দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে “ম্যানহাটন প্রজেক্ট” নামে আণবিক বোমা বানাবার যে দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো, সেটির জন্যে জায়গা বেছে নেয়া হয়েছিলো এই নিউ মেক্সিকোর লস আলামস নামক এক স্থানে। সুবিশাল আমেরিকার এত স্থান থাকতে এই জায়গাটি কেন বাছা হয়েছিলো? বেশ কয়েকটি কারণ ছিল এর পেছনে। প্রথমত গোপনীয়তার কারণে এমন একটি স্থান দরকার ছিল যেটি লোকালয় থেকে বেশ দূরে, আবার যেখানে চলাচল উপযোগী রাস্তা বেশ সহজেই তৈরি করা যাবে। নিউ মেক্সিকোর উত্তরের ওই এলাকায় গিয়ে আমি বুঝেছি কেন সেই সত্তর বছর আগে এই স্থানটিকে নির্বাচন করা হয়েছিলো। এখনও ওই দিকের শহরগুলোতে জনবসতি একেবারেই অপ্রতুল, দুটি শহরের মাঝে প্রায় মাইলের পর মাইল ধু ধু প্রান্তর, উষর মরুভূমি। আর আলমাগড়ড, অর্থাৎ দক্ষিণের যে স্থানে প্রথম পারমাণবিক বোমাটি পরীক্ষা করা হয়েছে, সে স্থানে যেতে হলে এখনও গাড়ির তেলের ট্যাঙ্ক পরিপূর্ণ করে তবেই রওনা দিতে হয়, কারণ একবার তেল শেষ হয়ে গেলে মহাবিপদ, পরবর্তী তেলের পাম্পের জন্যে হয়তো যেতে হবে আরও কয়েকশ মাইল। পরবর্তীতে এই দক্ষিণের আলমাগড়ড এলাকাতেই স্থাপন করা হয় আমেরিকার সামরিক মিসাইল উৎক্ষেপণ এবং পরীক্ষণ কেন্দ্র। এসব কিছু মিলিয়েই এমন একটি জাদুঘর গড়ার জন্যে নিউ মেক্সিকোর চেয়ে ভালো কোন স্থান মনে হয় আর হতে পারে না।
জাদুঘরে ঢোকার পর প্রথমেই চোখে পড়লো কিছু বোর্ড যেখানে এই পারমাণবিক গবেষণার প্রাথমিক সাফল্যের ইতিহাসগুলো বিধিত করা হয়েছে। জার্মান বিজ্ঞানী হান্স এবং স্ট্রাসমান ১৯৩৮ সালে যে নিউক্লিয়ার ফিসন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন সেটাই বলা চলে এই পারমাণবিক গবেষণায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এরপর ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জার্মানি লেগে পড়ে এই আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে বোমা বানানো যায় সে প্রয়াসে। বিজ্ঞানী হাইসেনবারগের নেতৃত্বে যে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় তাতে জার্মানি শুরুর দিকে বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। এই যেমন, ফিসন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ভারী জলের জোগান তারা পেয়ে যায় সদ্য অধিকৃত নরওয়ের এক সার কারখানা থেকে, অধিকৃত বেলজিয়াম থেকে জোগান পাওয়া যেতে থাকে ইউরেনিয়াম। নরওয়ের সেই কারখানাটি অবশ্য পরে ব্রিটিশদের পাঠানো একটি কমান্ডো দল বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। সেটি তো একটি কারণ বটেই, এছাড়াও বোমা তৈরির মূল কর্মকাণ্ডে আরেকটি কারণে বিশাল ফাঁক থেকে যায়, সেটি বিজ্ঞানী হাইসেনবারগের ফিসন পদ্ধতি নিয়ে কিঞ্চিৎ ভুল হিসেবের কারণে। সে কারণেই খুব কাছে আসার পরও জার্মান দলটি আর বোমা তৈরিতে সাফল্য অর্জন করে পারেনি। যদি পারতো তবে হয়তো আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতো।
