অরণ্যে রোদন

নীল রোদ্দুর এর ছবি
লিখেছেন নীল রোদ্দুর [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০১/০৭/২০১৩ - ১১:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোটবেলায় যখন বই পড়ার নেশাটা প্রথম মাথায় ওঠে, সেই সময়গুলোতে একটা বই হাতে পেতে অথবা পড়তে তখন আমায় মেলা কাঠ খড় পোড়াতে হত। সেইসব দিনগুলোতে আমার প্রধান অন্তরায় ছিলেন আমার মা। সারাটা জীবন অনেক রাগ করেছি, দুষেছি তাকে এই সব কারণে। আজ একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মাকে দেখতে বসলাম। বাংলার নারীদের দেখতে বসলাম আসলে।

আমার মাকে আজ আমি বাঙ্গালী নারীদের সাধারণ চিত্র বলব। জন্মেছিলেন এক অজ-পাড়াগাঁয়ে। সেইখানে বর্ষায় হাঁটু সমান কাদা মাড়িয়ে চলাচল করতে হত। যানবাহন বলতে ছিল ভ্যানগাড়ি। একটু সচ্ছল পরিবারে পুরুষদের ব্যবহারের জন্য থাকতো সাইকেল। গ্রামের ঘরবাড়ি গুলো সব বিলের ধারে এসে জমা হয়েছিল। আর বাকি গ্রামটাই আসলে কৃষি জমি। প্রত্যেকটা পরিবারই কৃষি প্রধান পরিবার। বয়স্কদের মাঝে শিক্ষা বলতে কিছু নেই বললেই চলে, যা আছে সেটাকে কেবল টাকা পয়সার হিসেব রাখতে জানা আর অক্ষর জ্ঞানের চেয়ে বেশী কিছু বলা সম্ভব নয়। মাইল খানেক হেটে গেলে একটা প্রাইমারী স্কুল, যেখানে গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চারা একসাথে স্কুল যেতো, স্কুল ছুটি হলে খেলতে খেলতে একসাথে ফিরত। পড়ালেখা নিয়ে কোন শিশুকেই কোন চিন্তা করতে হত না, পরীক্ষা এলে পাস করবে কিনা সেই ভয় হয়ত তারা একটু করত। তার চেয়ে বেশী কিছু নয়।

প্রাইমারী স্কুল পার করেই ঝরে যেতো অধিকাংশ শিশু। ছেলেরা বাবার সাথে লেগে যেতো কৃষি জমিতে আর মেয়েরা পুরাদস্তুর ঘরের কাজে। তাদের যে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। এখন আর স্কুলে গিয়ে কি হবে? তারচেয়ে ধান ভানতে শেখা, আধ একটু সেলাই করা, মায়ের রান্নায় হাত লাগানো এসব করলে কাজে লাগবে। তাছাড়া মেয়েদের জন্য গৃহস্থ ঘরের সম্বন্ধও আসতে শুরু করেছে, ঢ্যাং ঢ্যাং করে স্কুলে গেলে পাড়া প্রতিবেশীরাও তো ছি ছি বলবে। এইরকম একটা পরিবেশে বড় হয়েছেন আমার মা আর মামা প্রায় সমবয়সী দু ভাইবোন। তারা বড় হবার আগেই তাদের চেয়ে ছয় সাত বছরের বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মা বারো মাসের রোগী, বছরের নয় মাস একদম ছোট ছেলেগুলোকে নিয়ে বাপের বাড়ির পালঙ্কে শুয়ে থাকেন। বাবা ছন্নছাড়া, বাড়িতে আসে কি আসে না তার নেই ঠিক। কৃষি জমি থেকে বছরে যে ফসল আসে তাতে বছর চললে চলল, না চললে কিভাবে চলবে তা নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। তাই ছোট ছোট এই দুই ভাইবোনের একমাত্র কাজ, নিজেদের রান্নাটা নিজেরা করে খাওয়া আর এখনও যারা স্কুলে যায়, তাদের সাথে স্কুলে যাওয়া। তখনো যেহেতু তারা স্কুলে যায়, দুজনের মনেই একটু স্বপ্ন ছিল, পড়ালেখা করবে, মা শহরে গিয়ে একবার একজন মহিলা ডাক্তারকে দেখেছিল, সে তার স্বপ্নের ঘুড়ি ঐটুকুই উড়াতে পেরেছিল। আর মামা? তার কিছু করার ছিল না, এই নাই নাই সংসারের হাল যে একটু বড় হলেই তাকে ধরতে হবে সে বেশ ভালোই বুঝে গিয়েছিল।

অষ্টম শ্রেণীতে উঠতে না উঠতে মায়ের বিয়ের প্রস্তাবও আসতে শুরু করল, আর সেই সাথে এখনো বিয়ে হয়নি বলে গ্রামের লোকেরা নানা কথাও বলতে শুরু করল। তাই বারোমাসের রোগী নানী আর ছন্নছাড়াও নানাও মেয়ের বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে গেলো। মায়েরই এক চাচা সম্পর্কিত শিক্ষক আমার বাবার সাথে সম্পর্কে বেঁধে দিলেন আমার মা কে। নবম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েটি চিরচেনা গ্রাম ছেড়ে শ্বশুড় বাড়িতে এসে দিশেহারা হয়ে গেলেন। আমাকে গর্ভে নিয়েই দিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষা। আমার জন্মের পর আর তার পড়ালেখা হল না। তার নিজেরই আগ্রহের ইতি ঘটেছিল নাকি আসলেই আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারলেন না, সে আমি বলতে পারবো না। কেবল এটুকু জানি, বাবা নিজেই মাকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কলেজে। মা ক'মাস ক্লাস করে আর যাননি কলেজে। যাই হোক, তাতেই আমার মায়ের গ্রামে খ্যাতি জুটেছিল শিক্ষিত মেয়ে বলে।

আমি সারাটা জীবন মায়ের উপর রাগ করেছি আমাকে ক্লাসের বই ছাড়া অন্য বই পড়তে দেখলেই রাগ করতেন বলে। ভয়ে ভয়ে আমি খাটের নীচে বা দরজার আড়ালে এবং অতি অবশ্যই বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে বই পড়তাম। ধরা খেলে কপালে যা জুটত, তাও কখনো আমার বই নেশা ছাড়াতে পারতো না। সেই বয়সে আমার বোঝার বুদ্ধি ছিল না, যিনি নিজে কখনো স্কুল থেকে পাওয়া সরকারী পাঠ্যবই ছাড়া আর কোন বই চোখে দেখেননি, তিনি বইয়ের মাঝে কি অদ্ভুত সুন্দর একটা জগত লুকিয়ে আছে তাই জানবেন কি করে! তাই আমার মায়ের সাথে আমার ছিল চির বিরোধ। আমার স্পর্ধায় তার হৃদয় কাঁপে। আমি জানি, তিনি আফসোস করেন আমার মত বেয়াড়া সন্তানের জন্ম দিয়েছেন বলে। পরকালে আল্লাহকে কি জবাব দিবেন সেই আশংকাতেই তিনি আগুন হয়ে আছেন, বিরোধও এক্সপোনেনশিয়ালি বেড়েই চলেছে। আমি এই ২০১৩ সাল পর্যন্ত যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানে আসতে হয়েছে আমার মায়ের মনে জগদ্দল পাথরের মত স্থিতিশীল হয়ে থাকা শতাব্দী পুরনো সামাজিক প্রথার সাথে যুদ্ধ করে করে। এই সম্পূর্ণটা সময়ে ছায়ার মত কেবল একটি মানুষই আমার সাথে ছিলেন। তিনি আমার বাবা।

-----------------------------------------------------------

মায়ের সাথে আমার এই তিক্ত সম্পর্কটা আমার জীবনের একমাত্র হতাশা হয়ে ছিল এতকাল। আমি ভাবতাম ভিন্ন প্রজন্মের দুজন মানুষ বলেই আমাদের এতো তিক্ততা। আমি যত বাঁধা পেতাম, ততই আমার বাঁধা অতিক্রমের জেদ বেড়ে যেত। আর আমার মায়ের বেড়ে যেত শাসনের জেদ। আমার বাঁধা অতিক্রমের অপরাজেয় ইচ্ছা আর একটা জীবন আমার মত করে বাঁচার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় আমার পড়ালেখার উদ্দেশ্যে প্রবাসে পাড়ি দেয়া। অবধারিতভাবেই শুরু হয়ে গেল আমার জীবনের ট্রান্সফরমেশন। শুরু হল আমার নতুন পরিচয়ে বাঁচা। এই পৃথিবীতে আমি স্বতন্ত্র। শুরুটা স্বপ্নের মতই ছিল। তারপর স্বপ্নটা একটু একটু করে বাস্তব বলে যখন বোধ হতে লাগলো, তখন দাঁড়িয়ে যেতে হল এক অন্য পৃথিবীর মুখোমুখি।

চিরকাল পড়তে ভালোবাসা এই আমি এক বর্ণাঢ্য কলেজ জীবন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম। আমার কবিতার খাতা ছিল, বিতর্কের মঞ্চ ছিল, কার্টিজ পেপার আর পেন্সিল ছিল, গল্প করার জন্য লেখকেরা ছিল, তীক্ষ্ণ যুক্তির ফলা হাতে আমার বিপরীতে দাঁড়াবার মত বন্ধু ছিল, সতীর্থ ব্লগাররা ছিল। আর ছিল প্রজাপতির মত রঙ্গিন ডানা। আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেখি আমার জগতটাই ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক খেলার মাঝে স্বাধীন ভাবে বেড়ে ওঠার জগত।

আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল কেবল কলেজ কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা একই প্লাটফর্মে লেখালেখি করা নারীদের, দেখিনি, চিনিনি এর বাইরের ৯৯.৯৯ শতাংশ নারীদের। আমার স্বতন্ত্র জীবনে এসেই দেখেছি তাদের প্রথম। যাদের দেখছি এখন আমি, তারা আমার আগের প্রজন্মের কেউ নয়, আমার কাছাকাছি বয়সেরই নারী তারা।

প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলাম, আমার সমবয়সী এক দুই সন্তানের জননীকে দেখে, যার সন্তানদের বয়স ৫ এবং ৬। তিনি আপাদমস্তক বোরকায় মোড়ানো। কখনো পরপুরুষের সামনে যান না। তার বাসায় অতিথি এলে তার স্বামী-দেবতা সন্তান সমেত স্ত্রীকে অন্য ভাবীর বাসায় পাঠিয়ে দেন। ভদ্রলোক বাংলাদেশে পড়ালেখা করেছেন আইইউটিতে, বর্তমানে তার পিএইচডি শেষের পথে। আমি না বুঝে একবার তার বাসায় ঢুকে পড়েছিলাম এক ঈদের দিনে, এর পর আর কোনদিন যাওয়ার রুচি হয়নি। তবে ভদ্রলোকের স্ত্রীর সাথে আরও বার কয়েক দেখা হয়েছে, আমার সাথে কথা না হলেও অন্যদের সাথে কি কথা হচ্ছে তা শোনার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। তার কথার বিষয় ছিল, ইসলামের আলোকে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য কি, স্বামী স্ত্রীকে সন্তান সহ/সন্তান ছাড়া তালাক দিতে চাইলে স্ত্রী কি কি সুবিধা দাবী করতে পারে, মোহরানা সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রত্যেকটা নারীর জ্ঞান থাকা উচিত ইত্যাদি। বলা-বাহুল্য তিনি অন্য ভাবীদের ইসলাম শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আমি জানিনা উনি পড়ালেখা করেছেন কতদূর, তবে এটুকু জানি কলেজ পার করেছিলেন। আর যতদূরই করুন না কেন, উনার পিএইচডিধারী স্বামীর যে মানসিকতা দেখেছি তাতেই বুঝে নিয়েছি যে উনি কেমন জীবন যাপনের কথা কল্পনা করতে পারেন। তাকে দেখলে আমার কষ্টের সাথে মনে পড়ে আমার স্কুলের এক সহপাঠিনীর কথা, আর্মি অফিসার বাবা যাকে কলেজ পড়ুয়া অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল, হাসিখুশি সেই মেয়েটির আর পড়ালেখা করা হয়নি। কাল নেকাবের আড়ালে হারিয়ে গেছে সে চিরতরে চার সন্তানের জননী হয়ে। একদিন ফেসবুকে তার দুই বছর বয়সী কন্যার মাথায় হিজাব দেখে আর স্থির থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "তোর মেয়েকে এটা কি পরাইছিস?" যথারীতি উত্তর পাইনি। এই দুইজন তো তাও এই জীবন বরণ করতে বাধ্য হয়েছে বলে এমন জীবন যাপন করছে। আমার প্রাক্তন রুমমেট এক ক্যাডেট কন্যা এবং দুর্দান্ত মেধাবী আরেক সহপাঠিনী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ব্যাচেলর ডিগ্রী সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করে স্বেচ্ছায় এই জীবন বেছে নিয়েছে। তাদের কথা জানলেও আসলে বুয়েটের পাট চুকানোর পর আর দেখা হয়নি বলে ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি আসলে কোন জীবন চেয়েছে তারা! তা বুঝলাম কিনা প্রবাসে এসে।

এই দলটাকে ভয় পেয়ে দূরে থাকতে থাকতে দেখা হল অন্য একজনের সাথে। তিনি প্রাক্টিসিং মুসলিমাহ, কিন্তু গোঁড়ামি করেন না। সবার সাথে স্নেহ ভরে কথা বলেন, তার বাসায় নারী পুরুষ সবারই যাওয়া আসা আছে, সবার সাথেই সুসম্পর্ক রেখে চলেন। শুধু তাই নয়, তিনি এবং তার স্বামী দুজনেই একই সাথে পড়ালেখা করেছেন, একজন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, অপরজন সেকেন্ড, বর্তমানে একই সাথে দুইজনেরই পিএইচডি করছেন, আশা করা যায় মাস ছয়েকের মাঝে দুজনেই নামের সামনে ডক্টর লাগিয়ে ফেলবেন। সবকিছু ভালোই চলছিল, কেবল মাঝে মাঝে আমাকে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতেন, আজকাল যেটা হট টপিক সেটা নিয়ে আরকি। তাছাড়া এতো আকর্ষণীয় ব্যবহার করতেন যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। হঠাত একদিন মুখোমুখি হলাম অপ্রিয় সত্যের। সেই আপুর স্বামী একজন জামাত-শিবির সদস্য। মুখে মধুর ব্যবহার করলেও উনার আমার ধর্ম বিশ্বাস, চিন্তা ভাবনা সব কিছু নিয়েই আপত্তি আছে--- এতদিন শুধু চিনে নিয়েছেন আমাকে। বিদ্যুত-পৃষ্ট হয়ে যেন ছিটকে পড়লাম। আমি যা অনুধাবন করেছি এদের সাথে পরিচিত হয়ে, তা বলার ভাষা আসলে আমার নেই।

দৃশ্যপটে এবার মেজরিটির আবির্ভাব। আসলে আবির্ভাব আগেই হয়েছিল, এতদিনে উপসংহারে পৌছুলাম আরকি। এইখানে এবার বাংলাদেশের আমাদের প্রজন্মের নারীদের উপস্থাপন করবো, যাদের নিয়ে আমি আশাবাদী ছিলাম। এরা প্রগতিশীল বলেই নিজেদের উপস্থাপন করে। না এক্সট্রিম ইসলামিস্ট, না ঘষেটি বেগম। এরা মোটামুটি সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরুনো প্রবাসী গৃহবধূ। আধুনিকা, সাহিত্য জানেন, সু-রুচিশীল। এদের স্বামী কখনই নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছা স্ত্রীদের উপরে চাপিয়ে দেন না বলেই দাবী করেন। আর দিলেও তারা বিনা বাক্যে মানেন না। তবে তাদের কখনই আত্মনির্ভরশীল হতে ইচ্ছা করে না। এদের স্বামীর যথেষ্ট সামর্থ্য আছে স্ত্রীকে ভরণপোষণ করার। তাই তাদের কোন কাজ করতে ইচ্ছা করেনা বলে তারা করেন না। সেটা তাদের স্বেচ্ছা নির্বাচন বলেও প্রচার করেন। ব্যাপারটা সেখানে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলত, কিন্তু তারা আবার বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক ও বাহকও বটে। মেয়েদের অবশ্যই শপিং এ গিয়ে দামী এবং সু-রুচিশীল পোশাক কেনা উচিত। টপসের সাথে স্কার্টটা ম্যাচ করছে কিনা সেটার দিকে নজর রাখা উচিত। সেই সাথে মিলিয়ে সুন্দর জুতাও পড়া উচিত। সুন্দর সুন্দর রান্না করে অবশ্যই সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত। শিক্ষিত রুচিশীল আপুরা ভাবীরা একত্রিত হয়ে প্রতি সপ্তাহে সামাজিকতাও রক্ষা করা অপরিহার্য। তাই যে মেয়ে পড়া লেখা বা কাজ কর্ম করতে আগ্রহী তাদের তারা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক হবার পরামর্শও দিয়ে থাকেন। তারা যা করেন সেসব না করে কেউ পড়ালেখা চাকরী করতে চাইলে তাদের রুচিশীল মনে সন্দেহ জাগে মেয়েটি হয়ত আসলে মেয়ের স্বভাব যুক্ত না। আর মেয়ে হলেও আর যাই হোক বাঙ্গালী মেয়ে না। তারা প্রত্যেকে হুমায়ুন আহমেদের রূপা। তারা বাবা মায়ের আদরের মেয়ে, স্বামীর বা প্রেমিকের চরম আহ্লাদের পাত্রী। তারা এতোই ভালোবাসে তাদের জীবন সঙ্গীদের যে নিজেদের যে কোন নামের প্রয়োজন আছে, তা তারা মনে করেন না। মিসেস অমুক নামেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাদের সম্পত্তি নয় সম্পদ স্বামী/প্রেমিকের পরিচয় এবং গৌরব, তাদের সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ পায় একমাত্র রান্না ঘরে। তাদের প্রগতিশীল সুরুচির প্রকাশ পায় ফ্যাশন সচেতনতায়। এর বাইরে বাকি সব গুরুত্বহীন। ওহ, বলাই তো হয়নি, তারা আবার সকলেই খুব সুখী। সাপ্তাহিক পার্টিতে বা সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো মূলত এদের হাসির বন্যাতেই রঙ্গিন হয়ে থাকে। এভাবেই যদি জীবনের সব চাওয়া, সব সুখ হাতের মুঠোয় মিলে যায়, তাহলে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যা, কলা, স্থাপত্য, শিল্পের জগতে শুধু শুধু মাথা কুটে মরার কি মানে থাকতে পারে! এদেরকে আজ আমার মায়ের আধুনিক রূপ বলেই মনে হয়। বরং আমার মা যেভাবে বড় হয়েছেন সেটা চিন্তা করলে আমার মা এই ছদ্মবেশী প্রগতিশীলা স্মার্ট রমণীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তিনি শিক্ষার সুযোগ পাননি বলে সমাজ তাকে যা শিখিয়েছে তার বাইরে চিন্তা করতে পারেন নি। আর আজকের শিক্ষিতা স্মার্ট রমণীরা শিক্ষার সুযোগ পেয়েও আধুনিকতার ভং ছাড়া কিছুই ধরতে পারেনি।

আড়ালে রয়ে গেল আরেকটি দল, যাদের খুব কাছ থেকে না হলেও দেখেছি কিছুটা হলেও। এদের স্বামীরা সচ্ছল নয়, ক্ষুধার যন্ত্রণায় অথবা সন্তানের অন্নের যোগান দিতে, নিত্য ভোরবেলা তাদের কারখানায় বা বাসা বাড়িতে কাজের জন্য ছুটতে হয়। তাদের রুচি-বোধ নেই, নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের সময় নেই, সামাজিকতার কথা চিন্তা করাও বিলাসিতা। রান্না ঘরে তারা শিল্পের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবার কথা চিন্তা করতে পারে না, তাদের চিন্তা করতে হয় সারাদিন সারা মাস পরিশ্রম করে তারা যা উপার্জন করে তাতে তাদের উদরপূর্তি হবে কিনা, সন্তানের ক্ষুধা মিটবে কিনা। বাচ্চাটা স্কুলে যেতে পারবে কিনা, তাকে টিফিনের জন্য ক'টা টাকা হাতে দিতে পারবে কিনা। দিন শেষে সন্তানের কাছে, বাবা মায়ের কাছে, আপনজনের কাছে একটু যাবার সুযোগ পাবে কিনা। তারা নিতান্তই অসামাজিক, অসংস্কৃত, অশিক্ষিত, অচ্ছুত। তার পরেও অন্তত তাদের এতোটুকু ব্যক্তিত্ব-বোধ আছে এটুকু বলার, "আমি কারোর খাইও না পরিও না, নিজের খাওন নিজে যোগাড় কইরা খাই।"

এতকাল আমি অনেক লিখেছি নারী মুক্তির কথা। আমি বার বার বলেছি একজন নারীর মানুষ হয়ে উঠবার প্রয়োজনীয়তার কথা। নিজেদের জীবনের নাটাই পুরুষের হাতে ছেড়ে দেয়া নারীরা এবং পুরুষ সংগীরা আমার কথায় খেপেছে বহুবার। তাদের ভার্চুয়াল প্রতিক্রিয়াতেই আমার মনে হয়েছে আমি যেন বাঙ্গালী সমাজ এবং সংস্কৃতির সাথে একযোগে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছি। তারপরও আমি আশাবাদী হয়েছি আমাদের দেশের ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত নারী গোষ্ঠীকে নিয়ে। আমার সেই আশা আজ হতাশায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের এই শিক্ষিত সুবিধাভোগী নারীসমাজের একটা স্থিতিশীল ব্যক্তিসত্তা সৃষ্টি হবে, সেই সব আশা এখনও আকাশ কুসুম কল্পনা। এরা আহ্লাদী কন্যা থেকে সর্বোচ্চ লাস্যময়ী বধূ হবে, আর কিছু নয়। তারা তাদের মেয়েকেও সেই শিক্ষাই দেবে, ছেলেকেও তার মত একজন লাস্যময়ী বধূই খুঁজে আনতে বলবে। আজ আমি কেবল হতাশ নয়, অসহায় বোধ করছি এই লাস্যময়ী এবং রক্ষণশীলা নারীদের মুখোমুখি দাড়িয়েও কোন পরিবর্তনের কথা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলতে পারছি না বলে। বরং স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমিই আমার বাংলাদেশের সমাজ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছি।

বাংলাদেশের শতকরা ০.০১ শতাংশ সত্যিকারের প্রগতিশীল শিক্ষিত নারীদের দেখে ভেবেছিলাম বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ভুল স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার আজ নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে, অসামাজিক, অসংস্কৃত, অশিক্ষিত, অচ্ছুত গৃহকর্মটি বা গার্মেন্টস-কর্মীটি যে বাঙ্গালী সমাজের অলংকাররূপী তথাকথিত শিক্ষিত, সামাজিক, অভিজাত নারীটির চেয়ে হাজার গুন বেশী সম্মান এবং শ্রদ্ধার যোগ্য তা এতদিন অনুধাবন করতে পারিনি বলে।


মন্তব্য

আলতাইর এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

নীল রোদ্দুর এর ছবি

হাসি

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

পদব্রজী এর ছবি

একমত---বহুবার এই সামাজিক চক্করে পরে ক্লান্ত হয়ে অবস সন্ধ্যায় চার কাপ হাতে রাস্তার হেঁটে যাওয়া নারী শ্রমিকদের মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছি--যে বাঁধা আমি পেরুইনি সে মুক্তি আমি তাদের হাঁটায় পেয়েছি--------

নীল রোদ্দুর এর ছবি

চক্করটা ভাঙ্গি আসুন।

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

রণদীপম বসু এর ছবি

আপনার পর্যবেক্ষণটা অবশ্যই গুরুত্ববহ। সমাজ-বিজ্ঞানীদের জন্যেও একটা ভাবার বিষয়।

নারী যতোকাল না নিজেকে ভোগ্যপণ্য মানসিকতার বাইরে থেকে ভাবতে না পারবে ততকাল নারীমুক্তি কথাটা আসলেই শব্দগত অবস্থানে থেকে যাবে। তবে হতাশ হওয়ার কিছু দেখি না ! কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েও কত শতাংশ পুরুষ বাস্তবিকই মানুষ হয়ে ঊঠতে পেরেছে ? নারী জাগরণের বিষয়টা তো আরো অনেক বেশি প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ একটা বিষয়। তবে শিক্ষার আলো একটু একটু করে আলোকিত যে করছে তা অস্বীকার করা যাবে না। পানি ফুটতে ফুটতে একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রিতে পৌঁছলে তার অবস্থান পরিবর্তনটা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়।

ধন্যবাদ আপনাকে। হতাশ না হয়ে এসব হতাশার কথাগুলোই লিখে যান। আলো আসবেই। আজ না হোক কাল।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

নীল রোদ্দুর এর ছবি

দাদা, প্রত্যেক পুরুষ পিতা আর নারী মা যদি বুঝতে না শিখে, কি শিখাচ্ছে তাদের সন্তানকে, তাহলে এই চক্র ভাংগবে কি করে?

আপনাকে ধন্যবাদ দাদা, যতবার আমি হতাশার কথা বলি, আপনি আশার কথা শুনিয়ে আমায় আশ্বস্ত করেন বলে।

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

কৌস্তুভ এর ছবি

অ্যাঁ এইটা কী লিখেছেন? এসব কী লিখেছেন? নেহাত বিদেশে আছেন বলে বেঁচে গেলেন নইলে...

আর এইসব পোস্টে আগে হলে গরম গরম কমেন্টে একশ ছাড়িয়ে যেত আর আজকাল পাঁচটা মন্তব্যও নাই!

নীল রোদ্দুর এর ছবি

নেহাত বিদেশে আছি বলে বেঁচে যাচ্ছি এমন অনেক কারণেই, তবে যেই কালে দেশে যাবো, সেই কালে কল্লাটা থাকবে কিনা কে জানে? ইয়ে, মানে...

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার চারপাশের যে ছবি আপনি দেখেছেন তা মর্মান্তিক ভাবে সার্বজনীন এবং একান্ত-ই স্বাভাবিক। এর থেকে মুক্তি কি সম্ভব? জানা নেই। কিন্তু মুক্তির প্রথম শর্ত - একে স্বরূপে চিনতে পারা। দ্বিতীয় শর্ত এই ছবিকে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা। আপনি এই দুটি কাজ-ই করেছেন খুব দক্ষতার সাথে। এই রকম ভাবে আরো অনেকে মিলে এই কাজ দুটো করতে থাকলে একদিন হয়তো মুক্তির পথটারও দেখা মিলবে।
আর, রণদীপম-এর মন্তব্যের সাথে আমি একমত।
- একলহমা

নীল রোদ্দুর এর ছবি

সেই আশাতেই আছি একলহমা। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

প্রদীপ্ত এর ছবি

আমাদের সমাজে যুক্তি দিয়ে চলার প্রবনতা খুবই কম। তাই সুখ দুঃখ , স্বাবলম্বী হওয়া এই চেতনার উচু স্তরের বোধ গুলো ধরা দেয় না একেবারেই। সেটা নারী পুরুষ দুই দলের জন্যই প্রযোজ্য । নাহলে বাসায় শিক্ষিত স্ত্রী আছেন তিনি তার প্রতিভার কোন প্রয়োগ করছেন না সেটা তাকেই বা পার্টনার হিশাবে কেন অসম্মানিত বোধ করাচ্ছে না?! তার জীবন সঙ্গিনীর প্রতিভার অপচয় কেন তাকে আহত করে না......?দায় দুই পক্ষেরই আছে। নাম যদি জীবন সাথী হয় তবে দুই পক্ষকেই দায় নিতে হবে। সুতরাং সেদিক থেকে দেখলে ওই ০.০১ সবাই মিলেই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।