৩ জানুয়ারি, ২০০৯
সকাল ৬.৩০ মি.
নারায়ণগঞ্জ।
আদরের উৎস ও রাত্রি,
তোমরা কেমন আছো সে প্রশ্ন করে বিব্রত করব না। আজ ৩ জানুয়ারি। সারি সারি মানুষেরা আসবে বন-বাইদ পেরিয়ে। কাকড়াগুনি, সাতারিয়া, গায়রা, বেরিবাইদ, পীরগাছা, চুনিয়া, ক্যাজাই, জয়নাগাছা, টেলকি, গাছাবাড়ি... আরো কত কত গ্রাম থেকে। শিশির ভেজা গাদা, জবা, গোলাপ কিংবা নাম না জানা জংলা ফুলে ফুলে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবার দৃপ্ত পদচারণায় আর খা সাংমা, খা মারাক ধ্বণিতে মুখরিত হবে বিপন্ন বন। পাঁচবছর আগের এমনিই এক ভোরবেলায় রাষ্ট্রের ঘাতকেরা যেখানে তোমার বাবাকে গুলিবিদ্ধ করেছিল ঠিক সেখানটাতেই। তোমাদের বাবা পীরেন স্নালের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহটা যেখানে পড়েছিল ঠিক সেখানটাতেই তাঁর সহযোদ্ধারা খিম্মা তৈরি করেছে; আজ খিম্মার মাথায় খুতুপ পড়িয়ে দেয়া হবে, ফুলে ফুলে ভরে ওঠবে খিম্মার চারপাশ। সহযোদ্ধাদের মধ্যথেকে সংস্রেক নিয়ম মেনে কয়েন মৃ বা তাদের মতো অনেকেই গ্রাপা করবে তাঁর জন্য। আর গ্রাপার পরেই আবারো দৃপ্ত শ্লোগানে জনস্রোত মিলিত হবে জয়নাগাছা স্কুল মাঠে। তোমার বাবার সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে নেতৃবৃন্দ পুস্পাঞ্জলি আর প্রার্থণা করবে। তারপর স্মরণসভা; মঞ্চ আলো করে বসবে জয়েনশাহী আদিবাসী পরিষদ, বাগাছাস, গাসু’র নেতৃবৃন্দ আর সিপ্রাডের কর্তাব্যক্তি বা অন্যান্য আরো কেউ কেউ (যার মধ্যে ঘাতকের সাথে হাত মেলানো নেতারাও থাকতে পারেন!)। শ্লোগান আর বক্তৃতায় বক্তৃতায় একসময় তা শেষ হয়ে যাবে। তোমাদের দাদা নেজেন নকরেক বা দাদী সাইলো স্নালের উদাসী-নির্বাক চাহনী প্রতিদিনের ন্যায় তাঁদের বুকের ধনকে খুঁজে ফিরবে। কেননা এরকম মিছিল-মিটিংএই তো তাঁদের আদরের ধন সেদিন কলাবাগানের কাজ ফেলে ছুটে গিয়েছিল হা.বিমা রক্ষার সংগ্রামে।
শহীদের সন্তানেরা,
আচ্ছা, বাবার কথা কী তোমাদের মনে পড়ে। রাত্রিরতো মনে থাকা কথা নয়, সেতো তখন মাস ছয়েকের একটু পুটুলি, উৎস হয়ত কিছুটা মনে করতে পারবে। রাতে ঘুমাবার সময় মা কী তোমাদের বাবার কথা বলে? পাড়া-পড়শি কেউ? তখন কেমন লাগে তোমাদের সোনা! খুব কষ্ট লাগে!
সোনা-মনিরা,
প্রতিবারের মত এবারো হয়ত তোমরা আসবে জয়নাগাছা স্কুল মাঠে। মা সীতা নকরেক এর দকমান্দার আঁচল ধরে বসে থাকবে নীরবে; যেমন পাঁচ বছর আগে দাঁড়িয়েছিলে বাবার লাশের অপেক্ষাতে। মঞ্চের বক্তারা কত কথা বলবে তোমাদের বাবার নাম ধরে! কত সংগ্রামী প্রত্যয় ব্যক্ত করবে! কিন্তু জানি তোমার মায়ের যে নীরব হাহাকার কিংবা তোমাদের মনের যে অপূর্ণতা তার ধারে এইসব পোষাকি গলাবাজী কিছুই না। কিন্তু সোনারা এটা জেনো যে, পোষাকি গলাবাজি বিপরীতে আপন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের ধরণ কী রকম হতে পারে তা তোমাদের বাবা নিজের বুকের রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন।
প্রিয় উৎস ও রাত্রি,
রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে তোমাদের বাবা শহীদ হওয়ার পর এই মধুপুর বনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে; যেমনটা বদলে গেছে তোমাদের জীবনও। জাত্যাভিমানী এই রাষ্ট্রের শোষকেরা অনেক কলাকৌশলের মধ্য দিয়ে শালবনের আন্দোলন-সংগ্রামকে ভিন্ন দিকে ঠেলে দিতে পেরেছে। অনেকেই ভেবেছিলো তোমাদের বাবার আত্মদানের মধ্য দিয়ে হয়তো ইকোপার্ক প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। গত জরুরি অবস্থা জারির পরপরই শালবনকে আবার কংক্রীটের দেয়ালে ঘিরে ফেলার কাজ শুরু হয়ে যায়; যদিও কয়েকদিন পর তা আবারো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাঙালি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক-শোষণমূলক-নিপীড়নমূলক কর্মপরিকল্পনা মোটেও থেমে থাকে না। তোমাদের বাবার মৃত্যু ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যাদেরকে হয়রানিমূলক মিথ্যা দিয়ে চাপের মধ্যে রাখা হয়েছিল-চলেশ রিছিল ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। তাকেও তোমাদের বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজনেরা। তোমরা ভেবো না আসং ফাতেং চিগা সিম্মল দেং দেং এ তোমাদের বাবা একা আছেন। সিধু-কানু-বিরসা-আলফ্রেড-অবিনাশ-কল্পনা চাকমাও আছেন তাঁর সাথে।
প্রিয় সোনা-মনিরা,
বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকেইতো তোমাদের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়েছিল, কত কত প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু বাবার স্নেহ ভালোবাসার কাছে এইসব উদ্বায়ী ভালোবাসার যে কোন মূল্যই নেই তা তোমাদের থেকে আমার বেশি জানার কথা নয়। তারবাদেও নিজেদেরকে কখনো একা ভেবো না। আমি বিশ্বাস করি, তোমাদের সাথে প্রতিটি মান্দি আছেন, আছে দুনিয়ার সকল নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের ভালোবাসা। তোমরা একা নও-দূর্বল নও। তোমরা শহীদের সন্তান। আপন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে শহীদের সন্তান হতে পারা যেমন অনেক বেদনার তেমনি অনেক গর্বেরও।
ভালো থেকো সোনারা।
শুভকামনা
খা সাংমা, খা মারাক।
জুয়েল বিন জহির
মন্তব্য
ভালো লেগেছে। শহীদের সন্তানেরা নিশ্চয়ই একা না। আমরা আছি তাদের পাশে। ধন্যবাদ।
(মহসীন রেজা)
মহসীন আপনি ঠিকই বলেছেন, শহীদের সন্তানেরা একা হতে পারে না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রিয় লেখক,
বেদনার নিলাভ আকাশে নতুন করে আর মেঘ দেখতে চাই না। তাই আমাদের রাষ্ট্র চিন্তা অন্যভাবে ভাবতে হবে। না হলে যেখানে মৌসুমী বায়ুর সামান্য ঝড় সামলাতে আমাদের হাহাকার করতে হয়, সেখানে সুনামী আসুক তা কখনো চাই না।
হামোম প্রমোদ
http://www.somewhereinblog.net/blog/hamom
নতুন মন্তব্য করুন