গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর। বিদেশের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরছি কাতার এয়ারে করে (তুলনামূলকভাবে অন্য এয়ারওয়েজের চেয়ে সস্তা বলে)। আমার পাশের সিটে বসেছিলেন একজন রুশ ভদ্রমহিলা। তিনি বাংলাদেশের রাশিয়ান অ্যাম্বেসিতে কাজ করেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তারপরও বাংলাদেশ সম্পর্কে উনার ধারণা জানার জন্য কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সৌজন্যতার খাতিরে হোক আর সত্যিই হোক- ভদ্রমহিলা আমাকে নিরাশ করেননি। তোমাদের দেশটা খুব সুন্দর, গ্রীণ অ্যান্ড গ্রীণ, সামারে খুব গরম, উইন্টার ভালো। সাথে মাথে আমি প্রশ্ন করি, বর্ষাকাল কেমন লাগে? রেইনি সিজনে একটু বোর লাগে, তারপরও বেটার দ্যান সামার। আমি হেসে বলি, আমার কিন্তু বৃষ্টি খুব ভালো লাগে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষেরই বৃষ্টি ভালো লাগে। ভদ্রমহিলা অবাক হন, হয়তো বন্যার কথা মনে পড়ে যায় তার। এর মাঝে এয়ার হোস্টেজরা খাবার সার্ভ করেন। বিমানে যাত্রীদের প্রায় সবাই বাঙালি বলে, তারাও খাবার পরিবেশন করার সময় বিচিত্র উচ্চারণে খাবারের নাম বলতে থাকেন। যেমন ড্রিংকস পরিবেশনের সময় চাআআইই, চাআআইই, পাহআনি, পাহআনি এরকম মজার মজার উচ্চারণ।
যাত্রীদের সিংহভাগই মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক ভাইয়েরা যাদের রক্ত জল করা উপাজর্নে আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ে। যাত্রার পুরোটা সময় তাদের গল্প-কোলাহল-হাসি-ঠাট্টা-বাগ-বিতম্বা এসবে ভরপুর থাকে। এদের মধ্যে পনের-বিশ পরে দেশে ফিরছে এমন যাত্রীও আছেন। তাদের কাছে প্রতীক্ষার প্রহরগুলো কি রকম দুর্বিষহ সেটা আমার পক্ষে কল্পনা করাও অসাধ্য। আমার ঠিক সামনে সিটে ছিলেন একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। সারাটা সময় তিনি পাশের জনের সাথে গল্প করে যাচ্ছিলেন। 'ভাই, দেশ নাকি বহুত পাল্টি গেছে। নতুন গভমেন্ট আইছে। বড় বড় নেতাগোরেও ছাইড়তেছে না।' 'হ ভাই, ভালা অইলেই ভালা, দেশ উন্নত অইলে আমাগো আর বাইরে যাওন লাগব না। দেশে দুইটা ডাইল-ভাত জুটলেই সুখে থাকতাম পারি।' এই ধরনের অনেক কথাই কানে লাগে হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানির মতো। কতো ক্ষুদ্র চাওয়া- দুটো ডাল-ভাতের নিশ্চয়তা, আমাদের মতো মাসে লাখ টাকা বেতনের চাকরি না- বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বা মার্সিডিস গাড়ি না- শুধু দু'বেলা খাবার!
একসময় বিমানের জানালা দিয়ে সবুজ ভূখন্ড দৃষ্টিগোচর হয়। স্ক্রিন-ম্যাপ দেখে সবাই বুঝতে পারে এখন আমরা বাংলাদেশের আকাশসীমায় উড়ছি। গভীর মমতায় সবাই তাকায় জানলা দিয়ে যতদূর দৃষ্টি যায়, কারো কারো চোখ ছলছল করে ওঠে। আমার সামনের সিটের ভদ্রলোকটা গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন- এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি....। কিন্তু আমার তখন মনে হতে থাকে এই মুহূর্তে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধ ও সুন্দর সঙ্গীত। বিমান আস্তে আস্তে নীচের দিকে নামছে। তখন চোখে পড়ে প্রায় পুরো শহরটা যেন পানিতে ঢাকা। একজন চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন- সব তো পানি, বন্যা না হয়ে যায়, আল্লাহ আমার দেশরে রহম করো। বিমানবালার অ্যানাউন্স করেন, অল্প কিছুক্ষণের মাঝে আমাদের বিমান অবতরণ করতে যাচ্ছে, আপনার অনুগ্রহপূর্বক সিটবেল্ট বাঁধুন। কিন্তু যাত্রীদের তখন আর তর সয় না। সবাই হুড়মুড় করে লাগেজ নামানো শুরু করেন। আমাদের মতো কয়েকজন সচেতন ভদ্রলোক, সবাইকে বিনীত অনুরোধ করেন বসে সিট বেল্ট বাঁধার জন্য। কেউ কেউ বলেন, ভাই দেশের মান-সম্মান ডুবাইয়েন না। এরই মাঝে এবার বাংলায় অ্যানাউন্স হয়- সবাইকে সিটে বসার অনুরোধ জানিয়ে। এয়ার হোস্টেজরা বিস্মিত এবং বিরক্ত। সেই সাথে বিরক্ত আমাদের মতো কিছু পোশাকী ভদ্রলোকেরা।
দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবন থেকে অল্প কিছু সময়ের জন্য ঘরে ফেরা একদল মানুষের হুড়োহুড়িতে বিব্রত হয় সবাই, তবু এর মাঝেই আমি সেদিন খুঁজে পাই দেশের জন্য, প্রিয়জনদের জন্য তাদের অভব্য আবেগ, গভীর ভালোবাসা। সেই বেসুরো গলার "এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবো নাকো তুমি" আমাকে আরো একটি কথা মনে করিয়ে দেয়- এমন মানুষই বা কোথাও খুঁজে কি পাওয়া যাবে? এ যে সোনার বাংলার সোনার সন্তান, মৃত্তিকার সন্তান।
মন্তব্য
আজো খুঁজছি সেই মানুষ!(স্বাধীনতা তোমার বয়স বেড়েছে ঢেড়)
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
নরকের মতো সব সময় বুক খুলে রাখে একমাত্র স্বদেশ আর জননী
স্বদেশ আর জননীই শুধু নরকের মতো পুরোটা কন্ঠস্বর খুলে বলতে পারে
আয় বাপ আয় বুকে আয়
শ্রমের ক্লান্তি আর ঘামের দুর্গন্ধ যাই থাকুক না কেন তোর শরীরে
তুই আয়
আমার বুকে আয় বাপ
- রাইটিং...
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
দীর্ঘ পরবাস যাপনের পর দেশে ফেরার সময় বিমান অবতরণের মুহূর্তে যে বুকের মধ্যে কী বয়ে যায়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কে বুঝবে!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
হুমম।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
নতুন মন্তব্য করুন