পর্ব ৩
পুরো বাগানের সাথে এই অংশটা যেন মিলছে না। একটু বেখাপ্পা ভাব এই অংশটুকুতে। মাটি আলু-থালু। ভদ্রমহিলা পাশের এক জায়গায় অর্ণবকে তাকাতে বললেন। তাকিয়ে অর্ণবের ভেতরটা যেন একটু কেঁপে উঠল। ফুল-লতা-পাতা দেখে মানুষের অন্তর কাঁপে না। কিন্তু তাদের বিন্যাস অন্তর কাঁপাতেও পারে! কেউ নির্মমভাবে কিছু ছিঁড়েছে, গাছ উপড়ে ফেলেছে। তারপর সেগুলো মাটিতে সাজানো হয়েছে একটি জ্যামিতিক নকশায়।
‘গুণ’ চিহ্নের মতো করে। এই চিহ্ন দিয়ে তো বিপজ্জনক কথাটিকেও বোঝায়, না? ভদ্রমহিলা বললেন,
‘ও মারা যাবার পর আমি একাই থাকি এখানে। একজন দারোয়ান আর দুজন কাজের লোক আছে অবশ্য। কিন্তু কোনো দিন এমন দেখিনি। গত ক দিন ধরে কী হয়েছে বাগানের এই জায়গায় যেন ঝড় বয়ে যায়! সকালে দেখি সব কিছু ওলট-পালট। আবার ফুলগুলো এইভাবে সাজানো - কাজের মেয়েটা নাকি দু এক দিন ধরে এখানে কিসের ছায়া টায়াও দেখেছে। আমি বিশ্বাস করিনি। মেয়েটার বিশ্বাস ভূত-প্রেত আছে এই বাগানে। কিন্তু তোমার কাছে যাওয়ার আগের দিন আমি নিজেও চিৎকার মতো একটা শব্দ শুনলাম। দারোয়ানকে নিয়ে সাহস করে এলামও এখানে কিন্তু কিছু পেলাম না। আমার এখনো বিশ্বাস হয় না ভূত-প্রেত বলে কিছু আছে। দেখো তুমি কিছু করতে পারো কি- না।’
ভদ্রমহিলা কেন যেন নিশ্চিত হলেন অর্ণব এর সমাধান করতে পারবে। তিনি যোগ্যতার কোনো খতিয়ানও চাইলেন না। অর্ণব ফুলগুলো ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখল সেগুলো কোনো দুষ্টু ছেলে বা ফুলচোরদের কাজ কি না। কিন্তু চুরি করতে এসে কেউ নিশ্চয়ই ফুল সাজিয়ে রেখে যাবে না, তাও আবার জ্যামিতিক নকশায়। অর্ণব দেখল ফুলগুলো স্বাভাবিক ভাবে ছেঁড়া বা কাটা নয়। একটা দাঁতের মতো জিনিস ভেদ করেছে প্রত্যেক বৃন্তকে। ধাঁধায় পড়ে গেল ও। শহরে কোনো নতুন চিড়িয়ার আবির্ভাব নয়তো? সে সব সময় গোয়েন্দাকাহিনী পড়েছেই শুধু- প্রায় গল্পেরই সমস্যা পড়ে তার কোনো সমাধান নেই বলেই চিন্তা করেছে। কিন্তু শেষে যখন লেখক সহজ সহজ সব সমাধান দিয়েছেন তা বিস্মায়াবিষ্ট আনন্দ লাভ করেছে। কিন্তু নিজে তেমন একটি সমস্যার মুখোমুখি হয়ে প্রথমেই অর্ণব ঠিক করতে পারল না ঠিক কীভাবে এগোবে। কোনো ক্লু ছাড়া এ সব কাজে এগোনো যায় না। কাজ শুরু করার জন্য একটা ক্লু দরকার। সেটা খুঁজতে লেগে গেল অর্ণব। ও জিজ্ঞেস করে জানল রাতের বেলায় মেইন গেটসহ সমস্ত গেট বন্ধ রাখা হয়। দরজার ওপরে সুতীক্ষ্ন বর্শার মতো দন্ড লাগানো আছে। এখান দিয়ে ঢোকা সম্ভব নয়। বাকি থাকল সীমানাপ্রাচীর। সেটার ওপর কাচের ভাঙ্গা অংশ অবিন্যস্ত ভাবে সেট করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরী করা হয়েছে। খালি হাতে এটাও পেরুনো সম্ভব নয়। তবু অর্ণব প্রধান ফটক ভালো ভাবে পরীক্ষা করল। অনেক সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ চালানোর পরও দৃষ্টিকে আটকে দিতে পারে এমন কিছু পাওয়া গেল না। তখন ও গেল দেয়ালের কাছে। মিসেস শেখর ইতোমধ্যে কাজ শেষে কফি পানের নিমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেছেন। তাঁকে অনেক কাজ একাই করতে হয়। ভদ্রমহিলার জন্য সামান্য মায়া লাগল অর্ণবের। সাধারণ যুক্তি অনুসারে ‘ঘটনাস্থলের’ কাছাকাছি দেয়ালে কোনো কিছু পাওয়া গেলে পাওয়া যাবে। অর্ণব সে অনুযায়ী কাছাকাছি দেয়ালের অংশগুলো পরীক্ষা করল। বাড়িটা রাস্তা থেকে উঁচু। ফলে ভেতর থেকে সহজে পরীক্ষা করা গেল। কিন্তু অর্ণবের হিসাব মিলল না। ফলে সমগ্র দেয়ালটা ঘাঁটতে হবে ওর! খুঁজতে খুঁজতে ঘেমে নেয়ে যখন ক্লান্ত অবস্থা তখন নজরে পড়ল ওর ব্যাপারটা। একটা জায়গায় কাচ ভেঙ্গে পড়ে আছে। তার চেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কোনো কিছুর আঁশ লেগে আছে সামান্য জায়গা জুড়ে। আপাততঃ এই আঁশের কল্যাণে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করা যাবে ভেবে স্বস্তি পেল অর্ণব। ‘হায় আল্লাহ’ আফসোস করল ও। আঁশটাতো সবার প্রথমেই নজরে পড়তে পারত! আজ সম্ভবত ওর ভাগ্যটাই ভালো না!
ভূতে অর্ণবেরও বিশ্বাস নেই। বাগানে ‘ক্রসের ত্রাস’ সৃষ্টি করার পেছনে মানুষের যে হাত আছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এর সপক্ষে প্রমাণও দেয় দেয়ালের কাচে আটকানো আঁশ। হাত পা কাটতে পারে ভেবে কেউ দেয়ালের ওপর চটের বস্তা ফেলে পার হয়েছে দেয়াল। এখন নিজের চোখে তাই ঘটে কি না দেখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। যে সব ইনফরমেশন অর্ণব পেয়েছে তার মধ্যে একটা হলো শনি-মঙ্গল বারেই তথাকথিত ভূতের পায়তারা বেশি চলে। অর্ণব তাই সিদ্ধান্ত নিল সামনের শনিবার রাত জেগে পাহারা দেবে বাগান - দেখবে কেউ সত্যি আসে কি না। তার আগে বাড়িটা ভালো মত দেখা দরকার। একতলাকে প্রথমেই ও হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিল। কারণ ওখান থেকে গাছের রোধের জন্য পুরো বাগান দৃশ্যমান হয় না। দোতলা প্রায় পরিত্যক্ত। দুটো ঘরকে স্টোর বানানো হয়েছে। আর একটা ঘর পাওয়া গেল যেটা কী কারণে তৈরী করা হয়েছে তা বোঝঅ গেল না। সম্পূর্ণ খালি এখন ওটা। অই ঘরের একটা জানালা বাগানের দিকে। তাছাড়া খোলা বারান্দা থেকেও সরাসরি বাগান দেখা যায়। এই ঘরটা যে কাজেই তৈরী করা হয়ে থাক অর্ণবের মনমতো হয়ে গেল। ভদ্রমহিলাকে তার থাকার কথাটা এখনই জানাল না অর্ণব। যেদিন থাকবে তার আগেই বললেই হবে। কাজে কোনো খুঁত রাখতে চাইছে না সে আসলে। বেশি খুঁতে খুঁতে হওয়া ভাল গোয়েন্দার লক্ষণ নাকি!
‘বুঝলে কিছু?’ কফি খেতে খেতে মিসেস শেখর জানতে চাইলেন।
‘পুরো না বুঝলেও অন্তত এই টুকু বুঝেছি যে ভূতেরা কাজ করতে পারে না।’
চলে আসতে চাইছছিল অর্ণব। ভদ্রমহিলা জোর করে কফি খাওয়ালেন। দুঃশ্চিন্তা না করার অনুরোধ জানিয়ে আবারও যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে এলো ও। এখন শুধু শনিবারের জন্য অপেক্ষা করা। চন্দন এই মুহূর্তে পাশে থাকলে দারুণ হোত কিন্তু! বন্ধুকে ফাঁদে ফেলে নিজে কোন গর্তে ঢুকেছে তা ও-ই জানে।
শনিবার একটা ব্যস্ত দিন কাটালো অর্ণব। কেউ যে বাগানে এসেছে তা নিশ্চিত করতে একটা কলিং বেল সার্কিট তৈরী করতে লেগে গেল ও। কেউ যদি আসেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নিশ্চয়ই আসবে না। গভীর রাতেই আগন্তুকের আসার সম্ভাবনা। যদি কোনো ভাবে অর্ণব ঘুমিয়েও যায় - ওকে জাগিয়ে দেবে যন্ত্রটা। নিজের বাড়ি থেকে পুরনো আর স্থানে স্থানে ছিঁড়ে যাওয়া কিছু তার যোগাড় করল ও। শক্তি সরবারাহের জন্য দুটো ব্যাটারি অবশ্য ওকে কিনতে হলো। কিন্তু ডিটাচড্ কলিং বেল পেল না কোথাও। ওর পকেটের পরিস্থিতি এমন নয় যে একটা কলিং বেল এখনই কিনে ফেলতে পারে। শেষে নিজেই তৈরী করতে বসে গেল। ইলেকট্রনিক্স সব সময়ই অর্ণবের প্রিয় সাবজেক্টের অন্যতম। সময় পেলে এই নিয়ে বই পড়াও তার হবি। আজ সে বিদ্যা কাজে লেগে গেল! একটা মশার কয়েলের স্ট্যান্ড খুঁজে পেতে আনল ও। একটা আলপিন আর কিছু কয়েলের তার যোগাড় করাও কষ্টসাধ্য হলো না। স্ট্যান্ড এর মাথা সরু পাতটিকে মাঝ বরাবর বাঁকিয়ে ফেলল অর্ণব। একটা সমকোণ সূচিত করল সেটা। একটা ছোট্ট কাঠের বোর্ডে আলপিনটি সামান্য গেঁথে দিল ও। তারপর কয়েলের তার দিয়ে ইচ্ছেমতো মুড়ল আলপিনটিকে। স্ট্যান্ডটিকে অর্ণব সেই বোর্ডের ওপর এমন ভাবে আটকালো যাতে বাঁকানো অংশ আলপিনের সামান্য ওপরে অবস্থান করে। এবার তারের একপ্রান্ত স্ট্যান্ডে অন্যপ্রান্ত কয়েলের তারে যুক্ত করে তার দুটোর বাকি প্রান্ত ব্যাটারির সাথে সংযোগ করে দিল। অস্থায়ী চুম্বকে পরিণত হওয়ায় আলপিনটি ওপরে ঝুলন্ত স্ট্যান্ডের বাঁকানো অংশকে আকর্ষণ করল। ফলে তাদের সংঘর্ষে একটা ক্রমাগত যান্ত্রিক আওয়াজ বেরুলো যা কাউকে সর্তক করে দিতে যথেষ্ট। একটা পুরনো চওড়া কাঠে এর সুইচ এমন ভাবে স্থাপন করল অর্ণব যাতে সামান্য আঘাতে বা চাপে সার্কিট সম্পূর্ণ হতে পারে। তার পর সেই সুইচবোর্ডকে রেখে এলো সেই স্থানে যেখান দিয়ে কেউ ঢুকতে পারে। বেলটাকে অর্ণব নিজের কাছে রাখল। পুরনো তারে এক তলা পর্যন্ত হলো। শেষে দশ গজ তার কিনে আনতে হলো দোতলা পর্যন্ত কভার করতে। এবার নিরবচ্ছিন্ন অপেক্ষার পালা। (চলবে)
মন্তব্য
শেষ প্যারায় এসো নিজে করি টুকু ভালো লেগেছে। মিসেস শেখরের কাছে চাইলেই পারত। একটা কলিং বেল কেনার টাকা নিশ্চয় মহিলার আছে। না হলে বাড়িতে কোন কলিং বেল ছিলো না। ওটা খুলে নিত।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
এই লেখাটি আসলে অনেক আগে লেখা- প্রায় দুই যুগ হয়ে গেল! তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। তাছাড়া তখনকার কিশোরদের সময় কাটানোর একটা উপায় ছিল বিভিন্ন সার্কিট বানানো। এখন যেমন মোবাইল/ইন্টারনেট নিয়ে সময় কাটায় তেমন অনেকটা। তাছাড়া তাহলে তো ভালো লাগাটুকু থাকত না!!!
হুম্ম্ম্ ! দুই যুগ আগে আপনি গোয়েন্দা গল্প লিখে বসে আছেন? তখন আপনার কিশোর বয়স। নিজের বয়সটা কি বেফাঁসে নাকি ইচ্ছে করেই জানান দিলেন। "সেদিনের পুচকে ছোড়া এসেছে আমার ভুল ধরতে! হাহ! "
গোয়েন্দা গল্প খুব খঁটিয়ে পড়তে হয় জানেন তো, বইএর গোয়েন্দার আগেই খুনী আন্দাজ করে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হয়।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ভালো লাগলেই হলো। শেষ প্যারা না প্রথম প্যারা তা কে জানতে চেয়েছে!!!!
মধুর কোনো সমস্যা?
আজ্ঞে না হুজুর। মুই কেইস ধরিবার বিয়াপক চেষ্টায় আছি
পড়তেছি
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন