২৫ সে জুলাই, ১৯৪৫
কাইসার স্ট্রাসে স্ট্রিট। পোটসডাম শহরের বেবেলসবার্গ এলাকায় এ স্ট্রিটের অবস্থান। পোটসডাম এমনিতেই এক ছোটখাটো ছিমছাম শহর, বার্লিনের খুব কাছে হয়েও রাজধানীর কোলাহল একে স্পর্শ করেনি। আর এই যে বেবেলসবার্গ এলাকা, এটি তো আরও একধাপ উচ্চ বনেদী এলাকা। এখানে বিশাল সব এলাকা নিয়ে ধনী জার্মানদের বসতবাড়ি। তেমন সব বাড়ির অন্যতম একটি হল দু নম্বর কাইসার স্ট্রাসে স্ট্রিটের বাড়িটি। হাভাল হ্রদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাসাদপ্রম অট্টালিকায় কয়েক পুরুষ ধরে এক ধনী সওদাগরের বাস। যুদ্ধের ডামাডোলে সংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হলেও ভাগ্যচক্রে বেঁচে গেছে এ পাড়ার বাড়িগুলো। আর সেটাই হয়তো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এ বাড়ির বাসিন্দাদের। মাস দুয়েক আগে যুদ্ধ থামবার পর লাল ফৌজের লোকেরা এসে একদিন অকস্মাৎ বাড়ির লোকেদের টেনে বাইরে বার করে রাস্তায় তুলে দেয়, বাড়ির মালিকের একমাত্র কন্যা লাল ফৌজের সদস্যদের হাতে হয় ধর্ষিত। বাড়িটিকে ফৌজিরা পরিণত করে তাঁদের ব্যারাকে। তারপর গত দু মাস ধরে এ-এলাকায় বেশ কিছু সংস্কার কাজ চলে, রাস্তাঘাটগুলো মেরামত করা হয়, টানানো হয় রুশ ভাষায় সড়ক-নির্দেশক, ধ্বসে পড়া সেতুর স্থলে বসানো হয় অস্থায়ী পল্টুন-সেতু। আর এই জুলাই মাসে পাড়ার বাদবাকি বাসিন্দারা দেখেন আরেক অদ্ভুত কাণ্ড। তাঁরা দেখেন— এ বিশেষ বাড়িমুখী সড়কে বিশাল সব গাছের গুড়ি ফেলে বানিয়ে ফেলা হয়েছে এক কুৎসিত দেয়াল, যাতে করে বাইরের পৃথিবীর লোকেরা ভুলেও এ বাড়ির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ না করতে পারে। ভেতরে ভেতরে যে বিশাল কিছু একটা ঘটতে চলেছে এ-বাড়ি কিংবা এ-পাড়াকে কেন্দ্র করে, সেটি তাঁরা আঁচ করতে পারেন।
তাঁদের অনুমান কিন্তু মিথ্যে ছিল না। সপ্তাহখানেক আগে বাড়িটিতে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন এমন একজন যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল এক নিরাপত্তা বলয়। মস্কো থেকে তিনি যেভাবে এসেছেন সেটি হয়তো রাজাধিরাজদের আগমনকেও হার মানায়। এগারো বগির এক ট্রেনে প্রায় কয়েক হাজার সৈন্য সামন্তসহ তিনি মস্কো থেকে এসে পৌঁছেছেন পোটসডাম শহরে। তাঁকে অবশ্য অনেকে বিমানে চড়ে আসবার পরামর্শ দিয়েছিলো, কিন্তু হাউই গাড়িতে চড়বার ব্যাপারে তাঁর রয়েছে এক ধরণের সুপ্ত আতঙ্ক। সেটি লুকিয়ে তিনি পারিষদবর্গকে বলেছিলেন, ট্রেনে চড়েই তিনি এই হাজার মাইলের পথ পাড়ি দিতে চান, যাতে করে জার্মান-বাহিনীর হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বদেশের কিছুটা দৃশ্য নিজচোখে দেখতে পান। সেই বিশাল লটবহর নিয়েই তিনি অতঃপর এসে ওঠেন এ বাড়িতে। তাঁর আগমন উপলক্ষ্যে বাড়িটি সাজানো হয়েছে নতুন করে, পুরনো আসবাবগুলো ছুড়ে ফেলে সেখানে আনা হয়েছে আশপাশের বাড়ি থেকে লুট করে আনা ভিন্ন কিছু আসবাব। এ বাড়ির চারদিকে প্রায় দু একর জুড়ে যে উদ্যান, সেখানে এখন সঙ্গিন হাতে সদাসতর্ক প্রহরীদের পাহারা, তাঁদের এড়িয়ে মাছিটি গলবারও সাধ্যি নেই। প্রতিপক্ষের সৈন্য কিংবা চর তো বহু দূরের কথা! বাড়ির ভেতরের বয়-বেয়ারা থেকে শুরু করে চাপরাশি, সবাই রুশ গুপ্তচর সংস্থা এনকেভিডি-র সদস্য।
হাভাল হ্রদের দিকে মুখ করে বাড়ির নিচ তলের যে লম্বাটে বারান্দা, সেখানটায় কাঠের পাটাতনে পেতে রাখা এক চায়ের টেবিলে বসে প্রতাপশালী সে নেতা কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন, সেই সাথে পুড়ছে ঠোঁটের কোণে থাকা সিগারেটর অগ্রভাগ। ধূমপান তাঁর নিত্যসঙ্গী, ধূমপান-ভিন্ন সময় অতিবাহিত করা তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য প্রায়। যদিও অল্প কিছুদিন পূর্বে একটি হার্ট এট্যাক হবার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে সবিশেষভাবে নিষেধ করেছেন ও-বস্তুটি ছাড়বার জন্যে, কিন্তু এই ষাটের কোঠায় এসে কি আর এতকালের অভ্যাসকে ছাড়া যায়? যায় না। আজকের টেবিলে তিনি অবশ্য একা নন। সাথে আছেন বিদেশমন্ত্রী মলোটভ এবং এনকেভিডি-র প্রধান পাভলোভিচ বেরিয়া।
যে বারান্দায় তাঁরা চেয়ার পেতে বসেছেন, সে বারান্দার রেলিঙের ওধারে বাগানে ফুটে থাকা ইডেল ভাইস ফুলের ঝোপ সকালের রোদে স্নান করে আরও স্নিগ্ধ সফেদ দ্যুতি ছড়ায়। সেই সাথে ভেসে আসে আরনিকা ফুলের মাতাল করা গন্ধ। অদূরের পপলার গাছ থেকে ভেসে আসে ছাতার পাখির গম্ভীর কূজন। মধ্য গ্রীষ্মের তেজি রোদ তির্যকভাবে বারান্দার কিছুটা অংশ প্লাবিত করে জানান দেয় দিনের বাকি ভাগটা বেশ তেঁতে থাকবে। মস্কোর এ-সময়কার আবহাওয়া থেকে এ কিছুটা ভিন্ন-ই বলতে হবে। ফুলহাতা ধূসর রঙের সাফারি কোটে সেই নেতা তাই কিছুটা অস্বচ্ছন্দ বোধ করছেন। হাতের সিগারেটটি ছাইদানিতে জিরোতে দিয়ে তিনি গলার কাছের বোতামটিকে আলগা করে গোয়েন্দা-প্রধানের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তারপর, কি সংবাদ নিয়ে এসেছ বল?’
বলা চলে, বেরিয়ার সাথে সকালের এই বৈঠকটি করবার কল্পেই তিনি ট্রুম্যান এবং চার্চিলের সাথে বৈঠকের সময়সূচী ফেলেছেন বিকেল বেলায়। কেনই বা তিনি আগে বেরিয়ার সাথে বৈঠক করে তারপর বাকিদের সাথে বৈঠকে যাবেন, সেটি আরও পরিষ্কার করার জন্যে অতিরিক্ত দু চার কথা না বললেই নয়।
’৪৫ সালের এ বৈঠকটিরও আগে ইরানের তেহরানে এবং ক্রিমিয়া উপদ্বীপের ইয়ালটায় এই একই নেতাদের সাথে তাঁর বৈঠক হয়েছিলো। সেবারের দু বৈঠকেও প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তাঁর টোপ গিলেছিলেন। কারণ, এ- দুটো সভাস্থল-ই ছিল তৎকালীন সোভিয়েত বাহিনীর অধীনে, তাঁরা রুজভেল্ট পৌঁছুবার আগেই সর্বত্র আড়িপাতা যন্ত্র বসিয়ে রাখে, মার্কিন গোয়েন্দারা যেটি উদ্ঘাটন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। অতিশয় ধূর্ত এ নেতা বুঝে গিয়েছিলেন, রুজভেল্ট বস্তুত তাঁর উপর এক ধরণের আস্থা সংস্থাপন করেছেন, আর তিনি মনের সুখে সেই আস্থার বারোটা বাজিয়ে গেছেন। রুজভেল্টের অকস্মাৎ মৃত্যু হলে ট্রুম্যান হন প্রেসিডেন্ট, কিন্তু তিনিও রুজভেল্টের মতোই একইভাবে পাতা ফাঁদে পা দিলেন। অবশ্য সে-জন্যে ট্রুম্যানকে খুব একটা দোষারোপ করা যায় না। সবেমাত্র প্রেসিডেন্টের গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন, আর এ-সময়েই হুট করে সোভিয়েত পক্ষ সভার স্থান হিসেবে যখন পোটসডামকে মনোনীত করে তখন হয়তো তিনিও সরল বিশ্বাসে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই চলে আসেন এ-শহরে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে। সেসব দেখে মুচকি হাসেন সেই নেতা, আর তাঁর পরামর্শ অনুসারে বিশ্বস্ত শিষ্য বেরিয়া বিছিয়ে রাখে সবিস্তার গোয়েন্দা জাল।
হয়েছিলো কি, মিত্র বাহিনী বার্লিনের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছুবার পর পোটসডাম অংশটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সোভিয়েত বাহিনী। আর এই বৈঠক স্থলের ব্যাপারে সবুজ-সংকেত পাবার পর এনকেভিডি সুচারু পরিকল্পনা করে ঠিক কোন বাড়িগুলোতে থাকবেন ট্রুম্যান এবং চার্চিল, কোন বাড়িতে হবে শীর্ষ নেতাদের বৈঠক। সেভাবেই এ সকল বাড়ির নানা আনাচে-কানাচে বসানো হয় আড়িপাতা যন্ত্র, আর এখানে অতিথি আপ্যায়নের জন্যে বয়-বেয়ারা-বাবুর্চি যারা রইলেন তাঁদের প্রত্যেকেই ওই এনকেভিডির-ই সদস্য। এই পুরো জালটি বেছানোর পর বেরিয়া নেতার সাথে শলাপরামর্শ করে তাঁকে পরামর্শ দিলেন— যেন তিনি কায়দা করে সভার সময়কাল ঠিক করেন বিকেলের দিকে। ঠিক হল, আগের রাতে ট্রুম্যান এবং চার্চিল তাঁদের দলের বাকিদের সাথে যা-যা আলাপ করবেন সেসব সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহ করে বেরিয়া সকালে নেতার কাছে নিবেদন করবেন, যাতে করে সেই মোতাবেক বিকেলের বৈঠকে নেতা সঠিক চালটি চালতে পারেন।
সেই নেতার নামটি না-হয় এ বেলায় বলে ফেলা যাক। বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই এর মাঝে ধরে ফেলেছেন, যার কথা বলছি, তিনি সোভিয়েত দেশের পরাক্রমশালী রাষ্ট্র নায়ক জোসেফ স্টালিন।
আজ এখানে বেরিয়া আসবার পূর্বে স্টালিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মলোটভের সাথে আলোচনা করছিলেন মূলত পোল্যান্ড নিয়ে, ও দেশটির পূর্বভাগের বেশ কিছুটা অঞ্চল তিনি কেটে জুড়ে দিতে চাইছেন ইউক্রেনের সাথে, এ খায়েশ তাঁর বহুদিনের, এখন ট্রুম্যান-চার্চিল বাগড়া না দিলেই হয়।
তবে পোল্যান্ড-সংক্রান্ত কোন গোয়েন্দা তথ্য নয়, বরং বেরিয়া আজ নিয়ে এসেছে চমকে ওঠার মতো ভিন্ন এক খবর। বেরিয়া জানে, তাঁর এই নেতাটি ভীষণভাবে মন মেজাজের উপর নির্ভরশীল, কোন উৎকট সময়ে এমন ধাঁচের সংবাদ দিলে গালমন্দ আর অর্ধচন্দ্র খাবার সম্ভাবনাও প্রবল। তাই সে প্রথমে কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো— আজ সকালে কর্তার মেজাজ কেমন? যদিও পরমুহূর্তেই আবার ভেবে নিলো, মর্জি যেমন-ই থাকুক, এবেলায় কথাটি না জানালেই যে নয়! নয়তো কর্তা পরে কথাটি শুনলে হয়তো আরও তেলে-বেগুনে চেতে যাবেন, তখন চাকরিটি খোয়াবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দেখা দেবে। তাই ঈষৎ দ্বিধা নিয়ে শেষ অবধি তাঁকে বলতেই হয়, ‘কমরেড স্টালিন, আমেরিকার সন্দেহজনক পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজ-সম্পর্কিত গোয়েন্দা তথ্যের ব্যাপারে আপনাকে তো আগেই অবহিত করেছিলাম। এতদিন আমরা এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। আজ খবর পেলাম, সপ্তাহখানেক আগে ওরা নিউ মেক্সিকোতে সফলভাবে এ বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে। তাঁর থেকেও বড় কথা হল, আজকের বৈঠকে ট্রুম্যান খুব সম্ভবত বোমার ব্যাপারটি আপনার কাছে বলবেন। কেন বলবেন তাতো বুঝতেই পারছেন, জাপান সম্পর্কে আপনাকে কিছুটা চাপে রাখতে হয়তো এটা তাঁর কৌশল হতে পারে। আপাতত এ-ই হল আজকের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা তথ্য।’
বেরিয়া যতটা ভেবেছিলেন ততটা প্রতিক্রিয়া স্টালিনের মাঝে লক্ষ করা গেলো না। তিনি কেবল কয়েক মুহূর্ত হ্রদের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বেরিয়ার দিকে ফিরে বললেন, “বানাতে দাও ওদের, আপাতত ও-নিয়ে তেমন কিছু আমি ভাবছি না। তবে হ্যাঁ, আমাদেরকেও কিছু একটা করতে হবে। এক কাজ করো, কুরচাটভ-কে খবর দাও। তাঁকে বল, এমন ধরণের একটি বোমা আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যেও চাই, যত শীঘ্রই সম্ভব।
নেতার এমনতর নমনীয় কথায় এবার যেন কিছুটা স্বস্তি পেল বেরিয়া, তাই এবার সে শোনাল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর যেটি যোগাড়ের কারণে সে কিছুটা বাহবা পেতেই পারে।
‘কমরেড, আরেকটি খবর হল, ব্রিটেনে খুব সম্ভবত চার্চিল পরাজিত হতে চলেছেন, আগামীকালের মাঝে হয়তো আমরা চূড়ান্ত ফল পাব। তবে আমাদের গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, তাঁর পরাজয় প্রায় নিশ্চিত।’
এবারে চওড়া মোটা গোঁফের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্টালিনের ঠোঁটের কোণে কিছুটা যেন মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। বেরিয়ার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এবারে তিনি মলোটভের দিকে একটি কৌতুকপূর্ণ সচতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভারী গলায় কিছুটা থেমে থেমে বলেন, ‘ওদের এই নির্বাচন তো দেখি আমাদের জন্যে সুবিধের পথ করে দিলো। কি বলেন কমরেড মলোটভ?’
‘সে আর বলতে, কমরেড! আমার হিসেব তো বলছে, পূর্ব ইউরোপের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আপনাকে আর তেমন কোন বাঁধাই পেরোতে হবে না। কারণ, ছয় বছরের যুদ্ধে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই ত্রিশঙ্কু, তাই আমাদের সাথে বিশেষ কোনো বিবাদে জড়াবার মতো সাধ্য বা ইচ্ছে তাঁদের এই মুহূর্তে আছে বলে মনে হয় না। আর এখন যেহেতু চার্চিলকেও বিদেয় নিতে হচ্ছে, তাই এটা অনুমান করা-ই যায়, পরেরজনের পুরো দরকষাকষির ব্যাপারটা বোঝার আগেই আমাদের এই সম্মেলন শেষ হয়ে যাবে। তাই আমার মনে হয়, এখন আপনার শুধু কাজ হবে ট্রুম্যানকে সামলানো।’
জাপান নিয়েও স্টালিন কিছুটা চিন্তিত, আমেরিকাকে একা জাপানের ভাগ খেতে দেয়া যায় না, পূবের মাঞ্ছুরিয়া অংশে আক্রমণ করে কিছুটা ভূমি ছিনিয়ে নেবার একটা কুমতলবও তাঁর মাথায় আছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু ওদিকে জাপানের দিক থেকে কোনো আক্রমণ না হওয়ায় আর জাপানের সাথে একটা শান্তি চুক্তি থাকায়, তিনি ঘোমটা খুলে ফেলে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও যেতে পারছিলেন না। মলোটভের সাথে তাই তিনি এ নিয়ে আরও কিছু আলোচনা সেরে নিলেন; ট্রুম্যানের সাথে তিনি জাপান নিয়ে কি অবস্থান তুলে ধরবেন সে ব্যাপারে কিছু বুদ্ধি-পরামর্শ করলেন।
সেদিন অপরাহ্নের কিছু পর কাইজার স্ট্রাসের সেই বাড়িটি থেকে বেরিয়ে এলো একটি গাড়ির বহর। তার একটি গাড়িতে স্টালিন চড়েছেন মার্শাল ঝুকভকে নিয়ে, আর পেছনের গাড়িগুলোতে বেরিয়া এবং মলোটভসহ অন্যরা। তাঁদের গন্তব্য মাইল তিনেক দূরের আরেকটি বিশাল প্রাসাদ। সেটি-ই সভাস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুবিশাল সেই অট্টালিকাটির নাম সেসিলিয়েনহফ প্রাসাদ। প্রাসাদের সম্মুখের গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থামবার পর ফৌজি গাড়ির দরজা ঠেলে নেমেই স্টালিন দেখলেন সেখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছেন ট্রুম্যান। চোখে গোলাকার সোনালি রিমের চশমা, মাথায় পরেছেন স্যুটের রঙের সাথে মিলিয়ে একটি হ্যাট। করমর্দনের পালা শেষ হতেই সেখানে উপস্থিত হলেন চার্চিল। এবারে এই তিন নেতা প্রবেশ করলেন প্রাসাদের মূল সম্মেলন কক্ষে, যে-কক্ষের মধ্যবর্তী স্থলে স্থাপিত একটি গোলাকার টেবিলে বসেই তাঁরা পরবর্তী ক’দিনে রচনা করলেন যুদ্ধপরবর্তী ইউরোপ এবং জাপানের ভাগ্য, সেই টেবিলেই কাটা-ছেঁড়া হয়ে গেলো মানচিত্রে, আর সেই সাথে হয়তো সূত্রপাত হল পরবর্তী কয়েক দশকব্যাপী চলা মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের।
অগাস্ট, ২০১৬ সাল
পূর্ব বার্লিন থেকে এক ট্রেনে চেপে যাচ্ছি পোটসডাম শহরে। সাধারণত এ পথে বার্লিন-অভিমুখী ট্রেনে সক্কাল সক্কাল বেশ ভিড় থাকলেও এমন উল্টো পথে ততটা লোকসমাগম হয় না। আমি তাই যে কামরায় উঠি সেখানে উঠেছে হয়তো জনাদশেক লোক। আমার উল্টোদিকে যিনি বসেছেন, তিনি গভীর মনোযোগে সকালের কাগজের পাতা ওলটান, চারদিকে ফোন-গ্যাজেটের ভিড়ে এমন দৃশ্য কিছুটা যেন বেমানান। জানালার ওপরকার ফোঁকর দিয়ে হু হু করে বাতাস এসে উল্টে-পাল্টে দেয় পত্রিকার কোণের অংশটি। এমন উতাল হাওয়ায় আমি কিছুটা জুবুথুবু হয়ে জ্যাকেটের চেনটি তুলে গলা বন্ধ করি। আমার হিসেবমতে ঘণ্টাখানেকের মাঝেই ট্রেনটি পোটসডাম শহরে পৌঁছুবার কথা। কিন্তু সারলোটসবার্গ নামক এক ছোট্ট জনপদের স্টেশনে এসে কেন যেন ট্রেনটি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময়ে লাউড স্পিকারে ভেসে আসে কিছু নির্দেশ, তড়বড়িয়ে বলা কথাগুলোর মাঝে ‘আউসগাং’ শব্দটিকে আমি আলাদা করে ধরতে পারি, অনেকটা সে সময়েই আমার বাঁ কাঁধে খোঁচা মেরে পেছনের একজন বলে, নেমে পড়, এ গাড়ি আর যাবে না। স্টেশনটি নির্জন, আমি প্ল্যাটফর্মে পেতে রাখা এক বেঞ্চে বসে উল্টোদিকের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা সাদা গোলাকার ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে সময়ের হিসেব মেপে নিই। উঁচু পাটাতনের এই প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকে লালচে ইটের একচালা এক গুদাম ঘর আমার চোখে পড়ে। তার গা বেয়ে উঠে গেছে গ্রীষ্মে বেড়ে ওঠা লতা-গুল্ম। আর বেড়ে ওঠা দূর্বা ঘাসের আশ্রয়ে লুকিয়ে থাকা পরিত্যাক্ত এক জোড়া রেল লাইনের পাত ফাঁকে-ফাঁকে নিজেকে জানান দেয়।
আমাকে সেখানে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। মিনিট বিশেকের মাঝেই হাজির হয় বার্লিন থেকে ছুটে আসা উদ্ধারকারী ট্রেন, আর তাতে চেপেই পৌঁছে যাই গন্তব্ব্যে।
পোটসডাম স্টেশনে নেমেই বুঝি বেজায় খিদে পেয়েছে, সাত-সকালে তাড়াহুড়ো করে তেমন কিছু পেটে পড়েনি। আমি তাই স্টেশন ছেড়ে বেরুবার আগে সেখানে এক বেকারিতে ঢুঁকে পরি। দোকানের সম্মুখেই একটি কাচের সেলফে দুটি সিঙ্গারা সেখানে তখন অপেক্ষারত। এই জার্মান মুল্লুকে সিঙ্গারা আবিষ্কার করে আমি কিছুটা পুলকিত হই, অতঃপর সে দিয়েই তখনকার মতো উদরপূর্তি করি।
স্টেশনের ঠিক বাইরেই এক ট্রাম-বাস স্টেশন। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আমাকে কিছুটা বিপত্তিতে পড়তে হয়। কারণ, এখানে এসে পৌঁছুচ্ছে দু দিককার বাস-ই। যেটি শহরের দিকে যাচ্ছে সেটি, আবার যেটি মূল শহর থেকে এসে পৌঁছুচ্ছে সেটি-ও। তাই ঠিক কোনমুখী বাসে যে আমাকে চাপতে হবে সেটি ঠাহর করতে আমার কয়েক মিনিট লেগে গেলো। অবশেষে কিছুটা গবেষণা করে পেয়ে গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত বাস।
আমার যেখানে যাবার কথা সেই সেসিলিয়েনহফ প্রসাদের কাছাকাছি যখন পৌঁছুলাম তখন কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। প্রাসাদ বলতে আমি ভেবেছিলেম এমন এক ভবন হবে, যার সামনে থাকবে প্রশস্ত রাজপথ, থাকবে বিশাল সিংহদ্বার। কিন্তু কোথায় কি? বাসের চালক বরং আমাদের নিয়ে ঢুকলেন দু পাশে সিডার আর ম্যাপল গাছের পাতায় ছাওয়া সরু এক সড়কে, যে-সড়কে একটি গাড়ি চললে বিপরীতমুখী গাড়িকে বেশ কসরত করে তাকে পেরিয়ে যেতে হয়। এমন এক প্রাসাদের উদ্যান-সংলগ্ন দোর ঠেলে ভেতরবাগের সামনে পৌঁছে দেখি, এ প্রাসাদের একদিককে অধুনা পরিণত করা হয়েছে এক বিলাসী হোটেলে। এমন এক ঐতিহাসিক স্থানে হোটেল বানাবার ব্যাপারটি মোটেও মনঃপুত হল না আমার। বাঁ-পাশের সেই হোটেল থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এবার আমি মূল প্রাসাদের অভ্যন্তরে ঢুকি। মূলত এ দিকটিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ’৪৫ সালের সেই শীর্ষ সম্মেলন। প্রাসাদের মূল কক্ষ সংখ্যা হল আশি, যদিও তার মাঝে অল্প কিছু ঘর সম্মেলনের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিলো, আর এখন তো প্রদর্শিত হচ্ছে এই দশটির মতো কক্ষ। তবে এই দশ-বারোটি কক্ষের বিশদ ব্যাখ্যায় গেলে পাঠকের নির্ঘাত ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতে পারে, ও কাজটি করে তাঁদের অভিসম্পাতের লক্ষ্যবস্তু হতে চাই না। তাই মূল সম্মেলন কক্ষ এবং তিন নেতার ব্যবহৃত তিনটি বিশ্রাম কক্ষের বর্ণনাতেই এ লেখাটি সীমাবদ্ধ রাখছি।
কক্ষের আলোচনার যাবার আগে বরং প্রাসাদটির কিছু আদি কথা বলে নিই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িককালে যুবরাজ উইলিয়ামের সাধ হয় এই পোটসডাম শহরের হ্রদের ধারে তিনি একটি গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ বানাবেন। সে মোতাবেক শুরু হল নির্মাণযজ্ঞ, এর নকশা করলেন সেকালের দুজন বিখ্যাত স্থপতি। কিন্তু নবনির্মিত প্রাসাদে উঠবার সৌভাগ্য যুবরাজের হল না। তার আগেই বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি হলেন হল্যান্ডে নির্বাসিত। যুবরাজের স্ত্রী সেসিলি যার নামেই কিনা এ প্রাসাদের নামকরণ, তিনি এ প্রাসাদে পুত্র-কন্যাসহ থাকার অনুমতি পেলেন। তারপর বেশ কিছুকাল পর যুবরাজ-ও নিজ দেশ জার্মানিতে আসবার অনুমতি পান, যদিও সেটি ছিল শর্তসাপেক্ষে। হিটলার ক্ষমতায় এলে যুবরাজের আশা ছিল তিনি হয়তো আবার রাজমর্যাদা ফিরে পাবেন, কিন্তু সে আশা গুঁড়ে বালি। হিটলার তাঁকে বরং একপ্রকার নজরবন্দি করে রাখে এই প্রাসাদে। তারপর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আর এ যুদ্ধেও ত্রিশ বছর আগের মতোই জার্মানি হল পরাজিত। যুবরাজের পরিবারটি এবারে পালিয়ে গেলো অস্ট্রিয়ার দিকে, সোভিয়েত বাহিনী পোটসডাম শহরে এসে যখন এ প্রাসাদকে খুঁজে পেল তখন সেখানে কেও নেই, চারদিকে সুনসান।
বিশাল এ প্রাসাদকে যখন সম্মেলন-স্থল হিসেবে নির্বাচন করা হয়, তখন আশেপাশের বনেদি বাড়ি কিংবা বার্লিনের কিছু প্রাসাদ থেকে আসবাব এনে এটিকে প্রস্তুত করা হয়। আর তাই আজ এ প্রাসাদে যে আসবাবগুলো দেখা যায় সেগুলো সেই যুবরাজের সময়কালের নয়। বিশাল এই প্রাসাদটিতে তিন বিশ্বনেতা যখন বিকেল বেলায় সম্মেলনের মূল কক্ষে ঢুকতেন, তাঁরা কিন্তু একই দরজা দিয়ে ঢুকতেন না, বরং তিনজন ঢুকতেন ওই কক্ষের লাগোয়া তিনটি ভিন্ন দরজা দিয়ে। আর সম্মেলনের ফাঁকে বিশ্রাম অথবা আলোচনার প্রয়োজনে তাঁরা ওই দরজাগুলো দিয়েই বেরিয়ে যেতেন স্বীয় কক্ষে। আমার প্রাসাদ ভ্রমণ শুরু হয় তেমন-ই একটি কক্ষ পরিদর্শনের মাধ্যমে। কক্ষটি ছিল স্টালিনের বিশ্রামকক্ষ।
সুবিশাল সে কক্ষের এক ধারে ভারী মেহগনি কাঠের একটি পড়বার টেবিল, পাশে ফায়ার প্লেস। আর অন্যধারে একটি অর্ধ-বৃত্তাকার বসবার স্থান। সামনে পাতা একটি গোলাকার চায়ের টেবিল। তার তিনধারে পাতা সাদা চামড়ায় মোড়ানো নরম গদির সোফা। আলোচ্য সোফাটির পাশে যে সুবিশাল কাচের জানালা, সেগুলোও গিয়ে ছুঁয়েছে সুউচ্চ ছাদকে। আর সেই কাচ ভেদ করে সকালের মিষ্টি আলো এসে আলোকিত করেছে সোফার পৃষ্ঠদেশকে।
সম্মেলন কক্ষের অন্য ধারে আরেকটি বইয়ের আলমারিতে ঠাসা ঘরে করা হয়েছিলো ট্রুম্যানের বসবার ব্যবস্থা। এ ঘরটিতে কেবল বই আর বই, অন্তত হাজার দুয়েক তো হবেই, বইগুলোর অধিকাংশই মূল সময়ের, পরবর্তীতে সংযোজিত নয়। মাথার ওপরকার ছাদ পাইন কাঠের আবরণে ঢাকা। সেখান থেকে ঝুলছে বাহারি ঝাড়বাতি। কক্ষের এক কোণে লাল সিল্কের কাপড়ে মোড়া আবলুশ কাঠের একটি সোফা, আর উল্টোদিকে নোট নেবার একটি টেবিল। টেবিলের ঠিক পেছনেই ঝুলছে কনস্টান্টিনোপলের একটি ছবি, এককালে তুর্কী সুলতান ছবিটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন যুবরাজ উইলিয়ামকে। ট্রুম্যানের এই কক্ষটি ছিল একেবারে মূল সম্মেলন কক্ষের লাগোয়া, আর এই কক্ষটিকে পেরিয়ে যেতে হতো চার্চিলের কক্ষে। কক্ষটি কিছুটা যেন অন্ধকার, কেন সেটি বুঝতে গিয়ে দেখি পুরো ছাদটি এখানে ঢাকা পাইন কাঠের প্যানেল দিয়ে। এ ঘরেও ওই একই ভাবে রাখা হয়েছে একই ম্যাপেল কাঠের টেবিল-চেয়ার আর কোণের দিকে রাখা রয়েছে লালচে কাপড়ে মোড়া একটি ডিভান।
এবারে আসি সেই মূল সম্মেলন-কক্ষের কথায়। এই প্রাসাদটি দ্বিতল বিশিষ্ট হলেও এ কক্ষটির মতো বিশেষ কয়েকটি ঘর ছিল দু তল নিয়েই, যার ফলে মাথার ওপরকার ছাদ বেশ উঁচুতে। আর তাই বিশাল সব জানালাগুলো যেন গিয়ে আকাশকে ছুঁয়েছে। কক্ষের ঠিক মাঝখানে বিশাল এক গোলাকার টেবিল, আর চারধারে পাতা লালচে গালিচা। এ-টেবিলটি কিন্তু এখানেই ছিল না, এটিকে আনা হয়েছিলো মস্কো থেকে। যদিও টেবিলের চারপাশের চেয়ারগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিলো বার্লিনের এক প্রাসাদ থেকে। ঠিক করা হয়েছিলো— টেবিলের চারধারে বসবেন তিন রাষ্ট্রনেতা আর তাঁদের বিশেষ সহকারীরা, আর ঠিক পেছনের আসনে বসবে তাঁদের রাজনৈতিক এবং সামরিক পরামর্শ দাতারা। একটানা প্রায় দু সপ্তাহ ধরে চলে সে সম্মেলন। নানা মারপ্যাঁচ, নানা যুক্তি তর্ক, নানা দর কষাকষির পরিশেষে ঠিক এই টেবিলেই স্বাক্ষরিত হয় ত্রিপাক্ষিয় সনদ।
আমি এবার ভবনের মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাঁ-ধারে একটি কেয়ারি করা গাছের আড়ালে ঢাকা পড়া পথ ধরে চলে যাই প্রাসাদের পেছন দিককার এক বাগানে। সেদিকে অবশ্য প্রাসাদের ভেতর দিয়েও যাবার পথ আছে, কিন্তু সেটি সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত নয়। এদিকটায় আছে এক ফোয়ারা, তাঁকে ঘিরে টিউলিপ আর লাইলাক ফুলের সমাহার। ফোয়ারাটির একপার্শ্বে স্থাপন করা হয়েছে গ্রীক পুরাণে বর্ণিত নারসিসাসের ভাস্কর্য, যিনি কিনা জলের পৃষ্ঠে নিজের প্রতিবিম্ব দেখেই পার করে দেন সারা জীবন।
সেই যে বাগান, ওটি কিন্তু একটিমাত্র ছবির কল্যাণে পরবর্তীকালে পৃথিবী-বিখ্যাত হয়। সেই ঐতিহাসিক সম্মেলনটি শেষ হবার পর তিন নেতা এই বাগানের এক কোণে তিনটি আরাম কেদারায় বসে ছবির জন্যে পোজ দিয়েছিলেন, তখনও তাঁদের মাঝে বিস্তর মতপার্থক্য, বিস্তর অবিশ্বাস। কিন্তু তবু তাঁরা সহাস্যে ক্যামেরার সামনে এসেছিলেন, কারণ সে-মুহূর্তে সারা পৃথিবীকে মিত্রশক্তির এই আপাত মিত্রতার নিদর্শন দেখানোটির বড় প্রয়োজন ছিল। নতুবা হয়তো বৃহৎ পরিসরে দেখা দিত অনিশ্চয়তা। যাকগে, সেদিনের সেই ছবিটি খেয়াল করলে দেখা যায় সেখানে ট্রুম্যান এবং স্টালিনের সাথে তৃতীয় যিনি বসে আছেন তিনি কিন্তু চার্চিল নন। চার্চিলের দুর্ভাগ্য, এই ইতিহাস সুবিখ্যাত ছবিটিতে তিনি স্থান পাননি, কারণ তার ঠিক দু দিন আগেই তিনি নির্বাচনে হেরে উত্তরসূরি এইটলির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে পোটসডাম ছেড়ে চলে যান। সেদিন ঠিক যে-স্থানে ছবিটি তোলা হয়েছিলো সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অদূরের হ্রদের দিকে তাকাই, সেখানে তখন ভেসে চলেছে দুটো ডিঙ্গি নৌকো, সেখান থেকে ভেসে আসে বৈঠা ফেলার ছপ ছপ শব্দ, আর প্রাসাদ সম্মুখের উইলো গাছগুলো জুলাই মাসের তপ্ত হাওয়ায় ঝুম মেরে পাতা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি তেমনই দুটো উইলো গাছের মাঝ দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে যাওয়া বাঁধানো পথ ধরে দূরে কথাও হারিয়ে যাই।
মন্তব্য
চমৎকার।
লেখার বিষয়বস্তু বা প্রকাশভঙ্গী নিয়ে কোন কথা নেই, সবই অসাধারণ। তবে যেভাবে দুইভাগে ভাগ করে লিখেছেন (প্রথমে ইতিহাসের গল্প পরে নিজের ভ্রমণকাহিনী) সেইটা নিয়ে আরও পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখতে পারেন চাইলে।
উদাহরণ দেই। নেটফ্লিক্সে একটা টিভি সিরিজ আছে "সার্ভাইভিং এস্কোবার"। পাবলো এস্কোবারের পয়লা নম্বরি হিটম্যান জে জে বা হোতা হোতা জেলে ঢোকার পরে (এস্কোবার অক্কা পাওয়ার পরের কথা, মেদেইন কার্টেল তখন চরম বাটে) কিভাবে কিভাবে অন্য কার্টেলের হাত থেকে জীবন বাঁচায় সেইটা নিয়ে কাহিনী। গল্প এগিয়ে যায় ফিকশন হিসাবে, হোতা হোতা এই করল এই করল ইত্যাদি। তার মধ্যে এক নারী ঢুকে সত্যকারের হোতা হোতার গল্প বলা শুরু করে, সেই নারীর পিতা বিচারক ছিলেন এবং হোতা হোতা তাকে হত্যা করে। সুতরাং এইটা ফিকশনের মধ্যে ইন্টার্ভিউ, হোতা হোতার গল্প চলে আর হঠাৎ হঠাৎ বিচারককন্যা উদয় হয়ে তার জীবনের গল্প এবং সত্যই কি ঘটেছিল তা বলে যান। ফিকশন এবং ডকুমেন্টারির হাল্কা মিশেল।
আপনার এই লেখাটি, উপর নিচে দুই ভাগে বিভক্ত করার বদলে, মিশিয়ে মিশিয়ে (ধরুন কয়েক অনুচ্ছেদ পুরোনো দিনের গল্প তার মধ্যে একটুখানি আপনার নিজের দেখা গল্প) লিখে পরীক্ষা করতে পারেন। আপনার গদ্যের হাত সবল আমার ধারণা আপনি চমৎকার পারবেন।
শুভকামনা।
..................................................................
#Banshibir.
পীর দা,
নেটফ্লিক্সের ওই মুভিটা দেখা হয়নি এখনো। তবে শীঘ্রই দেখবো আশা করি। আপনার পরামর্শটি গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করলাম এবং ভবিষ্যতে এ ভঙ্গিতে লেখা যায় কিনা, দেখবো। ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে।
গুডরিডস
অনেক দিন আপনার কোন লেখা পাচ্ছিলামনা। অবশেষে আবার পেলাম। দারুণ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ সোহেল ভাই.
গুডরিডস
নতুন মন্তব্য করুন