আমরা সেই সাত সকালে চলা শুরু করেছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণের সান ডিয়েগো শহর থেকে। মানচিত্র মোতাবেক সেখান থেকে সিয়েরা নেভাডায় পৌঁছুতে বড়জোর ঘণ্টা পাঁচেক লাগবার কথা। তবে মানচিত্রের সময়ের হিসেব বোধ করি এই পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথের নিম্ন গতিসীমার কথা মাথায় রেখে করা হয়নি। আর তাই এই পাহাড় বাইতে গিয়ে টের পেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছুতে নিদেন পক্ষে আরও দু ঘণ্টা বেশি সময় প্রয়োজন পড়বে।
হোলও তাই, পাক্কা সাড়ে সাত ঘণ্টা পর লজ পোল নামক জায়গায় এসে যখন আমরা তাঁবু গাড়বার জন্যে বোঁচকা নামালাম তখন সূর্যের আলো মরে গিয়ে বিকেল নামবার পালা। পাহাড়ি এলাকায় নাকি সন্ধ্যেও নামে ঝুপ করে, তাই অয়ন আমাকে তাড়া লাগাল তাঁবু টাঙাবার কাজে হাত লাগাবার জন্যে। আমরা আজ রাতটা এখানেই কাটাবো। জীবনে কোনদিন ‘ক্যাম্পিং’র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি। তাই এ যাত্রায় ভেবেছি অয়নের কাছ থেকে এ বিষয়ে বিশেষ কিছু তালিম নিতে হবে। ও এ ব্যাপারে রীতিমতো দুর্ধর্ষ। আগের বছর অফিস থেকে টানা দু সপ্তাহের ছুটি নিয়ে কোন এক সাহেব পার্টির সাথে ক্যালিফোর্নিয়ার দুর্গম কিছু পাহাড়ি এলাকায় ক্যাম্পিং করে এসেছে। তাই এবারের এ অভিযানে ওকে ওস্তাদ না মেনে উপায় কি?
তাঁবু খাটাবার পর লেগে গেলাম খাবার দাবারের এন্তেজামে। আমরা সাথে করে দু দিন বেঁচে থাকবার মতো যা যা দরকার তাঁর সবই প্রায় বোঁচকাগত করে এনেছি। হেজাক বাতি, ছোট রান্নার চুলো, মাথায় ঝোলাবার টর্চ, বরফে ডুবিয়ে রাখা কিছু মাংস, শুকনো রুটি-বিস্কুট সবই আছে আমাদের সাথে। তবে আমরা সে বেলায় আর বড় কোন রান্নার ঝামেলায় না গিয়ে শুকনো খাবার দিয়েই রাতের ক্ষুধা নিবৃত্ত করবো বলে ঠিক করলাম। ওদিকে অয়ন আমাকে পাঠাল আশপাশ থেকে শুকনো কিছু ঝরা ডাল সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে, রাতে নাকি আগুন ধরাতে হবে এতে। হাতে তো আর কোন কুঠার নেই যে সুবিধেমত কোন গাছের ডাল-কাণ্ড কেটে নিয়ে আসবো, ওই হাত আর দৃষ্টি এই সম্বল করে বনপথের এখানে সেখানে পড়ে থাকা বেশ কিছু শুষ্ক ডাল তুলে আমাদের ক্যাম্প গ্রাউন্ডে যখন ফিরে এলাম ততক্ষণে অয়নের খাবার সাজানো শেষ। আর একটু পরেই অন্ধকার নামবে, এখনই সূর্য সরে গিয়ে পাতলা এক শিরশিরে বাতাস বইতে শুরু করেছে। রাতের সেই খাবারের পালা যৎতাড়াতাড়ি সাঙ্গ করে বেঁচে যাওয়া কয়েক টুকরো রুটি আর পরের দিনের বাকি খাবার আমাদের গাড়ির ট্রাঙ্কে রাখতে যাবো, এমন সময় অয়নের হুঙ্কার, “তুমি কি চাও আজ রাতে আমার এই নয়নের মনি গাড়িখানা ভালুকের পেটে যাক”?
“ভালুক? বল কি? ইয়ে মানে রাতে এখানে ভালুক আসার সম্ভাবনা আছে বুঝি”?
“কেন তুমি কি বাঘ, সিংহের আশা করছিলে নাকি হে”?
গভীর রাতে আমি আমাদের সাথে আনা ছোট তাঁবুখানার ভেতরে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছি, আর এক বুনো ভালুক তাঁবুর ঢাকনা সরিয়ে আমার শিয়রের কাছে গন্ধ শুকে দেখছে, এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করতেই যেন গলা শুকিয়ে এলো। অয়নকে আমার সেই আতঙ্কের কথাখানি খুলে বললাম, আর তাছাড়া আমি তো খাবার রেখে দেব গাড়ির ট্রাঙ্কের ভেতরে, সেখানে খাবার রাখার সাথে ভালুকের পদধূলি পড়বার যোগসূত্র সম্পর্কেও প্রশ্ন করতে ছাড়লাম না। অভিজ্ঞ ক্যাম্পারের মতো সে জানালো, না রাতের বেলায় ভালুক এলেও ক্ষতি নেই, মানুষ তাদের কোন ক্ষতি না করলে তারা সহসা তেড়ে আসে না। তবে তাদের ঘ্রাণশক্তি আমাদের চেয়ে কয়েকগুন বেশি প্রবল। তাই গাড়ির ডালার ভেতরে খাবার রাখলেও সেই ঘ্রাণ অনেক দূর থেকে ভালুককে প্রলুব্ধ করে নিয়ে আসতে পারে। এভাবে খাবার খুঁজতে গিয়ে ভালুক পুরো গাড়িটিই থাবা দিয়ে উল্টে ফেলেছে এমন কাণ্ডও নাকি বহুবার হয়েছে। তাহলে উপায়? উপায় আছে, এই বনের প্রতিটি ক্যাম্প গ্রাউন্ডেই সিন্দুকের মতো লোহার তৈরি কিছু বাক্স আছে, নিয়ম হল খাবার-দাবার সব সেই বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে লোহার ডালা বন্ধ করে রাখা। অয়নের কাছ থেকে অভয় পাবার পরও সেদিন মাঝরাতে প্রক্ষালনের কাজে বাইরে বেরিয়ে নিজেকে পুরোপুরি আতঙ্কমুক্ত রাখতে পারিনি, প্রতি মুহূর্তেই মনে হয় এই বুঝি গুটি-শুটি মেরে কালো লোমশ এক ভালুক এসে আমার পেছনে দাঁড়াল।
মাসটি সেপ্টেম্বর, সমতলে তখনও ঘাম ছুটে যাবার মতো গরম। তাই আমি ভেবেছিলাম পাহাড়ে আর কতখানি শীতলই বা হতে পারে। সাথে করে তেমন একটা গরম কাপড় আনবার প্রয়োজন তাই অনুভব করিনি। কিন্তু প্রকৃতি পাহাড় আর সমতলে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে নিজেকে মেলে ধরে। অন্তত রাতের বেলায় সেই তফাতখানি সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয়। সিয়েরা নেভাডার সেই সাত হাজার ফুট ওপরের রাতটি নেমে আসে সমতলের জানুয়ারি মাসের শীতলতা সমভিব্যাহারে। আমি ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকি। আমার কুড়িয়ে আনা সেই ডালগুলোতে অয়ন আগুন ধরায়, তাতে হাত পা সেঁকে কিছুটা আরাম হলেও রাতে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে শোবার সময়ে বুঝতে পারি আসল মজাখানি। অগত্যা সাথে করে আনা হাত মোছবার তোয়ালে দিয়ে গলা পেঁচিয়ে কুঁকড়ে শুয়ে ভোরের অপেক্ষা করি।
প্রচণ্ড শীতে আমার ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করে ঘুম না আসায় আমি তাঁবুর বাইরে মুখ নিয়ে মাথার ওপরকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। শহরে কেবল আমরা বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ এসবের কথা বলি। কিন্তু আলোক দূষণ নামেও যে একটি বস্তু আছে সে কি আমরা জানি? সৌভাগ্যবশত লোকালয়ের বহু দূরের এই বনটি কিন্তু এই তিন প্রকারের দূষণ থেকেই মুক্ত। আর সেকারণে আকাশের ঢেলে দেয়া তারাগুলো সাদা বেলি ফুলের এক মালার মতো দৃশ্যমান হয় পুরো পট জুড়ে। সেই রাতে শীতের কামড়ে ব্যাপক ভোগান্তি হলেও রাতের এই তারাখচিত আকাশ নিজেকে আমার কাছে পুরোপুরি উন্মোচিত করে ভোগান্তির ব্যাপারটি ভুলে যেতে সাহায্য করলো। আমি সেই নক্ষত্র মনিহার খচিত আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অলৌকিক নিস্তব্ধতায় মোড়া বনের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারের গভীরতা পরিমাপের চেষ্টা করি। কোথা থেকে যেন ‘হুপ-হাপ’ শব্দ ভেসে আসে, তারপরেই আবার সব চুপ। আমি কান খাড়া করে আবারও শুনবার চেষ্টা করি, কিন্তু সফল হই না। রহস্যময় আঁধারে ঢাকা সেই রজনী তার সকল গোপনীয়তা আমার কাছে ফাঁস করে না।
রাত শেষের ভোরটি আসে তার সমস্ত আলোক বিভাসহ। নাইলনের তাঁবুর চেন খুলে বাইরে এসে আমি এক সিডার গাছের ডাল ধরে থমকে দাঁড়াই। অদূরের এই পাইন গাছের ডালে কাটার মতো থোকা হয়ে ঝুলে থাকা পাতায় রবিরশ্মি বিকিরিত হয়ে আছড়ে পড়েছে পাশের আরেকটি গাছের ডালে, আর পত্রদলের মাঝ দিয়ে পলায়নের সময় সেই রশ্মি নিচের ভূমিতে ফেলে যাচ্ছে ঝড়ে পড়বার অপেক্ষায় থাকা সারা রাতের শিশির। আমি করতল বাড়িয়ে প্রভাতের এই অপার্থিব আলোক আর শিশির বিন্দুর ছোঁয়া পাবার চেষ্টা করি। অয়ন তখনো জাগেনি, আমি তাই একাই বনের মাঝে ঘুরতে যাই কয়েকটি পাখির সমবেত কূজনকে অনুসরণ করে।
যে অরণ্যকে নিয়ে এত কথা তার নামই তো বলা হল না। আমরা এসেছি সেকুইয়া ন্যাশনাল পার্কে। ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্য পূর্বাঞ্চলের সিয়েরা নেভাডা পার্বত্য এলাকায় এক বিশাল এলাকা জুড়ে এই পার্কের অবস্থান। একটি বিশেষ কারণে আজ এই পার্কটি জগদ্বিখ্যাত। কারণ এখানেই আছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ সেকুইয়া বৃক্ষটি। তবে শুধু সে বিশেষ বৃক্ষটিই নয়, এ অরণ্যের আর সব সেকুইয়া বৃক্ষের বয়সই নিদেনপক্ষে হাজার বছর। সময়ের খরস্রোতে আমাদের এই পৃথিবী থেকে বহু কিছু বিদেয় নিলেও হাজার বছর আগেকার প্রকৃতির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এই সেকুইয়া বৃক্ষগুলো এখনও নিজেদের জাগিয়ে রেখেছে।
উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে আমেরিকার বেশ কিছু পরেবেশবাদী এবং পরিবেশ-বিজ্ঞানী আঁচ করতে পারেন দেশের বিশাল বনাঞ্চল এবং পার্বত্য অঞ্চলগুলোকে যদি সরকারি ভূমির আওতায় এনে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা না দেয়া যায় তবে সেসব অঞ্চলের ভবিষ্যৎ অতি ম্লান। অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের শ্যেন দৃষ্টি যদি একবার এই বনাঞ্চলগুলোতে পড়ে তবে অচিরেই উজাড় হয়ে যাবে বনের কাঠ, প্রাকৃতিক নির্ভেজাল পরিবেশ। হয়তো বন কেটে সেখানে বানানো হবে পর্যটক লজ কিংবা আধুনিক সুবিধে সম্পন্ন স্কি রিসোর্ট। প্রায় একশ বছর আগেই তারা অনতিদূর ভবিষ্যতের চিত্রটি ধরতে পেরেছিলেন। মূলত তাদের উদ্যোগ আর সরকারের কাছে জোর তদবির, এসবের ফলেই মার্কিন ফেডারেল সরকার আঠার শতকের শেষ দিকে এই বনাঞ্চল এবং সংলগ্ন অঞ্চলকে একটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। সে সুবাদেই সেকুইয়া বন রক্ষা পায় বিংশ শতকের মানুষের লালসার হাত থেকে, আর আমাদেরও সুযোগ ঘটে বিস্ময়কর এই বৃক্ষগুলো নিজ চোখে দেখবার।
সেই হাজার বছর ধরে মেঘকে ছোবার সংকল্প নিয়ে দারুচিনি রঙের বাকল সর্বস্ব সেকুইয়া গাছগুলো নিজেদের কেবল নাড়িয়ে বাড়িয়ে তুলেছে। ফলশ্রুতিতে আজ এই গোটা বনানী ঢেকে গেছে আকাশছোঁয়া সেকুইয়া বৃক্ষরাজিতে। ওই যে দারুচিনি রঙের বাকল, সেটিই নাকি এই বিশেষ প্রজাতির বৃক্ষকে রক্ষা করে পোকামাকড়ের আক্রমণ, ফাঙ্গাস, আগুন কিংবা ক্ষয় থেকে। এদের এই বিপুল প্রাণশক্তির পেছনে এটাই একটা গোপন সূত্র। শুধুমাত্র প্রবল বেগের ঘূর্ণিবায়ু ছাড়া এমন বিশাল গাছগুলোকে উপড়ে ফেলা অসম্ভব। এই অমর, অজড় গাছের বনানীর মাঝেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ গাছটি, যেটি দেখতে প্রতি বছর শত শত লোক ভিড় করে। আমাদের আজকের সকালের প্রথম গন্তব্য সেখানেই। তবে সেই গাছটি ঠিক পথের পাশে নয়, আমাদের ক্যাম্প গ্রাউন্ড থেকে প্রথমে দশ মিনিটের পথ অতিক্রম করে সেই গাছটি এই বনের যে অংশে আছে সেখানের এক প্রান্তে গাড়ি রেখে বনের ভেতরে প্রায় মাইল খানেক হেঁটে তবেই সেই বৃক্ষের দেখা পাওয়া যেতে পারে। এই যাবার পথটিও ঠিক সমতল নয়, কিছুটা আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ। আমি এ পথের দু পাশের আর যে সেকুইয়া বৃক্ষগুলোকে দেখতে পাই তাঁর প্রতিটিকেই সেই বিশেষ বৃক্ষ ভেবে বসি, পথ চলতি মানুষের প্রবাহ সেগুলো অতিক্রম করে সামনের দিকে ধাবমান হওয়ায় নিজের ভুল বুঝতে পারি। সেখানেই এক উদর মেলে ধরা প্রকাণ্ড সেকুইয়া গাছের ভেতরে ঢুকে নিজেকে লুকিয়ে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকি আর ভাবি গৌতম বুদ্ধ কি এমনই কোন প্রকাণ্ড অশ্বথু গাছের নিচে বোধি লাভ করেছিলেন? সেই গাছের কোটরটিকে আমার রীতিমতো গুহার মতো মনে হয়, সঙ্গে লোটা কম্বল থাকলে হয়তো সেখানেই শুয়ে কাটিয়ে দিতাম একটি বেলা। ওদিকে আমার বন্ধু বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবার পর বুঝতে পারি আমি হাওয়া, আমাকে সেই কোটর থেকে সে এক প্রকার টেনে বাইরে নিয়ে আসে। আমি আবারও সেই বুনো পথে পা রাখি। অবশেষে প্রায় মিনিট বিশেক হাঁটবার পর সেই কাঙ্ক্ষিত বৃক্ষটির দেখা পাই, বিস্ময়ে হা হয়ে যাই এর কাণ্ডের বেধ দেখে। বহুতল ভবনের ঊর্ধ্বতলের দিকে তাকাতে গিয়ে ঘাড়ের দিকে যেমন অনেক সময় চিনচিনে ব্যথা হয়, এই গাছটির একেবারে শীর্ষদেশের দিকে তাকাতে গিয়ে আমারও সেই দশা হয়।
এই গাছটির একটি নাম আছে, জেনারেল শেরমান। আমেরিকার সিভিল ওয়ারের সময়কার এক বীর সেনানী জেনারেল শেরমানের নামানুসারে এই গাছটির নাম। বর্তমান পৃথিবীতে বৃহৎ গাছ পরিমাপের বেলায় উচ্চতা কিংবা কাণ্ডের ব্যাসকে প্রাধান্য দেয়া হয় না, বরং এক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারের জন্যে গাছের ঘনত্বকে বিবেচনায় আনা হয়। সে বিচারে ৫২,০০০ ঘনফুট কাঠ আর তেরশ টন ওজনের এই বিশাল গাছটি নিঃসন্দেহে সুবৃহৎ গাছ, যদিও ২৭৫ ফুট উচ্চতা নিয়েও এটি কিন্তু আবার পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গাছ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গাছও এই সেকুইয়া বৃক্ষের কাছাকাছি একটি জাত, আর সেটিরও দেখা মেলে এই ক্যালিফোর্নিয়াতেই।
প্রায় বাইশ শ বছরের পুরনো শেরমানের গাছটির সামনে আমি বিহ্বল হয়ে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি, এই মহীরুহের কাছে কেন যেন নিজেকে বড্ড ক্ষুদ্র আর ক্ষণস্থায়ী মনে হয়।
ফুটের হিসেবে আমি যদি এই সেকুইয়া বৃক্ষগুলোর কাণ্ডের পরিমাপ উল্লেখ করি, তবে হয়তো অনেক পাঠকই এই বিশালতা সম্পর্কে মনের মাঝে ছবি আঁকতে কিছুটা বেগ পেতে পারেন। তাই আমি কাজটি সহজ করে দেবার
জন্যে একটি ঘটনার উল্লেখ করি। সেই শেরমান গাছের বন থেকে বেরিয়ে এবার আমরা ধীরেসুস্থে গাড়ি চালিয়ে যাই এই বনের উল্টো দিকের এক ধারে। সেখানে হটাৎ দেখতে পাই আমাদের পথ রোধ করে আছে একটি দানবসম সেকুইয়া গাছ। এই গাছটি সেই ১৯৩৭ সালে কোন এক কারণে মাটিতে আছড়ে পড়েছিল, চলাচলের রাস্তাটিকে বন্ধ করে দিয়ে। প্রায় একুশ ফুট ব্যাসের এই প্রকাণ্ড গাছটিকে সরিয়ে এক পাশে রাখতে গেলে সেই আলাদিনের চেরাগের দৈত্যকে খবর দেয়া ছাড়া উপায় নেই। অগত্যা উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণকারীরা এক বুদ্ধি বাতলেন। সামনে এগিয়ে নেয়া রেলপথের সামনে হটাৎ কোন পর্বত এসে বাঁধা দিলে যেমন পর্বতের মাঝ দিয়েই সুড়ঙ্গ খুঁড়ে অপর ধারে রেললাইনকে নেয়া হয়, ঠিক সেভাবেই তারা গাছটিকে না সরিয়ে কাণ্ডের বেশ খানিকটা অংশ কেটে সড়কের দু ধারকে জোড়া দেবার পরিকল্পনা করলেন। আমেরিকায় তখন চলছে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা। আমাদের দেশের ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী’র মতো মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকার গরীব কর্মহীন অনেককে তখন সরকারের বিভিন্ন অবকাঠামোমূলক উন্নয়ন কাজে ঢোকাচ্ছে, পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশের দুর্গম এলাকাগুলোতে। এদেরকে বলা হতো ‘সিভিলিয়ান কনসারভেসন কর্পস’। সেকুইয়া বনেও তখন এমন একদল কর্পস নিয়োজিত ছিলেন, তাদের এ সময়ে ডেকে এই গাছ কাটার কাজে লাগিয়ে দেয়া হল। প্রবল উৎসাহে কিছু দিনের মাঝেই প্রয়োজন মাফিক এক সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তারা চলাচলের পথটিকে পুনর্জীবিত করলেন। ব্যাস তারপর থেকে সেটাই হল এক মজার বৃক্ষ টানেল। অনেকেই এখন এখানে আসেন ওই বৃক্ষ টানেলে নিজের গাড়ি হাঁকিয়ে বিরল এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে।
এবারে আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসি গ্রানাইট পাথরের এক পাহাড়ের পাদদেশে, পর্বতপ্রমাণ সব বৃক্ষের মাঝে হুট করে এই পাথরের পাহাড় কি ভাবে এলো কে জানে! সেই ত্রিশের দশকের সিভিলিয়ান কর্পসের লোকেরাই এই পাথুরের পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে তৈরি করেছিলো একেবারে চুড়োয় পৌঁছুবার সিঁড়ি। প্রায় চারশো ধাপের সেই সঙ্কীর্ণ সিঁড়ির দুশো ধাপ পেরুবার পরই আমি হাল ছেড়ে দিয়ে মুখ হা করে পুবের হাওয়া গিলতে লাগলাম। আর তখুনি আমাকে ঘেঁসে ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ ‘হাই’ বলে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। নিজেকে লজ্জা দেবার জন্যে ওই একটি দৃশ্যই যথেষ্ট। এতো অল্পতেই দমে যাবার জন্যে নিজেকে খানিক ভৎসনা করে হাঁটুতে আর কিছুটা জোর, বুকে আর কিছুটা দম ভরে নিয়ে বাকি দুশো ধাপ পেরোবার জন্যে তৈরি হলাম। সেই চুড়োয় পৌঁছুবার পর কিন্তু যাবতীয় ক্লান্তি কর্পূরের মতো উবে গেল বহু দূরের দিগন্তরেখায় মিশে থাকা বরফাচ্ছাদিত মাউন্ট হুইটনির শৈলশ্রেণি অবলোকন করে। আমি প্রাণভরে সাড়ে ছ হাজার ফুট ওপরের বিশুদ্ধ নির্মল বায়ুর স্বাদ নেবার পর পা ছড়িয়ে বসে মধ্যাহ্নের মিষ্টি আলো গায়ে মাখলাম।
সেকুইয়াতে দু রাত কাটাবার পর পরদিন সকালে আমরা সমতলের পথ ধরি। সিয়েরা নেভাডার সেই ভয়ংকর সুন্দর পাহাড়ি পথ বেয়ে সন্তর্পণে নেমে আসবার পর ভাইসালিয়া নামক এক গ্রামীণ জনপদের মেঠো পথ ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলে। সে পথে টেবিল পেতে কিছু-মিছু নিয়ে বসা এক কৃষককে দেখে আমরা কৌতূহলবশে গাড়ি থামাই। তার কাছে আমরা পাই এ অঞ্চলের টসটসে স্ট্রবেরি, কমলা আর হরেক পদের মধু। দশ ডলারে তেমনই এক বোতল মধু হস্তগত করে ভাবতে থাকি, যাক সিয়েরা নেভাডার কোন একটি স্মৃতি অন্তত সাথে করে নেয়া গেল।
মন্তব্য
এতো বড় বড় গাছ কি কোন কালে বৃক্ষপুজারীদের পুজা টুজা পায়নি? আমাদের এদিকে বট অশ্বত্থ নিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে যা হয় সেরকম কিছু করবার কি সেখানে লোক ছিলনা?
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
তেমন কিছু না হলেও বৃক্ষ পূজারী তো ছিলই, এই যে যাঁরা আন্দোলন করে এই বনকে সরকারী সংরক্ষিত ভূমির আওতায় আনলেন তাঁরাও তো একপ্রকার বৃক্ষ পূজারীই
গুডরিডস
মুরিকায় বিশ বছরের পুরানো গাড়ি, তাও আবার ম্যানুয়াল! কোন জাদুঘর থেকে কিনে আনা হয়েছিল নাকি?
কই জানি দেখছিলাম যে সবচে উঁচু গাছ নাকি মার্ক করা না, মানুষ যাতে না জানে এই জন্য। পার্কে আর কি আছে তা তো বললেন না; ছবিও দেখালেন না।
আম্রিকার ছাত্র পাড়াগুলোতে কিন্তু এমন গাড়ি বিরল নয়, সেখানে তিন-চারশ ডলারে এমন অনেক গাড়িই হাতবদল হয়. আমার বন্ধুটি এই গাড়ি ছাত্রকালে তার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলো, পরে দেখা গেলো গাড়ি পুরোনো হলেও সার্ভিস দেয় চমৎকার। তাই এই গাড়িটিকে সে ভালোবেসে ফেললো।
আপনি ঠিক বলেছেন, সবচেয়ে দীর্ঘ যে গাছটি সেটি মার্ক করা না. এই বন সম্পর্কে হয়তো আরো কিছু কথা বলতে পারতাম, কিন্তু তাতে করে লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যায় কিনা সে ভয়ে আর লিখিনি।
গুডরিডস
আপনার লেখা দীর্ঘ হলেও সমস্যা নাই।
গুডরিডস
চমৎকার!আপনার লেখা উপভোগ করি
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
গুডরিডস
চমৎকার আপনার লেখনি। নিজের অজান্তেই আপনার পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকি। ঠিক যেমন এখনও পরের লেখার অপেক্ষা শুরু করে দিলাম।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
ধন্যবাদ রূপক আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্যে
গুডরিডস
নতুন মন্তব্য করুন