আমার একমাত্র ভাগ্নিটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে প্রায় মাস পাঁচেক পূর্বে, কিন্তু অদ্যাবধি নানা ঝামেলায় ওকে দেখতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ওরা থাকে সিয়াটলে। আমার এখান থেকে সেটা ঠিক গাড়ি চালিয়ে যাবার মতো দূরত্বের পর্যায়ে পড়ে না। তাই গত মাসে প্লেনের টিকেট কেটে বোনকে জানিয়ে দেই আমি আসছি। যেহেতু এপ্রিল মাসেই যাবো বলে ঠিক করেছি তাই ওদের বাড়ি থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরের স্ক্যাজিট ভ্যালিতে ঢুঁ মারতে দোষ কোথায়? গত পাঁচ মাসে মেয়েকে সামলিয়ে আমার বোনটিও বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে, এমন কোন স্থানে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ঘুরতে গেলে হয়তো ওরও বাঁধাধরা দিনের কর্মসূচি থেকে কিছুটা মুক্তি মিলবে। সকালে রওনা হবার সময়ে ভগ্নীপতি জানিয়ে দেয়, যেহেতু শনিবার সকালের সময় তাই হাইওয়েতে মেলা ভিড় থাকতে পারে। তাই সে আমাদের নিয়ে যাবে শহর আর গ্রামের ভেতরের আরেকটি ছোট রাস্তা ধরে। আমি বলি তথাস্তু, হাইওয়ের একটানা গাড়ির হুস হাস শব্দ আর পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা, এর চাইতে ওই গ্রামের মাঝের রাস্তা দিয়ে কিছুটা সময়ে লাগিয়ে হলেও ছুটে চলাটা ঢের ভালো।
এ পথ দিয়ে এসে লাভের ঝুড়িতেই বেশি ফল এলো। কারণ পথেই পড়লো লেক স্টিভেন্স আর লেক ক্যাসেডি। লেক স্টিভেন্সের ঘাটে বাঁধা ডিঙি নৌকো আর তীরের কাঠের বাড়িগুলো, এই সব মিলিয়ে এমন এক ছবি যা কিনা যেকোনো পোস্টকার্ডের ছবিকেও হার মানায়। লেকের ধারের সেই সেই বাড়িগুলোর মাথা ছাপিয়ে বহু দূর দিগন্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট বেকারের তুষারাচ্ছাদিত চুড়োগুলো। হটাৎ করে এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হলে মনে হয় দূর ছাই, আর কোথাও যাবার প্রয়োজন নেই, এখানেই কোথাও লেকের ধারের সবুজ ঘাসে বসে কাটিয়ে দেই সারাটি বেলা।
চোখকে প্রশান্তি দেবার মতো এমনই অনেক দৃশ্য আর আঁকা-বাঁকা মন্থর পথ পেড়িয়ে আমরা এসে পৌঁছই রুযেন সাহেবের সেই বিখ্যাত খামারে। ১৯৪৭ সালে রুযেন নেদারল্যান্ড থেকে আমেরিকা এসেছিলেন টিউলিপ নিয়ে তার স্বপ্নখানি বুকে নিয়ে। টিউলিপের সাথে রযেন বংশের সম্পর্ক বেশ পুরনো। প্রায় ছয় পুরুষ ধরে সেই সতের শতক থেকেই রুযেন বংশ টিউলিপ চাষের সাথে যুক্ত। উইলিয়াম রুযেন তাই সম্বল করে নিয়ে এসেছিলেন পিতৃপুরুষ লব্ধ টিউলিপ চাষের পূর্ব অভিজ্ঞতা। সেই স্বপ্ন আর অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে মাত্র পাঁচ একর জায়গায় রুযেন শুরু করেন তার টিউলিপের বাগান। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র কয়েক দশকের পরিশ্রমেই সেই বাগানটি দাঁড়িয়ে যায় প্রায় হাজার একরে, আর এটি এখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় টিউলিপ চাষের কৃষি কোম্পানি। এখন অবশ্য শুধু টিউলিপ নয়, ডেফোডিল, আইরিসের মতো ফুলেরও চাষ চলে এই রুযেন খামারে। গত কয়েক দশক ধরে গ্রীষ্মের শুরু সময়টাতে প্রায় চার একর জায়গায় শুধুমাত্র টিউলিপ প্রিয় দর্শকদের জন্যেই প্রায় আড়াই লক্ষ চারা বপন করা হয়, যেগুলো একসময় পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয়ে এই মর্ত্যে সৃষ্টি করে স্বর্গসম আলোর ঝলকানি। সাদা, বেগুনী, লালসহ আরও হরেক রকমের রঙের টিউলিপ ফুটে এমন এক ক্যানভাস সৃষ্টি করে যেন হয় এই মাত্র কেও যেন সেই সবুজ প্রান্তরে নানা পদের রঙের কৌটো ঢেলে দিয়েছে। আমেরিকায় মাত্র দুটি স্থানে এতটা বড় পরিসরে ফুলোৎসব হয়, একটি এই স্ক্যাজিট ভ্যালিতে টিউলিপ উৎসব। আরেকটি হয় আমার বাড়ির খুব কাছেই কার্লসবাড শহরে, সেটি অবশ্য গোলাপ উৎসব। এই দুটি উৎসবই হয় প্রায় একই সময়ে, মধ্য মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত। খুব সম্ভবত এ সময়ে আবহাওয়া এই ফুলোৎসবের পক্ষে অনুকূল থাকে। কার্লসবাডের সেই গোলাপ উৎসবেও বার তিনেক যাওয়া হয়েছে। তবে কার্লসবাডের সাথে তুলনা করলে একটি বিষয়ে এই স্ক্যাজিট ভ্যালির টিউলিপ উৎসব আমার একটু বেশিই ভালো লাগলো, আর সেটির কারণ হল স্ক্যাজিট ভ্যালির নির্জনতা আর গ্রামীণ প্রকৃতি। কার্লসবাডে কয়েক একর জায়গা জুড়ে গোলাপের বাগান হলেও সেখানে গোলাপের বাগানের সীমানার পরেই শুরু হয়েছে শহুরে মার্কেটের চকচকে ইমারত, দৃষ্টি সীমানায় সেটি কেমন যেন একটি ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। গোলাপের বাগানটিকে তখন মনে হয় কৃত্রিম আর মেকি। স্ক্যাজিট ভ্যালির এই টিউলিপের মাঠটি কিন্তু সে দোষে দুষ্ট নয়। এখানে টিউলিপের রেখা যেখানে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে সেখান থেকেই শুরু হয়েছে পাইনের বন আর অনুচ্চ পাহাড়ের রেখা।
আমরা বেশ কয়েক ঘণ্টা সেই টিউলিপের মাঠে হারিয়ে যাই, টিউলিপের পাপড়িতে উড়ে যাওয়া মৌমাছিদের দেখি, ছোট ভাগ্নিটিকে টিউলিপ দেখাই। তারপর আমাদের ততটা ফেরার তাড়া না থাকলেও ওর মৃদু কান্নায় সম্বিত ফিরে পাই, বুঝতে পারি এবার বাড়ি ফেরবার পালা।
মন্তব্য
লেক স্টিভেন্স-এর কথা অল্প কিছু বললেন কিন্তু কোন ছবি দিলেন না। আর লেক ক্যাসেডির ছবি দুরে থাক, কথাও কিছু বললেন না!
ডেফোডিলের ছবি দিলেন না পারতে, আর আইরিসেসের ছবি দিলেনই না! এটা কি ঠিক হলো?
আপনার নিবাস কি লস এনজেলিস নাকি স্যান দিয়েগো? অই দুই শহরের কোনটাতে হলে ওখানকার ছবি দিয়ে তো অনায়াসে ছবি ব্লগ নামিয়ে ফেলতে পারেন।
লেক স্টিভেন্স এ আসলে কোনো ছবি তোলা হয়নি, মাঝে মাঝে আমার এমন হয় কোনো জায়গা বেশি ভালো লেগে গেলে শুধুই চোখের ফ্রেমে ছবিটি ধরে রাখতে ইচ্ছে হয়, ঠিক ক্যামেরার পেছনে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না তখন.
আপনার চোখ দুর্দান্ত, আইরিসের কোনো ছবি দেইনি, কারণ সেসব ফুলের সাথে নিজের ছবি ছিল বিধায়
আমি থাকি সান ডিয়েগো তে. দেখি ভবিস্যতে হয়তো ছবি ব্লগ না হলেও কোনো কিছু লিখবো এই শহর নিয়ে।
গুডরিডস
স্ক্যাগিত নয়, স্ক্যাজিট ভ্যালি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, বানান টা ঠিক করে দিলাম।
গুডরিডস
আপনার ছবি দেখে ভেবেছিলাম, আপনি আমাস্টার্ডামে চলে এসেছেন , জানেন তো কুহকেহনহফ এর কথা। যাবো যাবো করে এবারেও যাওয়া হলো না। ছবি যথারীতি চমৎকার, কিন্তু আপনার লেখা ছোট হয়ে আসছে, কি ব্যাপার
লেখা আর ঘুরোঘুরি চলতে থাকুক
........................................................
গোল্ড ফিসের মেমোরি থেকে মুক্তি পেতে চাই
শুধু আমি না, আমার সাথে পুরো জাতি
কুহকেহনহফ এর কথা শুনেছি, কিন্তু ওই যে বললাম সাধ আছে, সাধ্য কোথায়?
লেখা ছোটো হবার কারণ হলো, বড় লেখা লিখতে গিয়ে আমার আলসেমি চেপে বসে, মাসের পর মাস গড়িয়ে যায়. তাই ভাবলাম এই আলসেমিটা ত্যাগ করার উপায় হলো অন্তত ছোটো হলেও কিছু লেখা। আর তা ছাড়া অনেক পাঠক ও আজকাল বড় লেখায় বিরক্তি প্রকাশ করেন।
ধন্যবাদ আপনাকে
গুডরিডস
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
গুডরিডস
ফুলের বাগানে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে মনটা ভালো করে দিলেন।
সোহেল ইমাম
ধন্যবাদ আপনাকে
গুডরিডস
মের্কিন মুল্লুক যামু, ট্যাকা দ্যান।
টেকা চাহিয়া লজ্জা দিবেন না
গুডরিডস
বাংলাদেশে কোনো রুযেন সাহেব নাই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দেশে ত্যাল নাই, পানি নাই, গেস নাই। সবেধন নীলমণি রাষ্ট্রধর্মটা যা একটু টিকে আছে।
এই সব দুনিয়াবি টিউলিপের দুঃখ করে সেটাকে আহত করতে চাইতাছেন ক্যান? হুয়াই?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এক্কেরে ঠিক কথা
গুডরিডস
ছবিগুলো দারুণ।
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
ধন্যবাদ আশরাফ ভাই
গুডরিডস
নতুন মন্তব্য করুন