সেবার জেবতিক ভাইকে ছোটবেলা নিয়ে একটা লেখা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারিনি। এবার তিনি জানতে চেয়েছেন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস "তাকে ডেকেছিলো ধূলিমাখা চাঁদ"-এর পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। এবার আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দু:সাহস দেখানো সম্ভবপর হলো না বলে আজকের এই গ্রন্থালোচনা। এই লেখাটিকে সাহিত্যিক বিচারের কষ্টি পাথরে যাচাই না করলে কৃতার্থ হই। এই লেখাটিকে একজন পাঠকের একেবারে ব্যক্তিগত কথামালা বলা চলে।
আরিফ জেবতিকের "তাকে ডেকেছিলো ধূলিমাখা চাঁদ" মূলত অস্থির সময়ের কিছু মানুষের গল্প (গল্প বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না যেহেতু লেখক শুরুতে এবং শেষে উল্লেখ করেছেন উপন্যাসটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে রচিত)। এই উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্রের একজন হলো রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়া একসময়ের প্রতাপশালী ছাত্রনেতা যার নাম 'আনিস' আর আরেকজন হলো চাচা-চাচীর আশ্রিত অনাথ সাধারণ এক ছাত্র 'দীপু'। কলেজে প্রথমবারের মতো পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যেগ গ্রহণ করে দীপুর মতো কিছু সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। রাজনীতি থেকে নির্বাসিত বলে তারা সাথে নেয় আনিসকে। কিন্তু আনিসের একসময়ের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীরা এতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়, নিজের দলের নেতারাও শঙ্কিত হয় আনিসের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কায়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। এর মাঝে দীপুর সাথে গড়ে ওঠে সেজুঁতি নামে একটি মেয়ের সখ্যতা। কিন্তু সে সম্পর্ক গভীর হওয়ার আগেই দীপু খুন হয় 'ফয়েজ গ্রুপ'-এর ক্যাডারদের হাতে। দীপুর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু আনিসকে বাধ্য করে আবার ফিরে যেতে রাজনীতির সেই বিভৎস, অন্ধকার কুঠুরিতে।
এ ছিলো মূল ঘটনার সংক্ষেপ। "তাকে ডেকেছিলো ধূলিমাখা চাঁদ" উপন্যাসে প্রথম যে বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো সেটা হলো এর নামকরণ। উপন্যাসের নায়ক দীপুর সেজুঁতির জন্য লেখা ভালবাসা কাব্যের প্রথম লাইন ছিলো, "তাকে ডেকেছিলো ধূলিমাখা চাঁদ।" উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে দেখা যায় নিজের লেখা কবিতার পংক্তিগুলিকে সত্যি করে সে চলে গেছে দূরদেশে। তাই লেখক মানসপটের কল্পনাকে নিপুণভাবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি চমৎকার সাযুয্য বিনির্মাণ করেছেন নামকরণে। দ্বিতীয়ত, উপন্যাসের পটভূমি এবং চরিত্রগুলো একবারে সমসাময়িক যার দরুন পাঠক হিসেবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার অবকাশ নেই। বরং পড়তে পড়তে পাঠকই হয়ে ওঠেন একজন দীপু কিংবা আনিস। রাজনীতির ভয়ংকর কালো দিক, মৌলবাদী সংগঠনের নখর, বাঙালী সংস্কৃতি ও চেতনা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা এসব গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উঠে এসেছে উপন্যাসে। সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সবশেষে জয়ী হয়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। উপন্যাসের আবশ্যক যে জিনিস গতিময়তা সেটা ছিলো পূর্ণমাত্রায়। পাঠক হিসেবে বলা যায়, "তাকে ডেকেছিলো ধূলিমাখা চাঁদ" পাঠের পুরোটা সময় জুড়ে একধরনের আবহ ছিলো সমমাত্রায়। কাহিনীর বিন্যাস, উপস্থাপন এবং ভাষার প্রাঞ্জলতার কারণে খেই হারাতে হয়নি কখনো। প্রতিটা পর্বই হয়তো আনিস বা দীপুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। লঘু চালে গুরু কথার ফুলঝুড়ি সাজিয়ে গেছেন আরিফ জেবতিক পুরো উপন্যাসে। উত্তেজনার পাশাপাশি সমান মাত্রার হাস্যরস পাঠককে কখনো বিরক্ত হওয়ার সুযোগ দেননি। তাই বলা যায়, "তাকে ডেকেছিলো ধূলিমাখা চাঁদ" পাঠক হৃদয়ে আলোড়ন জাগাতে সক্ষম একটি উপন্যাস।
এবার ব্যক্তিগত কিছু অভিমত তুলে ধরবো। প্রচুর পরিমাণ টাইপো এবং কিছু বহুল প্রচলিত নয় এমন শব্দ ব্যবহারের কারণে (যেমন ফাজলেমি শব্দটি বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে, এটা যদি ফাজলামো লেখা হতো তবে পড়ার সময় আরামবোধ হতো) পাঠে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। লেখায় হুমায়ুন আহমেদের কিছুটা (অতীব কিঞ্চিত) প্রভাব লক্ষ্যণীয়। লেখক মোরশেদ নামক চরিত্রটির শুরুতে পাঠকদের ধারণা দিয়েছেন, মোরশেদ একজন মুডি মানুষ। কিন্তু উপন্যাসের দুই জায়গায় তার যে উপস্থিতি তাতে দেখা যায় তিনি যথেষ্ঠ পরিমাণ হাসি-তামাশা করেন (যেমন, দীপু তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি দীপুকে তার সাথে চা খেতে বলেন কারণ একা একা কোন কিছু খাওয়া যায় না। দীপু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, চা-ও কি দু'জনে মিলে খেতে হয়? তিনি তখন বলেন, হ্যাঁ, এমনকি চুমুও দু'জন মিলে খেতে হয়।) আরেকটি ব্যাপার যেটি লক্ষ্যণীয় সেটি হলো, উপন্যাসটির পুরোটাই সমসাময়িক আবহের মধ্যে আবর্তিত। লেখক যখন অনিসকে একজন রিটায়ার্ড ছাত্রনেতা বলে আখ্যা দেন তখন পাঠকের মনে কৌতূহল জাগে তার পেছনের কারণ জানতে, একইভাবে দীপুর বাবা সম্পর্কে কিছু গোপন রহস্যের আভাষ দিয়েও লেখক সেটাকে রহস্যময়তার অলিন্দেই রেখে দেন। কোন চরিত্রেরই অতীত বা গভীরতা আমরা সেভাবে পাই না। তাই সেগুলো পাঠক মনে অনেকগুলো প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দেয়।
জেবতিক ভাই যেদিন উপন্যাসটা পড়ে ফিডব্যাক জানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেদিন আরো একটি কথা বলেছিলেন, সেটি হলো- আপনাদের মতামত আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ , কারণ আমি উপন্যাস লেখা কন্টিনিউ করবো কি করবো না তা আপনাদের ফিডব্যাকের উপর নির্ভর করছে। জেবতিকদা'কে শুধু একথা বলতে চাই, আপনার পরবর্তী উপন্যাসের পাঠক হিসেবে ঝরাপাতাকে অবশ্যই পাবেন।
মন্তব্য
আরিফ ভাইয়ের বইটি কোন স্টলে পাওয়া যাচ্ছে?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান…
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
জাগৃতি ।
পড়লাম। দেশে গেলে কিনা পড়ুম।
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
আপনার মন্তব্যে অনুপ্রানিত হলাম । অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ।
যেসব বিষয়ে সমালোচনা করেছেন , সেগুলো ভবিষ্যতে শুধরে নেবার আশা করি ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার প্রথম উপন্যাসটাও পড়ার ইচ্ছা রইলো। কোথায় পাবো জানালে খুব খুশি হবো।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
উপন্যাস এটাই প্রথম । আসলে দীর্ঘ পরিসরে লেখার অভ্যেসটা গড়ে উঠছে এই ব্লগিং করতে করতেই ।
টাকার জন্য দুই তিনটি আবজাব লিখেছিলাম ছদ্মনামে , যেগুলো সরকারী বইক্রয়ের চালানে বিক্রী হয়েছিল । ( এটা কিছু প্রকাশকের একটা বিরাট ধান্দাবাজী , এ বিষয়ে পরে একদিন লেখার ইচ্ছা আছে ) সেগুলো উল্লেখ করার কিছু নেই । ভোরের কাগজের মাইক্রোস্কোপ কলামের জন্য জমানো জোকসগুলো নিয়ে জাগৃতি থেকে একবার একটা জোকসের বই বের হয়েছিল " পলিটিক্যাল জোকস " নামে ।
আমি ঐ পাড়া থেকে পড়ছিলাম কিছু পর্ব। পরে মনে হল একবারে কিনেই পড়বো। বই জিনিসিটা কেন জানি হাতে নিয়ে না পড়লে পোষায় না আমার। টাইপোর ব্যাপারটা আমারো চোখে পড়েছিল।
বইটা আমারও খুব পড়ার ইচ্ছা...... সমালোচনা পড়ে সেটা আরো বাড়লো ......
আরিফ, আপনার স্ত্রী অর্ণাও কি লেখেন?
অর্না একসময় বেশ লেখালেখি করতেন । এই লেখালেখির মাধ্যমেই তার সাথে পরিচয় । তবে ইদানিং সুযোগ পান না ( বলা ভালো , কম্পিউটারে বসার সুযোগ পান না আমার যন্ত্রনায় )
সচলায়তন-এ তার একটা লেখা এখানে খুঁজে পেলাম ।
সমালোচনা পড়ে ভালো লাগলো। আরিফ ভাই যদি বইটা গিফট করতেন তাহলে আরও ভালো লাগতো :)।
কি মাঝি? ডরাইলা?
বিদেশে বসে বইটা পাওয়া যাবে কিভাবে?
-জাহিদ হোসেন
________________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কখন যে হাতে পাবো!
ঝরাপাতাকে ধন্যবাদ।
ধারাবাহিক পড়তে শুরু করেছিলাম। ৫-৬ পর্বের পর দীর্ঘ বিরতি পড়লো। তার পরে আর পর্ব এসেছে কি না দেখা হয়নি। দেখা যাক, কবে বইটা সংগ্রহ করতে পারি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আমারো দুইখান কথা আছে, বেয়াদবী না নিলে কই।
(ধরে নিলাম বেয়াদবী নেন নাই!) তাওহীদের দলটার আরো কিছু সুকর্মের বিবরণ থাকলে ভালো হত। রাতের বেলা হুমকি দিয়ে যাওয়া শেয়াল চরিত্র ছাড়া এদের আর কিছু বের হল না।
ফিনিশিংটা আরেকটু বড় হতে পারতো, খুব সংক্ষেপে শেষ হয়ে গেছে মনে হল।
সাহিত্যগুণ-দোষ বিচারের যোগ্যতা নাই, সব মিলিয়ে বইটা ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ।
যে সময়ের কথা উপন্যাসে এসেছে সেই সময় শিবিরের উত্থানপর্ব চলছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে । অতপ্রতোভাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকার সুবাদে এই বিষয়টি আমার জানা যে শিবিরকে তখন সামনাসামনি কোন কিছুইতেই পাওয়া যেত না । তাদের সব কাজই ছিল
গোপনে গোপনে , একে তাকে লাগিয়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোকে দুর্বল করে দেয়ার ভেতরে ।
ফিনিশিং নিয়ে একই মতামত আমি অসংখ্য পাঠকের কাছ থেকে পেয়েছি । আমি চেয়েছিলাম একটি দ্রুত লয়ের ফিনিশিং দিতে , ঘটনাগুলো যে ভাবে দ্রুততার সাথে এগুচ্ছিল সেই একই ধারা আমি লেখার মাঝে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম । একটা অতৃপ্তি রাখতে চেয়েছিলাম ।
অতৃপ্তিটুকু রাখতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে , যদিও বিষয়টা বেশির ভাগ পাঠকই পছন্দ করেন নি ।
ভবিষ্যতে সাবধান থাকব ।
-----------------------------
কালের ইতিহাসের পাতা
সবাইকে কি দেন বিধাতা?
আমি লিখি সত্য যা তা,
রাজার ভয়ে গীত ভনি না।
নতুন মন্তব্য করুন