ক্যাপ্টেন সং এর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়, সেক্টর হেডকোয়ার্টারের সামনে। প্রথম পরিচয়ে সে আমাকে রীতিমত ভড়কে দিল পরিস্কার বাংলাভাষায় কথা বলে।সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল এই ভাবে, “ আমার নাম ক্যাপ্টেন বন্দুক।“ আমি বললাম” What ?” সে পরিস্কার বাংলা ভাষায় আবার তার নাম বলল, “বন্দুক”।আমি মনে করলাম লোকটার মাথায় মনে হয় ছিট আছে কিনচিৎ।পাশে থাকা একজন অফিসার বললেন যে, ও ওর নামকে অনুবাদ করেছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম? উনি ব্যাখ্যা করলেন, ওর চায়নিজ নাম সং। সং এর বাংলা হচ্ছে গান, আর গান ইংরেজিতে বোঝায় বন্দুক , সহজ ভাবে SONG=গান=GUN=বন্দুক। সুতরাং ক্যাপ্টেন সং হয়ে গেল ক্যাপ্টেন বন্দুক। আমি তার নামের শানে-নুযুল শুনে যারপরনাই চমৎকৃ্ত হলাম।বুঝলাম যে এই মালের সাথে আমার খাতির লাগাতে হবে। অচিরেই কঠিন বন্ধুত্ত হয়ে গেল আমার ক্যাপ্টেন সং এর সাথে।
জাতিসংঘে কাজ করতে এসে বিভিন্ন দেশের আর্মির ব্যাপারে একটা ধারনা হয়েছে।আমার মতে,চায়নিজ আর্মি হচ্ছে অত্যন্ত ভদ্র আর্মী। চুপচাপ, শান্তশিষ্ট টাইপ।আমার খুবই ভাল লাগে এদের কাজ কারবার।মুখে কথা নাই, কাজ করে যাচ্ছে।নাইজেরিয়ানরা রাফ এন টাফ, পাকিস্তানীরা আওয়াজে পাকিস্তান।ইন্ডিয়ানরাও মিশুক,তবে সহযোগীতার হাত খুব প্রশস্ত নয় বলে আমার ব্যাক্তিগত মতামত। আমেরিকানরা, পৃথিবী সম্নন্ধে কোন আগ্রহ নাই তাদের, খালী ভাব। সমালোচনা বাদ দেই। চাইনিজ দের কথা বলছিলাম।এরা চায়নিজ ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষা জানেনা। ইংলিশ এবং চড়ুই পাখির ভাষার মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য নাই তাদের কাছে।প্রান-পন চেষ্টা করেও এক লাইন ইংরেজী বোঝানো যায়না এদেরকে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,আমাদের বাংলাদেশের সৈনিকদের সাথে চায়নিজ সৈন্যদের গলায় গলায় ভাব। যেখানে আমরা চায়নিজ দের ইংরেজী বলেও কিছু বোঝাতে পারিনা, তাদের(বাংলাদেশী সৈনিকরা) কি খাতির তাদের (চায়নিজদের)সাথে!!
এই রহস্য ভেদ করার জন্য, আমার এক সৈনিক যার বেস্ট ফ্রেন্ড চায়নিজ আর্মির এক সৈনিক, তারে জিজ্ঞেস করলাম বলত ঘটনা টা কী? সে বলল, স্যার, ওরা বাংলা বুঝেনা, ইংরেজী বুঝেনা, কিন্তু নোয়াখালীর ভাষা বোঝে। আমার তো আক্কেল গুড়ুম! কস কী মমিন?? ক্যামনে? “স্যার, ওদের কে হাত নাড়াইয়া, আঞ্চলিক ভাষায় কিছু বললে ওরা বুঝে, আমন কি স্যার আপনার দেশের বাড়ী সিলেটের ভাষা ও ভালো বুঝে।“ বুঝলাম যে ‘ইশারায় শিষ দিয়ে’-ভাষায় আসলে এদের মধ্যে কথা হয়।
ইদানিং চীনের সাথে আমাদের সামরিক সম্পর্ক খুব নিবিড়। যেমন আমাদের বৈদেশিক কোর্স গুলাতে অনেক অফিসাররা চীনে প্রশিক্ষন নিচ্ছে। তেমনি বাংলাদেশেও অনেক চায়নিজ অফিসাররা আসছে কোর্স করার জন্য। সিলেটে একবার আরেকটা অফিসারের সাথে ৩ মাস কোর্স করেছিলাম, তার নাম মেজর ঝু-ঝিং। ৩ মাসের ২ মাস সে একটাও কথা বলেনি, ক্লাসে এসে ল্যাপটপ অন করে কি জানি লিখত।আমি পরে তাকে সিলেটী এবং বাংলা শুদ্ধ ভাষা শিখিয়েছিলাম।
আমরা মাঠ প্রশিক্ষনে এক জঙ্গলে ৫ রাত কাটিয়ে ছিলাম একসাথে।তখনি সে প্রথম মুখ খুলে।সে সব বুঝত, কিন্তু কথা বলত কম। আমাকে চীনের অনেক গল্প সে শুনিয়েছিল। সে একজন হেলিকপ্টার চালক এবং একজন কমান্ডো ছিল। সাপ কত উপাদেয় একটি খাদ্য তার কাছেই এই রান্না আমি শিখে ছিলাম।( দয়া করে কেউ ওয়াক করবেন না, ৫ দিন না খেয়ে থাকলে আপনি কোন কিছু খেতে আপত্তি করবেন না)। প্রথম কয়দিন জঙ্গলে সাপের উপদ্রব থাকলেও, সাপ রান্না করে খাওয়ার পর, সাপের উপদ্রব একদম কমে যায়।সে ছিল ভয়াবহ ফর্সা একজন মানুষ, মশা এবং পিপড়ার কামড়ে তার সারা শরীর লাল-কালো মিশ্রিত এক ধরনের দাগ হয়ে গিয়েছিল। আর জোকের কামড়ে আমার শরীরের রক্ত অর্ধেক কমে গিয়েছিল, আমাকে কেন জানি মশা তেমন কামড় দিতনা।
শেষ করি একটা প্র্যাকটিক্যাল ঘটনা দিয়ে। একবার মনরোভিয়া এয়ারপোর্টে আমার এক কলিগ গেছেন পরিবহন বিমান থেকে সামরিক ট্রাকে করে বড় বড় বক্স আনার জন্য। এখন প্লেন থেকে মাল ট্রাকে তুলতে হবে। এই কাজ টা চায়নিজদের দায়িত্ব। কিন্তু কোনভাবেই তাদের কে এই কাজ টা বোঝানো যাচ্ছেনা। অতঃপর, এক সৈনিক এগিয়ে এলো। সে একটা ছোট বক্স মাথায় নিয়ে চায়নিজদের বললো “ লইয়ায়া চল”। এই ‘লইয়া চল’ Command এ জাদুকরি কাজ হলো। মুহুর্তে চায়নিজ আর্মি ঝাপিয়ে পড়ল কাজে। এবং ৫ মিনিটে সব বক্স ট্রাকে!!
মন্তব্য
বহুত মজা পাইলাম
...........................
Every Picture Tells a Story
আরেকটু লম্বা টান দিয়ে....এভাবে....."লইয়াআআআআআ চল"
হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মিটেনা।
----------------------------------------------------------------------------
উঁহু, টানটা মনে হয় এরকম হবে...'লইয়াআ চঅঅঅল'
হা হা হা !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
হা হা। মজা লাগল চাইনিজদের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার ব্যাপারটা জেনে। ক্যাপ্টেন বন্দুক আপনার সাথে কোন ভাষায় কথা বলেন?
ভাল লেগেছে লেখাটা।
সং ব্যাতিক্রম। ও ইংরেজী ভাল বলতে পারে। সব ভাষায় সে একটু-আধটু বলে, এবং খুব মিশুক। সবাই ওকে খুব পছন্দ করে ওর সাবলিল ব্যবহারের জন্য।
হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মিটেনা।
----------------------------------------------------------------------------
মজা লাগল ।
আমার বাসার কাছে বেশ কিছু চীনা লোক ভাড়া থাকে । চীনাদের সাথে ঢাকার রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝে কথা হয়, বাসের টিকেট কাটার সময় কোন স্টপেজের টিকেট কাটবে - এই ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে । তবে এরা আসলেই ভদ্র, অন্তত আমারো তাই মনে হয়েছে ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
এই একুশে বই মেলায় হয়ত সম্ভব হবে না | তবে পরবর্তি বই মেলায় দুই মলাটের ভেতর চাই “লেটার ফ্রম লাইবেরিয়া ” |
সেনা সদরের অনুমতি ব্যতিত এটা করা যাবেনা।
---------------------------------------------------------------------------------
হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মিটেনা
হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মিটেনা।
----------------------------------------------------------------------------
সমস্যা হবেনা মনে হয়। নেটে খুজলেই অনেক ইউএস মেরিনের ব্লগও পাওয়া যায়।
....................................................................................
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
যায় । পড়িও মাঝে মাঝে । আমার কয়েকটা নেট ফ্রেন্ড আছে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর লোক । তবে ওদেরও কিছু নিয়মের মধ্যে থেকে ব্লগিং করতে হয় । কিছু কিছু জিনিস আছে যার ছবি তোলা নিষেধ । খেয়াল করলে দেখবেন, এধরনের ব্লগে কিন্তু সেরকম ছবি আসেনা ।
ওসব দেশের নীতি নির্ধারকেরা ব্লগ চিনে, না হলেও অন্তন অন্তর্জালে কি করা যেতে পারে সে সম্পর্কে ধারনা রাখে । আমার তো মনেহয় যুবরাজ যদি আনুষ্ঠানিক ভাবে অনুমতি প্রার্থনা করেনও, অনেক হ্যাপা সামলাতে হবে ব্লগ জিনিসটা কি তা বুঝাতে ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
সেরম।
সাপ খাওয়ার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের। সুযোগ হচ্ছে না।
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
সৌদি আরবে গিয়ে শুনেছি সিলেটিরা আর নোয়াখলিরা সিলেটি আর নোয়াখালিই বলে প্রথম প্রথম
কারণ সৌদিরাও নাকি আরবি ছাড়া শুধু সিলেটি আর নোয়াখলির ভাষা বোঝে
(সঙ্গে একটু হাত পা নাড়তে হয় এই আরকি)
জয়নুল আবেদীনকে নিয়ে একটা ঘটনা আছেনা, যেখানে তিনি ফ্রান্সের রেস্তোরাঁতে ছবি এঁকে আর হাতের ইশারায় বেয়ারাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কি খাবেন ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
হেহ হেহ, শুভঙ্করের ফাঁকিটাও ঐ জায়গায়ই। হয়তো নোয়াখালি আর সিলেটের ভাষায় শব্দের সাথে হাত-পা ছুঁড়ার রীতি আছে দেখেই দ্রুত বোঝে। প্রমিত ভাষায় তো সবাই স্রেফ কথাটা বলেই খালাশ।
এটা একটা ভালো পর্যবেক্ষণ
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
দারুণ লিখেছেন আবারো।
....................................................................................
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
সুন্দর লেখা।
সাপ খেতে কেমন? আমার তো বাইম মাছের মতই মনে হল।
২০০৩ সালে ফুদান ভার্সিটি থেকে আগত একদল নতুন গ্রাডুয়েটকে দলবদ্ধ করার মাধ্যমে চীনাদের সাথে প্রথম কাজ করি। পড়াশুনায় ও অন্যান্য বিচারে তারা বেশ পরিপক্ক(GRE 760 ও তদুর্ধ)। তবে প্রত্যেকেই নানান কারনে হীনমন্নতায় ভুগছিলেন। দলবদ্ধ পরিবেশে এরা বেশী সাবলীল। তবে একা কোন দায়িত্ব নিতে বা কাজ খালাস করতে এদের বিশেষ সীমাবদ্ধতা আছে। আবার মিশ্র জাতীয়াতার দলবদ্ধ পরিবেশেও এরা হাইররার্কি বুঝে কথা ও কাজ করেন। যতক্ষন না বক্তার সমাজ বা সংস্থাগত অবস্থান পরিস্কার না হচ্ছে, ততক্ষন কথার জবাব দিতেও এরা ইতস্তত করছিলেন। শুরুতে আমি এটাকে আমার নিজের স্টেরিওটাইপ মনে করেছিলাম - তবে এর পর তিন চারটি প্রজেক্টে বার বার একই জিনিস দেখেছি।
সিঙ্গাপুরী বা মালায়শিয়ার চীনাদের মধ্যে এ প্রবণতাটা দেখিনি। গত বছর পশ্চিম চীনের ঝিঞ্জিয়াং ভার্সিটির কিছু উইগুর এর সাথে কাজ করে তাদেরকেও আলাদা মনে হয়েছে।
এটা হতে পারে যে প্রথাগত ভাবে চীনা যুবাদের প্রতিযোগীতাবিমূখ করা হয়।
লিখত।আমি পরে তাকে সিলেটী এবং বাংলা শুদ্ধ ভাষা শিখিয়েছিলাম।
হাহাহাহা। চায়নীজদের সাথে ইংলিশ বলা একটা মহা অভিজ্ঞতা ঃ-}
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ব্যাংককে এক বুড়ি ভদ্রমহিলার দোকান থেকে আমার কাজিন প্রতিদিন জাম্বুরা নিয়ে আসত । থাই জাম্বুরা খুব মজা ।
তো একদিন আমি গেলাম । কিন্তু ইংরেজী বাংলা কিছুতেই বুঝাতে পারি না যে তাকের পেছনের জাম্বুরা আমার দরকার ।
একটু পরে কাজিন এসে এক হাঁক দিল - খালাম্মা ,বালাখরি কাটিয়া এখটা মাত্তু দেউকাছাইন ।
বুড়ি এক মিনিটে জাম্বুরা হাজির করল ।:)
এই হাতে নাতে প্রমান পাওয়ার পরে সিলেটী ভাষার মহত্ত্ব আমি বুঝেছিলাম ।
ক্যাপ্টেন সং নিঃসন্দেহে একটা দারুণ পোলা।
ও পরিচিত বাংলাদেশী অফিসারদের ফোন রিসিভ করে "দুস্ত" বলে হাঁক দিয়ে।
ওর বোনও (সে আবার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল) খুব কো-অপারেটিভ।
****
যথারীতি দারুণ হইছে।
এই সিরিজটা কি শেষ?
আজ হুট করেই তোর ফেইস বুকের লিংক ধরে পড়লাম।
নতুন মন্তব্য করুন