ভাগ্নে আমার সব্যসাচী

ঝরাপাতা এর ছবি
লিখেছেন ঝরাপাতা (তারিখ: রবি, ২২/০৭/২০০৭ - ৫:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার এক পুচকে ভাগ্নে আছে। নাম দুর্জয়। নামের মতোই তার সব কাজকর্ম। অসাধ্য সাধনে তার অব্যর্থ চেষ্টার কোন কমতি নেই। বয়েস যদিও পাঁচ কি ছয় হবে, কিন্তু কথা শুনে মনে হবে আদি কালের ভাদি বুড়ো। বাসার সামনের ছোট্ট খোলা জায়গাটাতে অ্যাপার্টমেন্টের অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করে। কিন্তু এর মধ্যেই সমবয়েসীদের মাঝে সে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। প্রতিদিনই তার নামে ডজনখানেক না হলেও হালিখানিক নালিশ আসে ফুফাতো বোনের কাছে। আজ ওকে ঘুষি মেরেছে তো কাল ওকে খামছি দিয়েছে, আজ ওর খেলনা ভেঙ্গে দিয়েছে তো কাল আরেকজনের জিনিস কেড়ে নিয়েছে। একবার ডান হাতটা মচকে গিয়েছিলো ওর। সবাই বললো, দুষ্টুমি করার ফল। খুব ভালো হয়েছে কয়দিন আর লোকজনের নালিশ শুনতে হবে না। কিন্তু কিসে কি! ভাগ্নে আমার সব্যসাচী। বা হাত দিয়েই সবগুলোকে মেরে ধরে হাত মচকানোর শোধ তুলেছে। দেখা গেলো সেদিন ডাবল অভিযোগ হাজির তার নামে। অবশেষে এই নাবালক দস্যুটাকে সাইজ করার জন্য আমার ডাক পড়লো। আমি হাজির হলাম বোনের ফ্ল্যাটে। তখনো বুঝতে পারিনি কপালে কি পরিমাণ দুঃখ আছে।

বেল বাজানোর দুই তিন মিনিট পরে দরজা খুললো। আপু ছিলো বাথরুমে। তাই ভাগ্নেই দরোজা খুলল। খোলার আগে চেয়ার টেনে হোল দিয়ে দেখে নিয়েছে কে এসেছে। তারপর চেয়ার সরিয়ে তার প্রস্তুতিপর্ব শেষ করে দরোজা খুলেছে। আমি ঢুকতে না ঢুকতেই পড়লাম তোপের মুখে। কিছু বোঝার আগেই অর্ধভেজা হয়ে গেলাম। বুঝলাম তার একটা জলকামান আছে, বিচ্ছুটা সেটার ব্যবহার করেছে। অর্ধেভেজা করার পর আবার চিৎকার করে বলছে- ‘আমি ল্যাব। তিসিয়া তিসিয়া। তুমি জিহ্বা বেল কলে মলে যাও।‘ ভাবলাম পড়েছি মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে, কাকভেজা হতে না চাইলে অভিনয় করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এর মাঝে আপু বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো। আমার এই অবস্থা দেখে একটা তোয়ালে নিয়ে এলো আর ভাগ্নেকে বকাঝকা করতে লাগলো। কিন্তু সে তো দমবার পাত্র নয়, তখনো বুঝতে পারিনি এরই মাঝে সে তার দ্বিতীয় দফা ব্যাটল প্ল্যান চূড়ান্ত করতে লেগে গেছে। আমি আপুর সাথে গল্প করতে লাগলাম। এরই মাঝে হঠাৎ ঘাড়ে এসে কি যেন একটা ধাক্কা মারলো। কিছুটা ব্যাথা পেলাম। পরে জানলাম, ওটা ছিলো শর্ট রেঞ্জের শুটিং গান। ভাগ্নে আমার মাথাটাকেই তার শুটিং প্র্যাকটিসের জন্য টার্গেট করেছে। এবার আপু কিছুটা বিরক্ত হয়ে গেলো। উঠে গিয়ে একটা চড় লাগালো। আর ভাগ্নেও অমনি কান্না সঙ্গীত শুরু করে দিলো। আপু চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে রান্না ঘরে চলে গেলে আমি ওর কাছে গেলাম। আদর করে কান্না থামালাম। তারপর ওকে সোফায় আমার পাশে এনে বসালাম। পকেট থেকে চকলেট বের করে হাতে গুজে দিলাম। ছোট বাচ্চাদের জন্য এটা একটা অব্যর্থ অস্ত্র। ভাগ্নে শান্ত হলো।

চকলেট খাওয়া শেষ হলে বললাম, একটা ছড়া বলো তো মামা। তাহলে আরেকটা চকলেট পাবে। ভাগ্নে একটু থেমে চকলেটের লোভে শুরু করলো।

হাত্তি মা তিম তিম
তালা মাথে পালে দিম
তাদেল খালা আ আ
তাদেল খালা আ আ
তাদেল খালা আ আ

এসময় আপু সোফায় এসে বসে। ও বলে, আম্মু বলো না, তাদেল খালা আ, তাদেল খালা . .। আপু বলে, তাদের খাড়া দুটো শিং। ভাগ্নে আবার শুরু করে-

তাদেল খালা দুতো শিং,
তালা…. তালা …..

আমি বলি, তারা হাট্টি মা টিম টিম। ছড়া শেষ করে পাওনা আরেকটা চকলেট বুঝে নেয়। আপা চলে যায় নাস্তা আনতে। আমি বলি- মামা আরেকটা ছড়া বলো। ভাগ্নে বলে- ছলা না, গান শোনো। আমি বলি আচ্ছা গান শোনাও তবে। চকলেট শেষ করে ভাগ্নে শুরু করে-

বোল চুলিয়ে, বোল কানা,
হাম হো গি মেলে সানা
. . . . . . . .

লে জা লে জা লে জা।

একটানে পুরো গানটা শেষ করে চোখ বন্ধ করে হাত পাতে চকলেটের জন্য। আমার তো তখন মেজাজ ফর্টি ফাইভ। বাংলা একটা ছড়া বলতে পারে না, দশবার আটকে যায়, কি অনায়াসে একটা পুরো হিন্দি গান একটুও না থেমে গেয়ে গেলো। চকলেটের বদলে দিলাম একটা গাট্টা। চোখ খুলে পরিস্থিতি বুঝে, শুরু করে দিলো ভ্যা এ এ এ। আপু ছুটে আসলো। কি হলো। আপু জানে আমি বাচ্চাদের গায়ে সহজে হাত তুলি না। আমি বললাম- একটা গাট্টা দিয়েছি তাই কাদঁছে। বাংলা ছড়া বলতে পারে না হিন্দি গান শোনায়। আপু বলে- ডিশ দেখে দেখে শিখেছে। ওর কি দোষ বল? আমার মেজাজ তখন চরম খারাপ। আমি দরোজার দিকে পা বাড়াই। আর বলি- আসলেই ওর কোন দোষ নাই। আমারই ভুল হয়েছে। গাট্টাটা ওকে না মেরে তোমাকে মারা দরকার ছিলো। আপু অপলক আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি একটুও পিছনে না তাকিয়ে তরতর করে সিড়ি দিয়ে নেমে যাই। কোন এক ফ্ল্যাটে গান চলছে- তু চিজ বড়ি হ্যায় মাস্তে মাস্তে . . .

** প্রথম প্রকাশ : হাজারদুয়ারী


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

কালকে রাতে হাজারদুয়ারীতে পড়লাম।
চমৎকার লেখাটির জন্য আপনাকে জাঝা চোখ টিপি
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

তারেক এর ছবি

জাঝা
ঝরাদা, আপ চিজ বড়ি হ্যায় মাস্তে মাস্তে . . .
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

নজমুল আলবাব এর ছবি

চমৎকার। আসলেই বইনরেই একটা গাট্টা দেয়া দরকার ছিল।

ঝরাপাতা এর ছবি

এই উত্তম ঝাজা দেয় ক্যামনে? আলবাব ভাই একটু কন না আমিও মন্তব্যের জন্য উত্তম ঝাজা দেয়।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নজমুল আলবাব এর ছবি

বাননাটা ঠিক করে লিখলেই জাঝা হয়ে যেত ডিয়ার ফলেন হাসি অক্ষরগুলা আগপিছ করেন

ঝরাপাতা এর ছবি

ধন্যবাদ আলবাব ভাইজান। অবশেষে আমি ফারছি। দেশে থাকলে খেক দিয়ে খোক খাওয়ায়তাম।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

জাঝা আর শ্রদ্ধা
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

শামীম এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো। চলুক
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

ফারুক হাসান এর ছবি

জাঝা

-----------------------
এই বেশ ভাল আছি

অপালা এর ছবি

আমার পোলাটা যে কি বান্দর হ্ইতাছে তা আল্লাহ মালুম। তবে এখন ও হিন্দি বলা শুরু করে নাই, তাবে দিবে, ঠেকায়ে রাখা যাবে না হয়তো।নিজের বাসায় না শুনলেই বা কি, যেখানে যায় সেখানে ই তো এখই অবস্থা।হিন্দি সিরিয়াল। আমি বুঝি না মানুষ এই আজগুবি সব জিনিস দেখে কি করে?

ঝরাপাতা এর ছবি

হায় হায়, পোস্টতো জাঝা -ময় হইয়া গেলো। ধন্যবাদ সবাইকে।

আবারো জাঝা।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

অমিত এর ছবি

পোলাপান কালে যেগুলা বান্দর থাকে, বড় হওয়ার পর দেখসি পুরা উল্টা হয়ে যায়। বুয়েটে পড়ার সময় আমি থাকতাম আমার বড়খালার সংগে। বুশ তেল দেখলে যেমন করে, বোনের পিচ্চিটার আমার জিনিসপত্রের উপর ছিল সেরম লোভ।এখন খারাপই লাগে ঐ বকাঝকাগুলা মনে হওয়ায়।
লেখার জন্য উত্তম জাঝা। (শিশু কবি জারীর এর জাতিকে দেওয়ার অনেক কিছু ছিল)

______ ____________________
suspended animation...

ঝরাপাতা এর ছবি

আমার ভাগ্নের বয়স এখন দুই বছর। তার জন্মের কিছুদিনের মধ্যে সুইডেনে চলে আসি। এখন ফোনে মামা মামা করে। আপা বলে, ভীষণ রকমের দুষ্ট হয়েছে। সেপ্টেম্বরে দেখা হবে ভাগ্নের সাথে।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।