নিউক্লিয়ার ফিসন নিয়ে পড়েছিলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে, সে প্রায় এগার বছর আগের কথা। বেশ কিছু বিষয় ভুল-টুলে বসে আছি। এই জাদুঘরের পরবর্তী বিভাগ দর্শন করে সেই ভুলে যাওয়া বিদ্যাটি একটু ঝালিয়ে নিলাম। নিউক্লিয়ার বিজ্ঞান নিয়ে জানতে হলে এই ফিসন পদ্ধতি না জেনে সামনে এগুবার উপায় নেই। ১৯৩৯ সালে বিজ্ঞানী নিলস বোর এবং ভিলার সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন যে যদি উচ্চ ভর সংখ্যার একটি অ্যাটমকে একটি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা যায়, তবে ফিসন প্রক্রিয়াটি চালু হবে। তবে শর্ত হল এই অ্যাটমটিকে এমন একটি অ্যাটম হতে হবে যাতে জোড় সংখ্যক প্রোটন এবং বেজোড় সংখ্যক নিউট্রন থাকবে। বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করে দেখলেন যে ইউ-২৩৫ হল এই ফিসন ক্রিয়ার যোগ্যপ্রার্থী। কিন্তু সমস্যা হল ইউরেনিয়ামের যে আকরিক প্রকৃতিতে পাওয়া যায় তাতে প্রায় কাছাকাছি আরেকটি অ্যাটম ইউ-২৩৮ থাকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে, মাত্র ০.৭% ইউ-২৩৫ পাওয়া যায় সেই আকরিকে। ইউ-২৩৮ এ জোড় সংখ্যক প্রোটন ও নিউট্রন থাকাতে এটি দিয়ে ফিসন প্রক্রিয়া চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং অন্যতম ভরসা ইউ-২৩৫ কে পেতে হলে ইউরেনিয়ামের আকরিক থেকে ভরের পার্থক্য সাপেক্ষে একে আলাদা করে তবেই বোমার জন্য প্রতুল পরিমাণে আহরণ করা সম্ভব, যেটি নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। বিজ্ঞানীরা অবশ্য পরে প্লুটোনিয়াম-২৩৮ নামে আরেকটি মৌলের সন্ধান পেয়েছিলেন যেটি দিয়েও ফিসন প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব, কিন্তু সেটির ক্ষেত্রেও ইউ-২৩৫ এর মতোই সমস্যা বিদ্যমান ছিল।
নিউক্লিয়ার ফিসন পদ্ধতিটিকে সফল করে বোমা বানানোর কার্যক্রমে বিজ্ঞানী হাইসেনবারগের অসফল হবার পেছনে আরেকটি বড় কারণ ছিল সহকর্মী কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর জার্মানিতে অনুপস্থিতি। এঁদের অনেককেই হিটলার ইহুদী হবার কারণে বা নাৎসি পার্টিকে সমর্থন না করার কারণে জেলে পুরেছেন অথবা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন। এমন কিছু বিজ্ঞানীই পালিয়ে এলেন আমেরিকায়, যাদের মধ্যে আইনস্টাইনও ছিলেন, এঁরাই মূলত আমেরিকান সরকারকে জার্মান গবেষণার কথা জানিয়ে আমেরিকাকেও অনুরূপ বোমা বানাবার কাজে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এই বিজ্ঞানীদের পরামর্শটি গ্রহণ করলেন এবং ঠিক করলেন যে করেই হোক আমেরিকাকে এই প্রকল্পে সফল হতেই হবে। তিনি ডেকে নিয়ে এলেন কর্নেল লেসলি গ্রোভকে।
