে হল কী বেওয়াকুফি করেছি।

এক কাজ করি, এটা বই থেকে সরিয়ে ব্লগে নিয়ে আসি। বইয়ের জন্য লেখার অন্য কথা মনে পড়ছে এখন অনেক। এইবার আর ভুল হবে না।

কনফুসিয়াস এর ছবি

মজা পেলাম পড়ে। আপনার লেখার হাত চমৎকার।
-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অমিত এর ছবি

হায় দাঁত‌...

______ ____________________
suspended animation...

দ্রোহী এর ছবি
আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ঝরঝরে বর্ণনায় - ছেলেবেলা। ভালো লেগেছে।

মেহদী হাসান খান এর ছবি

ইউল্যাব এ ছিলেন? ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছি ঐখানে। এখনও ভাবি, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল সেটা...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।