আজ অন্যরকম একটা আমেজ খেলা করছিল শাজাহান মিয়ার পুরো দেহ-মন জুড়ে। অন্যরকম না বলে বরং বলা উচিৎ সুখের একটা আমেজ। যা থাকলে নিজেকে মনে হয় প্রচন্ড সুখী কেউ, চিরপরিচিত স্থানটিও আর তেমন বিরক্তিকর লাগে না! উৎসাহের খাতিরে ডবল পানের সাথে একটা বিদেশী দামী সিগারেটও কিনে ফেলল সে।
অবশ্য পান আর ধূমপান এ দুটোই তার মজ্জাগত। আজ সেটাকে সামান্য স্পেশাল ভাবে করা আর কি! সুখের আমেজটাকে আরো কিছুক্ষণের জন্য প্রলম্বিত করতে যেয়ে এই সামান্য দু দশ টাকার বলিদান আজ তার হৃদয় পযর্ন্ত উঠে আসতে পারে না কিছুতেই। পান চিবুতে চিবুতে খুব আয়েস করে সিগারেট ফুঁকতে গিয়ে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়ে সে। শূণ্যে ছুড়ে দেয়া দলা পাকানো ধোঁয়া লক্ষ্য করে নিজের অজান্তে নিজের সাথেই কথা বলতে থাকে।
- বুঝলা মিয়া মাঝে মইধ্যে এই রহম বেহিসাবি হওন বালা!
তখন মনের মধ্যেই কে আরেকজন এর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। জবাব আসে,
-তুবুও বেহিসাবি হওন ঠিক না
- বুঝি, তয় সব তো আর নিয়মের মইদ্যে চলে না। এই যেমুন আমার নামের কথাই দরো। বাপজান আমার নাম থুইলো শাজাহান। অহন কও শাজাহান কার নাম?
- তুমিই না কইলা তোমার নাম শাজাহান---
- ধুৎ! অই কথা না। শাজাহান অইলো এক বাদশার নাম। বাপে আমার মনে করছিল আমি রাজা বাদশা হমু! তা যহন পারলাম না মাঝে মইদ্যে নিজেরে বাদশা মনে করতে দোষ কী?
- দোষের আর কী!
- আবার হেতে আমার মরা বাপের আত্মাটাও শান্তি পাইবো – নাকি কও?
- তাও তো ঠিকই।
নিজের সাথে সমঝোতায় আসতে পেরে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে সে। এবং বাদশাহী মনের পরিচয় দিতে গিয়ে ষাট টাকায় রিকশা ঠিক করে ফেলে। যা কিনা তার ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব ঘটনা। এখন দুপুর। একটু পরেই রিকশা জমা দেবার সময় হবে সে জন্য রাস্তাটা সুনসান হয়ে আসছে। শুধু পান দোকানটার বিপরীতে একটা রিকশা অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। রিকশাওয়ালাও আছে সাথে- নিজেই আরোহী সেজে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল বোধয়। লোকটা নিজের সীটের ওপর পা তুলে দিয়ে পান চিবুচ্ছে আয়েস করে। শাজাহান মিয়া তার সামনা সামনি এসে বলল
- যাইব? রিকশাওয়ালার বিশ্রামে ছেদ পড়াতে সে তাকাল শুধু। তারপর আবার ব্রতী হলো নিজের কাজে। যেন শাজাহান মিয়াকে সে দেখেইনি! ওর সামনে শাজাহান মিয়া না হয়ে কোনো সুবেশী ভদ্রলোক দাঁড়ালে সে হয়তো তড়িঘড়ি রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলত, ‘কই যাইবের স্যার আহেন!’, সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে ওরকম তোয়াজ করা অথর্হীন। যার শরীরে ছেঁড়া-ফাড়া, নোংরা কাপড়- তার মতো! শাজাহান মিয়া আবারো বলল
- যাইব?
-কই যাইবেন?
রিকশাওয়ালা কথাটা বলল বটে কিন্তু তাতে অবজ্ঞার ভাবটাই ধরা পড়ল প্রকট হয়ে। শাজাহান মিয়া ওসবের তোয়াক্কা না করে নিলির্প্ত কন্ঠে জানাল তার গন্তব্যস্থল। লোকটা ষাট টাকা ভাড়া হেঁকে দিয়েই ভাবল ব্যাটা এখন ভাগবে! কিন্তু শাজাহান মিয়া বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজী হয়ে যাওয়াতে সে প্রচন্ড বিস্মিত না হয়ে পারল না। একরকম অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে প্যাডেল মারতে লাগল।
শাজাহান মিয়ার পকেট আজ গরম। মেজাজ মর্জিও সপ্তমে না। তাছাড়া ওতো এখন শুধু শাজাহান মিয়া না শাজাহান বাদশা! একটা প্রসন্ন হাসি খেলা করতে লাগল তার পুরো চোখে-মুখে। রোদটা প্রচন্ড হলেও চলন্ত রিকশায় বোধয় ততটা লাগে না। আবার ফিনফিনে বাতাসও আছে। শাজাহার মিয়ার খুবই ভালো লাগতে লাগল। প্রায় শেষ হয়ে আসা সিগারেটে সুখ টান দিতে দিতে চোখ বুজল, বুজেই সাত-সকালের ঘটনাবলী তার মনে পড়ে গেল। কদিন বাদেই ঈদ। মুসলমানের পয়লা পরব। নতুন কাপড়-চোপড়, পায়েস-সেমাই খাওয়াই রীতি। কিন্তু তার হাত একেবারেই খালি। বউয়ের সঙ্গে এ নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটিও হয়ে গেছে। সে তেতো মুখে মাটির বারান্দায় বসে ছিল। তার তিন ছেলে মেয়েকে কিছু দিতে পারবে না এই চিন্তায় সে একেবারে মিইয়ে গেছে। এমন সময় একজন লোক যে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে টের পায়নি। লোকটা ‘দৃষ্টি আকষর্ণমূলক কাশি’ দিতেই শাজাহান মিয়া দেখল তাকে। প্রথমে তেল তেলে বাবু মার্কা চেহারার লোকটাকে সে চিনতেই পারেনি। পরে চিনল। লোকটার নাম আব্দুল আলী। বছর পাঁচেক আগে খাতির ছিল। মহা ধাপ্পাবাজ। এখনো অই লোকের কাছে তার বেশ কিছু পাওনা আছে। কিন্তু লোকটা এমন ভাবে কথা-বার্তা শুরু করল যেন সে নিতান্তই গো-বেচারা টাইপের লোক! সে শাজাহান মিয়ার বিষয়-বৃতান্ত জানতে খুব উৎসুক হয়ে উঠল। শাজাহান মিয়া বিস্মিত হলো আব্দুল আলী পকেট চিরে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করছে দেখে। তার ছেলেমেয়েদের জন্য প্রীতি উপহার! আব্দুল আলী লোকটা হঠাৎ শাজাহান মিয়ার দু হাত চেপে ধরে বলল,
- বাই অতীত কিচ্ছু না। অতীত অইলো গিয়া অতীত! সব অইল গিয়া বতর্মান। তুমি বাই অতীতের কথা বুইল্যা যাও। আমি তোমার লগে কেমুন ব্যবহার করছি সব বুইল্যা আমারে মাপ কইরা দেও বাই, আমি....।
শেষের দিকে আব্দুল আলীর কথাগুলো জড়িয়ে গেলো গভীর আবেগে। এই সব কী? একটু বাদেই ব্যাপার জানা গেল। লোকটা কী একটা স্বপ্ন দেখেছে। একজন সুফি মতো লোক তাকে ভাল হয়ে যেতে বলছে! পর পর তিন রাত্রি সে এই স্বপ্ন দেখে সে আর থাকতে পারেনি। পাঁচ বেলা মসজিদে যাতাযাত শুরু করেছে আর তার যত ঋণ ছিল সব শোধ করে দিচ্ছে সে! শাজাহান মিয়া লোকটার কাছে সাড়ে তিন হাজারের মতো টাকা পেত। সে এখন পুরো চার হাজার একটা প্যাকেটে পুরে শাজাহান মিয়ার হাতে জোর করে তুলে দিয়ে গেল। শাজাহান মিয়া বেশি নিতে চায়নি। কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা। তার একটা যুক্তি হলো- এই টাকাটা ব্যাংকে খাটানো গেলেও তো কিছু লাভ পাওয়া যেত। লাভে-মূলে সে টাকা চার হাজারকে ছাড়িয়ে যেত নিশ্চয়ই! এই টাকাতে ছেলেমেয়ের পোশাকের একটা হিল্লে হয়ে যাবে ভেবে সে খুশী হয়ে উঠল। কেউ স্বেচ্ছায় আজকাল ধার-দেনা পরিশোধ করে এমন ধারণাই ছিল না শাজাহান মিয়ার। একটু আগের ঘটনায় সে চমৎকৃত ছিল। কিন্তু তার স্ত্রী আরো বড় চমক নিয়ে হাজির হলো তার সামনে। একটা বাঁশের চোঙায় সে বছর খানেক ধরেই চুপেচাপে সঞ্চয় করে আসছিল- স্বামীকে না জানিয়ে। ওটা ভেঙ্গে দেখা গেল মোট দু হাজার সাতশ টাকা জমেছে। তার মানে ছ হাজার সাতশ টাকা হলো। খুব একটা কম না। এই দিয়ে সে অনায়াসে তার বউয়ের জন্য এমনকি নিজের জন্যও কিছু কিনতে পারবে। অনেক দিন পর তার খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। বোধয় একেই বলে সুখ!
রাস্তা-ঘাট খালি পেয়ে রিকশাওয়ালা চালাচ্ছিল খুব জোরসে। সে হঠাৎ করে ব্রেক চেপে ধরল তার রিকশার। বোধয় কিছু দেখতে পেয়েছে সে। আচম্বিতে ব্রেক কষায় এক বড়সড় ঝাঁকুনি লাগল রিকশায়। শাজাহান মিয়ার ঘোর পালাল। চোখ মেলেই একটা দৃশ্য দেখে সে তাজ্জব বনে গেল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক লোক। লোক না বলে ফকির দরবেশ বলাই উচিৎ। অন্তত তার পোশাক তাই বলে। এক খন্ড লাল কাপড়ে তার নিম্নাঙ্গ ঢাকা-লুঙ্গির মতো করে প্যাঁচানো। আরেক খন্ড গায়ে আড়াআড়ি দেয়া। কালো কুচকুচে শরীর। তৈলাক্ত। গলায় অজস্র মালা। মুখে দাড়ি গোঁফের পাহাড়। লোকটা নিশ্চিন্ত মনে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে চোখ বুঁজে তসবি জপছে। শাজাহান মিয়া মনে মনে মুগ্ধ হয়ে গেল। এমন সৌম্যমূর্তি চেহারা সে কমই দেখেছে। লোকটা চোখ মেলল এবার। তারপর শাজাহানকে হাতের ইশারায় সরে যেতে বলল এক পাশে। তার মানে সে এখন রিকশায় চড়বে। এটা অকল্পনীয় ছিল শাজাহান মিয়ার জন্য। সে একেবারে ধন্য হয়ে গেল। আজকের ঘটনার সাথে এর কি কোনো মিল আছে? আব্দুল আলী যে সুফিকে তিনরাত্রি স্বপ্ন দেখেছিল ইনি তিনি নন তো? শাজাহান মিয়ার শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল দারুণ ভাবে। লোকটার গায়ে কী মিষ্টি একটা গন্ধ! লোকটা তখনও তসবি জপে চলেছে। এক সময় সে তসবি রেখে কোমর থেকে একটা কৌটা বের করল। সে এখন পান খাবে। পর পর দুটো পান মুখে চালান করে দিয়ে সে বুঁদ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। একটা পান সে শাজাহান মিয়াকেও দিল। সেটা বিনা দ্বিধায় মুখে পুরে দিয়ে যেন আরো কৃতার্থ হয়ে গেল শাজাহান মিয়া। এতো পান নয় যেন বেহশতি বরদান! সামান্য পানেও এত মজা! লোকটা নিরবই ছিল এতক্ষণ। সে এখন গম গমে গলায় বলে উঠল
-বুঝলি দুনিয়াতে ইনসাফ নাই!
এই মুহূর্তে শাজাহান মিয়ার মনে হলো এই কথাটার চেয়ে উপযুক্ত কথা আর একটাও হতে পারে না। কী সুন্দর বিবৃতি! ইনসাফ নাই! আসলেই তো। সমাজে এখন কত অত্যাচার-অনাচার। সবাই শুধু ঠকানোর ধান্ধায় থাকে। এখানে লাঠি যার মাটি তারই। এখানে বিচার আছে কিন্তু ন্যায়বিচার নেই। এখানে ইনসাফ আসবে কোত্থেকে? এই সব ভাবতে ভাবতে তার সবকিছু যেন একটু তালগোল পাকিয়ে গেল।
হুঁশ হলো রিকশাওয়ালার ঠেলাঠেলিতে। যেন অনেকগুলো জগৎ অতিক্রম করে এসে তাকে পৌঁছুতে হলো বাস্তবে। তার চোখে তখনও রাজ্যের ঘুম। প্রথমে ব্যাপারগুলোকে শাজাহান মিয়া প্রথমে ঠিক মেলাতে পারল না। সে কোথায়? কোথায়? আবারো ঘোর চলে আসতে চাইছিল। রিকশাওয়ালার চেঁচামেচিতে সেটা কাটল। তখন আচম্বিতে মনে পড়ল একটা কথা। সাধু বাবা কই? সে তাকাল পাশে। নেই। সে দ্রুত পাঞ্জাবির পকেটে হাত গলিয়ে দিল। কিন্তু হাতটিকে ধরে রাখতে পারল না পাঞ্জাবির ছোট্ট পকেট। হাত বেরিয়ে পড়ল বাইরে। ছ্যাঁৎ করে উঠল শাজাহান মিয়ার বুকের ভেতরটার কোথাও। নেই! তার সমস্ত টাকা পয়সার একটিও অবশিষ্ট নেই। সব গায়েব হয়ে গেছে। শাজাহান মিয়ার সামনে পৃথিবীটা যেন উল্টে গেল এক পাক। তারপর দুলতে লাগল এদিক-ওদিক, সামনে পেছনে। এই ঘিঞ্জি শহরে হৈ-হট্টগোলের কমতি নেই। কিন্তু কোনো রকম শব্দই শাজাহান মিয়ার কান অব্দি এসে পৌঁছালো না। ওখানে শুধু একটি কথা, দুটি শব্দ ধ্বণিত-প্রতিধ্বণিত হতে হতে অসহনীয় পযার্য়ে চলে যেতে লাগল, ‘এখানে ইনসাফ নাই, ইনসাফ নাই!’
মন্তব্য
যাবতীয় ভণ্ড দম আটকে মরুক!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
দীর্ঘশ্বাস............
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ভালো লেগেছে......
ভালো লাগলে ভালো!
নতুন মন্তব্য করুন