সন্ধ্যা হয় হয় ঠিক এমন সময় রহিমুদ্দি গোঙ্গার হাটে এসে পৌঁছায়। হাটবার বলে ঘাটে অনেক নৌকা একটার সাথে আরেকটা এমন ভাবে লাগিয়ে রেখেছে যে, রহিমুদ্দি সচরাচর যেখানে নৌকা ভিড়ায়, সেখানে এগিয়ে যেতে পারলো না। কিছুটা পেছনে সরে এসে দুটো নৌকার মাঝে সামান্য ফাঁক পেয়ে তার নৌকার মাথা প্রবেশ করায়।
তারপর আস্তে আস্তে লগিতে চাপ দিলে তার নৌকা এগিয়ে যেতে যেতে দুপাশের নৌকা ঠেলে নিজেই জায়গা করে নেয়। নিজের জায়গা নিশ্চিত করে লগিটা নিয়ে ঘাটে নেমে পড়ে। কিছুটা নরম কাদা দেখে লগিটাকে সেখানে জোর দিয়ে খুঁটির মত করে গেঁথে ফেলে। শেষে লগির সাথে নৌকার দড়িটাকে বেঁধে ঢাল বেয়ে উপরে উঠে আসে।
এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে ধান কলের মালিক তালেব ব্যাপারির গদিতে এসে ব্যাপারির খোঁজ করে। কিন্তু মুন্সি আকবর আলি বললো, 'ব্যাপারি আইজ আসেনি।'
'তালি আমি যে চাইল নিয়ে আলাম?'
'ও নিয়ে তোমার মাতা গরম করতি হবিনানে! খাতায় তুলে চালান লেইখে দেবানি, যাবার সুমায় নিয়ে যাইও!'
রহিমুদ্দি কোমর থেকে গামছা খুলে হাতমুখ মুছতে মুছতে বলে, 'তোমার লোকজন কনে, আমার বস্তা তুলবে কেডা?'
'ও হবেনে!' বলে, মুন্সি গদি থেকে উঠে ঘাটমুখো দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, 'তোমার নৌকো কোনডা?'
'ওই যে পাটের নৌকোর সাতেই!'
'কয় বস্তা আইনেছো?'
'সাতবস্তা। বরাবর তো এই কয়ডাই আনি!'
মুন্সি হয়তো মনে মনে নৌকার বস্তা গোনে। কেমন যেন মাথা ঝোঁকাতে দেখা যায়।
তারপর বলে, 'ইবার কেমন জানি মনে হতিছে!'
রহিমুদ্দি অবাক হয়ে বলে, 'কেমন মনে হতিছে?'
'ইবার পুরাপুরি মাপের চাইল হবেনানে!'
'কয়েন কি মুন্সি!'
'হয়!'
'পরতেকবার যে বস্তায় আনি, ইবারও তো তাই রয়েছে!'
'উঁহু!'
টাকরায় জিভ লাগিয়ে চুকচুক শব্দ করে মুন্সি।
মুন্সির রকম-সকম দেখে রহিমুদ্দির খটকা লাগে। এর আগে যতবার এসেছে, প্রত্যেকবারই তালেব ব্যাপারিকে নৌকায় বস্তা দেখিয়ে হাটের ভেতর চলে যেতো রহিমুদ্দি। ওজন নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। আয়নাল মিয়া বস্তা প্রতি পঁচাত্তর কেজি করে চাল মেপে বস্তার মুখ নিজ হাতে সেলাই করে দেয়। এখানে এসেও ওজনের হেরফের হয় না। কিন্তু মুন্সি কী বলছে এসব?
রহিমুদ্দি কিছু না বলে বাইরে বের হয়ে আসে।
তারপর নৌকায় এসে বস্তার উপর বসে বসে বিড়ি টানে। কিন্তু মুন্সির কথার আগামাথা খুঁজে পায় না। এক সময় তার মনে সন্দেহ জাগে যে, মুন্সি তালেব ব্যাপারির গদি দখল করে ফেললো কিনা! কারণ, কত কর্মচারিই তো তার মালিকের সব কিছু লুটেপুটে একদিন নিজে মালিক হয়ে বসেছে!
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তালেব ব্যাপারির লোকজন বস্তা নিতে আসে না। মনে মনে সে অস্থির হয়ে উঠতে থাকে। ঘাটে নৌকা ভেড়াবার সাথে সাথেই তার পেটে একটা আগুনে ক্ষুধা লাগে। চালের বস্তা কাউকে না বুঝিয়ে দিয়ে সে কোথাও বেশি সময়ের জন্যে যেতেও পারছে না এখন। এমন সময় আরেকটা নৌকা থেকে তালেব ব্যাপারিকে নামতে দেখা যায়।
রহিমুদ্দি ব্যস্ত হয়ে বলে, 'সালামো আলাইকুম ব্যাপারি! কোনহানে গেইছেলেন? গদিতে যাইয়ে তো পালাম না!'
তালেব ব্যাপারি বলে, 'পুরান গদিতে গেইছলা?'
'হয়!'
'মুন্সির সাতে কতা হইয়েছে?'
'তাতো হইয়েছে!'
'ওডা আমি ছেইড়ে দিয়েছি কাইল! এহন বড় দেইহে আরেকটা নিয়েছি!'
'আমি তো ও খবর জানিনে!'
'আমার সঙ্গে আসো!'
'আমার নৌকা?'
'আমার মাঝি দেইহে রাখবেনে!'
রহিমুদ্দি তালেব ব্যাপারির পিছন পিছন উঠে আসে।
সত্যিই বড়সড় দালান ঘর। মেশিনও বসেছে বেশ কয়েকটা। রহিমুদ্দি দালানে প্রবেশ করতেই ব্যাপারি তার নতুন মুন্সিকে বলে, 'লোকজন পাঠায়ে বস্তা আনাবার ব্যবস্থা কর!'
তারপর রহিমুদ্দিকে বলল, 'সাত বস্তাই আনিছাও?'
'হয় ব্যাপারি!'
ব্যাপারি মুন্সিকে বলল, 'পঁচাত্তর কেজি কইরে সাতবস্তা চাইলের একখান চালান বানাইয়ে রহিমুদ্দিরে দিয়ে দেও দেহি!'
মুন্সি 'গোলাম হোসেন' বলে কাউকে ডাকলো। সঙ্গে সঙ্গেই একজন দরজায় মুখ বাড়ালে মুন্সি আবার বলে, 'ঘাটে আমাগের মাঝি রয়েছে। রহিমুদ্দির নৌকো থেহে চাইলগুলা তুইলে আনো। যাও!'
তালেব ব্যাপারি মুন্সিকে বললো, 'রহিমুদ্দিরে মিষ্টি আইনে খাওয়াও!'
রহিমুদ্দি অবাক হয়ে বলে, 'মিষ্টি খাতি কচ্ছেন ক্যান ব্যাপারি! ঘটনা কি?'
ব্যাপারি হাসে। 'নতুন গদিতে এয়েছো, মিষ্টি খাওয়াতি হবে না? তা ছাড়া তুমি এতদিন ধইরে আমাগের সঙ্গে আছো, তোমারে বাদ দিয়ে কোনো আনন্দ হতি পারে?'
ছোট্ট একটা কলাপাতার টুকরোতে দুটো মিষ্টি এনে রহিমুদ্দির হাতে দেয় মুন্সি।
তারপর কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চালান তৈরি করে সে এগিয়ে দেয়।
টপাটপ মিষ্টি দুটো মুখের ভেতর চালান করে দিয়ে রহিমুদ্দি হাত বাড়িয়ে মুন্সির কাছ থেকে সাতবস্তা চালের চালান নেয়। চালান হাতে পেয়ে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে তার।
তারপর ব্যাপারিকে সালাম দিয়ে গদি থেকে বেরিয়ে আসে।
দুটো মিষ্টি পেটে পড়তেই যেন তার ক্ষুধা আরো দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠে। সে প্রায় ছুটে যায় মন্টু মিয়ার ভাতের হোটেলে। হন্তদন্ত হয়ে সে হোটেলে প্রবেশ করে নিজে নিজেই টিনের থালায় ভাত নেয়। লবন আর দুটো কাঁচা লঙ্কা হলেই তার চলে। কোনো কোনো দিন শুধু ডাল অথবা মাছ। খুব বেশি ইচ্ছে হলে এক বাটি গরুর গোস্ত নেয়। আজ সে দ্বিতীয় থালার সাথে রুই মাছের পেটি নেয়। গোস্তর চেয়ে মাছ বরাবরই তার পছন্দ।
খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে রহিমুদ্দি এক কাপ চায়ের কথা বলে। ভাতের পরে কখনো কখনো চা পান করা তার এক ধরনের বিলাসিতা। এ ছাড়া বাজে খরচ সে কখনোই করে না। বিল শোধ করে সে কালুর দোকানে এসে এক টকুরো শুপারি নিয়ে মুখে দেয়। সেই সাথে এক প্যাকেট বিড়ি দিতে বলে।
কালু বললো, 'গত হাটবারে তো পয়সা ফেরত নিলা না!'
'তাতে হইয়েছে কি? পয়সা তো আর উইড়ে যাবে না!'
কালু হাসে। বিড়ির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে, 'বাকি দু'পয়সা পরে দিও!'
রহিমুদ্দি বিড়ির প্যাকেট হাতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিড়ি ধরিয়ে ভুস ভুস করে টানে আর মুখ ভরে ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর গজেন্দ্র চালে বাজারটা চক্কর দিতে এগিয়ে যায়।
(চলবে...)
মন্তব্য
ভাল লাগছে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
'তাতে হইয়েছে কি? পয়সা তো আর উইড়ে যাবে না!'
রহিমুদ্দিরা সত্যিই এমন বিশ্বাসী মানুষ।
রহিমুদ্দির মুখে ডায়লগটি ভীষন মানিয়েছে।
জানিনা আমি কেন আঞ্চলিক ভাষা বা শব্দ এত পছন্দ করি! হয়তো, আঞ্চলিক ভাষাতেই অঞ্চলের কথা মানায় ভাল।
যাদের কথা তাদর মুখে শুনতে খুব ভাল লাগে।
"গোঙ্গার হাটে" এবং অন্য সব চরিত্রের নাম গুলো অসাধারন দক্ষতায় গল্পের সঙ্গে মিলিয়েছেন। অনেক দিন পরে জিবীত লেখা পড়লাম।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আঞ্চলিক ভাষাটা প্রাকৃতজনের ভাষা। কোথায় যেন পড়েছি।
আর আঞ্চলিক ভাষাটা না হলে ঠিক মনখুলে কথা বলা যায় না। যেমন আমিই সাহিত্যের ক্লাসে ভাষায় আঞ্চলিকতার কারণে অনেক প্যাঁদানি খেয়েছি। কখনো লজ্জা পাইনি। এখনো সুযোগ পেলে মার্জিত আর ঘষামাজা চলিত ভাষাটা ভুলে যাই। হা হা হা!
পাঠ আর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
অসাধারণ বর্ণনা। পুতুলের মন্তব্যে একমত।
তাড়াতাড়ি পরের পর্ব!
আজ্ঞে!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
হুম। পাঠকের দলে ভীড়লাম। পরের পর্বের অপেক্ষায়...
কি মাঝি? ডরাইলা?
দলে ভীড়ার জন্য অভিনন্দন। আসিতেছে শীঘ্রিই...
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
- হাবিবি
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ইয়া হাবিবি!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
জুলিয়ান ভাই চালিয়ে যান। দারুন হচ্ছে!
-------------------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ কীর্তিনাশা!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
পুরোটা শেষ করে পিডিএফ দিয়েন। একসাথে পড়ব
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
আমিও এই দলে
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
ঠিকাছে!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা পড়ে। দুই নৌকায় পা দিয়ে খুব ভালো ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন। আর কোন কোন নৌকায় কয়টা করে পা দিছেন খুইলা কন তো!
পাশাপাশি নৌকা কয়টা বেঁধে নিয়েছি। এখন মাঝখানেরটায়। পা দেইনি। শুয়ে আছি।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন