কাহিনির শুরু আমাদের নায়ক ম্যানি ক্যালাভেরাকে নিয়ে। একটা স্বল্পালোকিত অফিস ঘরের ওয়েটিং রুম, জানালা দিয়ে এল মারো শহরের স্কাই লাইন দেখা যাচ্ছে, খুব অস্থির হয়ে সেখানে অপেক্ষারত ম্যানির নতুন ক্লায়েন্ট। দরজা খুলে গ্রিম রিপারের কস্টিউম পরা ম্যানিকে অফিসে ঢুকতে দেখে আরেকটু ঘাবড়ে যায় লোকটা। হাতে আবার রিপারের বিশাল এক সাইথ্-ও আছে! ম্যানি কিন্তু আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে নিজেকে ভদ্রলোকের নতুন ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে। বাড়ি ফিরতে চান শুনে একচোট হাসে ম্যানি, জানায় সেটা সম্ভব না, কারণ তারা সবাই এখন মৃত!
ম্যানি কাজ করে ল্যান্ড অফ দ্য ডেড-এর এল মারো শহরের ডিপার্টমেন্ট অফ ডেথ-এ। সদ্যমৃত আত্মারা যখন মৃত্যুদেশে পৌঁছে তখন তাদের চরম লক্ষ্য হয় নবম মৃত্যুজগৎ!
কিন্তু এখানে যাবার পথটা সহজ নয়। মাত্র ৪ মিনিট থেকে লেগে যেতে পারে চার-চারটি বছর! ডিপার্টমেন্ট অফ ডেথের ট্রাভেল এজেন্টরা, যেমন আমাদের ম্যানি কাজ করে এই আত্মাদেরকে জীবিত দুনিয়া থেকে নাইন্থ আন্ডারওয়ার্ল্ডে পৌঁছে দেবার সুবন্দোবস্ত করতে। কাজটা সহজ নয়, বিশেষ করে ম্যানির বরাদ্দে যখন জোটে যতসব পাপী-তাপী বান্দা যারা কখনোই সেই বিখ্যাত ৪ মিনিটে নবম দুনিয়ায় পৌঁছে দেবার বিলাসবহুল নাম্বার নাইন বা ডাবল নাইন এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট পায় না। বরং অধিকাংশ সময়েই পায়ে হেঁটে ৪ বছর ধরে চলতে থাকে, কখনো বা তার আগেই বাধ্য হয় অন্য কোন কাজে জড়িয়ে পড়তে, বা মৃত্যুর পরের মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়, নয়ত হতাশ হয়ে এই মাঝের দুনিয়েতেই লটকে থাকে।
ম্যানি নিজে যেতে পারে না নাইন্থ আন্ডারওয়ার্ল্ডে কারণ তার নিজের অনেক পাওনা বাকি। নিজের ভাগ্যকে আর বস ডন-কে গালাগাল করতে করতে ঠিক করে তাকে একজন ভাল ক্লায়েন্ট চুরি করতে হবে, এমন কেউ যে ঠিকই নাম্বার নাইনের টিকেট পাবে আর ম্যানিরও বেশ উপরি লাভ হবে। সহকর্মী ডমিনোর থেকে এমন একজন ক্লায়েন্ট চুরিও করে ম্যানি, মার্সেডেস ‘মেচে’ কলোমার। কিন্তু মেচের মত নিষ্পাপ সোলকেও যখন বঞ্চিত করা হয় ডাবল নাইনের টিকেট, ম্যানির মাথায় উঁকি দেয় এক ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা। তদন্তে বেরিয়ে পরে জটিল সব ব্যপার, অন্তরালের ষড়যন্ত্র। ডন আর ডমিনো ডিপার্টমেন্ট অফ ডেথের ডেটাবেস সিস্টেমে ঘাপলা করে শুধু যে বিলাসবহুল ডাবল নাইন এক্সস্প্রেসের টিকেট বঞ্ছিত করছে ন্যায্য লোকেদের কাছ থেকে তাই নয়, অপরাধী চক্রের হোতা হেক্টর লে মান্স সেগুলো জড়ো করে চড়া দামে বিক্রি করছে অযোগ্য পার্থীদের কাছে। ম্যানির আলাপ হয় বিপ্লবী নেতা সালভাদোর ‘স্যাল’ লেমোনস্ আর তার দলের সাথে। ঘটনা শুরুর এক বছর পরে, বন্দর নগর রুবাকাভায় ম্যানি ততদিনে নিজের একটা নাইটক্লাব দিয়েছে, কিন্তু হেক্টর আর তার চেলাদের ষড়যন্ত্র বানচাল করে, মেচেকে খুঁজে বের করতে অস্থির হয় ম্যানি, মেচের ন্যায্য পাওনা টিকেটটা তার হাতে তুলে দিতে চায়… দেখা হয় বটে আবার দু’জনার, আর শেষতক কী হয় তা বরং গেম খেলেই জানা ভাল।
