প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়বার সময়ে একটি গবেষণামূলক প্রকল্পে আমাকে কাজ করতে হয়েছিলো যন্ত্রকৌশল বিভাগের এক প্রভাষকের সাথে। আমেরিকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আমন্ত্রণপত্র পাবার পর যখন তাকে জানালাম সে কথা তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনেই তিনি বললেন, আরে ওখানে তো আমার এক বন্ধুই আছে এখন। তুমি আজই ওকে ফোন করো। ওই তোমার প্রাথমিক সব ব্যবস্থাদিতে সাহায্য করতে পারবে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল পাওয়া। আমিও আর কালবিলম্ব না করে সে দিনই সেই বড় ভাই অর্থাৎ জাবের ভাইকে ফোন করলাম বাংলাদেশ থেকে। তিনি সব শুনে বললেন নাকে তেল দিয়ে বাকি কটা দিন বাংলাদেশে ঘুমিয়ে নাও। আমি এখানে তোমার সব ব্যবস্থা করে রাখছি। আমার বাড়িওয়ালার একটা ঘর খালি আছে, সেখানেই ওকে বলে তোমার থাকার বন্দোবস্ত করছি। এর কদিন বাদে তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে জানালেন ঘর পাক্কা। ওই সেমিস্টারে নাকি আরও একজন বাংলাদেশি আসছে, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছরের সিনিয়র। ইনিও জাবের ভাইকে অনুরোধ করেছিলেন বাড়ি ঠিক করে দেবার জন্যে। তাই জাবের ভাই আমাদের দু জনকেই সেই দু রুমের ফ্ল্যাটে উঠিয়ে দেবেন। আমাকে জানালেন মাস প্রতি ভাড়া ৩১০ ডলার (অর্থাৎ আমাকে দিতে হবে ১৫৫ ডলার), কি চলবে তো? সত্যি বলতে কি আমি ভেবেছিলাম ভাড়াটা হয়তো এর চেয়ে মেলা বেশি হবে। তাই ভাড়ার এ অঙ্কে খুশি না হয়ে উপায় নেই। জাবের ভাইকে তাই আমি সবুজ সঙ্কেত দিয়ে বাকি দিনগুলো খোশ মেজাজে কাটাতে থাকি।
এরপর একদিন জানুয়ারি মাসের এক ঘুটঘুটে অন্ধকার অমাবস্যার রাতে ক্রন্দনরত মা আর দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছোট বোনটিকে পেছনে ফেলে আমি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বিশাল পেটে চেপে বসি। বিমানবন্দরে অবশ্য বাবা চোখ মোছেননি, শুধু কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন যে জন্যে যাচ্ছ, সে লক্ষ্যে সফল হইয়ো। আমি জানি বাবা আসলে ভান করেন নিজের ভেঙ্গে পড়া রূপটা ঢাকবার। সেটা সেই এক দশক আগে তিনি পারলেও, আজকাল আর পারেন না। এখন আমি দেশে গেলে বা তিনি আমার এখানে থেকে বিদায় নেবার বেলায় ঘন ঘন হাতের চেটোয় চোখ মোছেন আর বলেন, “তোমাদের ফেইলা যাইতে ইচ্ছা করতেসে না”।
ঢাকা শহরে মিটমিটে আলোগুলোকে পেছনে ফেলে বিমানটি একসময় কোন এক দূর দিগন্তে উড়াল দেয়, আমি বিমানের ছোট কাঁচের জানালায় মাথা পেতে পেছনের ফেলে আসা ভুবনকে শেষ বারের মতো দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা, ততক্ষণে সেই বিমান আমাকে নিয়ে ফেলেছে মেঘের আরেক অজানা রাজ্যে। আমি বুঝতে পারি এই আমার পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাত্রার সূচনা লগ্ন। একটা সময় পর পেছনের দৃশ্যকে দেখবার দুরাশা ত্যাগ করে আমি জানালার পাতলা পর্দা নামিয়ে দিই।
