শাহবাগে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ অবস্থান নিতে শুরু করার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠছিলাম। একেতো হরতাল, ঘর থেকে বের হওয়া হয়নি, ফেসবুক বা বন্ধুবান্ধব পরিচিতজনদিয়ে রাজশাহীতে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ সমাবেশের কোন আওয়াজই যেন ছিলো না অন্তত প্রথম দিনটা।
এটা ঠিক রাজশাহীতে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নড়াচড়াও যেন ঢাকার হাইকমান্ড না পাওয়া পর্যন্ত ঠিক শুরু হয়ে ওঠে না তা আজ বছর তিরিশেক ধরেই। বাবা-মাদের তরুণ যুগের রাজশাহী আর এখনকার শহরে অনেক ফারাক। তা সেই ফারাকটা মনে হয় জেনেরেশন গ্যাপ-ই হবে, শুধু আমার শহর না, পুরো দেশ জুড়েই। সবখানেই যেন আমরা আমাদের প্রজন্ম 'ধরি মাছ, না ছুঁই পানি' করে পাশ কাটিয়ে যেতে চাই সব ইস্যুকেই।
যখন বেশ ভালো রকমের বিরক্তি নিয়ে নিজেদের দম ফেলার ছোট্ট পরিসর ‘আমাদের রাজশাহী’ গ্রুপে জিজ্ঞেস করছি, “ঘটনা কী, জাগো বাহে, কুন্ঠে সবাই? “ হুট করেই চোখে পড়লো রাজশাহীর সাধারণ শিক্ষার্থীদের তৈরি করা দু’টো ছোট্ট ইভেন্ট। আলুপট্টির মোড়ে কসাই কাদের মোল্লাসহ সকল রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে সমবেত হতে ৭ তারিখ দুপুর আর ৮ তারিখ বিকেলে আহ্বান জানানো হচ্ছে রাজশাহীবাসীকে।
ছবিটা সোহেল ইমাম শুভ্র ভাইয়ের ক্যামেরায় ফেসবুকের অ্যালবাম থেকে -
পরে অবশ্য রাজনৈতিক নেতারা সুযোগ বুঝে এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে। রাজনৈতিক রূপ পেতে শুরু করার হাওয়া লাগতেই বিরক্তি ধরলো, চলে এলাম। শুনলাম সাধারণ মানুষের বেশ ভাল রকমের অপছন্দ হয়েছে ব্যাপারটা। ৮ তারিখের প্রতিবাদ কর্মসূচীর জন্যে তাই বারবার করে আয়োজক ছেলেমেয়েরা বিবৃতি দিলো ফেসবুকে, যেন প্রতিবাদ জানাতে আসা মানুষ কিছুতেই কোন রাজনৈতিক ব্যানার, পোস্টার না আনেন, কোনরকম রাজনৈতিক স্লোগান যেন না দেয়া হয় কালকের সমাবেশ, র্যা লিতে। সাধারণের প্রতিবাদ, জনগণের প্রতিবাদ হবে এটা।
কর্মসূচীতে ছিলো বিকাল ৪:৩০ এ আলুপট্টির মোড়ে জমায়েত হয়ে গণস্বাক্ষর, এরপর র্যালি। র্যালি জিরো পয়েন্টে পৌঁছালে রাজাকারদের প্রতীকি ফাঁসি, সাহেব বাজার বড় মসজিদের পাশ দিয়ে পদ্মা গার্ডেনে মুক্তমঞ্চে পৌঁছে অবস্থানগ্রহণ, এরপরে সেখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে গণসঙ্গীত, আর শেষে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী।
৭ তারিখ রাতে খেয়াল হলো কোন পোস্টার করা গেলে ভালো হত। International Crimes Strategy Forum-এর ফেসবুক পোস্টারগুলো প্রিন্ট করার অনুমতি পেলে বেশ হতো, সেগুলোতে রিটন ভাই আর অন্য সচলদের সেইইরকমের ছড়া আছে। অণুভাইকে ফোন করে বলতেই স্যাম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করা যায় কিনা দেখছেন জানালেন। ICSF থেকে সানন্দেই সাড়া পাওয়া গেল। সচলের স্যাম ভাই কিছু ছবি পাঠালেন। কিন্তু বাদ সাধলো আজকের দিনটা। শুক্রবার সাহেব বাজার এলাকা বন্ধ থাকে। আর রাজশাহীর ব্যবসায়িক কেন্দ্রটাই বাজার এলাকা। ডিজিটাল প্রিন্ট বলে এখানে যেটাকে, মানে ডিজিটাইজ ছবির কোন ফরম্যাট থেকে পিভিসি পোস্টারে প্রিন্ট করে দেবে, তার খরচ অনেক কম হলেও, আজকে দুপুরে ডিজিটাল প্রিন্টিং এর জন্যে নিউমার্কেট, রেল-স্টেশন সবগুলো দোকানই বন্ধ ছিলো। দ্রুত সিদ্ধান্ত হলো যেন রঙিন কাগজ, আর্ট পেপার কিনে আনা হয়, সাথে রঙিন সাইন পেন।
আমরা যখন পৌঁছেছি আলুপট্টিতে তখন গতদিনের মাদুর আবার বিছানো হয়েছে। লোকসমাগম গতদিনের ডাবল ঐ ৪:৩০-এই! দৈনিক বার্তা কমপ্লেক্সের বন্ধ অফিস-দোকানপাটের সামনে দ্রুত লিখে ফেলা হলো কয়েকটা পোস্টার।
ইতিমধ্যেই হাজির হলেন রাজশাহী-র ফেসবুক পেইজের শুভ্র ভাই, রাসেল ভাইরা। স্কুলের জুনিয়র কয়েকজন আসবে জানতাম, পোস্টার হাতে সবার মাঝে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাদের থেকে পোস্টার চেয়ে নিলো বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে। রাজশাহী কলেজ, নিউডিগ্রি আর অন্যান্য কলেজ, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েতে ভরা এলাকাটা।
অণু ভাইয়ের ক্যামেরায় ওভারব্রিজের উপর থেকে সমবেত হতে শুরু করা জনতা
পেছন থেকে ডাক শুনে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি শুধু স্কুলের জুনিয়র পরিচিত কয়েকটা মুখই না, ডিপার্টমেন্টের জুনিয়রদের পরিচিত মুখও আছে! আমি সত্যি সেরকম আনন্দিত হয়েছি ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে। পরীক্ষার সিজন, তার উপর হরতাল, কারও সাথে সেভাবে যোগাযোগ করা হয়নি, অথচ ওরা নিজেরাই এসেছে। হাতেলেখা পোস্টারগুলো মাথার উপরে তুলে র্যালিতে ছিলো, ছিলো রাস্তায়, অবস্থান কর্মসূচীতে আরও শ'খানেক ছেলেমেয়ের সাথে।
আবারও সোহেল ইমাম ভাইয়ের ক্যামেরায় শিক্ষানগরীর শিক্ষার্থীরা
অণু ভাইয়ের ক্যামেরায় –
আমার সেইইরকমের আফসোস যে আমার প্রিয় পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরাটা সুনামগঞ্জে ট্রেকিং করবার ট্রিপে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আপাতত সেটা দোকানে স্বাস্থ্য কিছুটা হলেও উদ্ধার করতে গিয়েছে। কিন্তু বয়ে আনা পড়ে থাকা ফুজির ক্যামেরাটা র্যালির মাঝপথেই চার্জ শেষ হয়ে গেলো!
র্যালির মাঝপথে দেখি রাস্তার ধারের বাসার ছাদ থেকে পতাকা আর স্লোগানে র্যালিতে থাকা মানুষদের সাথে একাত্ম তিন প্রজন্ম। এটা মিশার ক্যামেরায় -
জিরো পয়েন্টে রাজাকারদের কুশপুত্তলিকা প্রতিকী-ফাঁসী দিয়ে আগুন জ্বালানো হলো। থেকে থেকে চললো স্লোগান, রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে। সবাই ছাত্র-ছাত্রী, আর সাধারণ মানুষ। সাধারণ ছাত্রদের স্লোগান রেকর্ড করেছিলাম নিজের ফোনে। ডাউনলোড করা ফ্রি সফটওয়্যারে .amr ফাইল mp3তে কনভার্ট করে কেমন যেন খ্যানখ্যানে হয়ে গেছে। তবুও রইলো এখানে –
রাজাকারদের ঝোলানোর, মানে কুশপুত্তলিকা আরকি, একটা ছবিও আমার নিজের ক্যামেরায় নাই। এটা মিশার ক্যামেরায় -
সন্ধ্যায় যখন মোম আর মশাল জ্বেলে পদ্মার তীরে মুক্তমঞ্চে ছেলেমেয়েরা গাইছে, আমি অনেক কষ্টে সবেধন নীলমনি 2MP-এর ফোনের ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছি।
আরও কিছু ছবি মিলিয়ে একটা স্লাইড শো-র লিংক দিলাম।
খবরে দেখলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে গণমঞ্চে শুক্রবার প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জাগরণের গান, কবিতা ও পথনাটক হয়েছে। ফিরবার সময়ে আলুপট্টিতেই আর একটা সমাবেশ দেখে আসলাম, শুনলাম সেটা চারুকলার ছেলেমেয়েদের। আজকের র্যাশলি আর পদ্মার পারের অবস্থান কর্মসূচীর সফল উদ্যোক্তা একদম তরুণ কিছু মুখ। ইনিভার্সিটির জুনিয়রদের মুখে শুনলাম তাদের অধিকাংশই এবার ইউনিভার্সিটিতে বা উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হয়েছে, মাত্র কয়েকমাস হলো। ওদের সাথে কথা বলার আগ্রহ ছিলো, কিন্তু যেই ব্যস্ততা আর উচ্ছ্বাস তাদের মাঝে কর্মসূচী নিয়ে, সময় করতে পারবে না বুঝলাম। দেখা যাক, পরে কখনো আলাপ করলে ভালো লাগবে আমার নিজের। আজকে উপস্থিত সব শিক্ষার্থীর সাথেই কখনো চা-নিয়ে বসে আলাপ করতে পারলেই ভালো লাগবে জানি...
