ধান ভানতে শিবের গীত
গত ১৬ ডিসেম্বর চুনিয়ার ওয়ান্না শেষে দলবল সহ আমরা ধরাতিতে বন্ধু রিমি দিওদের বাড়ির উদ্দেশে ভ্যানে রওনা হই। দোখলা পার হয়ে সাইন্যামারি গ্রামে পৌঁছানোর পর পথে দেখা হয় সোহেল মৃর বন্ধু বিশ্বজিত ও আরো কয়েকজনের সাথে। ভ্যানে চড়তে চড়তে আমরা আমাদের গন্তব্যের কথা ওদের জানানোর পর ফিরতি পথে সবাই আমাদেরকে সাইন্যামারি তসরিফ রাখার আব্দার করল। আমরাও না করতে পারিনি। তাই ধরাতি থেকে ফেরার পথে পিপাসার্ত আমরা সাইন্যামারি প্রাইমারি স্কুলের পাশে এক বাড়ি বারান্দায় হাজির হলাম সন্ধ্যা (সন্ধ্যা না বলে রাত বলাই যুক্তিযুক্ত) সাতটার দিকে। গৃহকর্তা চা-বিস্কুট আর পান দিয়ে প্রাথমিক সেবা দিলেন। ক্ষাণিক দূরে রান্না ঘরে ফং দিয়ে চু ছাকার শব্দে শুনতে পেয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সময় পার করতে লাগলাম। আলোচনা চলছে বিভিন্ন বিষয়ে। কিছুক্ষণ পর পর বাড়ির এক ফান্থির (যুবকের) সিগারেট সাপ্লাই আলোচনায় বেশ গতির সঞ্চার করছিল। নানান অলি-গলি পার হয়ে আমাদের গপ্পো নির্বাচনে এসে স্থিতি লাভ করল। নির্বাচনের গপ্পো করতে করতে জগ ভর্তি চু আর গ্লাস চলে আসলে আলোচনা ডালপালা গজিয়ে গজিয়ে বিশাল অবস্থা। তিনটা দিখ্যা শেষ করে সাংমা-মারাকদের মধ্যে কে কার উপরে এটা নিয়ে তর্কযুদ্ধ করতে করতে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ছহিসালামতে চুনিয়া পৌঁছাতে সমর্থ হই।
শিবের গীতের পরে...
গতপরশু ফেসবুকে ঢুকে দেখি বাবুলদা’র (বাবুল ডি নকরেক) নয়া স্টাটাস- ’বাবুল নকরেক ইজ আপসেট এজ এড. প্রমোদ মানখিন এমপি ইজ নট ইন দ্য কেবিনেট’। এবারের হিসেব-কিতাবের বাইরের নির্বাচনী ফলাফল এবং তৎপরবর্তী মন্ত্রীসভা গঠনের ব্যাপারগুলো মজগের কোষে কোষে ভাল মতো পৌঁছানোর আগেই এই স্ট্যাটাসখানা দেখে মস্তিষ্ককে কিঞ্চিত রিফ্রেস করার লাগি সেই পুরনো আড্ডার বিষয়গুলো মনে করতে লাগলাম। মধুপুর গড় এলাকা মোটামুটি ভাবে আওয়ামীলীগের ঘাটিই বলা চলে। সেদিনের গৃহকর্তা সহ অনেকেই বেশ কনফিডেন্টলি বলেছিল যে, প্রমোদ মানখিন যদি এবার পাস করে আর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে তাহলে মন্ত্রীত্ব পাবেন। হালুয়াঘাট থেকে এই মান্দি এমপি গত ৯৬, ২০০১ সালে পরপর দু’বার সেখান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবারও নাকি পাস করার যথেষ্ট সম্ভবনা। আর উনার বিরুদ্ধে যেহেতু দুর্নীতি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কোনো অভিযোগ নেই কাজেই উনার মন্ত্রী না হওয়ার যেন কোন কারণ নেই। আসলে কোন কারণ থাক বা না থাক মান্দিরা যে প্রমোদ মানখিনকে মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান সেই আকাঙ্খাটা ছিল বেশ স্পষ্ট। সেদিন ঐ আড্ডায় প্রমোদ মানখিনকে ঘিরে মান্দিদের যে আকাঙ্খা তা একপ্রকার অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছিল আমার কাছে। আমার মনে হওয়ার পক্ষে কিছু যুক্তিও হাজির করেছিলাম। যাই হোক পরিবর্তনের জোয়ারে আওয়ামীলীগ মন্ত্রীসভা গঠন করেছে। মন্ত্রীসভায় অনেক নতুন মুখও এসেছে, প্রমোদ মানখিন সেখানে অনুপস্থিত। বাবুলদা’র স্ট্যাটাসে যে আপসেট, সেটাকে তাই আমার কাছে নিছক কোনো ব্যক্তির আপসেট বলে মনে হয়নি। এটা যেন পুরো মান্দি জাতির আপসেট বা বলা যেতে সমতলের আদিবাসীদের আপসেট। রাজনৈতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সমতলের আদিবাসীদের থেকে অনেক বেশী সংগঠিত-সংহত একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পার্বত্য আদিবাসীদের রাজনৈতিক ভিত্তি এই রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর জন্য যতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পেরেছে সমতলের আদিবাসীরা তার থেকে অনেক পিছিয়ে এটাও সত্য। অবশ্য ভৌগলিক অবস্থানগত দিকটাও এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিস্থিতি শাসকগোষ্ঠীর জন্য যতটা চিন্তার ব্যাপার রাজনৈতিক-সাংগঠিনকভাবে অসংহত সমতলের আদিবাসীরা ঠিক ততটা নয়। শাসক শ্রেণী যে করেই হোক পার্বত্য চট্টগ্রামকে শান্ত রাখতে চাইবে। অদ্যাবদি চালু থাকা সেনাশাসন যেখানে পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারকে দমাতে ব্যর্থ হয়েছে তার বিপরীতে শাসক শ্রেণীর দেয়া নানান সুবিধাদি বেশ টনিকের কাজই দিয়েছে বলতে হবে। আদিবাসী নিপীড়নের ঘটনা পাহাড়-সমতল সব জায়গাতেই আছে। কিন্তু সমতলের আদিবাসী নিপীড়ন বা এর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের প্রতিরোধী ধরণ এবং পাহাড়ে আদিবাসী নিপীড়ন বা এর বিপরীতে প্রতিরোধী ধরণে বেশ বৈচিত্র্য আছে। আর এই বৈচিত্রতার জের ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে যেমন অবিরাম সেনাশাসন কায়েম থাকে, তেমনি রাষ্ট্রের প্রলোভনের উন্নয়নও কয়েকগুণ বেশি বেগে চলতে থাকে সমতলের আদিবাসী এলাকার তুলনায়। যাই হোক, আমার মনে হয় পাহাড়ের আদিবাসীদের তুলনায় সমতলের আদিবাসীরা এই রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর কাছে রাজনৈতিকভাবে এমন কার্যকর কোন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারেনি যে শাসকগোষ্ঠী সমতলের আদিবাসীদের জন্য অনুরূপভাবে ভাবতে বাধ্য হয়। সমতলের আদিবাসীদের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মজবুত হলেই কেবল আশা করা যায় শাসকগোষ্ঠী একজন সান্তালকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী করবে বা একজন কোচকে হয়ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বানাবে বা একজন মান্দিকে হয়ত পূর্ণ মন্ত্রীত্ব দিবে।
মন্তব্য
লেখা পড়ে মনে হল রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারলেই রাষ্ট্র পশ্চাৎপদ জাতিগোষ্ঠীকে আমলে নিবে; তাদের উন্নয়নে মনোযোগ দিবে - এমন একটা অলিখিত নিয়ম চলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির কাছে জনগণ এমন কিছু প্রত্যাশা করে না। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই বা এমন আচরণ পাবে কেন কোন নির্দিষ্ট লোকালয়ের জনগণ? আশা করি এডভোকেট প্রমোদ মানখিনকে মূল্যায়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে সম্মান করবে বর্তমান সরকার। এদেশ হোক সকল নাগরিকের।
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
এদেশ হোক সকল জাতির সকল মানুষের।
আলোচ্য ব্যক্তি সম্পর্কে জানি না.. তাঁর মন্ত্রী হবার যোগ্যতাও আমার অজানা.. তাই কিছু মন্তব্য করতে পারছিনা।
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
হুম! এটাও এক ধরনের মন্তব্য।
ধন্যবাদ আপনাকে।
যাক অবশেষে প্রমোদ মানখিন মন্ত্রীত্ব পেলেন। অভিনন্দন!!!
মিঃ মানকিন মন্ত্রী হলেন। আমার স্ট্যাটাসে ৩২৭ টি যে কমেন্ট পড়েছিল (গালিগালাজ) তা নিমেষে উধাও হয়ে গিয়েছিল মন্ত্রী যেদিন হলেন সেদিনই! ৩০০ টির বেশি কমেন্টস রিমুভ হওয়ার ঘটনা বলে দেয় আমাদের দেশে গারো মানুষের মন্ত্রীও হতে নেই!
প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার নেতা, সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট প্রমোদ মানকিন এম পি চলে গেলেন না ফেরার দেশে!
তাঁর আত্নার চির কল্যাণ কামনা করি ...
নতুন মন্তব্য করুন