যে গ্রামে সামিরার চাকরি হয়, সেটি গণ্ড গাঁ। সারা দিনে একটি মাত্র বাস আসে। সেটি না পেলে সেদিনের মত অবরুদ্ধ। গাঁয়ের মানুষরা সামিরাকে দেখে অবাক কৌতূহলী চোখে তাকায়। শহুরে মেয়ে সামিরাকে তারা থাকতে দেয় স্কুলের পেছনের এক বাড়িতে। প্রথম কদিন ভালোই লাগে সামিরার। ওর জানালা থেকে দূরের সবুজ উপত্যকা দেখা যায়, কোলাহলহীন এই নির্জন গ্রাম্য পরিবেশ যেন সামিরাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তবে কদিন বাদেই খানিকটা বিষণ্ণতা যেন ওকে তাড়া করে। গাঁয়ের একমাত্র বুথ ফোনটি থেকে সারায়েভোতে বাবা-মা’কে ফোন করে। রিং হয় ওপাশে। কিন্তু কেও ফোন ধরে না। বাবা-মা গেল কোথায়?
এর কদিন বাদেই হটাত সামিরা দেখে, দূরের এক গাঁয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া। সেই সাথে শোনা যাচ্ছে মর্টারের শব্দ। অচিরেই সেই শব্দ আর আতংক এসে পৌঁছায় এই গ্রামেও। ও হ্যাঁ, সামিরা নিজে তো মুসলিম বটেই, সেই সাথে গ্রামটিও মুসলিম-প্রধান। আর সেদিন সকালে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যারা গ্রামে এলো তারা সার্ব।
ওরা এসেই নির্দেশ দিল জলদি কাপড় গুছিয়ে বাসে ওঠ। এখান থেকে তোমাদেরকে সরে যেতে হবে। সামিরা কিছু বোঝে না। কোথায় যাবে? কেন-ই বা যাবে? বন্দুকের নলের সামনে প্রশ্ন চলে না, এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ও বাসে ওঠে।
সবাইকে নিয়ে নামানো হয় একটি পরিত্যাক্ত গুদাম ঘরে। সামনে বহুকালের অব্যবহৃত একটি রানওয়ে। চারদিকে ঘাসের বন। দূরে প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে আছে শৈলশ্রেণি। এখান থেকে পালাবার কোন পথ নেই। এ যেন দ্বীপান্তর। প্রথমেই বলা হয়– পুরুষরা সবাই আলাদাভাবে বেরিয়ে এস। এদেরকে নেয়া হয় গুদামের বাইরে। ভেতর থেকে সামিরা’রা কেবল শুনতে পায় কিছু বুলেটের শব্দ। তারপর সবকিছু নিশ্চুপ।
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের ক্লান্ত সৈনিকের সামনে যুদ্ধবন্দী নারীরা হল হায়েনার সামনে পড়ে যাওয়া হরিণ শাবকের মত। সামিরা’দের দলের নারীদের অবস্থাও হল তাই। সার্বদের দ্বারা দিনে-রাতে ধর্ষিত হল ওরা। দশ বছরের শিশু থেকে শুরু করে চল্লিশোর্ধ নারী, কেউই বাদ গেল না। আর সব গ্রাম্য নারীদের মাঝে সামিরা একমাত্র শহুরে মেয়ে হওয়ায় এক পর্যায়ে সে চোখে পড়ে ক্যাম্প কমান্ডারের। ফলে এই কমান্ডারের নৈশভোগে তাকে নিবেদন করতে হয় নিজ দেহখানি। একদিন নয়। প্রতিদিন। এতে করে অবশ্য ওর প্রতি কমান্ডারের এক ধরণের দুর্বলতা তৈরি হয়। তবে সেই দুর্বলতা আরও গভীরে প্রথিত হবার আগেই এসে যায় মুক্তির বার্তা। সামিরা’রা জানতে পারে, বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় ওদেরকে মুক্তি দিয়ে কিছু সার্ব বন্দীকে ছাড়িয়ে আনা হবে।
আবারও সেই লাল বাসে চড়ে বসে ওরা। তবে এবারের যাত্রা দুঃস্বপ্ন থেকে পালিয়ে আসার যাত্রা।
সামিরা ঘরে ফেরে না। হয়তো ফিরতে পারে না। কীভাবে-ই বা ফিরবে? সারায়েভো তো তখন ধ্বংসস্তূপ। রেডক্রসের মাধ্যমে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে ও চলে আসে সুইডেনে। এখানে এসে জানতে পারে আরেক নির্মম বাস্তবতা। যে সার্ব পশুরা দিনের পর দিন ওর শরীরে ঢুকিয়েছে বিষের অনল, সেই পশুদের জৈবিক উপাদানে আজ ও গর্ভবতী। সামিরা আবারও যেন জীবনের কাছে থমকে যায়। যে অতীতকে ভেবেছিল ভুলে যাবে, সেই অতীত-ই যেন অদৃশ্য আততায়ীর মত পিছু নিয়ে পৌঁছে গেছে সেই সুদূর সুইডেনে।
সামিরা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। এখন কি করবে ও? ছেলেটিকে হাসপাতালেই পরিত্যাগ করে ফিরে যাবে নিজের নতুন বাস্তবতার জগতে? নাকি স্নেহশীলা মায়ের মতো আঁকড়ে ধরবে নিজ বুকে?
সামিরার জীবনের এই রুদ্ধশ্বাস গল্প আর টানাপোড়ানের উত্তর জানতে হলে আগ্রহী দর্শক-কে দেখতে হবে ‘এজ ইফ আই এম নট দেয়ার’ সিনেমাটি। সারায়েভো বা বসনিয়ার যুদ্ধের গল্প নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এই যেমন, ইন দ্যা ল্যান্ড অফ ব্লাড এন্ড হানি, দ্যা হুইসেল ব্লয়ার, বিহাইনড এনেমি লাইন্স, হান্টিং পার্টি। এদের মাঝে অনেকগুলোই একশন ভিত্তিক ছবি কিংবা হলিউড-ভিত্তিক হওয়ায় প্রচারণার আলোকপ্রাপ্ত। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে এজ ইফ আই এম নট দেয়ার’ খানিকটা ব্যাতিক্রমি। যুদ্ধের গুলি বা বোমার চেয়ে এখানে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে কিছু বসনিয়ায় নারীর মানবিক বিপর্যয়কে। সংলাপের চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে নৈঃশব্দ্যকে। তাই যুদ্ধের করুণ বাস্তবতার সাথে এখানে পরিচয় ঘটে খানিকটা যেন ভিন্নভাবে, ভিন্ন আঙ্গিকে।
আইরিশ পরিচালকের হাতে তৈরি এই সিনেমাটি নিয়ে পরিশেষে আরও দুটি মজার তথ্য যোগ করে রাখি। সিনেমাটির চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে যে বইয়ের উপর ভিত্তি করে, তার রচয়িতা কিন্তু জাতিগতভাবে বসনিয়ান মুসলিম নন, তিনি ক্রয়াট। অন্যদিকে সামিরার ভূমিকায় অভিনয়কারী নাতাসা পেত্রভিচ মেসিডোনিয়ার মেয়ে হলেও জাতিগতভাবে সার্ব। অথচ যুদ্ধকালে ক্রয়াট আর সার্ব– এ দু দলের সাথেই বসনিয়ান মুসলিমদের অসংখ্য হানাহানির নজির আছে। নিজ জাতির সেই কলঙ্ক মোচনের জন্যেই কি তারা সামিরা নামক এই মুসলিম নারীর যুদ্ধকালীন সময়ের দুর্দশা বই আর সিনেমার পাতায় পৃথিবীর মানুষের জন্যে তুলে ধরেছেন? কে জানে! হতেও পারে হয়তো।
মন্তব্য
দেখা হবে আশা করি। বেলগ্রেড যাবার পরিকল্পনা করছি ফের সামনের মাসে, তার আগে কয়েকটা সিনেমা দেখার চেষ্টা করব ঐ অঞ্চল নিয়ে। কিন্তু বড্ড কষ্টের, দেখা এবং সহ্য করা দায়
facebook
বেলগ্রেড নিয়ে একটা সিনেমা দেখলাম সেদিন। নাম- হিয়ার এন্ড দেয়ার। এটা অবশ্য খুব একটা কষ্টের না, খুব সাম্প্রতিককালের প্রেক্ষাপট নিয়ে। দেখতে পারেন।
গুডরিডস
নতুন মন্তব্য করুন