এরাই প্রজন্ম রাজশাহী।
Created with Admarket's flickrSLiDR.
মন্তব্য
সচলের পাতায় আপনাকে অনেকদিন পরে দেখে ভালো লাগলো পিপি'দা। আমি নিজেও অনিয়মিত হয়ে গেছি যদিও।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
দুর্দান্ত সব ছবি
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
দুরন্ত উত্তাল ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে আমার অনেকদিন পরে খুব ভালো লাগছিলো।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
দারুন দিদি।
খুব মিস করছি শাহবাগ, রাজশাহী, সমগ্র বাংলাদেশ।
তবে এখানে আমরাও আমাদের মত করে বিদেশীদের নিয়ে প্রতিবাদের আয়োজন করছি। দেখা যাক কি হয়।
মন বলছে এইবার রাজাকারগুলার আর কোন মুক্তি নাই।
সব গুলাকে ফাঁসিতে ঝুলা অবস্থায় দেখতে চাই।
প্রতিবাদ চলুক।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
দারুণ! প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
জীবন্ত ছবি এ যেনো প্রজন্মের দাবির কথা বলছে।
প্রতিবাদ জারি থাকুক সর্বস্তরে, সবখানে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ঘিরে লিব সব বুটাকে।
facebook
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ডুপ্লি ঘ্যাচাং___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
জব্বর ঘিরা ঘিরে লিয়েছে, সব মামুর বুঠাকে এবার ফাঁসিতে ঝুলানো হবে।
-- রামগরুড়
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
যে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে...
আজকে রাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশের ছবি অণু ভাইয়ের অ্যালবামে -
(১)
(২)
এই ছবিটা ৭ তারিখের, হাসনাত রনি ভাইয়ের অ্যালবাম থেকে -
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
রাবি’তে জামাত-শিবির বিরোধী মিছিল মানেই ভিন্নরকম ভালোলাগা। জয়তু রাজশাহী!
রাবির সমস্যা যেটা আমি মনে করি সেটা হলো সেখানে রাজনৈতিক লেবেল ছাড়া কোন সংগঠন নাই। একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন হলেও সেটার সাথে একটা রাজনৈতিক ট্যাগিং প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষভাবে আছেই। ছাত্রাবস্থাতেও কোন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে তাই দ্বিধা থাকতো। এখনো সেই দ্বিধাই দেখি বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের সাথে আলাপে। লিডারশিপ তৈরির জন্যে ছাত্র সংগঠন দরকার আছে, রাজনৈতিক তো বটেই, কিন্তু পাশাপাশি অরাজনৈতিক মুক্তালাপের একটা গ্রাউন্ডও থাকা দরকার। যাতে একটা ছেলে একাডেমিক সংগঠনের বাইরে (মানে কোন ডিপার্টমেন্টের তৈরি প্রোগ্রামিং ক্লাব বা এমনকিছু) মাঝেমাঝে খোলামনে কথা বলার একটা জায়গা পায় তাকে কোন রকমের রাজনৈতিক দলের ট্যাগিং দেয়া হবে না সেই নিশ্চয়তা নিয়ে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
আমরা শাহবাগে আছি।
আমরা রাজশাহীতেও আছি।।
আব্দুল্লাহ এ.এম.
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...
প্রতিবাদ বিক্ষোভ জারি থাকবে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
অপূর্ব !!!!!! ছবি, লেখা দুটোই।
ধন্যবাদ, প্রতিবাদ কর্মসূচীর সাথে থাকুন।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন