আব্দুল জলিল জেলে আছে এগার মাস পুরো হলো আজ। অথচ সে জানে না কী তার অপরাধ! কেন তকে ধরে এনেছে! এ পর্যন্ত কেউ এসে একবার জিজ্ঞেসও করেনি- কেন তাকে জেল খাটতে হচ্ছে।
একবার শুনতে পেয়েছিলো মানবাধিকার কর্মীরা জেলখানা পরিদর্শনে আসবেন। তার আগেই কয়েকজন ইঁদুরমুখো কনস্টেবল সেলে সেলে উঁকি মেরে বলে গেছে, 'যার মুখ দিয়া কথা ফাঁস হইবো তারেই গরম পানিতে সিদ্ধ করা হইবো।'
কিছুদিন আগে এক কিশোরকে বলাৎকার করে মেরে ফেলেছে কয়েকজন পুলিশ। ঘটনাটা বেরিয়েছিলো খবরের কাগজে। এবার তেমন কোনো ঘটনা না ঘটলেও এক কয়েদীর শরীরের গোপন জায়গা থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে নিজেরাই পকেটে পুরে ফেলে। ঘটনাটা আব্দুল জলিল আর তার সেলবাসীরা আঁচ করতে পেরেছিলো বলে যাতে মুখ না খুলতে পারে সে জন্যে তাদের পিটিয়ে প্রায় আধমরা করে ফেলে রেখেছিলো। তবুও পরে এ কান ও কান হয়ে ঘটনাটা পত্রিকার পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছিলো ঠিকই।
সেই থেকে আব্দুল জলিলরা অর্থাত্ তার সঙ্গে যে কজন আছে তারা কিছু দেখলেও দেখে না। শুনলেও শুনে না। এমন কি বলার প্রয়োজন হলেও বলে না। কী হবে এ চুতিয়া দেশে সত্যি কথা বলে? চারদিকে এত লুটেরা আর চোর ছ্যাচ্চোর যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়- ওদের বাপ-দাদা ওদের হাতে দেশটাকে নিলাম করে দিয়ে গেছে। যেন বাজারের কোনো যুবতী পাগলী। কে বা কারা রাতের অন্ধকারে তাকে গর্ভবতী করে রেখে যায় কেউ হদিস জানে না।
একটি পুরোনো ওভারলক মেশিন মেরামত করে রাত দশটার দিকে মালিবাগ রেললাইনের স্লিপার টপকে টপকে বেশ ঝরঝরে মন নিয়ে বস্তিতে ফিরছিলো আব্দুল জলিল। মনেমনে ভাবছিলো খেয়েদেয়ে চুপিচুপি আহাদ সাহেবের বাড়ির পেছনে গিয়ে নিসুর জানালায় টোকা দেবে আস্তে করে।
নিসু তাকে বলে দিয়েছে- প্রতিদিন রাতে এভাবে একবার দেখা করে যেতে। তাকে দেখতে না পেলে নাকি তার ঘুমই হয় না। আব্দুল জলিল হেসে বলেছিলো, 'আমি কি তোমার ঘুমের বড়ি?'
নিসুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো কোনো এক অজানা আনন্দ অথবা সুখে। কিংবা কোনো এক স্বপ্ন এসে রাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো তার মুখটি। সে বলেছিলো, 'ঘুমের বড়ির থাইক্যাও বেশি!'
গোলগাল চাঁদপনা মুখের নিসুকে দেখলেই আব্দুল জলিলের মনের ভেতরটা গলতে থাকে মোমের মত। সারাদিনের যাবতীয় অবসাদ, দুখ-তাপ সবকিছুই যেন ভুলে যায় সে। হৃষ্টমনে কোনো এক অজানা ভালোলাগার আবেশে টলতে টলতে সে হেঁটে চলে। বস্তিতে ফিরে যায় আরেকটি দিন বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা নিয়ে। যদিও সে ভালোমতই জানে যে, তার প্রতি নিসুর এ আবেগ বা দুর্বলতা এক ধরনের বিলাসিতা। বড়লোকের মেয়েদের অনেক ধরনের পাগলামী থাকে। কিন্তু সব বুঝলেও তার নির্বোধ হতে ভালো লাগে। মনে হয় এই নির্বুদ্ধিতাই তার প্রকৃত সুখ। চাঁদের নাগাল মানুষ কখনো পায় না। তাই বলে তার জোছনায় উন্মাদ হতেও কোনো বাছ-বিচার করে না।
এমনি নানা কথা ভাবতে ভাবতে লম্বা পা ফেলে ফেলে স্লিপার টপকাচ্ছিলো সে। তখনই খানিকটা দূরে আবছা শোরগোলের মত শুনতে পেলেও চলা বন্ধ করে না। এমন শোরগোল মাঝে মধ্যেই হয়। মাসে দু'একবার পুলিশ এসে হাঙ্গামা করে।
রাত দশটার পরই রেললাইনের দু'পাশে জমজমাট হাট বসে। তবে এ হাট আর সাধারণ আট-দশটা হাটের মত নয়। এ অন্যরকম হাট। দূরের সোডিয়াম বাতির ঝাপসা আলোয় আরো ঝাপসা আর দুর্বোধ্য চেহারা নিয়ে এখানে এ সময় বিভিন্ন বয়সের নারীরা আসে। না, এরা নিজেদের বিকোতে আসে না। আসে বিভিন্ন রকমের নিষিদ্ধ পন্য নিয়ে। যেগুলোর পরিচয় সাধারণের কাছে আরো ঝাপসা। আরো ধোঁয়াটে।
কারো বুকের মাঝখানে ব্লাউজের ভেতর থাকে ছোটছোট হেরোইনের পুরিয়া। কারো কোমরের খুতিতে থাকে গাঁজা বা চরসের পুরিয়া। হাতে থাকে নেভি বা ফাইভস্টার সিগারেটের প্যাকেট। তার ভেতরে বুইল্যা বা গুলা নামের অসাধারণ এক সিগারেট। কোনো মাঝ বয়সী নারীর শাড়ির নিচে পেটিকোটের গোপন পকেটে থাকে ফেন্সিডিল বা অফিসার্স চয়েস নামের নেশার বোতল। কেউ বা ব্যাগে করেই নিয়ে আসে বিয়ার কিংবা মদ।
এখানে যারা খদ্দের হয়ে আসে, তারা তাদের বাঞ্ছিত জিনিসটির নাম জানে। হেরোইনের নাম আগরবাতি। গাঁজা বা চরসের নাম ধূঁয়া অথবা ধোমা। ফেন্সিডিলের নাম ফেন্সি বা ডাইল। কিংবা ভিন্ন কোনো সাংকেতিক নাম। যা বিক্রেতা আর খদ্দেরের মাঝেই সীমাবদ্ধ।
পুলিশ সহ বিভিন্ন চাঁদাবাজ এদের কাছ থেকে বিভিন্ন হারে চাঁদা তোলে। থানার ওসি বা কমিশনার বদল হলেই একদিন হঠাত্ করে শুরু হয়ে যায় ধরপাকড়। নতুন চুক্তি হয়। চাঁদার রেট পরিবর্তন হয়। তারপর আবার সেই একই চালচিত্র। আধো অন্ধকারে চকচকে চোখে চলে লেনদেন। কথাবার্তা চলে ফিসফিস শব্দে। কখনো বা চাপা হাসি কিছুক্ষণের জন্য আপোসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে যায়।
হঠাৎ আধো অন্ধকার থেকে একটি নারী কন্ঠ অস্ফুটে বলে উঠলো, 'পলান মিয়া! যারে পাইতাছে তারেই ধরতাছে!'
ছুটে যাওয়া পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগে কিংবা কি করবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই দু'পাশ থেকে দু'জন পুলিশ ভুতের মত চেপে ধরলো আব্দুল জলিলকে।
বিস্মিত আব্দুল জলিল নিজকে ছাড়িয়ে নেবার ব্যর্থ আক্রোশে বলে উঠলো, 'কী করতাছেন ভাই?'
'পরে টের পাবানে!' বলেই একজন তার হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করলো আব্দুল জলিলের মাথায়। তারপর নিজকে সে আবিষ্কার করেছিলো এই সেলের ভেতর। একটু খোলা জায়গায় আসামীরা ঘুরবার জন্য প্রতিদিন দু বেলা সেলের দরজা খুলে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এই এগারো মাসের ভেতর একদিনও তারা ঘুরতে ফিরতে বাইরে যেতে পারেনি। যারা যারা কোর্টে হাজিরা দিতে যায়, তারাই কেবল বের হতে পারে। তাও হাতে পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরে।
(চলবে...)
মন্তব্য
চলুক। গল্প কেন যেন করুণ মনে হচ্ছে!!
দেখা যাক পরের পর্বে কি হয়।
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বাকিটা দিয়ে দিলাম। অবশ্যই করুণ। আব্দুল জলিল একটি প্রতিকী চরিত্র। কিন্তু কতটুকু পারলাম দেখেন। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
পড়ছি...। চলুক
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
বাকিটাও পড়েন। ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
২য় কিস্তি লাগান তাড়াতাড়ি। আপনার লেখনি বেশ ভাল।
তবে ভাই রেল লাইনের ঐসব জিনিস-পত্রের এতসব নাম আপনে জানলেন কেমনে ভাই?
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ওই রেললাইন ধইরা হাটলে আপনেরও মুখস্ত হইবো আশা করি। ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ভালো হচ্ছে খুব। আমাকে সাথে পাবেন। তবে আরেকটু বড় করে ছাড়েন বস।
পাঁচ তারা ছাড়া আর দেওনের কিছু নাই। সাথে থাকলে এক কাপ চা খাওয়াইতে পারতাম।
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
চা জমা রইলো। ইলাস্টিক টানলে দূর্ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সাবধানের মার নাই! বাকিটাও ছাড়লাম। খুশি মনে পড়েন।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন