কোপার্নিকাসের দেশে-০১

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১৩/০৩/২০১৫ - ৫:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


মে মাসের এক পড়ন্ত দুপুরে ড্রিমলাইনারের পেট থেকে বেরিয়ে ওয়ারশর শপ্যা বিমানবন্দরে পা রাখতেই দেখি চারদিক ছাপিয়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। শপ্যা এয়ারপোর্টটি ইউরোপ আমেরিকার অন্যান্য প্রধান বিমানবন্দরগুলোর মতো বিশাল না হলেও বেশ নান্দনিক আর ছিমছাম। পোল্যান্ডে এসেছি সপ্তাহ দুয়েকের জন্যে। উদ্দেশ্য পোল্যান্ড আর তার আশেপাশের সাবেক সমাজতন্ত্রী আরও কয়েকটি দেশ একটু ঘুরে ফিরে দেখা। আশির দশকের শেষ ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় তাসের ঘরের মতো সমাজতন্ত্রের পতন সম্পর্কে সেসময় পত্রিকান্তরে নানা ব্যবচ্ছেদ মূলক লেখা আসতো, সেরকমই কোনও লেখায় লেখায় মাঝেই মাঝেই চোখে পরত “ওয়ারশ প্যাক্ট” এর নাম। তখনো জানতাম না এই নামকরণের উৎসস্থল কোথায় আর এই প্যাক্ট ই বা কি। একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করাতে বাবা কপট রাগ করে বলছিলেন, “তুমি এসব রাজনৈতিক লেখা এ বয়সে পড়ো কেন?”, তারপর হেসে বুঝিয়ে বলেছিলেন সহজ কথায় যতটুকু বোঝান যায়। ছেলেবেলায় ছাপার অক্ষর থেকে স্মৃতির কোষে জায়গা নেয়া সে শহর আজ জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ধরা দিল।

এ বিমানবন্দরের যাত্রীদের তেমন কোন তাড়া আছে বলে মনে হলনা, সবার মাঝেই বেশ এক ঢিলেঢালা ভাব। আমারও যে তেমন তাড়া আছে তা নয়। আমিও তাই প্লেন থেকে নেমে একটু ধীর লয়েই গিয়ে দাঁড়ালাম অভিবাসন কাউন্টারের সামনে। আমার সামনের কয়েক জন বেশ টপাটপ পাসপোর্ট দেখিয়ে সিল নিয়ে গেলো। শুধুমাত্র আমার বেলাতেই কেবল অফিসার মহিলার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। পাসপোর্টের সবগুলো পাতা উল্টে-পাল্টে বলল তোমার সব হোটেলে থাকার কাগজ দেখাও। দেখালাম। তদুপরিও তার মনের সন্দেহ দূর হয়না। অবশেষে তাকে আমার ফিরতি ফ্লাইটের কাগজপত্র দেখিয়েই তবে পাসপোর্টে একখানা সিল আদায় করলাম।

“এক মালী-দু’ ফুল” এই সন্নিবেশে প্লেনের টিকেট কোনও কালে পেয়েছি বলে মনে পড়েনা, তবে এবার কেমন করে যেন সেটিই ঘটে গিয়েছিলো। শিকাগো থেকে ওয়ারশ পর্যন্ত ফ্লাইটে আমার এক ধারে বসেছে টেনিসির মেয়ে কেলি আর অন্য ধারে ইউক্রেনের মেয়ে মুনা। কেলি যাচ্ছে ওয়ারশ হয়ে মস্কো, ও ওখানে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমেরিকার মতো দেশ, যেখানে প্রায় প্রতি পঞ্চাশ মাইলে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সে দেশের মেয়ে এই হাজার মাইল দূরে মস্কোয় যাচ্ছে পড়াশোনা করতে এতে অবাক না হয়ে পারলাম না। সে প্রশ্ন ওকে করতে ও হেসে উত্তর দিল, “সেই পঞ্চাশ মাইল দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যদি মুঠো-মুঠো টাকা লাগে আর সেই হাজার মাইল দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনে পয়সায় পড়া যায় আর ওদিকে তোমার পকেট হয় আধুলিশুন্য, তাহলে তুমিই বা কোনটা বেছে নেবে?”। হুম, তা একটা যুক্তি বটে। ওদিকে ওপাশের মুনার গল্পটা একটু অন্য রকমের। উত্তর ইউক্রেনের এক ছোট্ট শহরের মেয়ে মুনা বছর সাতেক আগে বা-মামার হাত ধরে নতুন আশা আর নতুন স্বপ্ন নিয়ে থিতু হয়েছে নতুন দেশ আমেরিকায়, কিন্তু আজও তার মন পড়ে থেকে সেই ছোট্ট শহরেই। গ্রীষ্মের ছুটিতে তাই সে যাচ্ছে দাদু-দিদিমার সাথে দেখা করতে। আমেরিকায় এখন ওর কেমন লাগে জিজ্ঞেস করাতে একটু বিষণ্ণ আর উদাস হয়ে ও তাকায় জানালার পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘের পালের দিকে, কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলে, “ঠিক ভালো লাগে কিনা জানিনা, তবে আমেরিকার জীবন স্বস্তিদায়ক তো বটেই। এ দেশে নিস্তরঙ্গ ভাবনাহীন জীবন আছে, আছে চাকচিক্য, নেই শুধু আমার ফেলে আসা খুড়িমা, দাদু, দিদা, আর পরিবারের অন্যরা। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি ওদের সবাইকে এ দেশে নিয়ে আসতে পারতাম তবে হয়তো পরিপূর্ণ আনন্দ পেতাম। নাহ… হয়তো ভুল বললাম। তবুও একটা জিনিসের জন্যে হয়তো আমার আক্ষেপ থাকতই থাকত, আর তা হল ইউক্রেনের আকাশ। শিকাগোর আকাশের মাঝে আমি আজও আমার সেই ছোট্ট শহরের আকাশকেই খুঁজে বেড়াই”। কথার মোড় একটু অন্য দিকে ঘোরাবার জন্য ওকে জিগ্যেস করলাম ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। তার ঠিক আগের মাসেই রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ছিনিয়ে নিয়েছে, পূর্ব ইউক্রেন নিয়েও সে সময় রাশিয়া-ইউক্রেন বিরোধ চরমে। আর অনেকটা সেই সময়েই ইউক্রেনের জনতা দুর্নীতিবাজ রাশিয়াপন্থী ইয়াকুনভিচকে হটিয়ে নতুন সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে অনেক আগে থেকেই আমার মাথায় যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছিল তা হল যে কমলা বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিমাপন্থী তিমশেঙ্ক আর ইউশেঙ্ককে জনতা ক্ষমতায় এনেছিল, সে একই জনতা পাঁচ বছর পর কি করে মস্কো-পন্থী ইয়ানুকভিচকে ক্ষমতায় আনল। মুনা তো আর কোনও বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্লেষক নয়, এক সাধারণ পরিবারের সাধারণ মেয়ে সে। ওর সাধারণ ভাষাতেই ও আমাকে যা বলল, তা হল, “আসলে আমরা... বলতে পারো এক অভাগা জাতি, সোভিয়েত সময়ে আমরা তো স্বাধীন ছিলাম না বটেই, নব্বই এ স্বাধীনতা পাবার পরও যে আমরা পূর্ণ মুক্ত তেমনটি ভাবা হয়তো ভুল হবে। এখনও মস্কোপন্থী রাজনৈতিক, সৈনিক, গোয়েন্দাদের বিচরণ অনেক ক্ষেত্রে, আর এই গোষ্ঠীটিই পশ্চিমাপন্থীদের খুব সহজে সফল হতে দেয়না বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। এই নাগপাশ ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসা ইউক্রেনের পক্ষে যে কবে সম্ভব হবে সেটা একমাত্র হয়তো ঈশ্বরই জানেন”। আসলেই রাশিয়ার মতো এমন একটি বৃহৎ কর্তৃত্ববাদী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে টক্কর দেয়াটা সহজ নয় মোটেও, মুনার হতাশা আর মর্মবেদনার উৎসস্থল যে কোথায় সেটা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়না। আমার সেই অভিবাসন অফিসারের সব সন্দেহ দূর করে বেড়িয়ে আসতে আসতে মুনা আর কেলিকে শেষ বিদায়টি আর বলা হলনা, কারণ ওরা ততোক্ষণে ওদের পরের ফ্লাইটের পথে।

ঝুম বৃষ্টির মাঝেই চপিন থেকে বেড়িয়ে পুরনো শহরে যাবার বাস ধরলাম, আমার আপাতত নিবাস সেখানকারই এক হোস্টেল। এই পুরনো শহরটিকেই ওয়ারশর মূল প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জার্মান বাহিনীর আক্রোশে পুরো এই পুরনো শহরটিই প্রায় ধুলোয় মিশে যায় গোলার আঘাতে। তারপর পোলিশদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিল তিল করে আবারো সেই হারানো চেহারা ফিরে পায় এই শহর।

হোস্টেল খুঁজতে গিয়ে হল এক বিপত্তি। হাতের ম্যাপ যে জায়গা নির্দেশ করে সেখানে পৌঁছে দেখি হলদে চুনকাম করা এক ভবনের খিড়কী দরজার ওপরে দৃষ্টিগোচর-পূর্ণ জায়গায় লেখা “নো হোস্টেল”, ওদিকে সেটিকে ঠিক হোস্টেল নয় বরং বসত বাড়ি বলেই মনে হয় বাইরে থেকে। তাই আমি ভাবলাম হয়তো আমার মতো আরও অনেকে ভুল ঠিকানায় এসে নিশ্চয়ই কড়া নাড়ে এ বাড়িতে, আর তাই হয়তো বাড়ির মালিক বিরক্ত হয়ে লিখে রেখেছে “নো হোস্টেল”। আমিও বেকুব বটে। ওদিকে আমার খেয়ালই নেই আমার যে হোস্টেলে উঠবার কথা তার নাম “ক্যা-নো-নিয়া হোস্টেল”। সেকথা খেয়াল হতেই দেখি আসলে “নো” এর দু পাশে একটু নিচে লেখা “ক্যা” এবং “নিয়া”, অর্থাৎ “নো” এবং “হোস্টেল” একই সমান্তরালে আর বাকি শব্দদুটি ভিন্ন লাইনে। আর তাই আমার দৃষ্টি ও দুটোকে না ধরে কেবল গোচরীভূত করেছে “নো” আর হোস্টেল” কে। বোঝো ঠ্যালা।

হোস্টেলের পাওনা মিটিয়ে, নিবন্ধন খাতায় সই-সাবুদ করে উপরে উঠে নিজের ঘরে ঢোকামাত্রই বুঝলাম রাজ্যের ঘুম এসে তেড়ে ধরেছে আমাকে। কিন্তু তার আগে বরং একটা উষ্ণ গরম জলের স্নান হয়ে যাক। গত ন’ বছর মার্কিন মুল্লুকে থেকে অবস্থা এমন হয়েছে যে এখন কোনও হোটেল-হোস্টেলে গেলে অবধারিতভাবেই সাবান, শ্যাম্পু আর তোয়ালে এই তিনটে বস্তু সাথে করে নেবার প্রয়োজন বোধ করিনা, কারণ জানি হোটেলের স্নানাগারে ওগুলো মিলবে অবশ্যই। কিন্তু ভাগ্যিস ওই তালিকার তৃতীয় বস্তুটি বুদ্ধি করে এ যাত্রায় নিয়ে এসেছিলাম, নতুবা হোস্টেলের ‘কমন’ স্নানাগারে ঢুকে স্নান শেষ হবার পর পরতাম মহা লজ্জায়। কারণ এ হোস্টেলে যতটুকু বুঝলাম, ওই বিনে পয়সার বাড়তি জিনিসের চল নেই।

সেদিনের বিকেলটি ছিল অনেকটা যেন বাংলাদেশের বর্ষার বিকেলগুলোর মতো, যে বিকেলে হলুদাভ আকাশ মুখ ভার করে অপেক্ষায় থাকে ক্ষণিকের বৃষ্টির। কেমন যেন বিষণ্ণ আর অবসাদময় লাগে সেসব বিকেলে। ছোট একটা ঘুম থেকে উঠে একটু সতেজ হয়ে সদর-দরজার বাইরে সবে মাত্র পা রেখেছি এমন সময় দেখি এ পাড়ার কালচে ইট বিছানো পথ ধরে খট-খটিয়ে চলেছে এক ঘোড়ার শকট। মনে হল যেন ধাই করে ঢুকে গেছি “দ্যা পিয়ানিস্ট” সিনেমার কোনও দৃশ্যে। সেখানেই চমকের শেষ নয়। হোস্টেল থেকে বেড়িয়ে বামের পথ ধরেছি, এমন সময় পেছনে তাকিয়ে মনে হল ঠিক এই পথ, আর তার দু’পাশের মলিন বাড়িগুলো আগে যেন কোথায় দেখেছি। আমার সেই মনে হবার কারণও কিন্তু ছিল সেই “পিয়ানিস্ট” সিনেমা, ওই সিনেমার কিছু কিছু দৃশ্যের চিত্রায়ন আসলে হয়েছিলো এ পাড়াতেই।

সে বিকেলে নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা নেই আমার, তাই ভাবলাম বাসে করে একটু আশপাশটা ঘুরে দেখলে কেমন হয়? বাস-স্ট্যান্ড খুব কাছেই, সেখানে পৌঁছে দেখি একটি বাস অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে আমিও জানিনা কত নম্বর বাসে কোথায়ই বা আমি যাব। হটাৎ মনে হল বাস চালককেই জিজ্ঞাসা করে দেখিনা কোনও পরামর্শ পাওয়া যায় কিনা। ওয়ারশ শহরের সব বাস চালকেরই পরনের পোশাক এক, গাঢ় নীল রঙের শার্ট আর সাথে নীল প্যান্ট। বেশ-ভূষণে এরা বেশ ফিটফাট। আমার ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, যে চালককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি তো বলতে পারেনই , উপরন্তু পরোপকারীও বটে। সীমিত ইংরেজি দিয়েই আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কোথায় কোথায় আমি যেতে পারি, আর কত কত নম্বর বাসই বা আমাকে ধরতে হবে। একই রকম উপকার এর আগেও পেয়েছিলাম বিমানবন্দরের এক পুলিশের কাছ থেকে। “কান্তুর” কোথায় জিজ্ঞেস করাতে যেচে আমাকে বলেছিল, “এখান থেকে যতটুকু না ভাঙালেই নয় ততটুকুই ভাঙাও, বাকিটুকু শহরে গিয়ে ভাঙ্গিও, এখানে কিন্তু তোমাকে অনেক কম যলতি দেবে ডলারের বিপরীতে”। ‘কান্তুর’ হল পোলিশ ভাষায় মুদ্রা পরিবর্তনের স্থান আর ‘যলটি’ হল পোল্যান্ডের মুদ্রা। এই ভালো মানুষগুলো এই দেশ সম্পর্কে আমার ভালোলাগাটিকে নিঃসন্দেহে আরও বাড়িয়ে তুলল।

পরদিন আমার যাবার কথা ক্রাকভ শহরে, সাত সকালেই হাজির হলাম “সেন্ত্রালিনায়”। সেন্ত্রালিনা ওয়ারশ শহরের প্রধান বাস এবং ট্রেন ষ্টেশন। অধুনা আধুনিকিকরণের রঙ লেগেছে এই ষ্টেশনে। দূর থেকে এই ঝাঁ-চকচকে নীল কাঁচের ইমারতকে ষ্টেশন মনে না হয়ে মনে হয় কোনও বিপণি-বিতান। আসলে শুধু এই ষ্টেশন নয় গোটা ওয়ারশ শহরেরে খোল-নলচেই পালটে গেছে গত বিশ বছরে। পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশগুলোর তুলনায় পোল্যান্ডের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে বেশ মজবুতই বলা চলে। এ শহরের পরিপাটি মসৃণ পিচ-ঢালা রাস্তাঘাট, গগনচুম্বী ইমারত, মনোহরি দোকানের উপচে পরা দ্রব্যাদি দেখে আমার মন বারবারই প্রশ্ন করছিলো, তবে যে কালিকাকা বললেন...?

কালিকাকা, অর্থাৎ প্রখ্যাত চিত্রকর কালিদাস কর্মকার তার মেয়ে কঙ্কাদির সাথে প্রতি বছরই বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে যান আমেরিকায় আমি যে শহরে থাকি সে শহরেই। আর কালিকাকা মানেই হল অফুরন্ত গল্পের সমাহার। জাপান থেকে জার্মানি, ইরান থেকে ইন্দোনেশিয়া কোথাকার গল্প নেই তার ঝুলিতে? পোল্যান্ডে যাব শুনে এক আড্ডায় হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতে দিতে তিনি বলছিলেন তার কিছু স্মৃতিকথা। সত্তরের দশকে একটা বৃত্তি নিয়ে তিনি বছর চারেক কাটিয়ে গেছেন পোল্যান্ডে। সেটাই শেষ নয়। আশির দশকের মাঝামাঝিতে যখন কঙ্কাদি আবার চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে পোল্যান্ডে, কাকা তখন প্যারিসে। সে সময়ে প্রায়ই পূর্ব জার্মানি হয়ে ট্রেনে পোল্যান্ডে আসতেন মেয়েকে দেখতে, আর অবধারিত ভাবেই হাতে থাকত মেয়ের জন্যে নেয়া নানা উপহারসামগ্রি। একবার ক্রিসমাসের ছুটিতে তিনি পোল্যান্ড গেছেন কঙ্কাদির জন্যে বেশ কিছু ফল-মূল নিয়ে। ট্রেন পূর্ব জার্মানি থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশ করা মাত্র শুল্ক কর্মকর্তারা তাকে আটকাল, নাকি ফল-মূল নিয়ে পোল্যান্ডে প্রবেশ করা যাবেনা। ওদিকে কালিকাকাও নাছোড়বান্দা, এতটা কষ্ট করে মেয়ের জন্যে ফল-মূল নিয়ে এসেছেন কি জলে ফেলবার জন্যে? এমন সময় একজন শুল্ক কর্মকর্তা তার কাছে এসে চুপি-চুপি বলল, “ইয়ে মানে তোমার ওই কলার কাঁদি থেকে আমাকে চারটে কলা দেবে? না না আমার নিজের জন্যে নয়, চাইছি আমার মেয়ের জন্যে। ও কখনো টেলিভিশনের পর্দার বাইরে আসল কলা দেখেনি, ওই কলাগুলো বাড়ি নিয়ে আজ ওকে চমকে দিতে চাই। বাকি ফল-মূল তুমি নিয়ে যাও, আমি আর আটকাবনা”। এই গল্পটি বলে কালিকাকা বলছিলেন সমাজতন্ত্রের অন্তিম মুহূর্তে পোল্যান্ডের ভগ্নপ্রায় অর্থনীতির কথা, যা থেকে উদ্ভূত হতাশাই হয়তো পরবর্তীতে জন্ম দেয় “সলিডারিটি মুভমেন্টের“। তবে কালিকাকার দেখা সেই আশির দশকের পোল্যান্ড গত দু’ দশকে পালটে গেছে অনেক, এখনকার পোল্যান্ডে অন্তত পকেটে ‘যলটি’ থাকলে পছন্দের জিনিসটি দোকান থেকে কিনে বাড়ি ফেরা সম্ভব।

একটু ভয় ছিল ট্রেনের টিকেট পাব কিনা শেষ মুহূর্তে ষ্টেশনে এসে। কিন্তু না, টিকেট তো পেলামই, উপরন্তু ট্রেনে উঠে দেখি কামরার প্রায় পুরোটাই খালি। কেনার সময় প্রথম শ্রেণীর টিকেট কিনেছিলাম কিনা জানিনা, কিন্তু উঠে দেখলাম আমার বসার স্থান কাঁচের দরজা দেয়া এক কুপের ভেতর। প্রশস্ত জানালার ওপারে ততোক্ষণে আমাদের ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে লিন্ডেন, পাইন, ওক, বার্চ আর কত নাম না জানা বৃক্ষের বন। বেশ মজা পেলাম যখন আবিষ্কার করলাম এ টিকেটের সাথে এক কাপ কফি আর একখানা বিস্কুটের প্যাকেটও সংযুক্ত। অয়ারশ থেকে ক্রাকভ ট্রেনে ঘণ্টা তিনেকের পথ। আর তাই সকালের মিষ্টি রোদ ফুড়োতে না ফুড়োতেই আমাদের ট্রেন গুটিসুটি মেরে ঢুকল ক্রাকভ ষ্টেশনে।

সত্যি বলতে কি, ক্রাকভ ষ্টেশনে নেমে কিছুটা যেন বিষমই খেলাম, কারণ নিজের চিন্তার অন্তর্জালে যে ক্রাকভের চিত্র এঁকে রেখেছিলাম এ শহরে আসবার আগে, তার সাথে এই ষ্টেশনটির কোথায় যেন বড় ধরণের অমিল। আমার চিন্তার সে চিত্রে নিশ্চয়ই এমন বাজার অর্থনীতির আশীর্বাদপ্রাপ্ত আধুনিকতার মোড়কে ভরা প্ল্যাটফর্ম ছিলনা। সে যাকগে, কত ভাবনাই তো বাস্তবতার সাথে না মিলে এগিয়ে চলে রেল লাইনের সমান্তরাল পাতের মতো, ভাবনার সাথে বাস্তবতাকে মেলাবার চেষ্টা করাটাই হয়তো ভুল।

আগেই জানা ছিল আমার হোটেল এই ষ্টেশন থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তাই ভাবলাম আর ট্রাম-ট্যাক্সি না ধরে হেঁটে হেঁটেই চলে যাব হোটেলে। আর এই হাঁটা পথেই ঘটল আমার পোল্যান্ড আগমনের প্রথম বিপত্তি। কিছুটা পথ হেঁটে একটু জিরোবার জন্য দাঁড়ালাম, এমন সময় বুক পকেটের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার চশমা উধাও। চোখে আলাদা রোদ-চশমা থাকায় আমার দূর-দৃষ্টির অক্ষমতা মেটানো ওই চশমাটির প্রয়োজন এতক্ষণ বোধ করিনি, আর এর মাঝেই ওটি কখন যেন ভূপাতিত হয়েছে আমার অজ্ঞাতসারে। আশেপাশে অনেক খুঁজেও আর তার হদিস পেলাম না, মনে মনে তাও স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে আমি কখনই দুটি চশমা নিয়ে কোথাও ভ্রমণে যাইনা, সে আমি কি ভেবে যেন শেষ মুহূর্তে দ্বিতীয় চশমাটি ব্যাগে পুরেছিলাম।

আবারো সেই হোটেল খোঁজা নিয়ে বিপত্তি। আমার কি দোষ? আমার মার্কিন মুল্লুকের অভ্যস্ত চোখ কেবলই হোটেলের বড় সাইন বোর্ড খোঁজে। কিন্তু এ ক’দিনে বুঝে গেছি ওভাবে এ দেশে হোটেল খুঁজলে বিপত্তি। আমার এবারকার হোটেলটিও খুঁজে পেলাম কিছুটা মেহনত করে, আসলে কষ্টটা কিছুটা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন বগুড়ার মামুন ভাই, এই হোটেলের ঠিক নিচেই তার বিরিয়ানির রেস্তোরাঁ। ক্রাকভের মতো শহরেও যে বাংলাদেশীরা আছেন জানতাম না। বন্ধ সদর দরজার ডানে হোটেলের নাম লেখা ইন্টারকমের বোতাম টেপার পর ওপাশ থেকে বলা হল দরজা খুলে দিচ্ছি, চার তলায় উঠে এসো। মানে কি? ওদিকে আবার সে বাড়িতে ওপরে যাবার কোনও চলন্ত কামরাও নেই। নিজের ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠবার সময় মনে হল যেন অনন্তকাল ধরে কেবল সিঁড়ি ভেঙ্গেই চলেছি। বাইরে থেকে সাবেকি আমলের এলেবেলে বসতবাড়ি মনে হলেও হোটেলের ভেতরটা বেশ পরিপাটি ঘরোয়া ঢঙ্গে সাজানো। যদিও তেমন বড় নয় হোটেলটি, চারতলার গুটিকয়েক কামরা নিয়ে এটিকে সাজানো হয়েছে। অভ্যর্থনা কক্ষের মেয়েটির কাছ থেকে ঘরের চাবি বুঝে নিচ্ছি, এমন সময় আমার পেছন থেকে কে যেন মেয়েটিকে বলল, “আচ্ছা আমি কি এভাবে বাইরে বেরুলে গ্রেপ্তার হতে পারি?” ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি নির্বিকার মুখে নিম্নাঙ্গে শুধু একখানা অন্তর্বাস পরে খ্যাপাটে চেহারার এক ফরাসি যুবক দাঁড়িয়ে আছে। বেচারার সাধ হয়েছে এভাবেই মধ্য শহরে ঘুরতে যাবার। বুঝলাম, বেশ বিব্রত হয়েছে মেয়েটি। স্মিত হেসে বলল, “সে চেষ্টা মনে হয় না করাই ভালো“। বেশ অপ্রসন্ন মনে গজর গজর করতে করতে ছেলেটি ফিরে গেলো নিজের কক্ষে। সে হয়তোবা ভেবেছিলো তার নিজের দেশের মতোই পোল্যান্ডও সামাজিক ভাবে উদার। পোল্যান্ড কিন্তু এখনও সামাজিক এবং ধর্মীয় দিক দিয়ে বেশ রক্ষণশীল দেশ। ক্যাথলিক যাজকদের জোরালো প্রভাব এখনও সমাজের একটা বড় অংশ জুড়ে। অন্য আর সব প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক দেশের সাথে পোল্যান্ডের একটা বড় পার্থক্য এখানেই। এমনকি সমাজতন্ত্র বলবত থাকার সময়েও পার্টির অনেক বড় বড় নেতারা চুপি চুপি সমবেত হতেন গির্জার রবি-বাসরীয় প্রার্থনায়। আশেপাশের অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতারা পোলিশ কমিউনিস্ট নেতাদের এই ধর্ম-ঘেঁষা আচরণ নিয়ে হাসি তামাশা করতেন। কমিউনিস্ট সময়ে তাই এই ক্যাথলিক গির্জাই ছিল সরকারের একমাত্র এবং সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। পোলিশ সমাজের সাথে গির্জার যোগাযোগ ছিল বরাবরই বেশ দৃঢ়, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই দেশের রেখাচিত্রে এমন কিছু পরিবর্তন আনে যার ফলে সমাজের সাথে চার্চের বন্ধন আরও মজবুত হয় পরবর্তী দশকগুলোতে। সে পরিবর্তন সম্পর্কে বলতে গেলে শুরু করতে হবে উত্তর পোল্যান্ডের বালটিক সাগর পাড়ের এক বন্দর-শহর যিদান্সককে দিয়ে। গত শতাব্দীতে আধুনিক যন্ত্র-যুদ্ধের প্রারম্ভটা হয়েছিলো এই শহরটিকে কেন্দ্র করেই। শহরের বাসিন্দারা ছিল মূলত জার্মান, যদিও মূল জার্মানির সাথে এই শহরের কোনও সীমানা নেই। যুদ্ধের ফন্দি আঁটা হিটলার দাবি করে বসলেন পোল্যান্ডকে এ শহর আর জার্মানির মধ্যে যাতায়াতের এক করিডোর জার্মানির হাতে তুলে দিতে হবে বিনা শর্তে । এই হুমকির কদিন পরই ভোরের আবছা কুয়াশা ঢাকা এক সকালে যিদান্সক বন্দরের অদূরে দাঁড়ানো জার্মান সমর-পোতগুলো থেকে সারি সারি কামান গর্জে ওঠে। দিনপঞ্জির পাতায় সেদিনটি ছিল ৩৯’ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর। সেটাই শুরু। এরপর জার্মান বাহিনী বিদ্যুৎ-গতিতে মাত্র ১৭ দিনে পুরো পোল্যান্ড দখল করে নেয় আর সেই সাথে শুরু হয় পৃথিবী জুড়ে ছ’ বছর-ব্যাপী নরমেধ যজ্ঞের। যুদ্ধের পর সেই ক্ষোভ থেকেই এই শহর থেকে আদি জার্মানদের বিতাড়িত করা হয়, আক্ষরিক অর্থেই জার্মানদের একেবারে নাম নিশানা মুছে ফেলা হয় এ শহর থেকে। ওদিকে যুদ্ধের আগে যে পোল্যান্ড ছিল ইহুদীদের অন্যতম বৃহৎ আবাস-স্থল, যুদ্ধ তাদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলে পোল্যান্ড থেকে। পোল্যান্ডের তৃতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টি ছিল পূবের ইউক্রেনিয়রা। কিন্তু যুদ্ধের পরের ভাগবাটোয়ারায় ওই অংশটি গিয়ে পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনে। যার ফলে যুদ্ধের পর যে পোল্যান্ডের উদ্ভব হয় তা যেন শুধুই ক্যাথলিক পোলিশদের, জাতিগত আর ধর্মীয় বৈচিত্র্য ধ্বংস হবার ফলে জনগণের চার্চমুখীতা আরও বেগবান হয়। তো যে দেশে ধর্মের অবস্থান এতো সুদৃঢ় সে দেশের রাজনীতির সাথে ধর্মের সংযোগটা এখন কেমন, সে কথা একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম হাঙ্গেরি থেকে ট্রেনে পোল্যান্ডে ফিরবার পথে সহযাত্রীকে। তার কাছ থেকে জানলাম এখনকার পোলিশ রাজনীতির কিছু হাল-নাগাদ খবর। বছর চারেক আগে রাশিয়ার এক বনে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে যখন প্রেসিডেন্ট কাযিনিস্কি নিহত হন, তখন আমার ধারণা ছিল তার পরে হয়তো সহানুভূতি ভোটে তার পার্টিই ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে সেই আগাম নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছিলো তখনকার বিরোধী দল। কাযিনিস্কির “আইন ও বিচার” পার্টির নেতৃত্বে এখন তারই সহোদর ভাই। কাযিনিস্কি এবং তার ভাইয়ের রাজনীতি মূলত সোভিয়েত বিরোধিতা এবং ক্যাথলিক গ্রুপের সাথে নিবিড় যোগাযোগকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এই দুটি বিষয়কেই কাযিনিস্কির সহোদর আবারো সামনে নিয়ে আসতে চাইছেন পরবর্তী নির্বাচনের বৈতরণী পার হবার জন্য। যদিও জানতে পেলাম তরুণ প্রজন্ম এসবের চেয়ে মূলত করের বোঝা, বেকারত্ব, সামগ্রিক অর্থনীতি এসবের ভিত্তিতেই তাদের সমর্থন প্রদানে আগ্রহী।

ভিলপোল স্ট্রীটের একেবারে শেষ প্রান্তে আমার হোস্টেল, হেঁটে হেঁটে সড়কের মাথায় পৌঁছে ট্রামের জন্যে অপেক্ষা করছি। খেয়াল করলাম শুধু আমিই নই, এই ভর দুপুরে বই-খাতা হাতে আরও এক দঙ্গল তরুণ তরুণী অপেক্ষা করছে ট্রাম ষ্টেশনে। তবে কি আশেপাশেই কোনও বিদ্যাপীঠ আছে? হ্যাঁ আছে, জাগিলন্সকি বিশ্ববিদ্যালয় ভিলপল স্ট্রীটের খুব কাছেই। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য আমার জানা ছিলনা, সেটা জেনেছি ক্রাকভ থেকে ফিরবার পরে ওই কালিকাকার কাছ থেকেই। আর তা হল এটি ইউরোপের তো বটেই, সারা পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম, আর এই বিদ্যাপীঠেই পড়ে গেছেন কোপার্নিকাসের মতো অনেক মনিষী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী।

আমার এখনের গন্তব্য শিন্দলার সাহেবের কারখানায়। ভিলপোল স্ট্রীট থেকে মাইল তিনেক দূরে এই কারখানা, ষোল নাম্বার ট্রামে চড়ে দিব্যি চলে যাওয়া যায়। ওয়ারশতে দেখেছিলাম বাসে চেপে চালকের কাছ থেকেই টিকেট নেয়া যায়, অথবা বাস-ট্রামের ভেতরেও টিকেট কাটবার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র থাকে। আমি ট্রাম ষ্টেশনে দাঁড়াতেই আমার কাঙ্ক্ষিত ট্রামটি চলে এলো, আর আমিও ভাবলাম ভেতরে তো টিকেট কেনা যাবেই, তবে আর ভাবনা কি? উঠে পড়লাম ট্রামের দ্বিতীয় কামরায়। আর এই ট্রামেই ঘটল আমার ক্রাকভ আসার পর দ্বিতীয় বিপত্তি। ইতি-উতি খুঁজেও আমি টিকেট কাটবার কোনও যন্ত্র খুঁজে পেলাম না, পাব কিভাবে? ওয়ারশ শহরের ট্রামগুলোর মতো এ ট্রামগুলো যে ততটা আধুনিক নয়, এখানে এখনও চলে সেই সোভিয়েত আমলের ঢিমেতালে চলা ট্রাম। ওদিকে আমি উঠেছি দ্বিতীয় কামরায়, তাই চালককেও যে জিজ্ঞেস করবো সে উপায়ও বন্ধ। বেশ বিপদেই পরা গেলো। এখানে ট্রামগুলো বেশ স্বল্প দূরত্বে থামে, নেমে যাব কিনা ভাবছি, এমন সময়ই পরের ষ্টেশন থেকেই উঠল টিকেট চেকার, পরবর্তী কাহিনীটা সহজেই অনুমেয়। তবে সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলাম ওই বিশ্ববিদ্যালয়-ফেরত এক তরুণের জন্যেই, সে খেয়াল করেছিল আমি ট্রামে উঠেই টিকেট কাটবার যন্ত্র খুঁজছি, সেই টিকেট চেকারকে পোলিশ ভাষায় বুঝিয়ে নিরস্ত করে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলো। সেই তরুণটিই আমাকে জানাল ক্রাকভ শহরের ট্রামে উঠতে গেলে টিকেট কাটার একমাত্র উপায় হল ট্রাম স্টেশনের পাশের ছোট্ট টিকেট মেশিন, ট্রামে ওঠার আগেই যেখান থেকে টিকেট কেটে তবেই চাপা যায় ট্রামে।

ছবিঃ ক্রাকভ শহরের কিছু চিত্র

“ডয়েশে এমাইল ভারেন ফাব্রিক” বা সংক্ষেপে “ডি ই এফ” শিন্দলার সাহেবের কারখানার নাম তো এটাই ছিল যতদূর মনে পড়ে, কিন্তু প্রধান ফটকে ঢোকার মাথায় সেই নামটি কোথায় গেলো? শিন্দলারের কারখানায় গিয়ে এই ছিল আমার প্রথম হোঁচট খাওয়া। নব্বই এর দশকে স্পিলবার্গ তার অস্কারজয়ি “শিন্দলার’স লিস্ট” চলচ্চিত্রটি বানাবার পর শিন্দলার সাহেব সম্পর্কে বাইরের পৃথিবীর অনেকেই নতুন করে অনেকেই জানতে পারে, পর্যটকদের অনেকেই এই স্থানটি দেখতে আগ্রহান্বিত হয়। আমাকেও ওই চলচ্চিত্রটিই মূলত এ জাদুঘরে টেনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু একি, কোথায় সেই কারখানার মেশিনগুলো যেগুলো ব্যাবহার করে কিছু হতভাগ্য মানুষ উদয়াস্ত বুলেট থেকে মুক্তির পথ খুঁজত, কোথায়ই বা সেই আদি অঙ্গসজ্জা? কারখানাটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে মাত্র এক যুগ আগে। যুদ্ধের পর পর শিন্দলার চলে যাবার পর এই কারখানাটির হাত বদল হয়, আর তখনি স্মৃতি-বহুল অনেক সামগ্রী হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে যায়। আজকের এই জাদুঘরে তাই শিন্দলার সাহেবের ব্যবহৃত অফিস কক্ষের চেয়ার টেবিল, চেয়ারের পেছনে টানানো বিশাল একখানা ইউরোপের মানচিত্র, সেই কক্ষের লাগোয়া চওড়া সিঁড়ি আর একটি মাত্র মেশিন ছাড়া সেই কারখানা-সংশ্লিষ্ট আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ওদিকে সেই আদি কারখানার আদ্ধেক খানা জায়গা নিয়ে পেছনের দিকে গড়ে উঠেছে একটি পৃথক “সমসাময়িক শিল্পকলা” জাদুঘর। তারপরও এই ভেবে ভালো লাগলো যে পুরো স্থাপনাটিই অন্তত কালের গর্ভে হারিয়ে যায়নি। এই জাদুঘরে আজকাল মূলত প্রদর্শিত হয় ক্রাকভ শহরে নাৎসিদের আগমন, দখলদারিত্ব এবং নিপীড়নের ইতিহাস। কিন্তু মূল শিন্দলার সাহেব ও তিনি কিভাবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন প্রায় হাজার খানেক ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়ে, তা যেন বড্ড অনুপস্থিত। শিন্দলার ক্রাকভে এসেছিলেন ৩৯’ এ জার্মান বাহিনী ক্রাকভ দখলের পর পরই, জার্মান হওয়ায় এই যুদ্ধকালীন পরিত্যক্ত কারখানাটি বুঝে পেতে তার বেগ পেতে হয়নি, তিনি এটিকে রূপান্তরিত করেন এক এনামেল কারখানায়, আর তাতে কাজ দেন পাশের কনসেনট্রেসন ক্যাম্পের বন্দীদের। সে সময় ক্যাম্পের নিপীড়ন থেকে বাঁচা অথবা আরও বেশি প্রাণঘাতী ক্যাম্পে স্থানান্তরিত হবার থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল কোনও জার্মান কারখানায় নিয়োজিত থাকা। শিন্দলার এই সুযোগটিই ব্যাবহার করেন, প্রয়োজনের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি লোকবলের চাহিদা দেখিয়ে তিনি ঠেকিয়ে দেন অনেকের স্থানান্তর আর নিশ্চিত মৃত্যু। আর তাই হয়তো এই কারখানার সামনে এক মর্মর পাথরের ফলকে লেখা, “যিনি একটি প্রাণও বাঁচান, তিনি আসলে বাঁচিয়ে দেন পুরো পৃথিবীকে”।


ছবিঃ “শিন্দলার’স লিস্ট” চলচিত্রের একটি দৃশ্য


ছবিঃ শিন্দলার সাহেবের কারখানার এখনকার বহিঃ অবয়ব

ফেরার পথে ভেবেছিলাম মামুন ভাইয়ের দোকানে কিছু-মিছু খেয়ে এবেলা হোস্টেলে গিয়ে কিছুক্ষণ জিরব, কিন্তু ভিলপোল স্ট্রীট আর ওয়েস্তারপ্লাট স্ট্রীটের তেমাথায় গাঢ় সবুজ রঙে রাঙানো দুটো বিশাল বন্ধ কপাটের জীর্ণ দুটো পেতলের হাতল আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে সে পরিকল্পনা একটু এদিক সেদিক করতে বাধ্য করলো। এটি এ পাড়ার ডাকঘর, আর বাইরে টাঙ্গানো সময়সূচী দেখে জেনে গিয়েছিলাম সেই শনিবার বিকালেও সেটি সেবা দানে প্রস্তুত। শুধু পোল্যান্ড নয়, আশেপাশের দেশগুলোতেও দেখেছিলাম শনিবার তো বটেই, রবিবারেও অর্ধ-দিবস ডাকঘরগুলোর দুয়ার খোলা থাকে। কিছু ডাকটিকেট পকেটস্থ করার আকাঙ্ক্ষায় কাউন্টারের সামনের দু’ তিন জনের পেছনে লাইনে দাঁড়ালাম, এমন সময় আমার চোখ আটকে গেলো ডান ধারের এক ছোট্ট কক্ষে। এক বৃদ্ধা অলস ভঙ্গিতে টেবিলে বসে ম্যাগাজিনের পাতা উলটচ্ছেন সে ঘরে। কৌতূহলী হয়ে সে ঘরে উঁকি মারতে দেখি চারদিকের শেলফে কেবল ডাকটিকেট জমাবার খাতা আর পোল্যান্ড তো বটেই আরও অনেক দেশের রকমারি ডাকটিকেট সাদা কার্ডে সেঁটে বিক্রির জন্যে প্রদর্শিত। প্রতিটি মানুষের চমৎকৃত হবার উপাদান হয়তো ভিন্ন ভিন্ন, যা হয়তো সম্পূর্ণ নির্ভর করে তার ব্যক্তিগত অভিলাষ, রুচি, আগ্রহ, কিংবা শখের উপর। তবে নিশ্চিতভাবেই, এই যে আমি, যার শৈশব কেটেছে স্কুলের টিফিনের বাঁচানো টাকা বা রিক্সা ছেড়ে টেম্পোতে চেপে পয়সা বাঁচিয়ে পাড়ার বইয়ের দোকান থেকে ওই ডাকটিকেট সাঁটা সাদা কার্ডগুলো কিনবার মধ্য দিয়ে, তাকে এই ছোট্ট ঘরটি যেন চমৎকৃত করে পরশ বুলিয়ে দিল এক ঝলক ফেলে আসা শৈশবের। বিমুগ্ধ দশা কাটবার পর আজারবাইজান আর পোল্যান্ডের অসম্ভব সুন্দর কড়কড়ে কিছু ডাকটিকেট খামে পুরে সেই বৃদ্ধাকে ‘জিঙ্কুয়ে’ অর্থাৎ ধন্যবাদ জানিয়ে তবেই বেরুলাম সেখান থেকে।

পরদিন গিয়েছিলাম ক্রাকভ থেকে এক ঘণ্টা দূরের এক গ্রাম, “আউসভিতযে”, যে গ্রামে তৈরি হয়েছিলো গত শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ শব তৈরির কারখানা। কিন্তু সে গল্প নাতিদীর্ঘ নয়, তাই সেটি না হয় তুলে রাখলাম অন্য এক দিনের জন্যে।


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

ছবি আর লেখা মিলিয়ে দিব্যি পোস্ট। চলুক চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীডোর, ছবি তো তোলেন আপনি , তাক লাগার মতো

তিথীডোর এর ছবি

আস্তে কন, ফটুরেরা শুনলে হাসবে। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হাসুক গিয়ে, যা সত্যি তাই বললাম

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অতিথি সচল হবার পর বোধহয় প্রথম পোস্ট আপনার। আমি কিন্তু খুঁজতাম আপনার লেখা। সুন্দর পোস্ট।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ঠিক ধরেছেন সাদিয়া , এবার মাস দুয়েক পর লিখলাম মনে হয়। আপনার গল্পগুলোও কিন্তু অসাধারণ।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

কৃতজ্ঞতা। নিয়মিত লিখুন। ভাল থাকুন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

তারেক অণু এর ছবি

ভালো লাগলো। লেখা চলুক
বিশাল দেশ, এই একটাই সমস্যা মনে হয়েছে পোল্যান্ড গিয়ে, হাতে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে যাওয়া দরকার।

চপিন মানে কি শপ্যা বোঝাতে চাইছেন????

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নামটা তো শপ্যাঁই হওয়া উচিত। অবশ্য পোলিশরা কী উচ্চারণ করেন জানি না।

পোল্যান্ড দেখা নিয়ে তোমার আফসোস পড়ে একটা গল্প মনে পড়লো। মনে হয় আগে একবার বলেছিলাম। ষাটের দশকে একবার আমার শ্বশুর মশাই এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে ওয়ারশ্‌ গেছেন। যে হোটেলে তাঁদের থাকতে দেয়া হয়েছিল তার রিসেপশনে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওয়ারশ্‌তে দেখার মতো কী কী আছে? উত্তরে রিসেপশনের মেয়েটি তাঁকে হোটেল থেকে বের হয়ে হেঁটে একটা জায়গায় যাবার পথ নির্দেশ দিয়ে বললেন, তুমি ঐখানে গিয়ে যা দেখতে পাবে তাতে তোমার ওয়ারশ্‌ তো বটেই গোটা পোল্যান্ড দেখা হয়ে যাবে। তো শ্বশুর মশাই সেই নির্দেশনা মোতাবেক হেঁটে ঐ জায়গায় পৌঁছে দেখেন সামনে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাস!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

রিসেপশনের মেয়েটির রসবোধ ছিল বোঝা যায়, এক ছোট নির্দেশনায় সে কত বিশাল আর গুঢ় সত্যই না বুঝিয়ে দিয়েছিল।
ধন্যবাদ পান্ডবদা

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হ্যা ওটা মনে হয় শপ্যাই হবে, ধন্যবাদ অণুদা

মাসুদ সজীব এর ছবি

প্রথমেই হাচলের অভিনন্দন। আপনার ভ্রমণ গপ্পো একটু অন্য ধাঁচের, সেখানে ইতিহাস আসে, সংস্কৃতির কথা আসে, আসে নিজের নানান চিন্তা ভাবনার কথা। সবকিছু মিলিয়ে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। লেখালেখি চলুক, সাথেই আছি হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

সাথে থাকবার জন্যে আপনাকেও ধন্যবাদ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হাততালি হাততালি হাততালি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

হাসান মোরশেদ এর ছবি

চলুক

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নজমুল আলবাব এর ছবি

চমৎকার।

পরের পর্ব কবে আসবে?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ, দেখি আগামী দু সপ্তাহের মধ্যেই লিখে ফেলার চেষ্টা করবো

অতিথি লেখক এর ছবি

মনের পাখায় ভর করে আপনার সাথে আমরাও দেখে আসলাম ,চোখটা অবশ্য আপনার আর মনটা আমার।দারুন লাগলো
----------------
রাধাকান্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার লেখা। বলার কায়দার জন্য মনে হচ্ছিলো চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটছে। ভালো লাগলো। চলুক

কিরো

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ রাধাকান্ত এবং কিরো

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।