কিছু কিছু স্মৃতি মনের কোণে বড্ড বেদনাভাব জাগিয়ে তোলে। স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত হতে যা যা উপাদনের প্রয়োজন সৌর বছরের এই ৫২তম সপ্তাহে আমার চারপাশে তাঁদের আনাগোনা বেড়ে যায়। পুত্র সহ অর্ধাঙ্গিনীর সাময়িক প্রস্থানে এবছর উপরি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে একাকীত্বের বেদনা। বিছানায় সারারাত এপাশ-ওপাশ করি আর চোখ বুজে নস্টালজিক ভ্রমনে ফিরে যাই শৈশব-কৈশোরের মধুর দিনগুলিতে।
বড়দিনের ছুটির রাতগুলিতে লেপমুড়ি দিয়ে নানাবাড়িতে আয়েশ করে ঘুমানোর কোন সুখস্মৃতি আমার নেই। বেচারা নানু তাঁর দুই কামরার টিনশেডের ভিটেবাড়িতে ১০ জন সন্তানসহ ঢাকা শহর থেকে আগত গোটা পনের নাতিপুতিদের শোবার বন্দোবস্ত করতে হিমশিম খেত। ক্রমানুযায়ী সবার বড় নাতি হওয়া সত্ত্বেও মাটির মেঝেতে পাটি বেছানো সেই গণ-বিছানায় পাশ ফেরার জো ছিলনা। তারপরও ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে স্কুল ফাইনাল শেষ হবার দিন থেকে গ্রামে অবস্থিত মামাবাড়ি যাবার তর সইত না আমাদের। গ্রামের আত্মীয়দের জন্য শহর থেকে কেনা বড়দিনের উপহার নিয়ে সদরঘাট থেকে লঞ্চে চেপে ইছামতির তীরের সেই সবুজ-শ্যামলা গাঁয়ে যাবার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কখনো ভুলবার নয়।
মেঝো মামা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে প্রতি বড়দিনেই বানাতো নতুন এক তারা। বাঁশঝোপের সবচেয়ে লম্বা বাঁশ কেটে তাঁর মাথায় ঝুলিয়ে দিত রঙিন কাগজে মোড়া সেই বিশাল তারকা। ভেতরে থাকত কেরোসিনের কুপি বাতি। বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন সেই আঠারোটি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা জনপদে বড়দিনের প্রতীকী চিহ্ন হিসেবে মিটমিট করে সারারাত জ্বলত সেইসব রঙিন তারকা। প্রতিটি গ্রামের প্রবেশমুখে প্রতিবছর নতুন আঙ্গিকে বানানো হত গোশাল ঘর। যীশুর জন্মকালীন যে বর্ণনা বাইবেলে আছে তাঁর প্রতিরূপ হিসেবে গোশাল ঘরে সাজানো থাকত নানা চরিত্রের মাটির মূর্তি। সেরা গোশাল ঘর নির্মাতা আর কীর্তন গাইয়ে দল নির্বাচন করতে আজও হয়ত চালু আছে আন্ত:গ্রাম প্রতিযোগিতা। গ্রামের যুবকদের দেখেছি একেবারে কোমর বেঁধে নামতে নিজের গ্রামকে সেরা বানানোর প্রচেষ্টায়।
গ্রামাঞ্চলের পিঠে বানানোর মৌসুম আর বড়দিনের উৎসব পঞ্জিকার পাতায় আছে একই সারিতে। খড়ির চুলোয় বসানো মাটির পাত্রে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকা পিঠের সুঘ্রাণ আর তাঁর প্রধান কারিগর আমার মমতাময়ী নানির পরিতৃপ্তময় হাসিমুখ হৃদয়ে আজও অম্লান। সবার বড় নাতি হবার বাড়তি সুযোগ ঘুমানোর বেলায় নানুর কাছ থেকে আদায় করতে না পারলেও নানি সবসময় আমার পাতে সেরা পিঠাটাই দিয়েছে। জীবনে পিঠেপুলি যা ভক্ষণ করেছি সবই ছিল নানির হাতে বানানো।
ঢাকাবাসী আমার দাদীমা আবার ওসব নানা রকমের পিঠেছিটে বানানোর মানুষ ছিলেন না। তাঁর এককথা, বড়দিন এসেছে খাও 'দোদুল'। নারিকেল আর সুপারি গাছের সারিতে বাঁধা ছিল আমারের ঢাকার বাড়ির সীমানা প্রাচীর। সুদূর বরিশালে অবস্থিত আমাদের আদি পিতৃপুরুষদের বাড়ির স্মৃতি বহন করত এই সুউচ্চ গাছগুলি। দাদীমার বানানো সেই বিখ্যাত দোদুলের প্রধান উপাদানই ছিল বাড়ির গাছপাকা নারিকেল। মনে আছে ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলতে গিয়ে যতবারই দাদীমার খাটের তলায় পালাতাম, দেখতে পেতাম নারিকেলের সারি। সারাবছর ধরেই নারিকেল জমিয়ে আনন্দ পেতেন তিনি। বড়দিনের বিশেষ মেন্যুতে উনি খুঁজে বেড়াতেন হাঁসের মাংসের আইটেম। খোদ ঢাকা শহরেই দাদীমা একদা বসিয়েছিলেন রাজহাঁসের খোঁয়াড়।
পোলাও-কোর্মার সাথে একটা আইটেম আমার মা খুব চমৎকার রান্না করতেন আর সেটা হল 'ভিন্দালু'। শুয়োরের মাংসের দোকান আনন্দ সিনেমা হলের পাশের গলিতে এখনও আছে বলে শুনেছি। আর ভিন্দালু বানানোর অন্যতম উপাদান সিরকা আসত আমার নানাবাড়ি থেকে। যখন একটু বড় হয়েছি তখন বড়দের সাথে আমিও যেতাম কেক বানাতে। বাজারে যেখানে পাউরুটি আর বাটারবন বানানো হয় সেই কারখানাতেই বড়দিনের আগের দুদিন কারিগরেরা ব্যাস্ত থাকত খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সেবায়। কেক বানানোর মাল-মশলা আমরাই কিনে নিয়ে যেতাম। বেকারির কর্মচারীরা শুধু ময়দা, চিনি, ডিম আর মাখন মেশানোর কায়িক শ্রম আর তা সেঁকার পারিশ্রমিক চাইত। এখানেও চলত শহুরে পরিবারদের এক মজার প্রতিযোগিতা। কেউ খরচ বাঁচাতে মেশাতো ডালডা আর মাখন, কেউবা আবার দেশী ডিমের সাথে মেশাতো ফার্মের মুরগির কয়েক হালি ডিম। সেঁকা শেষ হলে দেখা যেত রঙের বৈচিত্র্যের রকমারি কেকের সারি। মাখনের সুঘ্রাণে ভরে উঠত বেকারির পরিবেশ।
অনেক গির্জাতেই বড়দিনের প্রার্থনার পর আয়োজন হত প্রীতিভোজের। সবাইকে শুভেচ্ছা জানানোর এই শহুরে কায়দায় চায়ের সাথে কাটা হত কেক। নতুন কেনা পোশাকে জড়িয়ে থাকা হাসিখুশি মানুষের কোলাহলে গমগম করে উঠত গির্জা প্রাঙ্গন। স্কুল পড়ুয়াদের তো ততদিনে শুরু হয়ে গেছে শীতকালিন ছুটি। হোমওয়ার্কের বালাই না থাকার আনন্দ আর বড়দিনের উচ্ছ্বাস মিলেমিশে হত একাকার।
সান্তাক্লজ কিন্তু আমার শৈশবেও ছিল একজন। বাসায় আসতেন সারাবছর, সপ্তাহে দুইবার। সারাবছর কাঁধে তাঁর অবিকল সান্তাক্লজের মত এক ঝোলা। খয়েরি রঙয়ের ইউনিফর্ম পরেই আসতেন বড়দিনে। কিন্তু সেইদিন থাকত তাঁর মুখে এক মধুর হাসি। দোতালার যে বারান্দায় বসে মন্থর দুপুর পার করতাম ফেরিওয়ালার ডাক শুনে, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতাম বড়দিনের বিকেলে সান্তাক্লজের প্রতীক্ষায়। প্রবাসী পিতার পাঠানো ক্রিসমাস কার্ড আমাদের ছোটদের হাতে পৌঁছে দিতে বহু দূরের পথ পায়ে হেঁটে আসত ডাকপিয়ন। ইচ্ছে করেই বড়দিনের সরকারি ছুটির দিনেও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকায় চিঠি বিলিয়ে বেড়াতেন তিনি। বকশিস হিসেবে মিলত সামান্য আর্থিক সাহায্য আর ঝোলায় পুরে নিতেন কেকের টুকরো। মুখে তাঁর লেগে থাকত অমায়িক হাসির ছোঁটা।
বড়দিনে প্রাপ্ত প্রতিটি ক্রিসমাস কার্ড সযত্নে সংরক্ষিত আছে ট্রাঙ্কে। এখনও ইচ্ছে হয় নখ দিয়ে হাল্কা আঁচড় দিতে সেই প্লাস্টিক কার্ডে, শুনতে ইচ্ছে হয় সেই মধুর আঁচড় ধ্বনি। শুঁকতে ভাল লাগে খামের গন্ধ যেখানে আজও জড়িয়ে আছে শৈশবের আবেগের আনন্দগাঁথা। নির্ঘুম রাতে প্রবাসী আমি খুঁজে বেড়াই হারানো শৈশব। হৃদয়ের বায়স্কোপে দেখি আমি শৈশবের সান্তাক্লজের হাসিমুখের ছবি।
মন্তব্য
বড়দিনের শুভেচ্ছা
শুভেচ্ছা আপনাকেও
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
জীবন মানেই স্মৃতির ঘর, একাকী নি:সঙ্গ সময়ে সে ঘরের দরজা জানালা খুলে যায় আর তাতে অসংখ্য ভালোলাগার স্মৃৃতি এসে দীর্ঘশ্বাসের কোমলতায় ছুঁয়ে যায়। ভালোথাকুক শৈশব, ভালোকাটুক বড়দিন। শুভেচ্ছা অবিরত
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
আপনার কথাগুলি খুব ভাল লাগলো। ভাল থাকবেন
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
ভাল লাগল। বড়দিনের শুভেচ্ছা। এবং, শুভ নববর্ষের।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ। আপনাকেও জানালাম নতুন বছরের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ভাল থাকবেন।
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
শহুরে বড়দিনের উৎসবের সাথে পরিচয় বোধের কাল থেকে তবে গ্রামের বড়দিনের উৎসব সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। আপনার বর্ণনা এতো মায়াময় যে পাঠকের সেখানে পৌঁছাতে কোন সময় লাগে না। গ্রামের উৎসব নিয়ে আরো লিখুন। ইস্টার কীভাবে পালন করা হয় বা অন্য উৎসবগুলো!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গ্রাম্য-মেলা নিয়ে কিছুমিছু লিখার ইচ্ছে আছে। ইস্টার পার্বণে সরকারি ছুটি থাকে না বিধায় ঢাকা শহরেই কেটেছে উৎসবের দিন।
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
বড়দিনের উৎসব নিয়ে এত সুন্দর লেখা পড়েছি বলে মনে পড়েনা।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
বিষণ্ণ চিত্ত নিয়ে লেখা পোস্ট আপনার ভাল লেগেছে জেনে বিষণ্ণতা কিছুটা লাঘব হল!
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
মায়ালু একটা লেখা!
এমন কেন আপনি?একটা পোস্ট দেন তারপর উধাও। মানে আছে কোন!
আচ্ছা আপনার মাত্র দুটো পোস্ট দেখাচ্ছে কেন ভাইয়া? বাকিগুলো কোথায় গেল!
---
অ:ট: 'Like father like son' দেখেছেন জেনে প্রীত হলেম। সময় করে পোস্টটা পড়তে হবেক
এবার আপনার জন্য হোমওয়ার্ক 'Night train to lisbon' 'Short trem 12' 'Nebraska' 'Intimate enemies' 'Into the white' 'Immigrant' 'Kolya' 'Fanny' এর মধ্যে কয়টা দেখেছেন? দেখাগুলো নিয়ে জলদি পোস্ট দেন। না দেখাগুলো দেখে ফেলুন সময় সুযোগ মত। মামার বাড়ির আব্দার বললেও শুঞ্ছিনা কিন্তু নতুন বছরের শুভেচ্ছা থাকলো।
মামা বাড়ির আব্দার রাখব কিনা তা ভেবে দেখব যদি আপনি আমাকে দেখিয়ে দেন ‘অতিথি লেখক’ হিসেবে লিখা আগের পোস্টগুলি কিভাবে আমার হাচল অ্যাকাউন্টে নিয়ে আসতে পারব। সচলের ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগ অকেজো হয়ে আছে বহুদিন ধরে।
আমি কিন্তু ভাল কোন মুভি দেখলেই ব্লগ লিখতে বসে যাইনা, শুধুমাত্র বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলেই ডাক্তার না ডেকে কলম হাতে তুলে নিই।
ভাল থাকুন, সাথে থাকুন।
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
যতটুকু জানি সেটা হলু আপনি
বরাবর একখানি পত্রবান করে মনের খায়েশ জানান দিবেন।
মডু প্যানেলের ঘুমকাতুরে লাল নীল বেগুনী ঈশ্বরেরা নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি পর্ব সারিয়া আপনার ইচ্ছা পূরণে ভূমিকা রাখিবেন।
---
কচুপোড়া! তা বলিনি ভাইয়া। সেরকম হলে আপনার মুভি সংক্রান্ত পোস্টের সুনামীতে সচল ভেসে যেতো না!
নতুন মন্তব্য করুন