এরপর সেই প্লেনটি বলা চলে আমাকে নিয়ে বিশ্বভ্রমণে যাত্রা করে। পথিমধ্যে আমরা নামি সিঙ্গাপুর বিমানবন্দর আর জাপানের নারিতা বিমানবন্দরে। অনেকেই হয়তো এমন দীর্ঘ আর প্রলম্বিত যাত্রা পথকে বিরক্তির চোখে দেখেন। আমি কিন্তু সেদিন বেশ উপভোগ করছিলাম আমার এই বিমান যাত্রাটিকে। জীবনে সেই প্রথম সত্যিকার অর্থে বিদেশ ভ্রমণ, যা দেখি তাতেই অবাক হই, তাই ভালো লাগে। নারিতা বিমানবন্দরে আমি তিন ডলার দিয়ে এক বাদামের ঠোঙ্গা কিনি আর বাদাম চিবোতে চিবোতে ঝকঝকে কাঁচের জানালা দিয়ে এক শীতমগ্ন সকালে বাইরের পার্কিং লটে লুটিয়ে থাকা শত শত আধুনিক গাড়িতে ছিটকে পরা সূর্যের আলোর ঝলকানি দেখি।
জাপান থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমার প্লেনটি আমেরিকার পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে ঢুকে সারা আমেরিকা চক্কর খাবার পর শেষমেশ গিয়ে থামে শিকাগোর ওহারে বিমানবন্দরে, এটি নাকি আবার বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে আমাকে নেমে আরেকটি টার্মিনালে গিয়ে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের উইচিটাগামী একটি ছোট প্লেন ধরতে হবে। তবে এখানেই আমাকে অভিবাসন ও শুল্ক কর্মকর্তার মুখোমুখি হতে হবে। তারপর নিজেকেই সেই প্রকাণ্ড সুটকেসদুটো বয়ে নিয়ে অন্য টার্মিনালে যেতে হবে। তখনও আমেরিকা মহাদেশে যাবার জন্যে সুটকেস প্রতি প্রায় সত্তর পাউন্ড মালামাল নেয়া যেত। আমি এদেশে আসবার এক কি দু বছর পর সেই সংখ্যাটি পঞ্চাশ পাউন্ডে নামিয়ে আনা হয়। আমি তাই আমার দুটি সুটকেসে বলতে গেলে বেঁচে থাকার জন্যে যা যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুই চালান করে নিয়ে এসেছি। চা ছাঁকবার ছাকনি থেকে শুরু করে বোতাম সেলাই করবার সুঁই, কিছুই বাদ নেই তাতে। কিন্তু ঝামেলা হল এই সুটকেসগুলো শুল্ক ছাড় করাবার পর। কারণ এবার আমাকে একটি ছোট ট্রেনে চেপে সেই অন্য টার্মিনালে যেতে হবে। কিন্তু একা আমি এই এতগুলো বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে এত অল্প সময়ে কি করে ট্রেনে উঠি! কিছুটা বে-আক্কেল হয়ে যখন দাঁড়িয়ে আছি তখন বলা নেই কওয়া নেই পেছন থেকে এক লোক আমার সুটকেসে হাত বাড়িয়ে টেনে ট্রেনে উঠে গেল, আমাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই। এক পূর্ব অভিজ্ঞতায় এ ব্যাপারটায় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। একবার জামালপুর জংশন থেকে ট্রেনে উঠছি মা আর আমি ঢাকাগামী এক ট্রেনে। ট্রেনে সেদিন প্রচণ্ড ভিড়, সবাই ব্যস্ত ঠেলে-ঠুলে সেই অল্প সময়ে কামরায় উঠবার। সেবারও এক সদাশয় ব্যক্তি ‘দিন আমাকে দিন’ বলে আমাদের এক ব্যাগ নিয়ে আমাদের সাথেই কামরায় উঠলেন, কিন্তু কামরায় উঠবার পরই যেইনা আমরা বলেছি ‘অনেক ধন্যবাদ, এবার দিন আমাদের ব্যাগ’, ওমনি তিনি চোখমুখ উল্টে বলে বসলেন, ‘কিসের আপনাদের ব্যাগ? এই ব্যাগ তো আমার’। কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম আমরা। কপাল ভাল, সে সময়ে ওই কামরায় ছিলেন আমার মামার এক ছাত্র যিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত, সেই এগিয়ে এসে বলল এই ব্যাগ যদি তোমারই হয় তবে খোলা হোক, দেখা যাক ব্যাগে কি আছে। বলাই বাহুল্য ব্যাগের চেন খুলতেই প্রথমে বেড়িয়ে এলো আমার মায়ের একখানা শাড়ি। সেই ছাত্র তখন তার টুটি চেপে বলল, তা বেটা তুই কি শাড়ি পড়ে ঘুরিস? সেই কটু অভিজ্ঞতা থেকেই আমি ভাবছিলাম এই সদাশয় ভদ্রলোকও আবার দাবি করে বসবে না তো এটি তারই ব্যাগ? আমার গায়ে যে তখনও বাংলাদেশের তাজা গন্ধ লেগে আছে, যে গন্ধ মানুষকে বড় সহজে বিশ্বাস করতে দেয় না। কিন্তু না তেমন কিছুই ঘটলো না। পরোপকারী সেই ভদ্রলোক আমার হাতে সুটকেসখানি সঁপে দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই একখানা সংবাদপত্র পড়তে মনোযোগী হয়ে পড়লেন। আমি এবার পরের টার্মিনালে গিয়ে বেশ চাপা ফুসেলজের একখানা প্লেনে চাপলাম। তখন সন্ধ্যে, কিন্তু শীতের সন্ধ্যে বিধায় তখনই ঘুটঘুটে অন্ধকার। কে যেন বহুকাল আগে আমাকে বলেছিল পশ্চিম গোলার্ধের ঠাণ্ডা কিন্তু ভয়াবহ। আমাদের মতো উষ্ণ দেশের মানুষের চিন্তারও অতীত সে ঠাণ্ডা, আর সে ঠাণ্ডা একবার লাগলে নাকি সহজে ছাড়ে না। তাই সে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল ওসব দেশে গেলে বিমানবন্দরেই নিজেকে পুটুলির মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে। আমার পরনে স্যুট টাই। আমি হটাৎ সেই ব্যক্তির পরামর্শ স্মরণ করে আমার ঝোলা ব্যাগ থেকে বাঁদর টুপি বের করে ঝট করে নিজের কান দুটোকে ঢেকে ফেলি, নতুন দেশে অযথা জ্বরে পড়বার ঝুঁকি নিয়ে লাভ কি? পরে সে কথা আর সবাইকে বলাতে তারা তো হেসে খুন, আর জানলাম সন্ত্রাসী সন্দেহে যে প্লেন থেকে আমাকে নামিয়ে দেয়নি, সেই নাকি আমার পরম ভাগ্য ছিল। ওভাবে বাঁদর টুপি পড়ে এমন বাসে ট্রেনে প্লেনে উঠলে এদেশে অনেকেই নাকি সন্দেহের চোখে দেখে।
উইচিটা বিমানবন্দরে আমাকে নিতে আসবার কথা জাবের ভাইয়ের। কিন্তু বিমান বন্দরে নেমে এক হাস্যোজ্বল তরুণের দেখা পেলাম যিনি নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন জাবের ভাইয়ের ফ্ল্যাট-মেট হিসেবে। ইনি আলম ভাই। বেশ পরিপাটি ধরণের আমুদে একজন মানুষ, সর্বদা দামি সেন্ট মেখে ঘোরায় গা থেকে খুশবু ছড়িয়ে চারদিকে জানান দেয় আলম ভাই আসছেন। ইনার পিতা দেশে একজন নামজাদা আমলা এবং আলম ভাই তার একমাত্র পুত্র। তাই সে অর্থে আলম ভাইরের পয়সা কড়ির অভাব নেই, তিনি মুখ দিয়ে “টা” উচ্চারণ করলে পুত্রবৎসল পিতা তাকে কয়েক হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। আলম ভাই তাই থাকেনও রাজার হালে। মানে আমাদের ছাত্র সমাজের অনুপাতে যেটিকে রাজার হাল বলা যায় আর কি। এই যেমন তিনি এ দেশে আসার তিন মাসের মধ্যেই বিশাল এক টেলিভিশন আর হোম থিয়েটার সিস্টেম কিনে এলাহি এক কারবার করে ফেলেছেন। সেই সুবাদে ওই শহরের ছাত্র সমাজে আলম ভাইরের বাড়ি একটি সুপরিচিত স্থান। কেও কোন নতুন ভালো সিনেমা সিডিতে পেলেই আলম ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে আসে দেখবে বলে। আলম ভাইও আনন্দচিত্তে আপ্যায়ন সহকারে তাদের সিনেমা দর্শনের ব্যবস্থা করে দেন। এহেন আলম ভাইয়ের নিজের একখানা গাড়ি থাকবে না তা তো হয় না। একটি মোটামুটি ধরণের গাড়িও তিনি খরিদ করে ফেলছেন আমেরিকায় পদার্পণের ছ মাসের মধ্যেই, সেটি নিয়েই তিনি আজ আমাকে তুলে নিতে এসেছেন। আমি পেছনের আসনে বসে এই ভিন দেশের ভিন শহরের মসৃণ রাস্তায় কিছু বাংলা গান শুনতে শুনতে আমেরিকার প্রথম আমেজটা পাবার চেষ্টা করি।
পরদিন সাত সকালেই কেইন এসে হাজির। ফেয়ার মাউন্ট স্ট্রিটে কেইনের এ বাড়িটি সম্পর্কে আগে কিছু কথা বলি। একটি বিশাল উঠোনের তিন ধারে তিনটি বাড়ি, জানুয়ারি মাসের কনকনে শীতে সেই উঠোনের ঘাস হয়ে পড়েছে বিবর্ণ হলদেটে। আর কোথা থেকে যেন মরে যাওয়া ম্যাপেল, সিডার আর ওক গাছের রাশি রাশি পাতা উড়ে এসে ডুবিয়ে দিয়েছে প্রায় পুরো উঠোনটিকে। উঠোনের তিন ধারের ওই তিনটি বাড়ির মালিক কেইন নিজেই। বাড়িগুলো বেশ পুরনো, সত্তর কি আশির দশকে বানানো। এই তিনটে বাড়ির ভেতর একমাত্র জাবের ভাই যে বাড়িতে থাকেন সেটিতেই শুধু বেজমেন্টে আরও দুটি ফ্ল্যাট আছে। অন্য বাড়িদুটোতে প্রথম তলায় কেবল দুটি করে ফ্ল্যাট। কেইন আমাকে আর বনি ভাইকে, অর্থাৎ এ সেমিস্টারে আগত আরেক বাংলাদেশীকে, নিয়ে গেল সেই বেজমেন্টের ফ্ল্যাটটি দেখাতে। প্রথমে ঢুকেই মনে হল যেন কফিনে ঢুকছি, ঠাণ্ডা হিম হয়ে রয়েছে পুরো ফ্ল্যাট। রুমের হিটারটি ভালোভাবে কাজ করছে না। যতটুকু বুঝলাম ওই ফ্ল্যাটে থাকলে ঠাণ্ডা আর অন্ধকারে অবস্থা কেরোসিন হতে বাধ্য। উপরে উঠে এসে জলদি জাবের ভাইকে বললাম সে কথা। জাবের ভাই আমাদের হয়ে মধ্যস্থতা করতে গেলেন কেইনের সাথে। তখন মাসের ১২ তারিখ। এই সালিশ বৈঠকের পর যা জানতে পেলাম তা হল উল্টো দিকের আরেকটি বাসায় থাকেন আসলাম ভাই নামক একজন, তিনি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমেই বাসা ছেড়ে চলে যাবেন। আপাতত তিনি বাংলাদেশে বেড়াতে যাচ্ছেন মাস ছয়েকের জন্যে, ফিরে এসে অন্য বাড়িতে উঠবেন। আমরা চাইলে ওই বাড়িটি ভাড়া নিতে পারি, তাতে ভাড়া বাড়বে মাত্র ত্রিশ ডলার। আর মাসের বাকি বিশ দিনের জন্যে ঠিক হল বনি ভাই রাতের বেলায় থাকবেন জাবের ভাইয়ের বাড়ির এক ঘরে আর আমি ঘুমবো সেই বেজমেন্টের একটি ঘরে গিয়ে। অর্থাৎ পরবর্তী বিশ দিনের জন্যে আমরা কিন্তু কেইনের সেই বেজমেন্টের ফ্ল্যাটতো আটকে রাখলামই, অন্যদিকে আমি ওই বিশ দিনের বিদ্যুৎও ব্যবহার করবো রাতের বেলায়। কিন্তু এ বাবদ কেইন একটি পয়সাও নেবে না। উল্টে আরও ওই হিটারজনিত সমস্যায় যে আমাদের কিছুটা ঝামেলায় পড়তে হল সে নিয়ে বারবার দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো। লোকটা কি পাগল? ওকে কখনো এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলত, এ তল্লাটে আমার এমন প্রায় দশ বারোটি ভাড়া বাড়ি আছে, বাড়িগুলোর পেছনে কোন ঋণ নেই, তাই ওগুলো থেকে যে ভাড়া পাই তা দিয়েই আমার দিব্যি চলে যায়। খুব বেশি টাকা আমার দরকার নেই। আবার ওদিকে কেইন একজন পাইলটও বটে। তবে ও অবশ্য নিয়মিত বিমান চালায় না, সেটি হলে তো ওর আনন্দময় জীবনে ব্যাঘাত ঘটবে। ও সাধারণত চালায় পণ্যবাহী বিমান, আর কখনো কোন বৈমানিকের সংকট দেখা দিলে তবেই কেইনের ডাক পড়ে। এভাবে মাঝে মধ্যে বিমান চালনা আর ভাড়া বাড়ির অর্থ এই দিয়েই কেইন তার মুখে হাসিটিকে বাঁচিয়ে রাখে।
আমাদের ক্লাস শুরু হতে দিন সাতেক দেরি, এর মধ্যে আমি আর বনি ভাই চুটিয়ে রান্না-বান্নায় মন দিই। মানে রান্নায় হাতে-খড়ি করি আর কি আর খাবারের পর রান্নার প্রশংসায় একে অপরের পিঠ চাপড়াই। বনি ভাই আমার বাঁধাকপির ঘণ্ট খেয়ে বেজায় মুগ্ধ আর আমি তার মুরগির ঝোল। এক সময় আমি প্রস্তাব দেই এখন থেকে সব সময় আমি পেঁয়াজ-আলু কুটে দেব বাসন মেজে দেব, কিন্তু মুরগী কাটা আর রান্নার কাজটি করবেন তিনি। আমার এ প্রস্তাবে কিঞ্চিত অসম্মতি জানিয়ে বনি ভাই আমাকে বলেন, আজ যদি তুমি এই মুরগী কাটা না শেখো তবে হয়তো কোনদিনই শিখবে না। জীবনের অনেক সময়েই এমন কাজ নিজেকেই করতে হবে। কথা সত্যি। পরে দেখলাম মুরগীর পেট চিরে কিভাবে দু ফালি করে কাটার কাজটি শুরু করতে হয় সেটি যদি সেদিন না শিখতাম তবে পরবর্তী জীবনের একা দিনগুলোতে সত্যি সত্যিই বিপদে পড়তাম।
দু দিন পরের এক সন্ধ্যেতে হটাৎ আলম ভাই এসে আমাদের প্রশ্ন করেন আমাদের মন খারাপ কিনা। আমরা মানে আমি আর বনি ভাই জবাব দেই, কই না তো, তেমন একটা মন খারাপ না। বরং কিছুটা উল্টোই বলা যেতে পারে। আমরা দু জনেই ঢাকায় বাড়ি থেকে ক্লাস করতাম, হল জীবন আমাদের ভাগ্যে জোটেনি। উইচিটার নতুন আবাসকে আমাদের মনে হচ্ছিলো হল জীবন। কিন্ত আলম ভাই নাছোড়বান্দার মতো বললেন তোমাদের মন খারাপ না হয়ে পারেই না। দাঁড়াও আজ রাতেই তোমাদের মন ভালো করার কিছু ব্যবস্থা করছি। আমরা উনার মতলবের বিস্তারিত কিছু বুঝি না, শুধু রাতের অপেক্ষা করি। অবশেষে রাত নটা নাগাদ তিনি আমাদের ঝটপট তৈরি হয়ে নিতে বলেন, নাকি আমাদের নিয়ে কোথায় যাবেন। আমরা বাধ্য বালকের মতো পরিপাটি জামা পরে যাবার জন্যে তৈরি হই। পথে তিনি বেশ উচ্চ ভলিউম এ এক গান বাজিয়ে নিজেও সেই গানের সাথে গুন গুন করে গাইতে থকেন। মিনিট বিশেকের পথ পাড়ি দেবার পর আমরা এসে থামি এক অন্ধকার মতো এক স্থানে। আশেপাশে তেমন লোক বসতি দেখা যায় না, এমনকি কোন মার্কেটও চোখে পড়ে না। শুধু দূরে কিছু অয়্যার হাউস চোখে পড়ে। আলম ভাই এবার এক চোখ টিপে বলেন পকেটে কিছু মাল কড়ি আছে? আসবার সময়ে আমার এক মামা ভাংতি কিছু টাকা আর পয়সা দিয়েছিলেন পথিমধ্যে বাদাম তেলেভাজা কিনে খাবার জন্যে। সেগুলো সেই মুহূর্তে আমার সাথেই আছে। বনি ভাইয়ের কাছেও আছে দশ ডলারের মতো। চলবে, ওতেই চলবে বলে আলম ভাই আমাদের নিয়ে নিয়ন আলোর সাইন ওয়ালা এক বাড়ির ভেতরে ঢোকেন।
লাউয়ের মাচার কঞ্চি বেয়ে যেমন করে বর্ষার জল পেয়ে নেড়ে-বেড়ে ওঠা ডগাগুলো এলিয়ে পেঁচিয়ে থাকে, ঠিক তেমনই কিছু কঞ্চি বেয়ে পেঁচিয়ে থাকা নারীমূর্তি আমাদের দৃশ্যমান হয় ভেতরে ঢুকবার পর। এদেশের ভাষায় এমন স্থানগুলোকে বলা হয়, ‘স্ট্রিপ ক্লাব’। আশেপাশের আলো আঁধারিতে তাকিয়ে দেখি এখানে ওখানে পেতে রাখা কিছু গোল টেবিলের পাশের গদিমোড়া চেয়ারে মাঝ বয়সী কিছু মর্দ সুরার গেলাস হাতে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছেন সেই নারীমূর্তিদের দিকে। ওদিকে মঞ্চের দিকে বাজছে চড়া বাদ্যযন্ত্রের গান। আলম ভাই আমাদের নিয়ে বসেন কোণের দিকের এক টেবিলে। আমরা বসবার পরেই হাতে একখানা ট্রে নিয়ে পরিবেশনকারী মেয়েটি হাজির হয়, কয়েকটি সুতো ছাড়া তার পরনে আর কোন পরিধেয় আমার চোখে পড়ে না। আলম ভাই আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, কি হে বিয়ার খাবে নাকি? আমরা দেশ থেকে সদ্য আগত নাদান, সমস্বরে মাথা নেড়ে ‘না’ বলি। ‘বাচ্চা ছেলে’, এই বলে আলম ভাই আমাদের জন্যে কোকের অর্ডার দেন। অর্ডার দেবার পরের সময় থেকেই শুরু হয় আসল উৎপাত। ততক্ষণে মঞ্চে একটি গান সমাপ্ত হয়েছে, আর তার পরেই এক ঝাঁক নর্তকী এসে আমাদের ধরল বখশিসের জন্যে। কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে আমরা আলম ভাইরের দিকে তাকাই। তিনি হেসে আমাদের একটা বিহিত দেন, ‘বলে দাও উই আর ব্রোক ফর টুডে’। ওদিকে আলম ভাই কিন্তু সেটি করছেন না। তিনি এর মধেই পকেট থেকে বের করে ফেলেছেন এক ডলারের নোটের একটি বান্ডিল। সে গন্ধে ফুলেল গন্ধ পাগল ভ্রমরের মতো নর্তকীর দল এসে ভিড় করলো তার কাছে। আর তিনি সেকালের জমিদারেরা যেভাবে মুজরো নাচের পর নর্তকীদের ‘বহত খুব বহত খুব’ বলে ছুঁড়ে দিত মুক্তার মালা, সেভাবেই নর্তকী দলের মাঝে বিলোতে লাগলেন সেই এক ডলারগুলো। এর মধ্যে অনেকে আবার এসে তার অধরে চুমো খেয়ে বলল, ‘এতকাল আসনি কেন সোনা’? সঙ্গত কারণেই বনি ভাই আগেই আলম ভাইয়ের একটি ছদ্মনাম আমার কাছে প্রস্তাব করে রেখেছিল, আর সেই নামটি ছিল ‘গরম দাদা’। এবার এইসব কাণ্ড দেখে বনি ভাই আমার কানের কাছে মুখ এনে চুপি চুপি বললেন, “গরম দাদার দেখি এখানে বাঁধা মেয়ে মানুষ আছে”। তবে তখনও সব খেলা সাঙ্গ হয়নি। এই দল মধু নিয়ে বিদায় হবার পর দীর্ঘদেহী আরেকটি মেয়ে এগিয়ে আসে গরম দাদার কাছে। আমরা ভাবি এও কি এসেছে বখশিসের লোভে? একে কিন্তু গরম দাদা একটু বাড়তি খাতির করেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর তাকে আদর করে নিয়ে বসান নিজের বাঁ হাঁটুর উপর আর মেয়েটির সাথে শুরু করেন খেজুরের গুড় মিশ্রিত মিঠা আলাপ। মেয়েটিও মজে গিয়ে বাঁধ ভাঙা হাসিতে ভাসিয়ে দেয় গরম দাদার কোল। আমরা দাদার কিনে দেয়া কোক গেলার এক পর্যায়ে বিষম খেয়ে দেখি তিনি আমাদের উপস্থিতি পুরোপুরি ভুলে গিয়ে ডুবে গেছেন লীলার সাগরে। আবারও বনি ভাই আমার দিকে ভাবপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করেন, যার অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা এমন, ‘এ কোথায় এলেম রে বাবা’? সাময়িক উত্তেজনা ভেঙ্গেচুড়ে গেলে পুরো ব্যাপারটি আমার কাছে বড্ড বেশি স্থূল মনে হয়, আমি ফেরবার সময়ে বনি ভাইকে চুপি চুপি বলি, ‘সালাম নমস্তে, এ জায়গায় আর নয়’।
(চলতে পারে)
মন্তব্য
একি কথা? চলতে পারে, মানে? অবশ্যই চলতে হবে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
দেখি সময় পেলে লিখবো হয়তো
গুডরিডস
শেষে চলতে পারে লিখে তো পপ্পনানুভূতিতে আঘাত দিলেন মিয়া, চলবে না মানে?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মাঝে মাঝে ভাবি কি হবে আর এতো কিছু লিখে, ক জনেই বা এসব পড়ে দেখে !
গুডরিডস
নীরব পাঠকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। এই যেমন আমি। লিখে যান। হয়তো আপনি জানছেন না, তবে অনেকেই পড়ছে এবং পড়বে।
রব
ধন্যবাদ, হয়তো আপনার কথাই ঠিক. দেখি সময় করে লিখে ফেলবো বাকিটা।
গুডরিডস
লেখালেখির জগতে যখন এসেছিলেন তখন তো স্বেচ্ছায় এসেছিলেন। কে কী বলবে না বলবে এসব না ভেবেই লেখা শুরু করেছিলেন। তাহলে আজ এ প্রশ্নকে প্রশ্রয় দেন কেন যে সেটা কেউ পড়বে কি পড়বেনা? একটু ভালো করে ভেবে দেখুন, আপনি আসলে তো লেখেন নিজের জন্য। যা কিছু লেখেন তার কত শতাংশ পাঠকের সামনে আনেন? তারচেয়ে ঢেড় বেশি অংশের পাঠক কি কেবল আপনি নন্? একটা লেখা লিখলে যে আনন্দ পাওয়া যায় সেই লেখাটা এক হাজার বার পড়লেও কি সেই অনির্বচনীয় আনন্দের ভাগ পাওয়া যায়? সৃজনশীলতাকে বাধাহীনভাবে বয়ে যেতে দিতে হয়। তাতে স্রষ্টার সামর্থ্য অনুযায়ী সৃষ্টিকর্ম তৈরি হতে থাকে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে হয় সৃষ্টিকর্ম মানসম্মত হবে না, নয়তো অব্যক্ত ভাবনা মনে ভেতর গুমরে গুমরে নিজের কষ্ট বাড়াবে। যাদের লেখালেখি জোরজার করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে একমাত্র তারাই জানে এর মর্মবেদনাটি কী!
আপনার এই কথাগুলো আমার মন ছুয়ে গেল, সত্যিই চমতৎকার বলেছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
গুডরিডস
চলুক, চলুক, চলতে থাকুক।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
গুডরিডস
আপনার জীবনের সাথে জড়িত (বলা যায়) এমন প্রতিটা গল্প পড়ার ,জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। অনুরোধ রইল চালিয়ে যান।
এ্যানি মাসুদ
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, চেষ্টা থাকবে।
গুডরিডস
নতুন মন্তব্য করুন