স্বপ্ন

জিপসি এর ছবি
লিখেছেন জিপসি [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৩/১২/২০১৫ - ১১:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সব ঠিকঠাক থাকলে সূর্যোদয়ের পূর্বেই ঢাকার মাটিতে আবার পড়বে আমার পদচিহ্ন। বিমানবন্দরের নাম বদলিয়ে গেছে, মানুষ হিসেবে নিজেও অনেক পালটিয়ে গিয়েছি কারণ ইতিমধ্যে একটি একটি করে হাতের দশটি আঙুল গোনা হয়ে গেছে কিন্তু আমার আর স্বদেশ ফেরা হয়নি।

প্রবাস থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রিয়জনের সাথে আলাপচারিতায় আজকাল প্রায়ই রেশ হারিয়ে ফেলি মনের অজান্তে। পটভূমিতে মৃদুস্বরে ভেসে আসা রিকশার টুংটাং, ফেরিওয়ালার হাঁক, আর মুয়াজ্জিনের সুরেলা আজানের সুরে ঢাকায় যাপিত জীবনের প্রথম তেইশটি বসন্তের সুখস্মৃতি মনের গভীরে কোন এক কোণে বড্ড বেদনাভাব জাগিয়ে তোলে।

এক দশক পর বাংলাদেশ যাচ্ছি হৃদয়ের টানে, কিছু প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্য পেতে। দশটা দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে, আমার ‘ঢাকার স্মৃতি’র পাতায় সংযোজিত হবে নতুন তথ্য, হাল নাগাদ হবে অনেক সেকেলে তথ্য। আমার ছেলেটা বড় হচ্ছে এই দূর প্রবাসে, ফেরিওয়ালা জিনিসটা কি তাই তো জানেনা এখনও। ঘুমপাড়ানি গল্প হিসেবে কতবারই তো ওকে বলেছি ঢাকার পণ্য ফেরির কথা, যারা ছিল আমার শৈশবের ম্যাজিশিয়ান।

আমাদের দোতলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য ফেরির ডাক আবার শুনতেই বাংলাদেশে যাব, কোনও কোনও ডাকে দীর্ঘ দুপুর হয়ত আরও দীর্ঘ হবে। ফিরে এসে ছেলেকে নতুন করে শোনাবো সেই দুপুরের গল্প।

অনেক কিছুই হয়ত কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, যা টিকে আছে তার অধিকাংশই হয়ত জীর্ণ ও বিবর্ণ। মহল্লার মোড়ের সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে সকাল-সন্ধ্যা বসে থাকত যে মুচি সে কি এখনও পালিশ করে বেড়ায় অফিস-যাত্রী মানুষের কালো-বাদামি রঙয়ের পাদুকা? ছোট সেই কাঠের বাক্স কাঁধে নিয়ে হোমসার্ভিস দিতে সপ্তাহে একদিন কি ঘুরে বেড়ায় মহল্লার অলিগলি? সন্ধ্যাবেলা আসবে কি আবার সেই লাল রঙয়ের অদ্ভুত বেশধারী চানাচুরওয়ালা চোঙ্গা হাতে নিয়ে? অর্থশাস্ত্রের সেই সুপ্রাচীন লেনদেন ক্রিয়ায় গুঁড়ো দুধের খালি টিন আর পুরাতন খবরের কাগজ নিয়ে কটকটিওয়ালা কি আমার হাতে তুলে দিবে অল্পসল্প কটকটি নাহয় তিলের খাজা? মহল্লার মুদি দোকানে সেই টিনের কালো বাক্স কি এখনও আছে ? যার ভিতর সারাদিন জ্বলত ফিলিপস বাতি, গরম থাকত তিনকোণা প্যাটিস আর গোলাকার চিনিযুক্ত ড্যানিস।

দেখা মিলবে না আর সেই শীলপাটা খোদাইকারিগরের। বহুজাতিক ব্রান্ডের গুড়ো মসলার প্যাকেটের সহজলভ্যতায় এতদিনে নিশ্চিত পেশা বদলিয়েছে শীলপাটা আঁকিয়ে কারিগর। কত যত্নের সাথেই না পাথরে তুলে ধরত শৈল্পিক নকশা, উবু হয়ে বিস্ময়ে দেখতাম আমার মার অতিপ্রিয় শীলপাটাটি। আজকের প্রজন্ম হয়ত জানবেই না কোনদিন শীলপাটা কি জিনিস, আঁকিয়েতো অনেক আগেই ফেলে দিয়েছে তার হাতুর আর বাটাল।

ধুনকর তো শীতকালেই মহল্লা ঘুরে বেড়াত সেতারের মত দেখতে ধুনট যন্ত্র হাতে নিয়ে। ঢাকাবাসী কি আজও পুরনো বালিশের তুলো ধুলে নতুন বালিশ বানায় বছরে একবার? নারিকেল আর সুপারি গাছ পরিষ্কার করতে ‘গাছি’ কি আজও আসে শুকনো মৌসুমে?

রাজধানী ঢাকায় যাপিত আমার শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের সেই মফস্বল রূপের হৃদয়গ্রাহী আকর্ষণ ছিল তার সবুজ। ঢাকা শহরেই তাল গাছে দেখেছি আমি বাবুইয়ের বাসা, তালপাতায় গড়েছি শৈশবের স্বপ্নবাড়ি। মহল্লার অনেক বাড়িতেই পেয়ারা গাছের নিচে দেখেছি হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়। জামরুল গাছে দেখেছি টুনটুনির বাসা, ডালিম গাছের ঝরা ফুলে গেঁথেছি মালা। বর্ষায় কাঁচা ড্রেনের জলে ডিঙ্গি নৌকা ভেবে ভাসিয়ে দিয়েছি খেজুরের পাতা, গ্রীষ্মের ভ্যাঁপসা গরমে শুঁকেছি আমি গাছপাকা কাঁঠালের সুঘ্রাণ।

গাছগাছালিতে ছেয়ে থাকা মনোমুগ্ধকর সেই শান্ত নগরীর আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে তা স্বচক্ষে দেখতে চাই আমি। দশ বছর আগে শেষবার যেবার বাংলাদেশে গিয়েছি তখন মন খারাপ করে বাসায় ফিরেছিলাম আমার মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শন শেষে। ঢাকার স্বনামধন্য সেই স্কুলে পাশাপাশি বড়সড় ফুটবল মাঠ ছিল দুটি, বড় পুকুর দুটি আর শতবর্ষী ফলের গাছে ঘেরা ছিল চারদিক। টিচার্স কোয়াটার আর স্কুল সম্প্রসারণের নামে হুটহাট করে ভরে ফেলল পুকুর, কেটে ফেলল বৃক্ষ। নেই সেই বিশাল কাঁঠাল গাছটি যার ছায়ায় বসে আমি টিফিন খেতাম। মহল্লার ছোট ছোট মাঠগুলি যেখানে শীতের ছুটির দিনগুলিতে ব্যাডমিন্টন আর টেপ টেনিস বল দিয়ে দলবেঁধে ক্রিকেট খেলেছি সেগুলি তো বহুতল ফ্লাটবাড়ি হয়ে গেল রাতারাতি। বিগত দুই দশকে হুটহাট করে গড়ে উঠা এইসব বহুতল ভবন আর ফ্লাইওভার দেখতে ঢাকা যেতে চাইনা আমি।

যে শহরে আমার শৈশব কেটেছে সন্ধ্যে বেলায় শিয়ালের হুক্কাহুয়া শুনে, ছুটির দিনে ঘুম ভেঙ্গেছে লেসফিতাওয়ালার দরাজ কণ্ঠে তা বিশ্বায়নের মোড়কে কতটুকু ঢেকেছে তা হয়ত প্রতিনিয়তই অনুভূত হবে। তবুও ভাবি নিশ্চিত দেখতে পাবো আমগাছের ডালে বানানো কাকের বাসা, সিঁড়িকোঠার দেয়ালের খাঁজে চড়ুইয়ের বাসা। শুনতে পাবো আবার কাঁচা বাজারের কোলাহল, বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে হাতে তুলে নিতে পারবো আবার টং ঘরের চায়ের পেয়ালা।

একরাশ গল্প নিয়ে আমি ফিরে আসবো বর্তমানে। হৃদয়ের বায়োস্কোপ খুলে দেখব আমি আমার আবাল্য প্রিয় ঢাকা, অসম্ভব ভালবাসার নগরী। কিছু সময়ের জন্য ভুলে যাবো শেকড়বিহীন প্রবাস জীবনের বেদনা।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

গিয়ে কিছু চিনতে পারবেন না। আপাতত এই গানটা শুনে রওনা দেন। চাইলে ফোনে ভরে যাত্রাপথে নিতে পারেন।

জিপসি এর ছবি

শুনলাম, চমৎকার একটি গান।
আমি এক দশক পর মার হাত ধরে মাতৃভূমিতে যাচ্ছি, এভাবে না গেলে হয়ত আমার আর কোনদিন ফেরা হবে না।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

যেন মনের কথাগুলোই লিখে দিলেন, এই শহরে ফিরে গিয়ে আজকাল নিজেকেই আগন্তুক মনে হয়, চেনা মানুষদেরও অচেনা মনে হয়.

জিপসি এর ছবি

আমি পরিবর্তনকে ভয় পাই না, তাই অনেক আগ্রহ নিয়েই ঢাকা শহরকে দেখতে যাচ্ছি। যে শহরের ফুটপাথ ধরে একটা সময় নির্বিঘ্নে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে টো টো করে হেঁটে বেড়িয়েছি সেখানে এতগুলি বছর পর দিন দশেকের জন্য আগন্তুক মনে হলেও কষ্ট পাবো না।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

আপনাকে স্বাগতম প্রাণের শহর ঢাকাতে।

গত বড়দিনের আগে বিষন্নতাবোধ নিয়ে বড়দিনের স্মৃতিচারনমূলক দুর্দান্ত একটা পোস্ট দিয়েছিলেন। এই পোস্টে বললেন, দিন দশেকের জন্য ঢাকাতে আসছেন!

বড়দিন পালন না করেই চলে যাবেন??

জিপসি এর ছবি

বিমানের টিকিট হাতে পেয়েই খুশির জোয়ারে পোস্ট লিখে ফেলেছি। ঢাকা আসতে আর অল্প কিছুদিন বাকি।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

বাস-সিএনজি-ট্যাক্সি কোন কিছু না পেয়ে একদিন রিকশায় উঠে মহাখালী যাবার সময় রিকশাচালক নানা গলিঘুঁচি দিয়ে যেতে থাকলেন। সেখানে হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দেয় বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা উঠোনওয়ালা টিনের বাড়ি যার চালে চালকুমড়ো, সীমানা দেয়াল ছাড়া হলুদরঙা একতলা দালান যার সামনে গাছগাছালি ভরা, মাচাতে সীম-লাউ। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে চোখের সামনে হাজির হয় নারকেলগাছ ঘেরা এক পুকুর যাতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে রাজহাঁসের পাল। এমন অনেক কিছু এখনো এই শহরে টিকে আছে। এক নদীতে যেমন দুই বার স্নান করা যায় না, তেমন এক শহরে আবার ফিরে আসা যায় না। নাই-বা হলো পুরনো শহরে ফেরা, কিন্তু দেশে তো ফিরছেন! সেটাই বা কম কিসের।

স্বদেশে আপনার ওবস্থান নিরাপদ আর আনন্দময় হোক। বড়দিনের আগাম শুভেচ্ছা রইলো।

জিপসি এর ছবি

আপনি তো আমাকে বড় আশার কথা শোনালেন। আপনার বর্ণনা পড়ে চোখের সামনে শৈশবের সেই শান্ত মায়ামাখা ঢাকা শহরের ছবি ফুটে উঠলো যেখানে একসময় মানুষ, গাছ আর পশুপাখির মিলিত আবাস ছিল।
ভাল থাকবেন, ধন্যবাদ জানবেন।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর, আহা রে!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জিপসি এর ছবি

যতবার জন্মস্থান হিসেবে 'ঢাকা-বাংলাদেশ' লিখি ততবার গর্বে বুকটা ভরে যায়।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

নজমুল আলবাব এর ছবি

শীল পাটার কাজ করা লোকটার চোখে চশমা ছিলো। লাল রঙ। দড়িতে বাঁধা। ঘোলা কাচ...

জিপসি এর ছবি

একদম ঠিক বলেছেন। চশমা চোখে দিয়ে আরেকজন আসতো কোরবানির আগে ছুরি-বটি ধার দিতে, সানগ্লাস লাগিয়ে একমনে ঘুড়িয়ে যেতো চাকা। ছুরি আর চাকার সংঘর্ষে বেরিয়ে আসতো বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ। এ যেন খোলা আকাশের নিচে পদার্থবিদ্যার প্রাকটিকাল ক্লাস।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

তিথীডোর এর ছবি

দেশে আপনার সময়টুকু নিরাপদ আর আনন্দময় হোক। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

জিপসি এর ছবি

ধন্যবাদ তিথী। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- হাসি

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাগ্যিস দশটা দিন পেরিয়ে যাওয়ার আগেই চোখে পড়ল পোস্টটা। তার মানে, আমরা একই শহরে অবস্থান করছি এখন, হয়ত দেখা হবে না, তবু অসম্ভব প্রিয় একজন সচল আছেন সেই শহরেই, যেখানে আমারও বাস, এই অনুভূতিটিও কম কিছু নয়!

সন্ধ্যাবেলা আসবে কি আবার সেই লাল রঙয়ের অদ্ভুত বেশধারী চানাচুরওয়ালা চোঙ্গা হাতে নিয়ে? অর্থশাস্ত্রের সেই সুপ্রাচীন লেনদেন ক্রিয়ায় গুঁড়ো দুধের খালি টিন আর পুরাতন খবরের কাগজ নিয়ে কটকটিওয়ালা কি আমার হাতে তুলে দিবে অল্পসল্প কটকটি নাহয় তিলের খাজা? মহল্লার মুদি দোকানে সেই টিনের কালো বাক্স কি এখনও আছে ?

আমাকেও স্মৃতিকাতর করে দিলেন ভাই, সেই সন্ধ্যের চানাচুরওয়ালা আমার কাছে ছিল রূপকথার নায়কের মতই, আর সেই কটকটি! পেটিস, খাজা বা ধুনকর অল্পবিস্তর চোখে পড়ে এখনো!

মহল্লার ছোট ছোট মাঠগুলি যেখানে শীতের ছুটির দিনগুলিতে ব্যাডমিন্টন আর টেপ টেনিস বল দিয়ে দলবেঁধে ক্রিকেট খেলেছি সেগুলি তো বহুতল ফ্লাটবাড়ি হয়ে গেল রাতারাতি।

সেই ফাঁকা ঢাকা আর নেই, উঁচু দালানের প্রতিযোগীতা নিশ্চয়ই এতদিনে দেখতে পেয়েছেন?
তবু আমাদের ঢাকা, শত সীমাবদ্ধতা নিয়েও ভালবাসার আঁচলে ঢেকে রেখেছে প্রায় দেড় কোটি মানুষকে মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার জায়গায়!
আপনার দেশে অবস্থান নিরাপদ, আনন্দময় হোক।
।।।।।।।
অনিত্র

জিপসি এর ছবি

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। দেখা হয়ত হবে না কিন্তু

তে আপনার ফোন নাম্বার ইনবক্স করলে অবশ্যই কথা হবে হাসি

ভাল থাকবেন অনিত্র।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।