অ্যাডভেঞ্চার গেমিং-এ যে নামটা আমার সর্বাগ্রে মনে পড়ে তা হল Grim Fandango! ফ্যান্দাঙ্গো হল এক রকম স্প্যানিশ-আমেরিকান ফোক ডান্স। এই গেমটা তৈরি করেছিল লুকাস আর্টস, ১৯৯৮ সালে তারা এটা বাজারে ছাড়ে। আমি মনে হয় খেলেছিলাম ২০০০ সালে। অ্যাডভেঞ্চার গেমিং-এ হাতেখড়ি হয়েছিল লুকাস আর্টস-এরই মাঙ্কি আইল্যান্ড সিরিজের কোন একটা গেম দিয়ে, যেটা শেষ করা হয়েছিলনা। এর পরে খেলা হয়েছে অনেক গেম যার মধ্যে অন্যতম ছিল সাইবেরিয়া সিরিজ আর দি লংগেস্ট জার্নি। কিন্তু গ্রিম ফ্যান্দাঙ্গো চিরকালই আমার টপ ফেভারিট লিস্টে থাকবে মনে হয়। গতরাতে পুরনো পোস্ট ঘাঁটতে গিয়ে খেঁকশিয়ালদার সাইবেরিয়া রিভিউ পড়বার সময় মনে পড়ল আবার এটার কথা। মজার ব্যাপার হল আমরা যারা অ্যাডভেঞ্চার গেমিং ভাল পাই, তাদেরও অনেকেই দেখি এই গেমটার নাম শোনে নাই, বা শুনলেও খেলে দেখে নাই। আমার নিজের কাছে না থাকায় দেয়া হয়না তাদেরকে। কালকে ঠিক করলাম খুঁজে বের করা দরকার আবার, আর লিখেও ফেলা যেতে পারে অন্যদের জন্যে।
এই গেমটা যদিও গ্রাফিকাল ভিউপয়েন্ট থেকে সাইবেরিয়ার মত অত অসাধারণ নয়, কিন্তু কাহিনি বিন্যাস আর ধাঁধাগুলোর দিক থেকে এটা এক নম্বরে বলতে হবে। নাটকীয়তা আর রহস্যে ভরপুর গেমটা আসলে বেশ কিছু আজটেক বিশ্বাস, মেক্সিকান-স্প্যানিশ ধারণা, আর ৪০-এর দশকের হলিউডি ক্রাইম-কোরাপশন-ড্রামা স্টাইলে তৈরি, আর এইটা একটা বাড়তি মজা খেলবার সময়। গেমটার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এর প্রতিটা মানব চরিত্র কিন্তু কালাকা (আর অন্যান্য কাজ যেমন ধরা যাক গাড়ি মেরামত বা এরকম কাজের জন্যে ল্যান্ড অফ দ্য ডেড-এ আছে কিছু ডেমন)। কালাকা হল কঙ্কাল বা মাথার খুলির মেক্সিকান-স্প্যানিশ, তবে ঠিক কঙ্কাল না বলে মেক্সিকান ডে অফ দ্য ডেড উৎসবের একটা প্রতীকি অংশ বললে মনে হয় বেশি ঠিক হবে। কালাকা কিন্তু ভয়ের বা দুঃখের প্রতীক নয়, বরং এগুলো সাধারণত হয় হাসোজ্জ্বল, রঙীন; আর প্রকাশ করে মৃত্যু, মৃত্যু পরবর্তী জীবন ইত্যাদি। গ্রিম ফান্দাঙ্গো-য় আসলে এইরকম অনেক আয়রনিক জিনিস এসেছে, যা আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। কাহিনির পেছনের কাহিনি, আফটারলাইফ নিয়েও ব্যবসা করা সিন্ডিকেট, আরও টুকটাক জিনিস রূপকভাবে তুলে ধরেছে বাস্তবের ছোট-বড় অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অসঙ্গতি। সারকাসমগুলোও ইন্টারেস্টিং লেগেছে, যেমন ধরা যাক ম্যানির নামটাই; ম্যানির পুরো নাম ম্যানুয়েল ক্যালাভেরা, ক্যালাভেরা হল মাথার খুলি বা স্কাল-এর স্প্যানিশ।
গ্রিম ফান্দাঙ্গোর মূল কাহিনিকার আর ডিজাইনার হলেন টিম শেফার। গ্রাফিক অ্যাডভেঞ্চার জেনারেশনের এই সিঙ্গল-প্লেয়ার গেমটা অন্য অ্যাডভেঞ্চার গেমের মতই, খেলতে হয় কী-বোর্ড, জয়স্টিক বা গেমপ্যাড দিয়ে (যতদূর মনে পড়ছে আমিও এটা কী-বোর্ড দিয়েই খেলেছি, মাউস না)। ম্যানিকে নিয়েই খেলা হবে গেমটা। সংগ্রহ করতে হয় টুকরো জিনিসপত্র যা বিভিন্ন সময়ে কাজে লাগে, খেলা চলাকালীন অন্য চরিত্রদের সাথে কথোপকথন এর সময় পাওয়া যায় খুঁটিনাটি তথ্য আর পরবর্তী করণীয় আইডিয়া, আর বিভিন্ন ধাঁধার সমাধান করে এগিয়ে নিতে হয় ম্যানিকে। চারটা পর্বে বিভক্ত গেমটা, চার বছরের কাহিনি, প্রতি বছরের নভেম্বরের ২ ডে অফ দি ডেড-এ শুরু হয় প্রতিটা অংশ। ’৯৮-এর গেম, কাজেই সিস্টেম রিকোয়ারমেন্টস তেমন কিছু নয়, ১৩৩ মেগাহার্জ প্রসেসর, আর ৩২ মেগা র্যাম হলেই যথেষ্ট!
আমি খুঁজে দেখলাম এখানে বেশ কিছু ভাল টরেন্ট আছে ডাউনলোড করবার জন্যে। দেখলাম উইকি বলছে নর্থ আমেরিকায় ২০০৩ পর্যন্ত প্রায় ৯৫,০০০ কপি বিক্রি হয়েছে যা কমার্শিয়ালি ফেইলিওর। হয়ত সে কারণেই অনেকেই এর নাম শোনে নাই, কিন্তু মজার ব্যপার হল অর্থ আয়ে ব্যর্থ এই গেমটা প্রায় চোখ-বন্ধ করে পজিটিভ রিভিউ পেয়েছে সর্বত্র! PC Gamer একে ’৯৮-এর Adventure Game of the Year ঘোষণা দিয়েছিল, আর অনেক পাবলিশারের টপ গেম লিস্টেই প্রথম ১৫-এর মাঝে গ্রিম ফান্দাঙ্গো আছে। আর রিভিউ স্কোরে দেখলাম ৯০% ভোট পেয়েছে গড়ে!!
[তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া]
মন্তব্য
Amar onnyotomo prio khela
ল্যাব থেকে বেরুলে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইল।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
মিচি, লোলা, এভাদের কথা না কইলে কিন্তু কেউ খেলবনা
মিচির ছবি দিলাম যে! বললামও তো! আর সব বলে দিলে খেলার মজা নষ্ট হতে পারে। তারচেয়ে আপনার পছন্দের অংশগুলো বলুন।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
কম্পিউটারের মতো একটা ভালো কাজের জিনিসরে যারা খেলনা বানায়া ফেলছে তাদের দিক্কার
তবে গল্প পড়ে মজাই লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সেটাই নজরুল ভাই! সেটাই!! এভাবে কী করে উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া যাবে বলেন তো?! <মাথা চাপড়ে হাহাকার>
গল্পটা আসলেই মজার। অ্যাডভেঞ্চার গেম যেহেতু অ্যাকশন বা স্ট্র্যাটেজি নয় (আমার কিন্তু এই দুইও ভাল লাগে ), সেহেতু মূল কাহিনিটার গুরুত্ব এখানে অনেক বেশি মনে হয় আমার। গেম শেষ হবার পরে একটা গল্প বা উপন্যাস শেষ করার অনুভূতি হয়, আর তাই গল্পটা ভাল না হলে হুদাই খাটলাম এমন মনে হয়। অনেক গেম খেলেছি একেবারেই মিডিওকার কাহিনি নিয়ে। ইদানীং সময়ও কম, তাই খেলাও হয় না। তবুও ৩/৪টা জমান আছে, কারণ শুনেছি যে গল্পটা মজার। দেখা যাক কবে সময় পাই!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ভাল্লাগসে কাহিনী, খেলতে হয় দেখি! পোস্টে বুড়ো আংলা
------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
শেষের অংশটা খুব মজার লেগেছিল। খুঁজলে মনে হয় ইউটিউবে পাওয়া যাবে, ইন্ট্রোটা দেখলাম আবার। কিন্তু এন্ড সিকোয়েন্সটা এখানে দিয়ে দিলে খেলার মজা নষ্ট হতে পারে। তুমিতো খেলবেই, দেখ কেমন লাগে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
দুর্দান্ত গেম রিভিউ হইছে! আমি এইটা খেলছিলাম আমার পিসিগেমিঙ লাইফের এক্কেবারে প্রথমদিকে, নিরানব্বই কি দুইহাজারের আশেপাশে মনে হয়। একটু নস্টালজিয়ায় ভুগতেছি।
সচলায়তনে আজকাল গেম রিভিউ তো বলতে গেলে দেখাই যায় না। আচ্ছা ঠিকাছে, আজকাল হেলোঃ রিচ আর হেলোঃ ওডিএসটি খেলতেছি। একদিন নাহয় আমিও...
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
মন্তব্যের আর তারার জন্যে ধন্যবাদ ওডিনদা।
তুমি এইটা খেলেছ তাইলে? বাহ্! আরো কাওকে পাওয়া গেল। তুমি হেলো নিয়ে লিখে ফেলো, পড়ে দেখি, খেলার সময় পেলে আরো ভালো হবে অবশ্য!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন