জলফড়িং এর ছোটাছুটি
ধানমন্ডি ৩২ নং এর পাশ দিয়ে প্রায় যাওয়া আসা করতে হয় আমাকে। তবে কখনই অবসর মেলেনা লেকের দিকে ঘুরে তাকাবার। আজ মিলেছিল। কাজ শেষ করে দেখি মাত্র দুপুর ৩টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম লেকের ধারে। মোটামুটি জনমানুষহীন একটা জায়গা দেখে বসে পড়লাম। নিভৃতচারী মানুষদের যা অবস্থা... মাঝে মাঝে মানুষজনের উপস্থিতি ভাল লাগে না, আমার সেই মুহুর্তে সেই দশা। লেকের জলে হাল্কা ছন্দ... তাতেই হয়ে গেলাম মগ্ন। একটা মরা ডাল জলের মাঝে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে... তাতে একটা স্বচ্ছ পাখনার ফড়িং বসে আছে অলস দুপুরের ভঙ্গিমায়। ডালটার ঠিক আশেপাশের অঞ্চলে পাঁচ-ছয়টা জলজ পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে... ওগুলো যে আসলে কি... তা তখনও ঠিক বুঝে উঠিনি। কেন যেন ডালে বসা অলস ফড়িং এর প্রভাবে আমার মস্তিস্ক বলে উঠল... ওগুলোও ফড়িং... জলফড়িং! জলফড়িং! মগ্ন হয়ে ওগুলোর জ্যামিতিক দিগ্ববিদিক ছোটাছুটি দেখছি...কিসের সন্ধানে জলফড়িং এর ছুটে চলা!
মগ্নতা ভাঙ্গালো একজোড়া ছেলেমেয়ে... উফ, বিরক্তিকর! ওরা কি এই জায়গা ছাড়া আর কোন জায়গা পেল না... মেজাজটাই গেল চড়ে। মনটাও গেল বিক্ষিপ্ত হয়ে... জলফড়িং এর ছোটাছুটি বাদ দিয়ে এবার নজর পড়ল জলফড়িং এর দিকে... আরে! এগুলো তো ফড়িং না... ফড়িং কি জলে থাকে! এগুলোর তো পাখনা নেই, পাখনা ছাড়া ফড়িং হয় কি করে?... দিব্যি লম্বা লম্বা পা দিয়ে সাঁতার কাটছে... কি এগুলো? কি দরকার তা নিয়ে মাথা ব্যথা করার! আজ থেকে এগুলোই জলফড়িং... আর কেউ না জানুক... আমি তো জানি! ইচ্ছে করল না... এতো সুন্দর নামটা বাদ দিয়ে অন্য কোন নামে এগুলোকে ডাকতে... জলফড়িং! জলফড়িং! জলফড়িং!
প্রথমে ভেবেছিলাম... ছেলেমেয়ে দুটো এসেছে আমার মত বেরসিকের ধারে কাছে বসে নিরাপদে প্রেম করতে... আমাকে দেখলে এটুকু অন্তত বোঝা যায়, আপদ বা বিপদ ঘটানোর যোগ্যতাটুকুও আমার নেই... নিতান্তই উদাসীন পাগলাটে টাইপের মানুষ। প্রয়োজন পড়লে তাদের এখান থেকে উঠতে হবে না, আমিই উঠে যাবো... একটু পর আমার ভুল ভাঙলো... এরা আসলে প্রেম করতে আসেনি... এসেছে মনোরোগ সারাতে... সম্পর্কে দেবর-ভাবী। ছেলেটা পড়ে কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে। ভাবীর বয়স তার চেয়ে দুবছর বেশী। চোখের সামনে দেখেছে... তার দেবর মহাশয় দিনে দিনে বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে... কারো সাথে কথা বলে না... ঘরের বাইরে যায় না... কি যে সমস্যা কাউকে বলে না... ভাবী তাই জোর করে তাকে নিয়ে এসেছে বাইরে... বাইরের আলো বাতাস দেখাতে... বার বার দেবর কে জিজ্ঞেস করছে... কেন তুমি তার নাম বলতে চাইছ না... কি সমস্যা নাম বললে? দেবর মৌন। সে তার হৃদয়ের ধন কাউকে দেখাবে না... কাউকে বলবে না তার প্রিয়তমার নাম। ভাবী গল্প করতে লাগল... সে নাকি তার বরের কাছে শুনেছে, সানি নামের ছেলেটি আগে খুব ধার্মিক ছিল... খুব প্রানোচ্ছল ছিল... তারপর হঠাৎ করেই সব কিছু ছেড়ে দিল... হারিয়ে গেল তার উচ্ছলতা... তাকে যে আবার আগের মত উচ্ছল দেখতে চায় সবাই...কে সে... যে কেড়ে নিল তার উচ্ছলতা টুকু! অবশেষে তার দেবর মশায়ের মৌনতা ভাঙলো।
নাহ... আর এখানে বসে থাকা যাবে না... এবার বরফ গলে গেছে... এরপরো বসে থাকলে অনাহুত আমাকে বসে বসে সানির বিষন্নতার গল্প শুনতে হবে... আমি আনন্দের গল্প শুনতে চাই, বিষন্নতার নয়। আমার সহপাঠী সুনীল যেদিন আমাকে বরুনার গল্প শুনিয়েছিল... আমার ভাল লাগে নি... মনীষার চোখে যেদিন টলটলে জল দেখেছিলাম... আমার ভালো লাগেনি।
ভালো লাগে লিমা-রহমতের চোখে চোখে হাসি দেখতে...
আমি সানির গল্প শুনতে চাইনি... তবু গল্পের ভূমিকা আমায় শুনতে হয়েছে... উঠে আসার সময় মনের অজান্তেই একবার সানির মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, মাথা নীচু করে বিষন্ন ছেলেটা তার ভাবীকে কষ্টের গল্প শোনাচ্ছে... সানিদের মাথা যেদিন হৃদয়ের আনন্দে উঁচু হয়ে যাবে... সেদিন আমার ভালো লাগবে... আমি সুনীল-বরুনার গল্প শুনতে চাই না... তবুও কেন যেন গল্পচিত্র চোখে পড়ে যায়। জলফড়িং এর জ্যামিতিক দিগ্ববিদিক ছোটাছুটি চোখে পড়ে যায়!
এর পর কিছুটা সময় ধানমন্ডির রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেছি... চলার পথে একটা হলদে রঙের ফুল দেখে থমকেও দাড়িয়েছিলাম... ফুলটার নাম জানিনা... নাম দিতেও আর ইচ্ছা করল না... মাথায় যে শুধুই জলফড়িং এর ছোটাছুটি!
বাসায় ফিরেছি সন্ধ্যায়। সাইন্সল্যাবের মোড়ে দুটো বাস নাকি কারা পুড়িয়ে দিয়েছে... তাই বাস বন্ধ। রিকশায় করে বিশাল লম্বা পথে হাওয়া খেতে খেতে বাসায় ফিরে এসেছি। সমস্ত পথ জুড়ে মাথায় ছিল শুধুই জলফড়িং এর ছোটাছুটি! তার মাঝেও একটা কথা চোখে পড়েছিল... ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সামনে লেখা ছিল... “সাহস অনেক কিছু বদলে দেয়।”
ঘরে ফিরে খুব ক্লান্ত... ঘুমিয়ে পড়েছিলাম... ঘুম ভাঙলো মেসেজ আসার শব্দে... মেসেজ পাঠিয়েছে আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের ছোট এক ভাই... “আপু, কিছু ভালো লাগে না। মন খারাপ।”...
মাথার ব্যথাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল... জলফড়িং এর ছোটাছুটি!
-- নীলকন্ঠ
২৭.০৯.০৮
মন্তব্য
কি হয়েছে? এতো বিক্ষিপ্ত কেন আপু!!!!
কল্পনা
...........................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
অর্থাৎ আপনি এক ঝাঁক উপলব্ধ সত্য থেকে দূরে সরে এলেন। বিষণ্নতার কোন গল্প কি হয় ? ওটা নিজেই এক গভীর অনুভবের বিদীর্ণ হাহাকার। আনন্দের উল্লসিত হল্লাও এর কাছে ম্লান। বিষণ্নতার পক্ষে ওকালতি নয়, তবে আমি বিশ্বাস করি, যে বিষণ্ন হতে জানে না, সে আনন্দকেও পেতে পারে না। বিষন্নতার মধ্যেই মানুষের গভীর উপলব্ধির সত্যকথনগুলো আঁকা থাকে। হৃদয় চিনতে হলে বিষণ্নতা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
জীবনানন্দের, 'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে..' মূলত হৃদয়ের খোঁড়াখুড়িই।
ধন্যবাদ, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। লিখতে থাকুন।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আপনিও তো 'জলফড়িং এর ছোটাছুটি'তে একটা বিষণ্নতার গল্পই শুনালেন। আর আমার মন ভালো করে দিলেন।
................................................................
তোমার হাতে রয়েছি যেটুকু আমি, আমার পকেটে আমি আছি যতটা, একদিন মনে হবে এটুকুই আমি, বাকি কিছু আমি নই আমার করুণ ছায়া
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
আমাদের সবার জীবনের গল্পই কি কোন না কোনভাবে সানির গল্প নয়? ভাল লাগল লেখা।
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
আহারে! বস আপনের আবার কি হৈল? সানির কেস? ভাবি দরকার?
---------------------------------
বিষণ্ণতা, তোমার হাতটা একটু ধরি?
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
কোথাও যেন পড়েছিলাম কিংবা শুনেছিলাম
মানুষ যখন কোনো কিছুর নতুন নাম দেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখনই তাকে বলে হতাশা
আপনারটা হতাশা না ক্লান্তিই মনে হয়েছে আমার
বিষণ্ন মানুষ তাকিয়ে থাকে কিন্তু দেখে না কিছুই
আপনি তো দিব্বি দেখলেন আর শুনেও ফেললেন
ঘুম লাগান টানা তিনদিন
@ কল্পনা-- হা হা হা... আমি চলি ঘড়ির কাটার মত... ঘড়ির কাটাতেও তো মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ততা আসে... ব্যাটারী বদল করতে হয় তখন... নতুন জীবনীশক্তি লাগে... ধন্যবাদ আপনাকে।
@রণদীপম বসু-- উপলব্ধির ব্যাপারটা... আমি মনে হয় আমার বয়সের তুলনায় বেশীই উপলব্ধি করে ফেলেছি... তাই এখন বিশ্রাম নিচ্ছি। সানির গল্প আমার কাছে বহুবার শোনা গল্প... একি গান রিপিট মোডে দেয়া... তাই আর শুনতে ইচ্ছা হয় না... নতুন ডাইমেনশনে নতুন কিছু উপলব্ধি করার ব্যাপার আসলে ঠিকই শুনতাম।
ধন্যবাদ ঃ)
@মুজিব মেহদী-- মন ভালো করে দিয়েছি... শুনে আমারও মন ভাল হয়ে গেল... ঃ) ঃ)
@অতন্দ্র প্রহরী-- আসলেই তাই ... আমার চারপাশের দেখা মানুষ গুলোর ... অধিকাংশের জীবনেই সানির গল্পকেই দেখি
@মাহবুব লীলেন-- সত্যি কথা... আমি ক্লান্ত... আসলেই ক্লান্ত... ঘুমেও সেই ক্লান্তিটুকু আসুক... চাচ্ছি না তা... অন্তত ঘুমের মজা টুকু থাক...
নীল কন্ঠকে আবার লিখতে দেখে খুব খুব ভাল লাগছে।
যন্ত্র প্রকৌশলের অযান্ত্রিক মানুষটার কাছ থেকে নিয়মিত লেখা চাই কিন্তু।
আর সবকথার শেষ কথা, আমারও ওরকম একটা ভাবী দরকার।
---------------------------------
বিষণ্ণতা, তোমার হাতটা একটু ধরি?
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
- পুরো পোস্ট জুড়েই দেখি জলফড়িং এমাথা টু ওমাথা ছুট লাগিয়েছে! গোল্লাছুট খেলে নাকি?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
হুমম! এই পোস্টটাই
উপস্থাপনাটা দারুণ লেগেছিল। তখন অফলাইনে পড়েছিলাম বলে মন্তব্য করা হয় নি।
শুভ প্রত্যাবর্তন, নীল রোদ্দুর।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
নতুন মন্তব্য করুন