কর্নেল লেসলি আমেরিকান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের এক মোটাসোটা জাঁদরেল অফিসার, কয়েকটি ব্যাপারে তাঁর বেশ সুনাম আছে বাহিনীতে। আর তার একটি হল ইনি একবার কোন কাজে হাত দিলে শেষ না করে বা সফল না হয়ে বাড়ি ফেরেন না। কিছুদিন আগেই তিনি পেন্টাগন ভবনটি সফলভাবে নির্মাণ করে একটি পদোন্নতি বাগিয়েছেন। তবে এবার এই বোমার প্রকল্পটি হাতে নেবার সময় তিনি কিছু আশাহত হলেন, তিনি ভাবছিলেন এটি নিছকই এক নির্মাণ প্রকল্প। যদিও এর অল্প কদিনের মাথাতেই তিনি বুঝে যান এ প্রকল্পের গুরুত্ব, আর নাওয়া খাওয়া ভুলে পরবর্তী প্রায় পাঁচ বছরের জন্যে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেন এতে।
লেসলি সামরিক বাহিনীর মানুষ, তিনি নির্মাণ বোঝেন, নিরাপত্তা বোঝেন, শৃঙ্খলা বোঝেন। কিন্তু এমন একটি প্রকল্পে তো আসলে দরকার বাঘা বিজ্ঞানীদের। তাই তিনি দল গড়লেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের সাথে। ওপেনহাইমারই তাকে বুঝিয়ে বললেন এই এউ-২৩৫ এবং প্লুটোনিয়াম-২৩৮ কে পৃথকীকরণের সমস্যার কথা। লেসলি ঝানু লোক, তিনি দ্রুত বুঝে নিলেন ব্যাপারটা এবং কোনরূপ ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। ইউরেনিয়ামের প্রকল্প যদি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়, সে কারণে তিনি ঠিক করলেন একই সাথে প্লুটোনিয়াম দিয়ে বোমা বানাবার প্রকল্পও চালু রাখবেন। ঠিক হল ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের হানফোর্ডে স্থাপন করা হবে প্লুটোনিয়াম বিশুদ্ধিকরণের প্ল্যান্ট, আর টেনিসির ওক রিজ নামক স্থানে নির্মাণ করা হবে ইউরেনিয়াম বিশুদ্ধিকরণের প্ল্যান্ট। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হল এই দুটি স্থানে। রাতারাতি দুটি শহর গড়ে উঠলো এই দুটি স্থানে এই দুটো প্রকল্পকে ঘিরে, প্রায় লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হল সেখানে। ওদিকে লস আলামসের মূল কেন্দ্রে তখন চলছে বোমা তৈরির মূল গবেষণা, নকশা প্রণয়ন, ওক রিজের প্ল্যান্ট থেকে পাওয়া ইউরেনিয়াম দিয়ে বোমা বানাবার পরীক্ষা ইত্যাদি কাজ।
লেসলি এবং ওপেনহাইমারের প্রকল্পের প্রাথমিক বাঁধা এবং শঙ্কার বিষয়টি ছিল ইউ-২৩৫ কে ইউরেনিয়ামের আকরিক থেকে পৃথক করা। সেটি সম্ভব হয়ে গেলো ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে এবং শিকাগো ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকের যৌথ গবেষণায় উদ্ভাবিত কিছু পদ্ধতি এবং যন্ত্রের কারণে, বিশেষত বিজ্ঞানী লরেন্সের উদ্ভাবিত সায়ক্লোটন যন্ত্রটি পাবার পর। এ জাদুঘরে ম্যানহাটন প্রকল্পে ব্যবহৃত একটি সায়ক্লোটন যন্ত্র রাখা আছে, যেটি ইউরেনিয়াম পৃথকীকরণের কাজে ব্যবহৃত হতো। জাদুঘরের আরেকটি ঘরে কিছু দুর্লভ ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে দেখান হচ্ছিলো সেইসব সফলতার কাহিনি।তবে এই ভিডিও দেখতে গিয়ে একটি সাক্ষাৎকার পর্বে আমি রীতিমতো হোঁচট খাই। ওক রিজে সে সময়ে কর্মরত এক বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, “আপনাদের বানানো বোমা দিয়েই তো হিরোশিমা-নাগাসাকিতে এতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তা আপনাকে যদি আবারও এমন একটি বোমা বানাবার কাজে ডাকা হয় আপনি কি আসবেন”? সেই বিজ্ঞানী নির্বিকার চিত্তে বললেন, “দেখুন হিরোশিমায় শুনেছি যে সংখ্যক মানুষ মারা গেছে, সেই সংখ্যাটিকে যদি ওই সময়ে ওক রিজে কর্মরত সবাইয়ের সংখ্যা দিয়ে ভাগ দেয়া হয়, তবে হয়তো আমার ভাগেও পড়বে দেড়শ কি দুশো মানুষ। কিন্তু তারপরও বলব এরপরেও যদি এমন বোমা বানাবার কাজে আমাকে ডাকা হয় আমি সানন্দে এগিয়ে আসবো। কারণ আমি চাই এমন যেকোনো যুগান্তকারী বোমা সর্বপ্রথম আমেরিকার হাতেই আসুক”। অর্থাৎ তাঁর কাছে দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবোধ হয়ে গেছে মুখ্য, আর বৈশ্বিক মানবতাবোধ হয়ে গেছে গৌণ।
ওক রিজ প্রকল্পের একটি সায়ক্লোটন যন্ত্র
এই জাদুঘরের সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং কৌতুহলোদ্দীপক বস্তুগুলো ছিল তিনটি বোমার রেপ্লিকা। এই তিনটি বোমা হল লেসলি এবং ওপেনহাইমের দল যে বোমাটির নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, দ্বিতীয়টি হল সেই ইউরেনিয়াম বোমাটি যেটি বিমানবাহিনী হিরোশিমায় নিক্ষেপ করে এবং তৃতীয়টি হল সেই প্লুটোনিয়াম বোমাটি যেটি নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি, নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে সে বোমাটি পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরণ করা হয়, লেসলির কিন্তু প্রবল আপত্তি ছিল সে সম্বন্ধে। কারণ তাঁর যুক্তি ছিল শোধন করে পাওয়া ইউরেনিয়ামের পরিমাণ এমনিতেই খুব কম, তাই এই পরীক্ষার মাধ্যমে অযথা ইউরেনিয়াম নষ্ট করে কি লাভ! কিন্তু ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের দলের দাবি ছিল এই পরীক্ষাটি করবার, কারণ তাদের যুক্তি ছিল এমন একটি বোমা কোন প্রকার পরীক্ষা না করে যদি প্রথমেই যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়, আর সেটি যদি আদৌ না ফাটে, তবে! অবশেষে লেসলি বিজ্ঞানীদের কথাই মেনে নিয়েছিলেন। বোমার রেপ্লিকাগুলোর পাশের এক কাঁচের বাক্সে দেখা পেলাম সেই বিস্ফোরণে মরুভূমির বালি প্রচণ্ড উত্তাপে জমাট বেঁধে যে কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছিলো তার কিছু নমুনা।
নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে বিস্ফোরণ ঘটানো বোমাটির একটি রেপ্লিকা
জলপাই রঙের মিসাইলের মতো একটি সমরাস্ত্রে বন্দি করা হয়েছিলো হিরোশিমায় পাঠানো বোমাটি, আর নাগাসাকিতে পাঠানো প্লুটোনিয়াম বোমাটি ছিল রূপচাঁদা মাছের পেটের মতো হোঁৎকা আকারের এক ধাতব খোলসে বন্দি হয়ে, যে কারণে এ বোমাটিকে ডাকা হতো ‘ফ্যাট ম্যান’ হিসেবে।
নিউক্লিয়ার বোমা বা বোমাক্রান্ত বস্তু এসবের সাথেই যেহেতু তেজস্ক্রিয়তার ব্যাপারটি যুক্ত থাকে তাই এ জাদুঘরে প্রকৃত বোমার খোলস খুব বেশি রাখা হয়নি। থাকবার মধ্যে কেবল আছে ১৯৬৩ সালে ইতালির এক উপকুলের কাছে মার্কিন বিমান বাহিনীর এক দুর্ঘটনায় ভূমিতে ছিটকে পরা দুটি পারমাণবিক বোমার খোলস, অবধারিত ভাবেই ভেতরের বোমার উপাদান সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবুও ভেবে রোমাঞ্চ লাগলো যে এটি অন্তত কোন এক কালে জলজ্যান্ত একটি পারমাণবিক বোমার খোলস ছিল। একেবারেই আসল আর সব কিছু বস্তুর মধ্যে চোখে পড়লো কয়েকটি সামরিক লিমুজিন, যেগুলোতে চড়িয়ে স্টেশনে নামবার পর বিজ্ঞানীদের লস আলামসের প্রকল্প কেন্দ্রে নিয়ে আসা হতো ৩৯ থেকে ৪৫ সালের দিনগুলোতে।
আমার ধারণা ছিল এই জাদুঘরটিতে হয়তো পারমাণবিক বোমার আঘাত পরবর্তী জনসাধরনের যে দুর্দশা, দুর্গতি সেটিতে একটু বেশি আলোকপাত করা হবে, ভুল ভেবেছিলাম আমি। এখানে বরং জয়গান করা হয়েছে কিভাবে আমেরিকা মূলত এই বোমা বানাবার প্রক্রিয়ায় প্রথম সফল হয়েছিলো সে নিয়ে। হিরোশিমার মানুষের আর্তনাদ এখানে বড্ডভাবে অনুপস্থিতি। দায়সারাভাবে অল্প কয়েকটি ছবি দিয়ে সে কাজ সাড়া হয়েছে। শুধু বোমাই নয়, চেরনোবিল দুর্ঘটনা নিয়েও তেমন কোন অধ্যায় চোখে পড়লো না। শুধু এক কোণে তেজস্ক্রিয়তা মাপায় ব্যবহৃত কিছু পুরনো উপকরণের বাক্সে চেরনোবিলে ব্যবহৃত একটি ডসিমিটার চোখে পড়লো।
শিশুদের জন্যে অবশ্য রয়েছে চমৎকার কিছু ব্যবস্থা। সহজ কিছু রেপ্লিকার মাধমে তাদেরকে দেখান হয় কিভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়, বা কিভাবে মূল ফিসন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এই জাদুঘরটিতে স্বল্প সময়ের দর্শনে অনেক কিছুই নতুন করে জানতে পেলাম সেটা ঠিক, কিন্তু মনের মাঝে একটা খচখচ রয়েই গেলো। কারণ আমি মনে করি পারমাণবিক গবেষণার যতটুকু ধারণা সাধারণ মানুষকে দেওয়া প্রয়োজন, ততটুকু প্রয়োজন এর ভয়াবহ দিক সম্পর্কে আলোচনা এবং সচেতন করা। উচিত হিরোশিমা, চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমা দাইচির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরা। তারপর নাহয় মানুষই সিদ্ধান্ত নিক, কি চায় তাঁরা, বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় জনমানবহীন অরণ্য, নাকি কোলাহলে ভরা সবুজ ঘাসের প্রান্তর।
মন্তব্য
আপনার ভ্রমণ কাহিনী লেখার হাত অনেক ভালো।
একটু কথা যোগ করে দেই, জার্মানির হাইজেনবার্গ সফল না হওয়ার পিছনে শেষ মুহূর্তে নরওয়ে থেকে হেভি ওয়াটার এর যোগান না পাওয়াটাও একটা বড় কারণ ছিল। যুদ্ধের শেষ দিকে ব্রিটিশ আর নরওয়ের রেজিস্ট্যান্স দল মিলে নরওয়ের হেভি ওয়াটার স্থাপনাতে স্যাবোটাজ হামলা করে। আপনি নরওয়ে এর বানানো একটা ডকুমেন্টরি মিনি সিরিজ (The Saboteurs অথবা নরওয়েজিয়ান ভাষায় নাম Kampen om tungtvannet দেখতে পারেন) [url=http://www.imdb.com/title/tt3280150/ ]লিঙ্ক [/url]
........................................................
গোল্ড ফিসের মেমোরি থেকে মুক্তি পেতে চাই
শুধু আমি না, আমার সাথে পুরো জাতি
আপনি ঠিক বলেছেন, আমি ওই সিরিজটা দেখেছি, কিন্তু ওটার কথা যোগ করে আর লেখাটাকে বড় করতে চাইনি। ধন্যবাদ লেখাটি পড়বার এবং মন্তব্যের জন্যে।
গুডরিডস
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, আমাদের এ রকম একটা মিউজিয়ামের কথা লিখে জানানোর জন্য
........................................................
গোল্ড ফিসের মেমোরি থেকে মুক্তি পেতে চাই
শুধু আমি না, আমার সাথে পুরো জাতি
১। যথারীতি ভাল লাগল।
২। হিরোশিমা'র দুঃস্বপ্নের সাথে পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় দুই সেলিব্রিটি 'আইনস্টাইন' আর 'ফাইনম্যান' জড়িত, এটা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
৩। হিরোশিমা এবং চেরনোবিল-ফুকুশিমা দুটিই বিপর্যয়। প্রথমটা মানবিক, দ্বিতীয়টা প্রাকৃতিক। দুটোকে এককাতারে আনাটা কি দরকার ছিল, সঞ্জয়'দা?
৪। হুমম, "হিরোশিমার মানুষের আর্তনাদ এখানে বড্ডভাবে অনুপস্থিত। দায়সারাভাবে অল্প কয়েকটি ছবি দিয়ে সে কাজ সাড়া হয়েছে।" দেখলে মনে পড়ে এইটা হেনরি কিসিঞ্জারের দেশ, জর্জ হ্যারিসনেরটা না।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দুটো ঠিক এক কাতারের ঘটনা না, আমি আসলে এ দুটিকে দেখতে চেয়েছি তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত জনগোষ্ঠির দুর্দশার দৃষ্টিকোণ থেকে।
চতুর্থ পয়েন্টে পূর্ণ সহমত। ধন্যবাদ আপনাকে।
গুডরিডস
চেরোনোবিল কি প্রাকৃতিক? আমি ঠিক জানি না, তবে কোথায় যেন পড়েছিলাম, এটা হিউম্যান এরর (মানবীয় ভুল), কোন একটা অতি ঝুঁকিপূর্ণ, অসাবধানী পরীক্ষার কারণএ এটা ঘটেছিল। ইচ্ছাকৃত না, তবে ঠিক প্রাকৃতিক ও না।
চেরনোবিলের দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক নয়, ওটি ঘটেছিলো কন্ট্রোল রুম চিফের এক খামখেয়ালী মূলক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। ২৬ সে এপ্রিল ১৯৮৬, ও দিন রাত একটায় একটা পরীক্ষা করা হচ্ছিল, দেখা হচ্ছিলো ফিসন গতি বাড়িয়ে ঠিক কতটা পরিমাণে সর্বোচ্চ বিদ্যুত উত্পন্ন করা যায়. এ ব্যাপারে একটা গাইড লাইন আছে, গ্রাফাইটের রড ঠিক কতটা পর্যন্ত তুলে রাখা যাবে। কিন্তু এই পাগলা চীফ সেদিন অধস্তনদের কথা না শুনে বিপজ্জনক পর্যায়ে রিয়াকটর কে নিয়ে যান. যার ফলশ্রুতিতে একসময় বিস্ফোরণ ঘটে, উড়ে যায় সেই ভবনের ছাদ. চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ.
গুডরিডস
দুঃখিত, প্রাকৃতিক না, অনিচ্ছাকৃত। হিরোশিমার মত 'ইচ্ছাকৃত' না।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আমি নিউ মেক্সিকো ছেড়ে এলাম আর আপনিও ঘুরতে গেলেন। হৈলো?
এ জাদুঘরে গিয়েছিলাম, ভাল্লাগেনি। লেখা ভাল হয়েছে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অসুবিধা নাই, অস্টিনে চইলা আসি ঘুরতে। তাইলেই তো হয়.
গুডরিডস
ভাল লিখেছেন।
ধন্যবাদ কৌস্তুভ দা
গুডরিডস
নতুন মন্তব্য করুন